বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[শিল্প]

[শিল্প]

নাগরিক (ছোট গল্প)

অনিতা অগ্নিহোত্রী

photo

ভোর হয় কিন্তু আকাশে আলো ফোটে না। এ যেন অচেনা কোনও শহর। আগে ঠাণ্ডা এমনি ছিল, কিন্তু আকাশ এমন কালো ধূসর ভোর থেকে? হলুদ রোদ নেমে আসত ফুটপাথে, বস্তির চালে, উঠোনেও।আজ থেকে তিরিশ বছর আগে। জাভেদ তখন যুবক। সকাল সকাল ট্যাক্সি নিয়ে বেরোত স্ট্যাণ্ড থেকে। তখন দিল্লিতে এত খারাপ ছিল না বাতাস। বাইরে বেরোলে মাস্ক পরতে হতো না। এখন হরিয়ানা পাঞ্জাবের ফসলের গোড়া পোড়ানো ধোঁওয়া, রাজস্থানের বালুঝড়, আফগানিস্তানের ধুলো সব এসে শহরের বাতাসে জমা হয়। আর পাথরের মত ভারী সে বাতাস মানুষের ফুসফুসকে কুরে কুরে খায়। রাতে ঘরের মধ্যে দমকে দমকে কাশি ওঠে। বড়লোকেদের কোঠীতে রাতে হিটার জ্বলে, বাতাস সাফ করার যন্ত্র চলে। জাভেদদের একখানা ঘরে একটা মাত্র ইলেকট্রিক হিটার, মোমবাতির মত টিমটিমে। তার উপর বিষ হাওয়া, সারারাত কাশি।
জানুয়ারি মাসের গোড়ায় মাঝরাতের পর তাপমান নেমে আসে দু’ তিন ডিগ্রিতে। তখন গোবিন্দপল্লীতে তাদের বস্তি যেন জমে যায়। অ্যাসবেস্টসের ঘরে কোন সব অচেনা ফাঁক ফোঁকর থেকে হুহু করে শীত ঢুকতে থাকে। কুঁকড়ে শুয়ে মনে হয় বিছানা যেন জল থই থই। প্রতিবার ভাবে একটা অয়েল হীটার কিনবে। নতুন না হয় পুরোনোই সই। কিন্তু শীতের আগে পাঁচ ছ’ হাজার টাকার জোগাড় আর হয়ে ওঠে না। কখনো সে আর সাকিনা, স্বামী স্ত্রী মিলে পরামর্শ করে ভাল একটা লেপ, যার নাম এখানে রজাই, বেশ করে দাঁড়িয়ে থেকে তুলো পিঁজে তৈরি করবে। সেও তো তিন সাড়ে তিন হাজারের কমে হবে না। দাঁড়িয়ে থেকে লেপ বানানোর সময়ের ও দাম আছে। জাভেদের কোনও ছুটি নেই। একেবারে নেই তা নয়। ঈদ আল আধা-য় এক দিন। সকাল আট থেকে সন্ধে আট, সপ্তাহে সাতদিন তার ডিউটি। আজ পনেরো দিন হল সকালে তার উঠতে একেবারে ইচ্ছে করে না। মনে হয় যদি শুয়ে থাকতে থাকতে প্রাণটা চলে যায় বেশ হয়। সাকিনা বাইরে বেরোয় না বলে বিছানা থেকে ওঠার তার কোনও গরজ থাকে না। অনেক বেলায় উঠে জল তোলা, রাঁধা বাড়ার কাজ, যা না করলে নয়। কিন্তু জাভেদ তৈরি হয়ে না বেরোলে সামনে ক্ষিদের মরুভূমি। ছোট ইমরানটা আছে, স্কুলে যায়। স্কুল খুলে গেছে। বাপ ছেলে দু’ জনে ওঠে। সোয়েটার গায় দিয়ে মোজা পরে শুতে হয় ভাল লেপের অভাবে। মাথা ঢেকে হাতে ব্রাশ নিয়ে কমন বাথরুমের লাইনে দাঁড়াতে দাঁড়াতে শরীর জমে যায়। রাতের রুটি, কড়কড়ে শুকনো পেঁয়াজ আর আচার দিয়ে মুখে ভরে বাপ আর ছোট ছেলে তৈরি। তারপর বাস ধরে শহরের অভিজাত পল্লিতে ঢোকার মোড়। সেখান থেকে টানা হাঁটা।
