বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[শিল্প]

[শিল্প]

কমিউনিস্টদের ‘বাঙালি’ চেতনা কি অপরাধ?

দীপক পিপলাই

photo

শুরুর কথা


১) বাংলাকে কেন বাঙালিদের ‘দেশ’ বলা যাবে না?
২) কেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থে এবং তাদেরই উদ্যোগে তৈরি রাষ্ট্র ‘ভারতবর্ষ’-কেই ‘‘দেশ’’ বলে মানতে হবে?
৩) বাঙালির ‘দেশ’ কোনটা, তার সীমানা ঠিক করে দেবে বিদেশি তস্করেরা?
৪) শোষক, লুঠেরা, অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকদের মর্জিকেই কেন মান্যতা দিতে হবে বাঙালি জাতিকে?
৫) বাংলার প্রাকৃতিক সম্পদ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সামাজিক বৈচিত্র্য, ভাষিক মাধুর্য, অর্থনৈতিক অর্জন, রাজনৈতিক পরম্পরা, ইত্যাদি সবকিছুর উপর প্রতিটি বাঙালির অধিকার কেন নিরঙ্কুশ হবে না?
৬) বাঙালির যাবতীয় ঐশ্বর্য কী শুধুই শোষকশ্রেণীর এবং শাসক বর্গের স্বার্থরক্ষার জন্য? 
৭) বাঙালি কী বাস্তবকে বিচার না করে, শুধুই কেতাবি জ্ঞানকে আশ্রয় করে বাঁচবে?
সাধারণত এ’সব প্রশ্নের পরিস্কার কোনও জবাব পাওয়া যায় না তথাকথিত কমিউনিস্ট ‘নেতা’-দের কাছ থেকে! শুধুই নানারকম কথার কেরামতি। বরং প্রশ্নগুলোর মধ্যে অনেক ‘নেতা-ই কটু গন্ধ পান! প্রশ্নগুলো কেমন যেন “বাঙালি প্রাদেশিকতা”-য় দুষ্ট! এঁদের মোদ্দা কথা – “আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাসী কমিউনিস্টদের বাঙালি নিয়ে নয়, তাঁদের ভাবতে হবে ভারতীয় জনগণকে নিয়েই।”
জাতি/ জাতিসত্তা (Nation), জাতীয় (National), জাতীয়তা (Nationality), জাতীয়তাবাদ (Nationalism) – প্রতিটি শব্দের ব্যঞ্জনা ও অর্থ আলাদা, কিন্তু সবই সম্পর্কযুক্ত। কোনটা গ্রহণ এবং কোনটা বর্জন করাই শ্রেয়, সেটাই বিচার্য।
বাঙালি জনগণ যাঁদের নাম-ও শোনেননি কোনোদিন, চোখেও দেখেননি কখনও, যাঁদের সম্পর্কে কিছুই জানেন না, ভাবনায় যে-জাতির কোনও অস্তিত্ব-ই নেই, – তাঁদের স্বার্থকেই প্রধান গুরুত্ব দিয়ে, নিজেদের জাতীয় স্বার্থকে কার্যত বিসর্জন দিতে হবে! এই ধরনের মহৎ(!) চিন্তার সঙ্গে মার্কসবাদী চিন্তা-ভাবনার মিল কতটুকু? 
একটু দেখা যেতে পারে।

‘দেশ’ ‘শ্রেণী’ ‘জাতি’: কমিউনিস্ট শিক্ষকরা কী ভাবতেন



’দেশ’


কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, দু’জনে মিলে লিখেছিলেন “কমিউনিস্ট ইস্তাহার” (‘Communist Manifesto’)। আজ থেকে ১৭৫ বছর আগে, ১৮৪৮ সালে। এই রচনার একদম শেষে আছে একটা আহ্বান – “সকল দেশের শ্রমজীবী মানুষ, ঐক্যবদ্ধ হও।” (“Working Men of All Countries, Unite.” - ইংরাজি এঙ্গেলসের)। এখানে দুটো বিষয় অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে লক্ষ্য করা দরকার:
১) ‘শ্রমিক শ্রেণী’ (Working Class)-এর কাছে নয়, “শ্রমজীবী মানুষ” (Working Men) -এর কাছে আহ্বান জানানো হয়েছে। কবে থেকে, কোথায়, কেন, কার দ্বারা প্রথম এই আহ্বান পাল্টে গিয়ে “দুনিয়ার মজদুর, এক হও” (“Workers of the World, Unite”) হয়ে গেলো, তা খুঁজেও পাইনি!
২) ‘দুনিয়ার’ (World) নয়, “সকল দেশের” (All Countries) - এর কথা বলা হয়েছে। শুধুই ‘দুনিয়া’-র ভাবনা নয়, সকল “দেশ”-এর বাস্তব স্বীকৃতি।
‘কমিউনিস্ট ইস্তাহার’ লেখার ৯০ বছর পরে, মাও ৎসে-তুঙ বলেছেন (১৯৩৮), “একজন কমিউনিস্ট যিনি একজন আন্তর্জাতিকতাবাদী, একই সময়ে কি আবার দেশপ্রেমিকও হতে পারেন? আমরা মনে করি, তিনি শুধু হতেই পারেন না, তাঁর হওয়া উচিত।” আরও বললেন, “দেশপ্রেম হচ্ছে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিকতাবাদের বাস্তব প্রয়োগ।” একই সঙ্গে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লিখলেন, “আমরা হচ্ছি আন্তর্জাতিকতাবাদী, একই সময়ে দেশপ্রেমিকও বটে। আমাদের স্লোগান হচ্ছে – মাতৃভূমিকে রক্ষা করার জন্য আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করো।”
শাসকের প্রশাসনিক দাগে চিহ্নিত ভূখন্ড কখনোই জনগণের ‘দেশ’ হ’তে পারেনা। আম জনতার হৃদয়ের আবেগেই তৈরি হয় তাঁদের দেশ। আইন মেনে ‘দেশ’ গড়ে ওঠে না; দেশকে যথার্থ মর্যাদা দিয়েই আইন তৈরি হয়।

