বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[শিল্প]
৬ই আগষ্ট, ২০২৩ পশ্চিমবঙ্গে ছিলাম না, ম্যাঙ্গালুরুতে গিয়েছিলাম। জানতে পারিনি অন্ধ্র-তেলেঙানার চারণকবি গুমড়ি ভিট্টল রাও-য়ের মৃত্যুর খবর। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর।
তিনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে একজন গণ-সংস্কৃতি আন্দোলনের মানুষ— চারণকবি। তেলেগুতে অত্যন্ত সহজ ভাষায় গ্রামে গ্রামে গিয়ে গান-নাটক-কবিতায় মানুষের কাছে রাজনীতি-অর্থনীতির কথা তুলে ধরতেন এই চারণকবি।
যৌবনের প্রথম থেকেই তিনি অন্ধ্রপ্রদেশে নকশালপন্থী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৮০ থেকে তিনি মাওবাদী সংগঠনে যুক্ত হন। তিনি ছিলেন অন্ধ্র-তেলেঙ্গানায় গণসাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। তাঁর পরিচালনায় গড়ে ওঠে গণসাংস্কৃতিক সংগঠন জন নাট্য মণ্ডলী। যদিও তিনি ২০১০ সালে মাওবাদী দলের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেন। গণনাট্য আন্দোলনের সঙ্গে দলিত আন্দোলন ও পৃথক তেলেঙানা রাজ্যের দাবিতে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নেন।
আমি তাঁর কবিতা কমই পড়েছি, তাও আবার অনুবাদ কবিতা। কিন্তু তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার কারণ হল আমার মনে হয়েছে তিনি একজন শ্রমজীবী মানুষের কবি ও গায়ক।
আজ থেকে তেরো বছর আগে ২০১০ সালের ১৮ ডিসেম্বর ধর্মতলার মেট্রো চ্যানেলে নকশালপন্থীরা ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা’ ব্যানারে একটা সভা করেছিল। আমরা কোনও দিনই তাঁর মাওবাদী মত-পথে বিশ্বাস করিনি। তবুও ছুটে গিয়েছিলাম ওই সমাবেশে ওই কবির জন্য। একবার দেখাবো এবং নাই বা বুঝি তাঁর ভাষা তবুও সুর, গলার আওয়াজ শুনতে পাবো।
গুমড়ি ভিট্টল রাও-য়ের জন্ম ১৯৪৯ সালে হায়দ্রাবাদ প্রদেশের মেডাক জেলার তুপ্রাণে। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন নকশাল আন্দোলনের ঘনিষ্ট একজন সংগঠক ও কর্মী। কিন্তু তাঁর চারণকবি স্বত্তা ছাপিয়ে গিয়েছিল তাঁর রাজনৈতিক স্বত্তাকে। তাঁর সৃষ্টিতে ছিল সমাজের প্রান্তিক জনের জন্য বন্দনা স্তব গাথা। তাই রাষ্ট্র চায়নি তিনি জীবিত থাকুন। ১৯৯৭ সালে গ্রেহাউন্ড পুলিশী স্কোয়াড তাঁকে ছয়টি গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করতে চেয়েছিল। পারেনি। আহত মানুষটির সম্পর্কে সেদিন তারা একটি লাইন খবর করে নি, কোনও প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা।
আজকে তাঁর মৃত্যুর পর কর্পোরেট পুঁজির দালাল সংবাদপত্র তাঁকে নিয়ে কুমিরের কান্নার লিখছে তখন মনে হল আমার কিছু কথা বলা উচিত।
জানিনা এই ধরনের মানুষগুলোর সৃষ্টির মূল্যায়ন কবে, কিভাবে হবে!
তেলেগু ভাষায় তিনটি চলচ্চিত্রে নেপথ্য সঙ্গীতের লিরিক তাঁরই সৃষ্টি। ১৯৭৯ সালে ‘মাভূমি’, ১৯৯৫ সালে ‘ওরই রিকশা’, ২০১১ সালে ‘জয় বলো তেলেঙ্গানা’। তাঁর শরীরের পাঁচটি গুলি বার করা গেলেও একটা থেকে গিয়েছিল মেরুদণ্ডের জটিল অবস্থানে। যদিও তিনি ভুগছিলেন হৃদরোগের সমস্যায়। এবছর ২০ জুলাই তাঁকে হায়দ্রাবাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং ৩ আগষ্ট বাইপাস সার্জারি হয় কিন্তু তিনি আর ফিরতে পারলেন না।
গদর কবি কিন্তু একজন বিপ্লবী— সন্নাসী মানুষ ছিলেন না। অনেকেই চরিত্র বিচার করেন কতটা কমিউনিস্ট ছিল বা কতটা সঠিক রাজনীতি, তা দিয়ে। আমি মনে করি ওটা ভুল, একেবারে ভুল। দেবতা বানালেই শ্রমজীবী মানুষের থেকে দূরে চলে যায়। গদর কবিকে স্মরণ করতে হবে সেই দৃষ্টি মনে রেখে। তিনি প্রাণের কথা প্রাণের কবিতায়, গানে বলে গেছেন। ব্যবহার করেছেন লোকশিল্পের উপকথা। এটা ঠিক তাঁর কবিতা, গানের ক্ষুদ্র সীমানায় জীবনকে ধরতে গেলে এত সংঘাত এসে পড়ে যে সেটাকে আর বাস্তব মনে হয় না। এই কবির সাফল্য এখানেই যে, তিনি কবিতা, গানকে এমন স্তরে নিয়ে গেছেন যাতে স্বপ্ন বাস্তব মনে হয়েছে প্রান্তিক মানুষদের। তাঁর পাশের শ্রমজীবী শ্রোতাদের কাছে ফিরিয়ে দিতে পেরেছেন দিনগত পাপক্ষয়ের থেকে মুক্ত এক পরিবেশ। মার্কসবাদের মূল তত্ত্বকে বা বিপ্লবের সারমর্মকে তাঁর কবি কল্পনায় কেমনভাবে মূর্ত করে তুলেছেন সেটাই লক্ষ্যণীয় ও শিক্ষণীয়। কবিতা, গান কর্পোরেট মিডিয়ার সম্পত্তি নয়, শ্রমজীবী মানুষের সম্পত্তি— এই বিশ্বাসের থেকেই গদর কবিকে দেখতে হবে। যে সম্পদ থেকে সমাজের বিশ্বকর্মাদের বঞ্জিত করে শাসক নিজেদের সিন্দুকে চাবি দিয়ে রাখে। গুমড়ি ভিট্টল রাও ওরফে গদর কবি জীবন দিয়ে চেষ্টা করছেন শ্রমজীবীদের কাছে সেই সাংস্কৃতিক সম্পদ ফিরিয়ে দিতে। কবিতা একদা ছিল একান্তভাবে জনতার নিজস্ব। হাটে বাজারে কবিয়াল শোনাতেন কবিতা-গান। আর আজ কবিতা বুদ্ধিজীবীর পাঠ্য, পাঠাগারে বন্দী কবি। গান বন্দী কর্পোরেটদের কারাগারে। গদর কবি গান-কবিতার মুক্তির চেষ্টা করে গেছেন সারা জীবন।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করতে হবে।