আটটায় রিপোর্টিং। পাঁচ মিনিট আগেই পৌঁছতে চেষ্টা করে জাভেদ। কিশলয় মিত্র কড়া মানুষ। চাকরিটা একবার হাত বদল হয়ে পেয়েছিল জাভেদ। কিন্তু আবার হাত বদল হবার মত জোশ তার শরীরে আর নেই। অমল মুখার্জির কাছে অনেক দিন ছিল সে। অমলবাবুরা কলকাতায় ফিরে গেলেন বাড়ি বিক্রি করে, তাকে সঁপে দিয়ে গেলেন কিশলয় মিত্রের হাতে। অমল বাবুর গাড়ি চালাত জাভেদ। পনেরো বছর কাজ করার পর তার ডান হাত জখম হয়ে গেল বরাবরের মত। গাড়ি ধাক্কা মেরে ছিল লাইটপোস্টে। জাভেদের দোষ ছিল না। রং সাইড থেকে আসা স্কুটারকে বাঁচাতে ডানে চলে গিয়েছিল। কিন্তু বেখেয়ালে হাতটা বার করতে গেল কেন যে। মেশিন থেকে বেরনো ছিবড়ের মত মাংসপিন্ড তার ডান হাতটা অকেজো হয়ে গেল বরাবরের মতো। তিস হাজারি মনসবদার ছিল ইতিহাসে। মনসবদারের অধীনে ত্রিশ হাজার সৈন্য। জাভেদ হল দশ হাজারি গার্ড, বড়লোকের ছ’ কোটি টাকার বাড়ির। ছুটিহীন বিরামহীন কাজের মাস মাইনে দশ হাজার। চারতলা বাড়িটায় তিনটে ফ্ল্যাট। একটা অফিস। নীচে পার্কিট লটে তিনটে গাড়ি। একটা বিএমডব্লু, একটা স্কোডা, একটা হন্ডা সিটি। তাদের দেখলে কোনও উত্তেজনা জাগে না জাভেদের।কারণ স্টিয়ারিং সে আর ধরতে পারে না। সে কেবল গাড়ি ধোয়। ধাতব তিনটে ঝকঝকে যন্ত্র কে স্নান বা ‘স্পা‘ করায়, কিন্তু তাদের থেকে কিছু ফিরে পায় না।
গ্রীষ্ম বর্ষায় তো বটেই এই প্রখর শীতেও জাভেদ সারা মাস তিনটে গাড়ি ধোয় পাঁচশো টাকা গাড়ি পিছু। বাড়ির ফুটপাথ ঘেঁষা একটা জায়গায় একটা ছোট সাদা গাড়ি থাকত। সেই জায়গাটা এখন খালি। ওই গাড়ি যার তার কথা রোজ ভাবে জাভেদ। শুভা ম্যাম। ওকীল ম্যাম, বলত ওরা, পার্কিং লটের লোকজন।
এ বাড়ির চারতলায় ছিল তিন বছর। এখন আর নেই। খুব খেটে রোজগারের টাকায় কেনা গাড়ি। ওরা মিত্রদের বলেছিল পার্কিং লটে রাখতে পারলে ভাল হয়। রাতের বেলা গাড়ি রাস্তায় পড়ে থাকা অনেক টেনশনের। উঁহু। ভাড়াটের গাড়ি বাইরে থাকবে। পার্কিট লটে ক্যাপাসিটি আছে তাতে কি! দিল্লিতে সবার গাড়ি বাইরে থাকে। অকেজো হাত নিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না জাভেদের। তার কথা কে শুনবে। শুভা ম্যাম চিন্তায় থাকত। বাইরে গেলে ফোন করত জাভেদকে। জাভেদ ভাই গাড়ি ঠিক আছে তো? জাভেদের খবর তো সন্ধে আটটা পর্যন্ত। একটা নাইট গার্ড আগে রেখেছিল রেসিডেন্ট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন। তারপর তো সব খোদার হাত। দোয়া করা ছাড়া উপায় কি? জাভেদের দোয়াতে আগে কাজ হতো, এখন আর হয় না। এটা বোঝা গেছে।