’শ্রেণী’


ঐতিহাসিক ইস্তাহার রচনার ১৬-বছর পরে (১৮৬৪), গঠিত হয় ‘প্রথম আন্তর্জাতিক’ (‘First International’)। ১) শ্রমিকশ্রেণীর আত্মরক্ষা (defence); ২) পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শ্রেণীসংগ্রাম; এবং ৩) সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। এইসব উদ্দেশ্যে যে প্রতিষ্ঠানটি গঠিত হয়েছিল তার পুরো নাম ছিল “শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সংগঠন” (International Workingmen’s Association)। নভেম্বর ১৮৬৪-তে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয় “Address and Provisional Rules of The Working Men’s International Association” শিরোনামে একটা পুস্তিকা।
পুস্তিকাতে “সাধারণ নিয়মাবলী” (General Rules) অংশে বলা হল –
“শ্রমিক শ্রেণীগুলোর মুক্তি অবশ্যই শ্রমিক শ্রেণীগুলোকে নিজেদেরই জয় করে নিতে হবে।” (The emancipation of the working classes must be conquered by the working classes themselves.)
একটিমাত্র ‘শ্রমিক শ্রেণী’-র বদলে, “শ্রমিক শ্রেণীগুলো”-র কথা বলা হয়েছে এই ঐতিহাসিক দলিলে। কারা ছিলেন এই সংগঠনের নেতৃত্বে? কার্ল মার্কস, ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, মিখাইল বাকুনিন, লুই ব্লাঁকি প্রভৃতি তদানিন্তন দুনিয়ার প্রথম সারির সমাজতান্ত্রিক নেতারা।
নিয়মাবলী লিখেছিলেন স্বয়ং কার্ল মার্কস।
শ্রমিকশ্রেণীর উপর পেটিবুর্জোয়া ‘কমিউনিস্ট’ নেতাদের ধারাবাহিক মাতব্বরি দেখতেই আমরা অভ্যস্ত। সেই পরিস্থিতিতে, মার্কসের এই লেখার গুরূত্ব উপলব্ধি করা বিশেষভাবে জরুরি।

’জাতি’


