বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[শিল্প]
প্রথমে ছিল একটা বড় পুকুর। তাতে মাছ ধরতে আসত বাড়ি থেকে ঝগড়া করে বেরিয়ে আসা হুমদো পুরুষরা। তারা আড়চোখে মেয়েদের ছ্যান দেখছে কিনা ভাবার আগেই জলে ভাসা বুকের কাপড় তুলে নিজেকে ঢেকে ঢুকে নিত ওরা। তারপর ভিজে কাপড়ে ভিজে চুলে বাড়ি আসা। পথেও লোকের দৃষ্টি আছে বুকের দিকে, কিন্তু সেখানে তো তারা জলে পড়ে নেই। হনহনিয়ে হাঁটা যায়।
যাই হোক পুকুর ছিল, বড়সড় পুকুরে ওপারে থই থই বস্তি। পুকুর টা পুরো বস্তির চানের, বাসন মাজার, কাপড় কাচার জায়গা। তপু এই বস্তির কেউ ছিল না। তবু মেয়েদের সঙ্গে চানে আসত মাঝে মধ্যে, কখনো সময়ে না মিললে, একাই। তার শ্বশুরবাড়ি আর বস্তির মাঝে একটা ফাঁকা মাঠ। পাঁচটা টালির ঘর পাশাপাশি, দেওয়াল ঘেরা, ভিতরে রান্না ঘর। তোলা জলের চৌবাচ্চা। সেই জলও পালা করে তুলে আনে তপু, তার জা, শাশুড়ি। জনমুখী সরকার মিউনিসিপাল ইলেকশানের আগে বস্তিতে জলের কল দিয়েছে, বছর পাঁচেক হল। তার সঙ্গে তাদের ঘরের জলের কল বসিয়ে নিয়েছে ভাসুর। ক’দিন সেই পাঁচিল ঘেরা কলে মনের সুখে চান করেছিল তপু, তারপর ফরমান হল, তাকে পুকুরেই যেতে হবে। কেন, আমি পুকুরে যাবো কেন! সবাই এখেনে করছে, ভাড়াটে বউরাও— ভাসুর ট্যাঁক ট্যাঁক করে বলেছিল, যাদের ভোট দিয়েছিলি, তাদের বলগে যা। তোর জন্যে একটা কল-পাইখানা বানিয়ে দিক।
পুকুরটা বড়সড় ছিল, ওপারে বস্তি। বস্তির পাশে ফাঁকা মাঠ। সেখানে তপুর শ্বশুরবাড়ির পাঁচখানা খোলার ঘর। মাঠের উপর একটা গোবদা বট। তার কাছ ঘেঁষে একরত্তি একটা চালা ঘর খালি পড়ে ছিল। সুবল ডাক্তার মারা যাওয়ার পর বছর তিনেক। সেটাকে সারিয়ে সুরিয়ে চুণ কাম করিয়ে এখন বসছে শুভ। শুভজিৎ। পাশ করা ডাক্তার বটে, তবে ভদ্রলোকের পাড়ায় তার মান্যি নেই। সে হল বস্তির ডাক্তার। বাবাও তাই ছিল। মা জ্যেঠিমার কাছে বিস্তর খোঁটা খেয়েছে এই নিয়ে। বাবার একটা নেশা ছিল। এখানে না এলে বাবা থাকতে পারত না। দশ কুড়ি টাকা ফীস। যে যা পারে। কেউ বাড়ির সজনে, কুমড়ো। চারা পোনা। বাবা বাড়ি এসে থলে ওলটালে হাসাহাসির ঢেউ উঠতো।
শুভজিৎ বেসরকারি হাসপাতালে পাঁচ বছর কনসালটান্ট থেকে বাবার চেম্বারে ফিরে এসেছে। যেখানে সে ছিল, ভেনটিলেটরে একবার ঢুকলে পেশেন্ট পার্টি জানতে পারত না, মানুষটা মারা গেছে না বেঁচে আছে। মিটার ওঠাতে দেওয়াই তাদের কাজ ছিল। পেশেন্ট মরে গেলে মুখে সেলোটেপ লাগিয়ে বসে থাকা তার ডিউটি ছিল। অত নেওয়া গেল না। তাই পালিয়ে পুকুর ধারে চলে এসেছে। তিন দিক ঢাকা চালাঘরের তিন ধারে ফুল গাছ লাগিয়ে দিয়েছে বস্তির বুড়ো মালি। রোদের দিন বিকেলে জল দিয়ে যায় বউ মেয়েরা। আর সপ্তাহে দু’বার তপু আসবেই। তাল ঢ্যাঙা লম্বা, হিলহিলে কালো, হাত পা নেড়ে কথা বলা তপু। তার সাতাশ রকমের সমস্যা। তা ছাড়া এমনি এমনি আসা।
বস্তিতে জলের কল আসার পর থেকে পুকুরটা কেমন ছোট হয়ে আসছে। আর একটা ক্লাব ঘর গজিয়েছে পুকুরের ধারের দিক থেকে। খোলার ঘরগুলোর আড়াআড়ি। রাতে রাতে লরি লরি ঘেষ ইঁট সব পড়ে। ঝপাস ঝপাস শব্দ পাই। পুকুর বোজাচ্ছে। আপনি তো থাকো না বিকেলের পর, কি করে জানবে।
তাই নাকি? শুভ যেন অবাক।
হ্যাঁ গো। পুকুর বোজালেই ফেলাট বাড়ি। জমিটা তো মাগনা। ফেলাট বিক্রি হয়ে যাবে। ওই পমোটার না কি বলে, ক্লাবটা ওই বানিয়েছে। ছেলেদের ঠেলছে পিছন থেকে। গত জেনারেল ইলেকশনের পর থেকে চাপ বাড়ছে। এটা সবাই বুঝতে পারছে।
শুভজিৎ ও তার বাইরে নয়।
কাকে ভোট দিলে? তপুর কাছে জানতে চেয়েছিল শুভ। ঐ যাদের দিয়ে এসচি গোড়া থেকে—
বামেদের? বামটা বুঝতে পারেনি তপু।
ওই যে কাস্তে হাতুড়ি যারা—
তোমরা সবাই?
