বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[শিল্প]

[শিল্প]

পুস্তক পর্যালোচনা

মনোজ চট্টোপাধ্যায়

photo

ব্যাঙ্ককর্মীর অকথিত ধারাভাষ্য
তরুণ চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশক: দে পাবলিকেশনস্
১৩, বঙ্কিম চ্যাটার্জী ষ্ট্রীট
কলকাতা- ৭০০০৭৩

লেখক তরুণ যখন ব্যাঙ্কের কাজে যোগ দেন সে সময় সবে দেশের বড় বড় চোদ্দটি বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ককে রাষ্ট্রায়ত্তকরণ করে, দেশে নতুন করে উন্নয়নের জোয়ার সৃষ্টি করেছেন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। দেশের সর্বত্র, বিশেষ করে, অনুন্নত ও স্বল্প উন্নত গ্রাম ও আধা শহরাঞ্চলে, ছড়িয়ে পড়ে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির শাখা-প্রশাখা।
যে কাজ এতদিন স্তব্ধ হয়ে ছিল, ব্যাঙ্কগুলি বেসরকারি পুঁজির অধীনস্থ থাকার কারণে। দেশের বড় বড় একচেটিয়া পুঁজিপতিরা তাদের মালিকানাধীন ব্যাঙ্কগুলিকে ব্যবহার করছিলেন শুধুমাত্র স্বীয় শিল্পসাম্রাজ্য বিস্তারের সঙ্কীর্ণ স্বার্থে, যার সঙ্গে জাতীয় স্বার্থের সামান্যতম যোগসূত্রও ছিল না। ফলে শিল্প পুঁজি ও ব্যাঙ্কিং পুঁজি মিলেমিশে জন্ম নিচ্ছিল এক চরম প্রতিক্রিয়াশীল লগ্নি পুঁজি, যা দেশকে নিয়ে চলেছিল প্রতিক্রিয়ার অতল অন্ধকারে, দক্ষিণপন্থার গহন জঙ্গলে।
ক্রমবিকাশমান জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম শর্ত হল: নিরন্তর কর্মসৃজন, যা সম্ভব হল ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের ফলে। ইন্দিরা গান্ধী তখন দেশের শিক্ষিত বেকার যুবসম্প্রদায়ের চোখের মণি।
দেশের বিভিন্ন পশ্চাত্পদ, দারিদ্র্যকবলিত অঞ্চলে ব্যাঙ্কগুলির শাখা সম্প্রসারণের ফলে একদিকে যেমন গ্রামাঞ্চলের উদ্বৃত্ত এসে জমা হচ্ছিল জাতীয় সঞ্চয় তহবিলে এবং বাড়ছিল জাতীয় সঞ্চয়ের হার, একই সঙ্গে ব্যাঙ্কিং পুঁজির চল্লিশ শতাংশ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে দাদন দেওয়া শুরু হল— কৃষি ও কৃষিভিত্তিক গ্রামীন ক্ষুদ্র শিল্প, ক্ষুদ্র বাণিজ্য, স্বনিযুক্তি প্রকল্প সমূহ, এবং রপ্তানি বাণিজ্য ইত্যাদি সুচিন্তিতভাবে চিহ্নিত ক্ষেত্রগুলাতে।
লেখক হিসাবে আত্মপ্রকাশ অবসর গ্রহণের পর বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে লেখা “ব্যাঙ্ককর্মীর অকথিত ধারাভাষ্য” পুস্তকের প্রেক্ষিত।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে কর্মী হিসেবে যোগদান করে প্রথমে পুরুলিয়া-বাঁকুড়ার জলে-জঙ্গলে ঘেরা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যঘেরা, কুসংস্কারাচ্ছন্ন আদিবাসী অধ্যুষিত এবং মাওবাদী প্রভাবিত পশ্চাৎপদ এলাকাগুলির বিভিন্ন শাখায়, কখনো সাধারণ ব্যাঙ্ক-কর্মী, কখনো বা পদোন্নতির মাধ্যমে গ্রামোন্নয়ন অফিসার বা অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার বা ম্যানেজারের ভূমিকায় কাজ করতে করতে গ্রাম বাংলা তথা গ্রামীন ভারতের সঙ্গে যে পরিচিতি ঘটেছিল লেখকের। পরবর্তীতে হাওড়া- হুগলির আধা-শহরাঞ্চলের বিভিন্ন শাখায় ও আঞ্চলিক কার্যালয়ে প্রশাসনিক পদে সিনিয়র ম্যানেজারের অভিজ্ঞতা অর্জনের পর অবসর নেওয়ায়, সেই বিপুল অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে লেখক হিসাবে আত্মপ্রকাশ তরুণবাবুর। প্রথম জীবনে নামী সংবাদপত্রে সাংবাদিকতার পেশায় নিযুক্ত থাকায় এবং পরবর্তীতে মাঝে মাঝেই ফ্রীল্যান্স সাংবাদিকতার কাজ করায় তাঁর সুবিধা হয়েছিল লেখক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে।