কার্ল মার্কস যখন লেখেন (৯ এপ্রিল, ১৮৭০) – “আইরিশদের আবেগপূর্ণ চরিত্র এবং এই সত্য যে ইংরেজদের তুলনায় তাঁরা বেশি বিপ্লবী।” – তখন তিনি আইরিশদের এবং ইংরেজদের জাতীয় চরিত্রের কথাই বলেন।
ফ্রেডরিক এঙ্গেলস যখন (৩০ মার্চ, ১৮৯২) বলেন – “সরকারের চাইতে বুর্জোয়ারা ভাল জানে, কীভাবে এক জাতিসত্তার (Nationality) বিরুদ্ধে আরেক জাতিসত্তাকে লড়িয়ে দিতে হয়।” – তখন জাতি/ জাতিসত্তা নিয়ে তাঁর ভাবনার কথাই আমরা জানতে পারি।
একদিক থেকে বিচার করলে, কোনও জাতীয় আন্দোলন অবশ্যই শ্রমিকশ্রেণীর শ্রেণী-আন্দোলন না। তা জাতীয় বুর্জোয়াদেরও স্বার্থ রক্ষা করে। কিন্তু ‘মাতৃভাষা’ বাংলার জন্য নানা সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলে সংগঠিত ঐতিহাসিক সংগ্রামগুলো ছিল বৃহত্তর বাঙালি জাতির লড়াই। কোনও জাতির মধ্যে শোষক ও শোষিতের মাতৃভাষায় কোনও ফারাক থাকেনা।
১) ১৯১২ সাল থেকে শুরু হওয়া – হিন্দীভাষী শাসকদের তরফ থেকে হিন্দী ভাষা চাপিয়ে দেবার বিরুদ্ধে, জেল-জরিমানা সহ নানারকম অত্যাচার সত্ত্বেও, মানভূম অঞ্চলে সংগঠিত পৃথিবীর দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন; ২) ১৯৫১ সালে পূর্ববঙ্গে, উর্দুভাষী পাকিস্তানি শাসকদের তরফ থেকে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেবার বিরুদ্ধে ৫ জন শহীদের রক্তস্নাত ঐতিহাসিক ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’-র সংগ্রাম; ৩) ১৯৬১ সালে অসমের বরাক উপত্যকায়, অসমীয়া ভাষাভাষী শাসকদের তরফ থেকে অসমিয়া ভাষা চাপিয়ে দেবার বিরুদ্ধে ১১ জন শহীদের রক্তে রাঙা সংগ্রাম; – সবই ছিল ধর্ম-বর্ণ-জাত-শ্রেণী নির্বিশেষে, বাঙালি জাতির ভাষিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম। এইসব লড়াই চালাতে গিয়ে কখনও জাতীয় কংগ্রেস ভেঙে তৈরি হয়েছে নতুন সংগঠন (উদাহরণ, মানভূম)। কখনও রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র মতপার্থক্য (উদাহরণ, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’)। আবার কখনও শাসক গোষ্ঠীর উগ্র বাঙালি-বিরোধী চরিত্র নগ্ন হয়ে পরেছে (উদাহরণ, আসাম)। বিভিন্ন ভাষাভাষী শাসকদের আধিপত্যবাদী ভাষিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য বাঙালি জাতির এইসব আন্দোলন কখনোই শুধু বুর্জোয়াদের আন্দোলন ছিলনা, শেষপর্যন্ত তা সরাসরি জনগণের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।
১৯৭১ সালে, পূর্ববাংলার ছাত্র, শিক্ষক, ইন্টেলেকচুয়াল সমাজ, নাগরিক সমাজ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বাঙালি পুলিশ ইত্যাদির উপর নির্বিচার ও বীভৎস গণহত্যা এবং অবর্ণনীয় সাম্রাজ্যবাদী অত্যাচার চালাচ্ছিল উর্দু-পন্থী পাকিস্তানি মিলিটারি শাসকেরা। মার্চ থেকে ডিসেম্বর, ৯ মাসে তারা হত্যা করেছিল ৩০ লক্ষ বাঙালিকে। এই ভয়ঙ্কর হত্যালীলা চলাকালীন সময়ে, পশ্চিমবঙ্গের এক কমিউনিস্ট বিপ্লবী নেতা লিখলেন (২৯ জুন, ১৯৭১), “কমিউনিস্ট পার্টির দায়িত্ব ব্যাপক কৃষক জনতাকে উদ্বুদ্ধ করে বিদেশি আক্রমণের মোকাবিলা করা এবং ইয়াহিয়া খাঁর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান রাখা।” শিশু-নারী-বৃদ্ধ নির্বিশেষে লক্ষলক্ষ বাঙালিকে তখন বীভৎসতম হত্যালীলা চালিয়ে যাচ্ছে যে ইয়াহিয়া খাঁ, তার সঙ্গে “ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান”! শ্রেণী সংগ্রাম, জাতিগত নিপীড়ন, মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি প্রশ্নে নেতার অবাস্তব, বাঙালি-বিরোধী, এবং অ-মার্কসীয় চিন্তাভাবনাই প্রকট হয়ে উঠেছিল।
বাঙালি কমিউনিস্টদের কাছে এইসব ঘটনাও একেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
সব মার্কসবাদী শিক্ষাই যখন অনুপস্থিত
উপরের কথাগুলো অত্যন্ত জোর দিয়ে বারবার বলা দরকার এই কারণে, ‘দেশ’ ‘শ্রেণী’ ‘জাতি’ ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্পর্কে আজও ভাসাভাসা ধ্যানধারণাই ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে আছে এখানকার কমিউনিস্ট শিবিরে। মার্কসবাদী দর্শনের মৌলিক কোনও শিক্ষাই এখানে ‘নেতা’-রা আদৌ কোনোদিন আত্মস্থ এবং অনুশীলন করেছেন কিনা, সেটাই গবেষণার বিষয়! ‘আন্তর্জাতিক’ হ’তে গিয়ে ‘দেশ’, ‘শ্রেণী’ এবং ‘জাতি’ সম্পর্কে একপেশে ও যান্ত্রিক বোধের প্রাদুর্ভাব তারই প্রমাণ। ‘দেশ’ কিম্বা ‘জাতি’ নিয়ে কথা বললেই “প্রাদেশিক” কিম্বা “জাতীয়তাবাদী” তকমা লাগিয়ে দেন বহু ‘কমিউনিস্ট’ নেতা। জাতিগত সমস্যা সমাধানের কোনও বাস্তব পথ তাঁরা কখনোই দেখাতে পারেন না। তাঁদের নিদান – সবাইকে, সব বিষয়ে, প্রতি মুহূর্তে শুধুই অস্পষ্ট ও তথাকথিত ‘আন্তর্জাতিকতাবাদী’ হতে হবে!
কেন?