আরে আমাদের সবাই তো বদলে নেছে গো! শশুর ভাসুর শাউড়ী। বরটা তো ন্যালাক্ষাপা। মোদো মাতাল। বোঝে না কিছু। আমি পাটি বদলাই নি। তাইতে এমন মারল সবাই যে হাতটা ফুলে গেছে, দেখ না। চুল ধরে মেরেছে। কেলাব পিছনে লেগেছে যে, এবার আর ছাড়ান নেই।
কিন্তু এদের ভোট দিলে, ভোটটা নষ্ট হল না? এরা তো জিতবে না!
মাথা ঝাঁকিয়ে হাসে তপু। ভোটের আবার নষ্ট কি গো— বলি যাকে দিলাম, সে পেল কি পেল না? পেল তো? তাহলে, নষ্ট কেন?
তাই তো ভাবছিল শুভও। নষ্ট কেন? ভোট দিয়ে এসে দুপুরে বিরিয়ানী আনাল পিসতুতো দাদা বৌদিরা। ওদের ভোট এপাড়ায়। এদের আর এবার দিলাম না বুঝলি। যেন লজ্জা আড়াল করতে গলা ঝেড়ে বলেছিল, নষ্ট তো। কেউ জিতবে না যখন।
ওদের থেকে ক্লাস ফোর অবদি পড়া তপু ভালো বোঝে?
আগে ক্লাব ছিল না, পার্টি ছিল। পার্টির সাঁড়াশি চাপ থাকত পাড়ায়, লোকের ব্যক্তিগত ব্যাপারে। সরকারে নেই, তবু পাড়ায় পার্টি রাজ করত। আস্তে আস্তে গত পাঁচ সাত বছরে উঠে এসেছে ক্লাব। তাদের পুজো, বক্স ডিজে। মোচ্ছব তোলা। তপুর শাশুড়ি যশোদার সঙ্গে শুভ ডাক্তারের আলাদা চ্যানেল। যশোদা আবার তপুর কথা তাকেই নালিশ করে যায়।
ভালো মন্দ জানি না ডাক্তার, বউটাকে তো তাড়িয়ে দিয়েছিলাম, তিন নম্বর মেয়েটা হওয়ার পর নিজে নিজে সেলাই হয়ে এসেছিল বলে। ভদ্র ঘরের মেয়ে বউ এমন করে দেখিনি। বলে, আর বাচ্চা হলে খাওয়াবে কে? বলি তুই গতর খাটাবি তোর বর যখন মাতাল। রোজগার পাতি করেমনা। তা বলে, আমি কি নিজে যেচে মাতাল জেনে এসেচি তোমাদের বাড়ি? বিয়ে দিয়ে আনল তো ভাসুর ঠাকুর নিজে। খাওয়াবে তোমরা! পার্টি এসে হল্লা করল, বউটা কে আবার ঘরে নিতে হবে। নিলাম। সে ছিল একরকম। কিন্তু কেলাব এমন করছে যে ঘরটা না হাতছাড়া হয়ে যায়।
শুভ জানে, ভয়ের কারণ ঘনাচ্ছে। পুকুরটা বোধহয় বুজিয়ে দেবে প্রমোটার। ক্লাব যশোদাকে বলেছে পাঁচটা ঘরের তিনটে ভাঙতে হবে, কারণ মেপে দেখা গেছে ঘরগুলো ক্লাবের জমি অর্ধেক খেয়ে গেছে। এটাই ওরা বুঝতে পারে না, না যশোদা, না তপু। ক্লাবটা তো এখানে ছিলই না। তবে ভিটের জমি খেল কি করে? তপু বলেছিল, বিয়ে হয়ে এসে ও জানত না ওর শাশুড়ির দুটো বিয়ে। এই জমি আগের পক্ষের বরের। সেখানে ঘর তুলেছে এ পক্ষের বর, মানে তপুর শ্বশুর। কিন্তু এখন আগের পক্ষের মেয়েরা এক জোট হয়েছে। তারা বলছে, আমরা পাই না পাই বাপের সম্পত্তি, তোমাদের উঠিয়ে ছাড়ব। ক্লাবকে হাত করেছে আগের পক্ষের মেয়েরাও। এখন আরম্ভ হয়েছে এক মুষল যুদ্ধ। তপু হল সব পক্ষের টার্গেট। তাকে না শ্বশুর ভাসুর শাশুড়ি পছন্দ করে, না ক্লাব, না আগের পক্ষ। যার বর রোজগার করেনা, মদ খেয়ে পড়ে থাকে, তার কে থাকবে? তার ওপর সে দল বদলায়নি। থই থই বস্তি। কিন্তু তপুর পাশে কেউ দাঁড়াবেনা। কারো পাশেই আজকাল কেউ দাঁড়ায়না। ক্লাবের শাসন, তোলার টাকা ওপর পর্যন্ত যায়।