শুভা ম্যামের গাড়ি রাখার জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেছে, তেমন ফাঁকা হয়ে গেছে জাভেদের বিছানার পাশে ওর বড় ছেলে আজিজের শোওয়ার জায়গাটা।গত দু’ সপ্তাহ ধরে রাতে শীতে ঘুম ভেঙে ঐ জায়গাটা বার বার দেখা স্বভাব হয়ে গেছে জাভেদের। ছেলেটার আর শীত করছে না। এই ভেবে সূক্ষ্ম আনন্দ হয় কি মনে? দিল্লি শহর কত বদলে গেছে। ঠাণ্ডা আর ধুলো ধোঁওয়া বাদ দিলেও তাদের থাকার মতো নেই আর শহর। নাগরিকত্ব আন্দোলনের লোকজনের পথে বসা তুলে দিতে পুলিশ অনেক বার চেষ্টা করেছিল। করোনা আসতেই সংক্রমণের ধুয়ো তুলে সবাইকে হঠিয়ে দিল পুলিশ। তারপর দুই সীমান্তে একটানা অনেকদিন গেল কৃষক আন্দোলন। এরা সম্পন্ন কৃষক। হই চই করে রান্না বাড়া করে। লঙ্গর চালায়। ওয়াশিং মেসিনে লস্যি বানায়। এদের নানা ভাবে জব্দ করার চেষ্টা করে সরকার হার মেনে যায়। ভাগ্যিস সরকারের বিল প্রত্যাহারের আশ্বাসে কৃষক রা আন্দোলন তুলে নিল।
এর পর বাধল উত্তর পূর্ব দিল্লির রায়ট। শুরুতে দায় দু’ পক্ষেরই ছিল। কিন্তু সরকার তো একপক্ষের। প্রচুর ধড়পাকড় হল, মসজিদ ভাঙচুর হল, দোকানপাট ব্যবসার উপর জনতা হামলা করল, ব্যবসাপাতি লাটে। সেই অবস্থার জের চলল অনেক দিন। সবই জানে জাভেদরা গোবিন্দপল্লীর কয়েক ঘর, তবু আজিজকে যখন মোবাইল চুরির কেসে ফাঁসিয়ে তুলে নিয়ে গেল পুলিশ, তখন সাকিনার উথাল পাথাল কান্না দেখে শুভা ম্যামকে সংকোচেই বলেছিল, জাভেদ। কিছু কি করা যায়? ততক্ষণে পুলিশ লক আপ এ প্রচুর থার্ড ডিগ্রি দিয়ে আজিজকে জেল হাজতে পাঠানো হয়ে গেছে। সেই কেস হাইকোর্টে নিয়ে গিয়ে আজিজের জামিন করিয়ে এনেছিল শুভা ম্যাম। কিন্তু পুলিশ ঘা খাওয়া বাঘের মতো ফিরে এল। একটা বস্তির ছেলে তাও মাইনরিটি, এত হিম্মত কি করে হয়। পিছনে কে আছে, আর কেন, ঠিক বুঝে ওঠা যাচ্ছে না তো! এবার আজিজকে ধরল আর্মস অ্যাক্ট এ। ঠিক যে সাইজের ছুরি পকেটে থাকলে আর্মস অ্যাক্ট লাগানো যায় তার চেয়ে ইঞ্চি কয়েকের বড় ছুরি নিয়ে নাকি আজিজ ওদের মহল্লার পার্কে সন্দেহজনক ভাবে বসেছিল। পুলিশ ওর পকেট থেকে ছুরি বার করে আনলে কারণ টারণ কিছুই বলতে পারেনি। প্রতিদিন গরীবের উপর এমন শ’য়ে শ’য়ে কেস হয়। আর্মস অ্যাক্ট এ জামিন পাওয়া যায় না বলে টাকায় রফা করতে সুবিধে। কিন্তু আজিজ তো সংখ্যালঘু। তার সঙ্গে রফা নয়, তাকে জামিন না দিয়ে আটক রাখাই পুলিশের দায়িত্ব। শুনে চোখ জলে ভরে গিয়েছিল শুভা ম্যামের। পুরো অফিসের লোকজন নিয়ে কেসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। হাইকোর্টে জামিন হল না। ওরা গেল সুপ্রিম কোর্ট। এবার জামিন করিয়ে ঘরে আনল বটে, কিন্তু কেস তো চলবে লোওয়ার কোর্টে। সেখানে অপরাধী সাব্যস্ত হলে আবার জেল।কাজেই কেসের রশি ছাড়া চলবে না। আমিনার রান্না বিরিয়ানি আর সেমুইএর পায়েস ছাড়া আর কিছু দিতে পারেনি জাভেদ। তাতে অবশ্য শুভাদের উৎসাহে কোনও ভাঁটা পড়েনি। এর মধ্যে বাড়ির চারতলাটা অন্ধকার হয়ে গেল।