মার্কসবাদ-বিরোধী কিম্বা মার্কসবাদ সম্পর্কে অজ্ঞ তথাকথিত ‘কমিউনিস্ট’-দের কাছে ‘দেশ’ কিম্বা ‘জাতি’ ব’লে তো কিছু থাকতেই নেই, থাকবে নাকি শুধুই ‘দুনিয়া’! ‘দেশপ্রেম’ এবং ‘জাতীয়তা’-র কথা বলা নাকি সাঙ্ঘাতিক বিচ্যুতি! শ্রমিকশ্রেণীর কাছে ‘দেশ’-ই যখন নেই, ‘দেশপ্রেম’ শব্দটাও তখন নেহাতই অর্থহীন! শুধুই থাকবে বোধহীন, আবেগসর্বস্ব ও অস্পষ্ট ‘আন্তর্জাতিকতাবাদ’ নামক এক ট্যাঁশগরু দর্শন!
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের আন্তর্জাতিক শিক্ষকদের কোনও মৌলিক মতামতই এখানকার কমিউনিস্ট আন্দোলনে কখনোই যথার্থ মান্যতা পেলোনা। ভাষায় স্বীকৃতি এবং বাস্তবে বিকৃতি,-- এটাই বাংলায় তথা ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রধান ধারা হয়ে রইলো! রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক-ভাষিক সহ, যে কোনও বিষয়েই এ’কথা প্রযোজ্য।
জাতীয়তাবাদ (Nationalism) এবং জাতীয়তা (Nationality); অর্থনীতিবাদ (Economism) এবং অর্থনৈতিক (Economic); সংসদবাদ (Parliamentarism) এবং সংসদীয় (Parliamentary); – এইসব প্রত্যেকটি শব্দেরই রয়েছে আলাদা আলাদা মানে, ব্যঞ্জনা এবং তাৎপর্য। তা কী এখানকার কমিউনিস্ট আন্দোলনের রথী-মহারথী নেতারা জানেন না? তাঁরা কী এগুলোর পার্থক্য নিয়ে নেহাতই অজ্ঞ? নাকি, তাঁরা তাঁদের নিজেদের অনুসৃত, পেটিবুর্জোয়া সুবিধাবাদী রাজনীতির স্বার্থেই, এইসব শব্দ-অর্থের সচেতন বিকৃতি-কারী?
এ’সব প্রশ্নের জবাব তথাকথিত ‘কমিউনিস্ট’-দের মনোহারি কথাবার্তার মধ্যে নয়, তাদের বাস্তব কাজকর্মের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে।
যে সব কথা প্রায় শোনাই যায় না
লেনিন যখন লেখেন (১৯১৩), “সকল জাতিগত নিপীড়নের বিরোধিতা করতে হবে? হ্যাঁ, অবশ্যই।” – তখন কী তিনি ভুল বলেন?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন বলেন (১৯১৭), “জাতীয়তাবাদ এক ভয়াবহ বিপদ।” – তখন কী তিনি রূঢ় সত্য কথাই বলেন না?
স্তালিন যখন ‘জাতি’-র (Nation) সংজ্ঞা দিয়ে লেখেন, “জাতি বলতে ঐতিহাসিকভাবে বিবর্তিত এমন একটি স্থায়ী জনসমাজকে বোঝায় যা এক ভাষা, এক বাসভূমি, এক আর্থনীতিক জীবন এবং এক মানসিক গঠনের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে, এবং এই মানসিক গঠন সাধারণ সংস্কৃতির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।” – বাঙালি জাতি তো তার চমৎকার উদাহরণ।
অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে, উপরোক্ত সকলের সবগুলো কথাই ঠিক। জাতিগত প্রশ্নে কেউই কারও বিরোধী না, বরং সকলেই সকলের পরিপূরক। এ’কথা না বুঝলে, অথবা না বুঝতে চাইলে, কিম্বা নিজেদের মগজে আগে থেকেই গেঁড়ে বসে থাকা ভাবনার বা রাজনৈতিক স্বার্থে বুঝেশুনে সবকিছুই ঘেঁটে দিতে চাইলে অবশ্য আলাদা কথা।
আন্তর্জাতিকভাবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যখনই ‘জাতিগুলোর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার’-এর যুক্তি দেখিয়ে বিভিন্ন জাতির এবং উপনিবেশুলোর উপর নিজেদের দখলদারি কায়েমে তৎপর হয়ে উঠলো, কমিউনিস্টদের নীতিও তখন স্বাভাবিকভাবেই গেলো পাল্টে। তাঁরা বলিষ্ঠভাবে ঘোষণা করলেন, “বিচ্ছিন্ন হবার অধিকার সহ, জাতিগুলোর আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার” (Right of Nations to Self-determination, including the right to secede)-এর নীতি। কমিউনিস্ট আন্দোলনের এই আন্তর্জাতিক নীতি পশ্চিমবঙ্গের তথা বাঙালিদের ক্ষেরেও প্রযোজ্য।
বাঙালির ঘরের মধ্যেই এর চমৎকার উদাহরণ মজুত আছে। পাকিস্তানি অবাঙালি শোষকদের ভাষিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক আগ্রাসন ও উৎপীড়নের জোয়াল থেকে বিচ্ছিন্ন হ’য়ে, সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে এবং তিরিশ লক্ষ বাঙালির আত্মাহুতির বিনিময়ে, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। যে ভাষিক অধিকারের জন্য বাঙালির এতো বছরের এতো লড়াই, এতো সংগ্রাম, এতো আত্মবলিদান, সেই ভাষার অধিকারটুকু অন্তত তাদের আজ প্রতিষ্ঠিত। ‘‘বিচ্ছিন্ন হবার অধিকার সহ, জাতিগুলোর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার’’ বিষয়টা শুধুই কেতাবি পণ্ডিতী দেখানো কথার কথা না। দুনিয়া জুড়েই, “বিচ্ছিন্ন হবার অধিকার”-কে আধিপত্যবাদী শাসকরা কোথাওই স্বীকার করেনা। প্রতিটি বাঙালির এবং সমগ্র বাঙালি জাতিরও এই জন্মণত অধিকার আছে। ভারতবর্ষের মতো একটি বহুজাতিক রাষ্ট্রে, বাঙালিদের মতো, এই অধিকার আছে প্রতিটি জাতির মানুষেরই।
এটা প্রকৃত কমিউনিস্টদের কাছে সর্বকালীন এবং শোষণ ও আধিপত্যবাদ বিরোধী দৃঢ় নীতিগত-রাজনৈতিক অবস্থান।
সকলের সমান অধিকার থাকলেই, সকল জাতির মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক-ভাষিক অগ্রগতির জন্য সমানে সমানে কাজ করবেন। কারও জন্মগত ও ন্যায্য অধিকার শাসকরা অস্বীকার এবং দমন করতে চাইলে, প্রতিবাদ ও সামাজিক ঝড় অনিবার্য। হয়তো শুধু সময়ের অপেক্ষা।

