বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[শিল্প]

[শিল্প]

মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া

ড. নুরুল ইসলাম

photo

মানব সংস্কৃতির ইতিহাস নানা বাধা-প্রতিকুলতা অতিক্রম করে অগ্রগতির ইতিহাস। স্রোতের বা গড্ডালিকা প্রবাহের বিরুদ্ধে চলাই হল জীবনের ধর্ম। অন্ধকার থেকে আলোর দিকে, অজ্ঞানতা অন্ধ-কুসংস্কার সরিয়ে আলোর পথযাত্রী হওয়া চিরকালীন তপস্যা সচেতন মানুষের। এই পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়, কণ্টকাকীর্ণ। তবুও যুগে যুগে আগমন ঘটেছে সমাজ সংস্কারকের। সমাজধারা ও মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটেছে। এই কাজে প্রাণ গেছে বহু বিজ্ঞানী, দার্শনিক, চিন্তাবিদের। নানা ভাবে সমালোচিত, আক্রান্ত, এমন কি প্রাণও দিতে হতে হয়েছে অনেককে। তবুও থেমে থাকেননি তাঁরা। রাজা রামমোহন, বিদ্যাসাগর, জ্যোতিবা ফুলে প্রমুখের সমাজ সংস্কার আন্দোলনে ব্যাপক অংশের মানুষ ছিলেন বিরোধী, সমর্থক ছিলেন যৎসামান্য। তবুও তাঁদের আন্দোলন স্বীকৃতি পেয়েছে এক সময়।
শিক্ষা হল হীরক খণ্ড — আর সংস্কৃতি হল হীরক খন্ড থেকে বেরিয়ে আসা দীপ্তিচ্ছটা। শিক্ষা ব্যক্তি জীবনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ জীবনকেও আলোকিত ও গতিময় করে। শিক্ষা মানুষের সর্বাঙ্গীন বিকাশ ঘটায় আর এই শিক্ষার অধিকার আদায় করতে গিয়ে মহাকাব্যে একলব্য, কর্ণ সহ কত না চরিত্রকে চরম আত্মত্যাগ করতে হয়েছে, অপমানিত হতে হয়েছে।
মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া নারী শিক্ষা ও আর্থ-সামাজিক অধিকার মর্যাদার লড়াইয়ের অন্যতম প্রধান পথিকৃত। তিনি একজন বিখ্যাত বাঙালি মুসলিম চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ, ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক। নারী শিক্ষা ও তাঁদের অধিকার মর্যাদার লড়াইয়ে বিশাল ভূমিকা পালন করেছেন আজীবন। বহু বাধা পেরিয়ে তিনি যেমন শিক্ষা অর্জন করেছিলেন তেমনি বাঙালি বিশেষত মুসলিম সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়ার জন্ম হয় অবিভক্ত বাংলার রংপুর জেলার মিঠা পুকুর মহকুমার পায়রাবন্দ গ্রামে। তাঁর পিতা জহিরুদ্দীন মোহাম্মদ আবু আলি হায়দার সাবের ছিলেন একজন শিক্ষিত জমিদার। তিনি নিজে আরবি, ফারসি, উর্দু, বাংলা, হিন্দী, ইংরাজি বেশ কয়েকটি ভাষা জানতেন। তিনি দুই ছেলেকে কলকাতার বিখ্যাত সেন্ট জেবিয়ার্স কলেজে শিক্ষার ব্যবস্থা করেন অথচ মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন বেশ রক্ষণশীল। বাড়িতে ধৰ্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে আরবি ফারসি ভাষার শিক্ষার ব্যবস্থা করলেও বাংলা ইংরেজি সহ আধুনিক শিক্ষার কোনও সুযোগ দেওয়া হয়নি মেয়ে রোকেয়া ও তাঁর দিদি করিমুন্নেশাকে।
বেগম রোকেয়ার মা রাহাতুন্নেশা সাবেরা চৌধুরানী ছিলেন ছেলেদের মতো মেয়েদেরও লেখা পড়া শেখাতে আগ্রহী ছিলেন। রোকেয়ারা ছিলেন তিন বোন ও তিন ভাই। এক ভাই অল্প বয়সে মারা যায়। বড় বোন করিমুন্নেসা ছিলেন বিদ্যোৎসাহী ও সাহিত্য অনুরাগী। রোকেয়ার শিক্ষা, সাহিত্য চর্চা এবং সামগ্রিক