গ্রাম বাংলা তথা গ্রামীন ভারতের অতি দুর্দশাগ্রস্ত, ছন্নছাড়া রূপটি বিশ্বস্ততার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন তরুণ, তাঁর প্রথম প্রকাশ এই বইটিতে। পুরুলিয়া থেকে আরশা যাওয়ার পথে, বাসে ছাগল-মুরগীর সঙ্গে সহযাত্রী হওয়ার অভিজ্ঞতা, আরশার অদূরে ভুতুড়ে রেল স্টেশন “বেগুন কোদরে” একা নিশিযাপনের গা ছমছমে অভিজ্ঞতা, মানবাজারে টুটুর সাহায্যে ও সহযোগিতায় গড়ে ওঠা “ইন্ডিয়া মেস” এ থেকে কুমারী নদীতে বুনো হস্তিশাবকদের জলকেলি দেখতে দেখতে নদী পেরিয়ে খড়িদুয়ারা শাখার হটশিটে বসে ম্যনেজারি করতে করতে শাখার দালানে বসে গ্রামবাসীদের “মিঠাই এর পরিবর্তে বই কিনতে” আগ্রহী করে তোলার মাধ্যমে নিরক্ষরতা দূরীকরণ অভিযানে অংশগ্রহণ, গ্রামের গরিব মেধাসম্পন্ন আদিবাসী যুবককে শিক্ষা-ঋণদানের মাধ্যমে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করা... এইভাবে দেশের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর স্বপ্নকে সার্থক করে তুলতে উদ্যোগী হওয়া, এসবই লেখককে দিয়েছে এক অনির্বচনীয় আনন্দ। আর সেই আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বইটির প্রতিটি ছত্রে।
ম্যানেজার হিসেবে সাফল্যের শিখরে আরোহন করেছিলেন লেখক। এ ব্যাপারে তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি: শাখার সকলের বিশ্বাসভাজন হতে পারা এবং তাঁদের কাছ থেকে সর্বোত্কৃষ্ঠটা আদায় করে নেওয়ার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল তাঁর সাফল্যের চাবিকাঠি। সাফল্যে তিনি আনন্দিত হয়েছেন, একথা যেমন ঠিক, এই সাফল্যের স্বাদ তিনি তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চেয়েছেন সবসময়েই। এই অর্থে বইটির শীর্ষনাম হতে পারত “সাফল্যের চাবিকাঠি বা গুপ্তরহস্য”।
“ককপিটে বসে দিন ভোর আকাশযান উড়িয়ে সন্ধ্যায় রানওয়েতে নেমে আসা”র কল্পনাটা বেশ কিছুটা উপভোগ্য হলেও পুনঃপুনঃ প্রয়োগে উপমাটির কিছুটা মর্যাদাহানি ঘটেছে। ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হিসাবে কাজ করার ক্ষেত্রে উপমাটা কিছুটা সুপ্রযুক্ত মনে হলেও সাধারণ কর্মী, গ্রামোন্নয়ন অফিসার বা অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার হিসাবে কাজ করা কালীন এই উপমাটি গ্রহণীয় নয়।
বইটার বেশ কিছু জায়গায় আত্মপ্রচারটা কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক ও উগ্র বলে মনে হয়েছে, এবং এতে বইটির সাহিত্যগুণ ব্যাহত হয়েছে। মেধা এবং আবেগের প্রয়োগ যথাযথ হলেও ভাষাপ্রয়োগে সংহতির অভাব দেখা দিয়েছে কোথাও কোথাও।— ১ নভেম্বর, ২০২২, শ্রমজীবী ভাষা

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.