বাংলা ও বাঙালির স্বার্থ


বাঙালি জাতি, কিম্বা বাংলা ভাষা, অথবা বাংলার সংস্কৃতি, কিম্বা বাংলার অর্থনীতি এবং রাজনীতি, – এ’সব নিয়ে কোনোরকম আলোচনায় উপরের কথাগুলো মনে রাখা খুবই জরুরি। কারণ, পেটিবুর্জোয়া ‘কমিউনিস্ট’ নেতাদের মধ্যে সবই ঘেঁটে ‘ঘ’ হয়ে গেছে! অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, “গণতান্ত্রিক নির্বাচন”-এর মাধ্যমে ‘শাসক’ হ’তে পারলে (ডান-’বাম’ নির্বিশেষে) বাঙালি ‘নেতা’-রাও বিক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদী বাঙালির উপর গুলি, গ্রেপ্তার, অত্যাচার এবং হুমকির চিরাচরিত স্বৈরাচারী পথেই হাঁটেন। এঁদের হাতে বাংলার এবং বাঙালির স্বার্থ কীভাবে নিরাপদ হ’তে পারে? এ’প্রশ্নের জবাব শাসকরাই দিতে পারবেন!
বাংলা ভাষার মর্যাদা এবং বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে যারাই অগ্রাহ্য করতে চাইবে – তারা অবাঙালি কিম্বা বাঙালি যা-ই হোক – তাদের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম জারি রাখতে হবে। বাঙালি জাতি এবং বাংলা ভাষার স্বার্থে। শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত, অবহেলিত অবস্থান থেকে জাতীয় মুক্তির স্বার্থে।
প্রত্যেকটি জাতির বা দেশের মুক্তিসংগ্রাম নিশ্চিতভাবেই সেখানকার জনগণের শক্তিতে এবং প্রাথমিকভাবে তাঁদের নিজেদের স্বার্থেই সংঘটিত হয়। আবার, সেইসব ঘটনাবলীর আন্তর্জাতিক প্রভাবও পড়ে অনিবার্যভাবেই। রুশ-বিপ্লব নিশ্চয়ই চীনা জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য হয়নি। চীন-বিপ্লব কী বাঙালি জাতির স্বার্থে হয়েছিল? কখনোই না। কিন্তু যে কোনও দেশের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার আন্তর্জাতিক প্রভাব থাকেই। প্যারি কমিউন, রুশ বিপ্লব, চীন বিপ্লব, কিউবার বিপ্লব, ভিয়েতনামের মুক্তি যুদ্ধ, ইরাক যুদ্ধ, কিম্বা চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ, ইত্যাদি প্রতিটি দেশে সংঘটিত ঘটনাবলী একই সত্যের উদাহরণ। প্রত্যেকটি দেশের বিপ্লব, কিম্বা প্রতিবিপ্লব, অথবা পুঁজিবাদী শিবিরের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কলহে বেঁধে যাওয়া যুদ্ধ, সবকিছুরই প্রাথমিক ও প্রধান প্রভাব পড়ে সেখানকার জনগণের উপরেই; আন্তর্জাতিক প্রভাব তারই ফলশ্রুতি মাত্র।
হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতির মানুষ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি জাতির মুক্তিদাতা হয়ে উঠবে, কিম্বা বাঙালি হয়ে উঠবে সেইসব দূরবর্তী জাতির ত্রাতা, – এর চেয়ে বড়ো কল্পনাবিলাস বোধহয় আর কিছুই হ’তে পারেনা! কয়েক বছর পরে পরে, সংসদীয় নির্বাচনে নিয়মমাফিক ‘গণতান্ত্রিক’ ভোট দিয়ে এবং বাঙালি শাসক পেয়েও, বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ভাষিক ইত্যাদি কোনও সমস্যাই যে মেটেনি, গত ৭০ বছরে সংসদীয় রাজনীতির বাস্তব অভিজ্ঞতা সেকথাই বলে। নেতা-মন্ত্রীদের অনুগ্রহই আজও সাধারণ বাঙালিদের ভরসা! পশ্চিমবঙ্গ ‘স্বাধীন’ হবার ৭৫ বছর পর, আজও এখানে দারিদ্র থেকে মুক্তি পাবার জন্য কৃষক এবং শ্রমিকের আত্মহত্যার ঘটনাগুলো, আর পাঁচটা ঘটনার মতোই যেন বাঙালির গা-সওয়া হয়ে গেছে! ডিগ্রী লাভের পরেও, বাঁচার রাস্তা খুঁজে না পেয়ে সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণীদের আত্মহত্যার খবরও পাওয়া যায় সংবাদমাধ্যমে! পেটের দায়ে বাঙালি মায়ের সন্তান হত্যা কিম্বা সন্তান বিক্রি; সন্তান সহ মায়ের আত্মহত্যআ; কাজ-হারানো বাঙালি পরিবারের রমনীকে দূরবর্তী স্থানে গিয়ে দেহবিক্রি করে ‘উপার্জন’ করা; – কোনও কিছুতেই বাঙালি শাসকের মাথা লজ্জায় হেঁট হয়ে যায়না!
বাঙলা ভাগের বছরেই, অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন -
“তেলের শিশি ভাঙল বলে
খুকুর পরে রাগ করে করো
তোমরা যে সব ধেড়ে খোকা
বাঙলা ভেঙে ভাগ করো!
তার বেলা?”
এ’প্রশ্নের জবাব আজও বাঙালি জাতি খুঁজে বেড়ায়!
“বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল–
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান॥
বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ–
পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক হে ভগবান॥
বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা–
সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক হে ভগবান॥
বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন–
এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান॥”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(রচনাকাল: বঙ্গাব্দ ১৩১২ || খৃষ্টাব্দ 1905)
১১৮ বছর পরে, আজও এই রচনা বাঙালি জাতির অনুপ্রেরণা। বিদেশি শাসকের শোষণ-অত্যাচার-বঞ্চনা জারি থাকার সময়ে রচিত বাঙালির প্রতি এই আহ্বান, স্বদেশি এবং জনবিরোধী শোষক-শাসকদের আমলেও সমান প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে। স্বদেশি যুগের সেইসময়েই রবীন্দ্রনাথের আহ্বান – “শঙ্খ-মুখরিত দেবালয়ে যে পূজারি আগত হইয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, অস্ত সূর্যের দিকে মুখ ফিরাইয়া যে মুসলমান নমাজ পড়িয়া উঠিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, যে রাখাল ধেনু দলকে গোষ্ঠগৃহে ফিরাইয়া আনিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো,” – এই আদর্শ সেক্যুলার ভাবনা সঙ্কীর্ণ ধর্মীয় চেতনায় সিক্ত বাঙালি রাজনৈতিক নেতাদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি! তাঁদের যে-যার নিজস্ব ধর্মীয় মানসিকতায় অটল থেকেছেন সেদিন, বাঙালির ঐক্যবদ্ধ সামাজিক স্বার্থকে উপেক্ষা করে। বর্তমানে কিম্বা ভবিষ্যতে বাঙালি জাতি কী করবে, তার দায় অবশ্যই বাঙালির।