মূল্যবোধ গঠনে বড় দুই ভাই ও বোন করিমুন্নেসার অবদান ছিল বিশাল।রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে মেয়েদের গৃহের গণ্ডি অতিক্রম করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের কোনও সুযোগ ছিল না। আরবি ভাষা শিক্ষার সুযোগ ছিল ধর্মীয় কারণে, কিন্তু বাংলা, ইংরাজি, উর্দু, ফারসি ভাষা শিখতে হয়েছে বহু বাধা অতিক্রম কর।
পাঁচ বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে কলকাতায় থাকাকালীন একজন মেম শিক্ষিকার কাছে লেখাপড়া শুরু করেন। কিন্তু সমাজ ও আত্মীয় স্বজনদের প্রবল সমালোচনায় তা বন্ধ করে দিতে হয় তাঁকে।
বাড়িতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর বেগম রোকেয়া ও তাঁর দিদি করিমুন্নেসা বড় দাদার ঘরে ইংরাজি, বাংলা, ফারসি ও উর্দু ভাষা শিখতেন। জানাজানি হয়ে যাবার পর বাবার প্রবল আপত্তিতে তাও বন্ধ হয়ে যায়।বেগম রোকেয়া ইংরাজি ও উর্দু ভাষায় বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন তাঁর স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে ১৮৯৮ সালে বিবাহের পর। তখন তাঁর স্বামীর বয়স ৩৮ এবং রোকেয়ার বয়সমাত্র ১৮। তাঁর স্বামী বিপত্নীক হওয়ার পরে রোকেয়াকে বিবাহ করেন এবং তার এক কন্যা সন্তান ও ছিল।
সাখয়াত হোসেন পেশায় ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি সমাজ সচেতন ও প্রগতিশীল মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ হওযায় তাঁর সহযোগিতা ও উৎসাহে বেগম রোকেয়া ইংরাজি ও উর্দু ভাষা শিক্ষার পাশপাশি সাহিত্য চর্চায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাঁদের দাম্পত্য জীবন মাত্র ১১ বছরের। তাঁদের দুটি কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করলেও শিশু অবস্থাতেই মারা যায়।
তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পরে ভাগলপুরে ১৯০৯ সালে মাত্র ৫ জন ছাত্রী নিয়ে সাখয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল স্থাপন করেন। কিন্তু পারিবারিক সমস্যায় স্কুল বন্ধ করে কলকাতায় চলে আসতে হয়।
এখানে ১৯১১ সালে ১৬ মার্চ মাত্র ৮ জন ছাত্রী নিয়ে ১৩ ওয়ালীউল্লাহ লেনের একটি বাড়িতে নব পর্যায়ে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ধীরে ধীরে ছাত্রী সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং কয়েক বছরের ছাত্রী সংখ্যা শতাধিক হয়ে যায়।
ব্যক্তি জীবনে বেগম রোকেয়া যেভাবে প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন ঠিক সেই ভাবেই তাঁর সাহিত্য ভাবনা ফুটে উঠেছে। বেশিরভাগ লেখাতেই নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও লিঙ্গ সমতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন এবং ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের তীব্র কষাঘাতে সমাজকে বিদ্ধ করেছেন। ধর্মের নামে নারীদের উপর অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি একের পর এক যুক্তি সাজিয়ে নিজের মত প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেছেন নানা লেখায়। অলঙ্কারকে তিনি দাসত্বের প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করতেন। তিনি নারীদের অলঙ্কার ত্যাগ করে আর্থ-সামাজিক স্বাধীনতা অর্জনে সচেষ্ট হতে আহ্বান জানিয়েছেন।