হাসিখুশি ফুটফুটে ওকীল ম্যামরা উঠে গেল।
না, শুভা এ বাড়িতে থাকতে পারল না। নিত্য টেনশন, গাড়ি নিয়ে, লিফটের মেরামত নেই। চুক্তি শেষ হবার আগেই একটা অন্য ফ্ল্যাট দেখে চলে গেল পাশের ব্লকে। বলে গেল, লড়াই চলবে, জাভেদ ভাই। হিম্মত না হার না। আমি তোমাকে জানাতে থাকব, কোর্টে কি হচ্ছে।
আজ অসাড় হাত পা নিয়ে ডিউটিতে এসে অনেক দিন পর শুভা ম্যামের ফোন পেল আজিজ। টগবগ করে ফুটছে শুভা। জাভেদ ভাই দু’ তিন বার ফোন করেছি। ধরো না কেন? জানো, শীতের ছুটির আগে আজিজের এফআইআরটা পুরো খারিজ করে দিয়েছে সুপ্রীম কোর্ট। আমরা তো পিটিশনে
লিখেছিলাম, কেবল ছোরা পকেটে রাখলে আর্মস অ্যাক্টে কেস হয় না। অস্ত্র নিয়ে ব্যবসা কিংবা কাউকে অ্যাটাক এর প্রমাণ দিতে পারেনি পুলিশ। এবার কি হল বলতো? কেসটাই আর চলবে না লোয়ার কোর্টে। আজিজ এখন পুরো ফ্রি! নো টেনশন।
সুপ্রীম কোর্টের উইন্টার ভেকেশন তখন। খুব বীমার ছেলেটা। পেটে ব্যথা। ডাক্তারের ওষুধে যায় না। এ হাসপাতাল ও হাসপাতাল ঘুরে ভুল ভাল চিকিৎসায় প্রচুর ধার করে আজিজকে
শেষ পর্যন্ত মাটি দিয়েছে জাভেদ। এক হাসপাতাল এক এক কথা বলে। লিভারের ভিতর নাকি একটা টিউমার ছিল। ভেবেছিল ম্যামকে বলবে কিনা সরকারি হাসপাতালে যদি একটা বেড পাওয়া যায়। সংকোচ হয়েছিল। ছুটিতে হয়তো কোথাও বেড়াতে গেছে। জাভেদের সমস্যা যেন ম্যামের পিছু ছাড়ে না। বলতে পারেনি জাভেদ। আর আজ এই খুশ খবর পেয়েও তার দু’ হাত আর বুকের ভিতরটা জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে। যার জন্য এত লড়াই, পুলিশের সঙ্গে পাঙ্গা, সেই আজিজ, তরতাজা কুড়ি বছরের জোয়ান ছেলে আর নেই। যদি থাকতও, ওকে বাঁচতে দিত কি এ দেশ? আবার কোনও না কোনও ভাবে তুলে নিত পুলিশ, জাভেদ, আজিজ, ইমরানকে। দশ হাজারি গার্ডের তাপ্পি দেওয়া লেপ আর পোশাকের পরিবার। লড়তে লড়তে হয়রান হয়ে যাবে শুভা ম্যামরা, হুকুমৎ এর জেদ ফুরোবে না।মাটির নীচে চলে গেছে আজিজ, তার বাপ কিছুটা যেন নিশ্চিন্ত এখন।
সেমুইয়ের পায়েস খাওয়াবে তো জাভেদ ভাই, ওদিক থেকে শুভা কলকলিয়ে বলে যাচ্ছে। সে কি জানে কত ঘন দুর্বার শীত জাভেদের কলিজার ভিতর?

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.