বাঙালির মুক্তি: নিজেদেরই হাতে


১৯০৫ থেকে মুসলমান-হিন্দু ভেদাভেদের ভিত্তিতে বাঙালি জাতির ক্ষতি করতে তৎপর ছিল ব্রিটিশ শাসকরা। তারপর থেকে তারা সক্রিয়ভাবে এই চেষ্টা চালিয়ে গেছে নানাভাবে। শেষপর্যন্ত, কুলাঙ্গার বাঙালি মোড়লদের সহযোগিতায় বাঙালি জাতির চরম সর্বনাশ ঘটাতে তারা সক্ষম হল ধর্মের ভিত্তিতে ‘বাংলাভাগ’ করে, ১৯৪৭ সালে। একই জমিতে বসবাসকারী, শতশত বছরের প্রতিবেশী বাঙালিও এক মুহূর্তে হয়ে গেলো ‘বিদেশি’! সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে দেশভাগের বিরুদ্ধে সংঘটিত ক্ষোভ-বিক্ষোভ-প্রতিবাদের ঘটনাবলী আটকাতে পারেনি রাজনৈতিক মোড়লদের বিশ্বাসঘাতকতাকে। মুসলিম লীগের দাবি, ধুরন্ধর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের সমর্থন ও  পরিকল্পনা, আর বাঙালি জাতির হিন্দু ও মুসলমান দুই তরফের সাম্প্রদায়িকতাবাদী মানসিকতাসম্পন্ন কুলাঙ্গারদের সমর্থন ও সহযোগিতাতেই দেশ-ভাগাভাগি সম্ভব হয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদীদের এক কলমের আঁচড়ে তৈরি ‘সীমান্ত’-র দুই পারের বিপুল সংখ্যক বাঙালি সর্বস্ব হারিয়ে, ভিটে-মাটি-আয়হীন ‘উদ্বাস্তু’ হয়ে, চরম দুরবস্থার মধ্যে জীবন কাটাতে বাধ্য হ’ন। কিন্তু তা ভাগাভাগিপন্থী ‘নেতা’-দের মনে এতটুকুও দাগ কাটেনি! শোষকদের বিরুদ্ধে বাঙালি শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যবদ্ধ ও আপোষহীন প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আন্দোলনে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল দেশি-বিদেশি শোষকের দল। তাই নিজেরা বাঁচার স্বার্থেই তাদের ‘বাংলাভাগ’-এর দুরভিসন্ধিমূলক পরিকল্পনা।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে মুসলমান ও হিন্দু, দুই সম্প্রদায়েরই চিন্তাবিদ মানুষজনের ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ বাঙালি ঐক্যের এক আদর্শ সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই হিন্দু নেতাদের উগ্র সাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনার দাপট, মুসলমান সমাজের প্রতিনিধিদের সেই সম্ভাবনাময় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য করে। বাঙালির সেই ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচিকে তছনছ করে দেয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর  অনেক লেখায় ও ভাষণে এই বিষয়টি চমৎকারভাবে বলেছেন। প্রকৃত সেক্যুলারিজমের প্রতীক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ; তিনিও শেষপর্যন্ত দূরত্ব তৈরি করতে বাধ্য হ’ন হিন্দু সাম্প্রদায়িক নেতৃত্বের পরিচালিত আন্দোলন থেকে। তখন থেকে ১৯৪৭-এর ‘বাংলাভাগ’ এবং তৎপরবর্তী কালের হিন্দুবাদী রাজনৈতিক নেতাদের সাম্প্রদায়িক পদক্ষেপগুলো লাগাতার হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদকে ক্রমাগত চওড়া করেছে। মুসলমান সাম্প্রদায়িকতাবাদী শক্তির উগ্র ‘হিন্দু’ ও ‘নাস্তিক’ বিরোধিতা, এবং বিপরিতে, হিন্দু সাম্প্রদায়িক নেতাদের তরফ থেকে ‘মুসলমান’ বিরোধিতার যে অসামাজিক ভাবনাচিন্তার প্রাবল্য চলে আসছে, তার বিশফল আমাদের খেতে হচ্ছে! নানা ধরনের ‘গণতান্ত্রিক’ পদ্ধতি অনুসরণ করতে করতে, ‘সীমান্ত’-র ওপারে কার্যত এক ‘মুসলমান বাংলা’ এবং এপারে কার্যত এক ‘হিন্দু বাংলা’ দেখতে পাচ্ছি আমরা! সমগ্র বাঙালি জাতির ‘দেশ’ হিসাবে অবিভক্ত, সেক্যুলার ও শক্তিশালী এক বাংলার সম্ভাবনা ক্রমশই যেন দূরে সরে যাচ্ছে!
অবিভক্ত বাংলায় বাঙালির অর্থনৈতিক সম্পদ, শিক্ষার পুঁজি, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, এবং রাজনৈতিক পরম্পরা স্বাধীন বাঙালি জাতিকে যে সামাজিক উচ্চতায় উন্নীত করতে পারতো, তা ছিল দেশি-বিদেশি শোষকদের কাছে মহা দুশ্চিন্তার বিষয়। তাই, ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতিকে বিভক্ত করার উদ্যেশ্যেই ‘বাংলাভাগ’ নিয়ে তাদের এতো আগ্রহ ও তৎপরতা বেড়ে উঠেছিল।
আগামীদিনে মানুষের মতো ইজ্জত, মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে পথচলার রাস্তা বাঙালিকেই ঠিক করতে হবে। বাঙালি জাতিকে ধর্মের ভিত্তিতে ‘ভাগ’ করে ‘দুই দেশ’-এ পরিণত করার যে শয়তানি প্রকল্প, তাকে বলিষ্ঠভাবে প্রত্যাখ্যান অথবা মেরুদন্ডহীনভাবে তার তাঁবেদারী, কোনটা করবে, তা-ও বাঙালিকেই ঠিক করতে হবে। কোনও ‘দেবদূত’ বা ‘ফেরেশতা’ অথবা ‘অ্যাঞ্জেল’, কিম্বা ভারতরাষ্ট্রের অধিবাসী অপর কোনও দূরবর্তী জাতির মানুষ, অথবা ভিন্ন কোনও দেশের জনগণ এসে বাঙালিকে উদ্ধার করবে না।
বাঙালি সত্ত্বাকে উপেক্ষা করে ‘ভারতীয়’ সত্ত্বার ভাবনা, সোনার পাথর বাটি ছাড়া আর কিছুই নয়।
বাঙালি কৃষকের স্বার্থে গত শতাব্দীর তিরিশের দশক থেকেই, ক্যারিয়ারের লোভ বিসর্জন দিয়ে এবং বাড়িঘর ছেড়ে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়েছেন, অনাহারে থেকেছেন, শহীদের মৃত্যু বরণ করেছেন বাঙালি কমিউনিস্ট কর্মীরাই। বাংলায় কর্মরত বিভিন্ন জাতির শ্রমিকদের হ’য়েও দশকের পর দশক লড়াই চালিয়েছেন ক্যারিয়ার বিসর্জন দেওয়া বাঙালি কমিউনিস্টরা। তাঁদের অনেকেই অত্যাচারিত হয়েছেন, খুন হয়েছেন শ্রেণীশত্রুদের হাতে।
এঁদের সকলেরই মাটিছোঁয়া জীবন সাধনার কেন্দ্রে ছিল বাঙালি জাতির শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত শ্রমজীবী সমাজ। আগামী দিনগুলোতেও, হাজার হাজার মাইল দূরে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতির মানুষ বাঙালি জাতির সমব্যথী হ’তে পারেন, কিন্তূ মুক্তিদাতা হ’তে পারবেন না। যে মাটিতে শিকড় ছড়ায়নি, সে মাটিতে মহীরুহ হতেই পারেনা। এই সত্যকে উপলব্ধি করেই, আগামীদিনে এগোতে হবে আন্তর্জাতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন বাঙালি কমিউনিস্টদের।