বেগম রোকেয়ার প্রথম লেখা ‘পিপাসা’ রম্য রচনা ১৯০২ সালে নভপ্রভা পত্রিকায় প্রকাশ পায়। “দুঃখ শুধু এই ছেড়ে গেলে অভাগায় ডুবাইয়া চিরতরে চির পিপাসায়! যখন যেদিকে চাই, কেবলি দেখিতে পাই, পিপাসা-পিপাসা লেখা জ্বলন্ত ভাষায়।” এই পিপাসা বেগম রোকেয়ার জ্ঞান পিপাসা, সমাজকে জানার পিপাসা, নারীর মর্যাদা অধিকার আদায়ের পিপাসা।
‘Sultan's Dream’ তাঁর প্রথম ইংরাজি লেখা, ১৯০৫ সালে মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসকে বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যের অন্যতম মাইল ফলক হিসেবে বিবেচনা করেন কেউ কেউ। ধর্মীয় ও সামাজিক বাস্তবতায় এটি অত্যন্ত সাহসী সাহিত্যকর্ম। এই গ্রন্থে তিনি নারীবাদী স্বপ্নরাজ্যে নারী-পুরুষের প্রচলিত চলমান ভাবনার বাইরে গিয়ে নতুন ভাবনার পথ দেখিয়েছেন। এখানে নারীরা সমাজের যাবতীয় চালিকাশক্তি আর পুরুষ প্রায় গৃহ বন্দী।
১৯০৪ সালে ‘মতিচুর’ প্রবন্ধ গ্রন্থে রোকেয়া নারী সমাজের আর্থ-সামাজিক অধিকার মর্যাদার কথা তুলে ধরেন এবং শিক্ষার অভাবকে নারী সমাজের পশ্চাদপদতার প্রধান কারণ বলে চিহ্নিত করেন।
‘পদ্মরাগ’ উপন্যাস ১৯২৪ সালে প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাস নিয়ে বিতর্ক আছে সমালোচক মহলে। নারীর অধিকার ও মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার লোক সংস্কৃতির অনেক নিদর্শন আছে এই উপন্যাসে। সিদ্দিকা বা পদ্মরাগ আসলে জয়নব বেগমরূপী রোকেয়ার প্রতিরূপ। এই উপন্যাসের পরিণতি সংবেদনশীল পাঠকে নতুন ভাবে ভাবতে শেখায়, চোখের জলে ভাসায়। পদ্মরাগ ভাঙে কিন্তু মচকায় না, সে ইচ্ছা শক্তির জোরে প্রতিকূলতাকে জয় করার চেষ্টা করে।
বেগম রোকেয়ার অন্যতম প্রধান সাহিত্যকীর্তি ‘অবরোধ বাসিনী’ উপন্যাস ১৯৩১ সালে প্রকাশিত হয়। ৪৭টি ঘটনা অনুগল্প আকারে প্রকাশ পেয়েছে। প্রতিটি গল্পে পর্দার নামে নারীদের সমস্ত রকম অধিকার থেকে বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
ইসলাম ধর্ম নারী শিক্ষার বিরোধী নয়। ইসলামে শিক্ষা অর্জন করা নর-নারীর সমান অধিকার। শিক্ষা ছাড়া দুনিয়া ও আখেরাতের অর্থাৎ মৃত্যুর পরে জীবনের প্রকৃত কল্যাণ ও সফলতা আসবে না। মহানবী মহম্মদের (স.) প্রতি আল্লাহর প্রথম নির্দেশই ছিল শিক্ষা সংক্রান্ত। মহানবী দ্ব্যর্থহীন ভাবে ঘোষণা করেন, “প্রত্যেক মুসলিম নর নারীর জন্য জ্ঞানার্জন করা ফরজ বা অবশ্য পালনীয়।” (ইবনে মাজাহ: ২২৪)। অর্থাৎ নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক।