দেখতে দেখতে ক্লাব লেগে গেল শুভর পিছনেও। এই যে ডাক্তার, এবার গুটিয়ে নাও। এই জায়গাটায় ক্লাবের বাগান হবে। এর মাঝে মাঝে তপু আসে। পাঁচ বাড়ি ঠিকে কাজ করে, সকাল সাতটা থেকে বিকেল তিনটে। তারপর বাড়ি এসে ভাত তরকারি বেড়ে দেয় ছেলে মেয়েদের। বর থাকলে বরকে। দশ কুড়ি যা পারে টাকা দেয়। সময় নেই তাই হাসপাতালে যেতে পারে না। বুকের ব্যথা, হাতের পুরোনো ব্যথা, বড় ছেলের হাঁটুর ঘায়ের চিকিৎসা, কাদায় পা পিছলে নিজের কোমর গেল। দেখ ডাক্তার বাবু, লোকটাকে রিকশ কিনে দিয়েছি নিজের রোজগারের ট্যাকায়, তবু সে ভাড়া না পেলে আমাকে বসাবে না। তিরিশের জায়গায় কুড়ি দিতে হবে। বলে কি, বাজার রেটের কম চাইছি, দে। রোজ রোজ কোথ্থেকে টাকা দিই? আমার টাকায় চাল আলু ডিম কিনি, ও তো ভাড়ার টাকায় বোতল কিনবে। এদিকে ভাসুর বলছে, আমাদের ঘর ছাড়তে হবে। আধখানা জায়গা পার্টি নিলে আমাদের ঘর খানা যাবে। তিনটে বাচ্ছা নিয়ে কোথায় দাঁড়াবে, তাই তপুর চিন্তা। বর আছে আবার নেই ও।
অদ্ভুত অর্থনীতি। রাজনীতির নল থেকে বেরিয়ে আসা অর্থনীতি। শুভ ভাবতে বসে। আর সেইদিনই শেষ অঙ্কের পর্দা নামে কারণ ক্লাবের ছেলেরা বলে যায়, কাল চেম্বার ভাঙা পড়বে। আর আসবেন না। পুকুরটা কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে, ধারের দিকে একটু জল। মাঝখানটা পুড়ে কুঁকড়ে উঠেছে। ওখানেও শিগ্গির বাগান হবে, খেলার মাঠ হবে, কাউন্সিলর ফিতে কাটবেন। কিন্তু সে দিন দুপুরেই তপুর ছোট মেয়েটা গলা ফাটিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ওর দিকে ছুটে আসে— মাকে মেরে ফেলল গো জ্যাঠামশা। ভিতরের কলে চান করতে গেছিল, পুকুরে জল নেই বলে— গলা ধরে মাটিতে আছাড় মেরেছে।
চেম্বার নেই তবু, ডিগ্রি তো আছে, আসপাশের হাসপাতালে চেনা জানা আছে। এখনও শুভ জীবন দেওয়ার লড়াই করতে পারে। স্টেট হাসপাতালের ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে সে শুয়ে থাকা অচেতন ভেজা শরীরটাকে দেখে, কপালে রক্ত, বুকে রক্তের ছিটে। কালো হিল হিলে লম্বা একটা সাপ, সাপ না বিদ্যুৎ, যেন এখনি উঠে বসবে, ছোবল দেবে— মার খেয়ে হাত খোয়াতে বসেছে তবু ভোট নষ্ট করেনি, তার কমরেড। তপুকে এমার্জেন্সির ভিতরে নিয়ে যাবে শুভ। তাকে কেউ আটকাতে পারবে না। জীবন থাকলে চেম্বার পুকুর সব হবে।
শহীদ হবে না ডাক্তার।
তপুকেও হতে দেবে না।
— শ্রমজীবী ভাষা, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২২