প্রকৃত কমিউনিস্টরাই একমাত্র ভরসা


অন্য রাজনৈতিক দলের কর্মীরা কৃষক-শ্রমিকের ছিটেফোঁটা ‘উপকার’ করলেও করতে পারে, কিন্তু শোষণমুক্তির লক্ষ্যে লড়াই চালাতে পারবেন না তাঁদের নিজেদের দলীয় রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার জন্যেই। সময় এবং রাজনীতির প্রেক্ষিত অনেক পাল্টে গেলেও, বাঙালি জাতির উপর দেশি-বিদেশি শোষকদের শ্রেণী-শোষণ আজও অপরিবর্তীত। শোষকশ্রেণীর এবং শাসকবর্গের যোগ্য প্রতিপক্ষ হিসাবে, বাংলায় শ্রমজীবী মানুষের বাস্তব সমব্যথী ও সহযোদ্ধা হয়ে উঠতে পারেন একমাত্র প্রকৃত কমিউনিস্টরাই। শোষণ-বঞ্চনার বিষবৃক্ষকে বাঁচিয়ে রেখে, ডালপালা ছেঁটে তাকে ‘সুন্দর’ করাই অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর লক্ষ্য; প্রকৃত কমিউনিস্টরা শিকড় সহ মূল গাছটাকেই উপড়ে ফেলতে চায়। পূর্বসূরিদের দেখানো আপোষহীন লড়াইয়ের পথে। শ্রমজীবীদের রুজি-রোজগারের ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধে দ্বিধাহীনভাবে জান-কবুল লড়াই করতে পারেন একমাত্র প্রকৃত কমিউনিস্টরাই। বহু ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, এটাই ঐতিহাসিকভাবে সত্য। সংসদবাদের অন্ধ-গলিতে অনন্তকাল ঘুরপাক না খেয়ে, মাঠে-ময়দানে কলে-কারখানায় প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের মাধ্যমে, শোষকদের বিরূদ্ধে লড়াই-সংগ্রামের সেই রাস্তাতেই রয়েছে বাঙালির সংগ্রামী উত্তরাধিকার। সেই পথেই আসতে পারে, অন্যান্য জাতি/ জাতিসত্তার মতো, বাঙালি জাতিরও মুক্তি।
মানবসমাজে সকল জাতি-ই সমান। সব ভাষাই সমমর্যাদা সম্পন্ন। সকল সংস্কৃতির রংধনু সৌন্দর্যেই মানবসমাজের ঔজ্বল্য। বাঙালি শোষক এবং কুলাঙ্গারদের বিরুদ্ধেও লড়তে হবে বাঙালি জাতিকেই। বিভিন্ন জাতির তরফ থেকে বাঙালিদের উপর বারবার জঘন্য হামলা হয়েছে। কিন্তু “উড়ে তাড়াও”, “বিহারি ভাগাও”, “অসমিয়া খেদাও”, – এ’ধরনের কোনও অসভ্যতা বাঙালি কখনও বরদাস্ত করেনি। বরং, অপর যে কোনও জাতির উপর জাতিগত শোষণের বিরুদ্ধেও বাঙালি জাতি লড়েছে এবং লড়বে। বাংলায় বসবাসকারী এবং বাংলাকে আপন করে নেওয়া যে কোনও জাতির মানুষকে আপন করে নেওয়াই তার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। এটাই বাঙালির মানবিক ঐতিহ্য।
সংসদীয় পথে নির্বাচিত বিভিন্ন ‘বাঙালি সরকার’ পশ্চিমবঙ্গকে শাসন করে চলেছে গত ৭০ বছর যাবৎ। জাতীয় কংগ্রেস, সিপিআই(এম) দলের নেতৃত্বে পরিচালিত ‘যুক্তফ্রন্ট’ এবং ‘বামফ্রন্ট’, তৃণমূল কংগ্রেস ইত্যাদি ডান ও ‘বাম’ রাজনৈতিক শক্তিগুলোর শাসনেই থেকেছে পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু এখানে রাজনীতির অধঃপতন এমন এক স্তরে পৌঁছেছে, যখন সংসদীয় রাজনীতির পরিমন্ডলে নীতি-নৈতিকতার হদিশ পাওয়াই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে! সম্পূর্ণ রাজনীতিহীন চূড়ান্ত নোংরামির অনুশীলনই হয়ে উঠেছে সংসদীয় শাসক দলগূলোর একমাত্র ‘রাজনীতি’!
ক্ষুদিরাম, বাঘাযতীন, সূর্য সেন-অনন্ত সিং-গণেশ ঘোষ, মাতঙ্গিনী হাজরা, সুভাষচন্দ্র বসু, বাবুলাল বিশ্বকর্মা, – সকলেই আজ যেন বাঙালি জাতির কাছে কেতাবি স্মৃতিমাত্র! রামমোহন-বিদ্যাসাগর, শুধুই অতীতের ‘গর্ব’! রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-সুকান্ত, কেবলমাত্র নিরুপদ্রব ‘জন্মজয়ন্তী’-র উপলক্ষ্য! সুভাষচন্দ্র নেহাতই শাসকের বিশ্বাসঘাতকতাকে আড়াল করার মুখোশ! প্রাত্যহিক জীবনে এঁদের সকলের জীবনবোধকে আত্মস্থ করতে পারলেই বাঙালি সমাজের মুক্তি সম্ভব।