মহানবির কাছে পুরুষ সাহাবী বা অনুগামী অনুসারীগণ যেমন জ্ঞান অর্জন করতেন তেমনি মহিলারাও সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন না। হজরত হাফছা (রা:), হজরত আয়েশা (রা:) সহ অনেকেই লেখা পড়া জানতেন। হজরত আয়েশা (রা:) সমকালীন শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে উচ্চ মর্যাদার অধিকারিনী ছিলেন। ফারায়েজ, ইলম, হালাল- হারামের মাসায়েল, কোরানের শিক্ষায় দক্ষ ছিলেন। সেই সঙ্গে কবিতা সাহিত্য, চিকিৎসা, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়েও তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল। হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে তাঁর মর্যাদা ছিল অনেক পুরুষ সাহাবির উপরে। হাদিস গ্রন্থসমূহের মধ্যে তাঁর থেকে বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ২২১০, যা সব সাহবায়ে কিরামের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। হাদিসে বর্ণিত, যখন কোনও মাসায়লার ব্যাপারে সন্দিহান হতেন বা সমস্যায় পড়তেন, তখন তাঁরা পর্দার আড়াল থেকে হজরত আয়েশা (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করলে সঠিক সমাধান পেয়ে যেতেন।
তাছাড়া যেসব মহিলা সাহাবী শিক্ষায় খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তাঁরা হলেন আরওয়া বিনতে আব্দুল মুত্তালিব, সুদা বিনতে কোরায়স, রসুল (সা.)-এর দুই বোন শায়মা, আতেফা বিনতে দায়েদ, হজরত খানসা প্রমুখ। নবিজী হজরত খালসার কবিতা অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে শুনতেন এবং বলতেন “হে খানসা, আরো কিছু শোনাও।”
সুতরাং ইসলামের সূচনা লগ্ন থেকেই নারী সমাজের জ্ঞান চর্চার ব্যপারে নারী শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ ছিল এবং এ ধারা পরবর্তী যুগেও অব্যাহত ছিল। ইমাম বুখারি ৮০ জন নারী মুহাদ্দিস থেকে হাদিস সংগ্রহ করেছেন।
নারী শিক্ষা প্রদানের ব্যাপারে পবিত্র কোরআন-এ বলা হয়েছে “তোমরা নারীদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করো ও উত্তম আচরণ করার শিক্ষা দাও। (সুরা নিশা ১৯)। কারণ মা যদি মূর্খ হন, তাঁর ভবিষ্যত প্রজন্ম জ্ঞান ভাণ্ডার থেকে বঞ্চিত হবে। মা যদি শিক্ষিতা হন, তাহলে তাঁর সন্তানরাও মার কাছ থেকে সেই জ্ঞান ভাণ্ডার পাবে। শুধু তাই নয় শিশুদের উপর মায়ের চারিত্রিক প্রভাব থাকে সবচেয়ে বেশি। সন্তানের আদব শিষ্টাচার বহুলাংশে নির্ভর করে মায়ের শিক্ষার উপর।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেগম রোকেয়ার জীবনী ও বিশেষত নারী শিক্ষার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা বড়ই প্রাসঙ্গিক। ভারত তথা বাংলায় ধর্ম বর্ণ জাতপাতের চরম ভেদাভেদ। এর বড় কারণ অর্থনৈতিক-শিক্ষাগত পশ্চাদপদতা। নারী শিক্ষার দিক থেকে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। অহেতুক ধর্মীয় নিষেধের নামে নারীদের শিক্ষার অধিকার থেকে দূরে রাখলে বিজ্ঞান প্রযুক্তি চিকিৎসা সহ নানা ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে পড়ব। সাবধান হবার সময় এসেছে। বেগম রোকেয়া আমাদের অনুপ্রেরণা উদ্দীপনা জোগায় সর্বদা।
মৌলবাদী শক্তির চাপে বেগম রোকেয়াকে কলকাতায় কবরস্থ করা যায়নি, সুখচরে সমাধিস্থ করা হয়। বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা ভারতে মৌলবাদের কোনও পার্থক্য নেই।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.