মাতব্বরদের উপর ভরসা করে লাভ নেই


আবার একটা নতুন বছর শুরু হয়ে গেলো দু’মাস আগে। বাঙালি হিসাবে রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে বলতে ইচ্ছা করছে, “বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক // … মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, // অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।”
১) ‘নির্বাচিত’ শাসকচক্রের মধ্যে ঘুষ, চুরি, জালিয়াতি, স্বজনপোষণ, নীতিহীনতা এবং স্বৈরাচারের স্তুপ অভূতপূর্ব উচ্চতায় পৌঁছেছে। ২) সমাজে পারস্পরিক ঘৃণা, অবিশ্বাস এবং সন্দেহের বিষকে ভয়াবহ করে তোলা হয়েছে। ৩) জনগণের উপর পুঁজিপতিদের শোষণ ধারাবাহিকভাবে জোরদার হয়ে উঠছে যুগযুগ ধ’রে। ৪) শাসকবর্গের সমস্ত ধরনের জনবিরোধী কাজকর্মকে ‘‘মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়া’’-র মতো দাসত্বের মানসিকতা সংক্রামিত করেছে বাঙালি জাতিকেও! ৫) মাতৃভাষা বাংলাকে অসম্মান, অবজ্ঞা এবং উপেক্ষা করাকেই যেন সাধারণ প্রবণতায় পরিণত করা হয়েছে!
সময়ের সঙ্গেসঙ্গে, বহুকিছুর প্রভাবে, যে কোনও জনগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ইত্যদি সবকিছুই পাল্টায়। এটাই স্বাভাবিক। চিরস্থায়ী এবং অপরিবর্তনীয় কোনওটাই না। বাঙালি সমাজ ব্যতিক্রম কিছু না। কিন্তু কোন পরিবর্তন ঘটছে সময়ের স্বাভাবিক প্রভাবে, আর কোন পরিবর্তন ঘটাতে চাইছে আধিপত্যবাদী শক্তির আগ্রাসী দাপট, তার ফারাকটা বোঝা খুবই জরুরী। ‘স্বাভাবিক’-কে বরণ এবং ‘অস্বাভাবিক’-কে প্রতিহত করা যদি না যায়, তবে যে কোনও জাতির/ জাতিসত্তার দুর্ভোগ অনিবার্য। বাংলা ভাষা এবং বাঙালি সংস্কৃতিকে বিকৃত করার এবং বিলুপ্ত করার যে ধারাবাহিক অপপ্রয়াস চলে আসছে সুদীর্ঘকাল ধ’রে, বাঙালি জাতিকেই তা প্রতিহত করতে হবে।
সবরকম গ্লানি ও জরা থেকে বাঙালি সমাজকে মুক্ত করতে পারে তারুণ্যে ভরপুর সেই জেদী মানসিকতা, যা শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা উপেক্ষা করে পুরো ২০২২ সালটাই খোলা আকাশের নীচে আন্দোলনে কাটিয়ে দিতে প্রেরণা জোগায়। বারবার পুলিশের এবং রাজনৈতিক ভৈরববাহিনীর হামলা সত্ত্বেও, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগঠিত আন্দোলনের অগ্নিস্নানে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে।
বাঙালি সমাজকে মানবিক, শোষণমুক্ত এবং অসামাজিক ক্লেদমুক্ত করার জন্য তৎপর হ’তে হবে সমগ্র বাঙালি জাতিকে। কোনও হোমরাচোমরা ‘নেতা’, বা ভোটের হিসাবে তথাকথিত ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ দাপুটে কোনও রাজনৈতিক শক্তি, কিম্বা কোনও ‘নির্বাচিত সরকার’ – কারও হিম্মতে কুলোবে না এ’কাজ। বরং তারাও বর্তমান দমবন্ধ করা পরিস্থিতির জন্য কমবেশি দায়ী। অন্য ভাষা বাঙালির ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে আগ্রহী কোনও আধিপত্যবাদী শক্তি, ধর্মীয় কিম্বা জাত-ভিত্তিক অথবা দলীয় সাম্প্রদায়িক মাতব্বরেরা, – এঁরা কেউ-ই বাঙালির ইজ্জত ও অধিকারের জন্য কোনওদিন লড়েনি, এবং লড়বে না। একমাত্র স্বাধীনতাকামী এবং বাঙালি চেতনাসম্পন শ্রমজীবী জনগণই বাঙালি জাতির আগামী দিনের ভরসা হয়ে উঠতে পারে। তামিল জাতির সমস্যা নাগা জনগণ সমাধান করতে পারবেন না; ওড়িয়া জাতির সমস্যা মারাঠি জাতির পক্ষে সমাধান করে দেওয়া সম্ভব না। বাঙালির জাতিগত সমস্যাও গুজরাটিদের পক্ষে নিষ্পত্তি করা অসম্ভব। বাঙালি জাতির সব সমস্যা সমাধানের জন্যেও বাঙালি জনগণকেই তৎপর হ’তে হবে।
ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, পূর্ব পাকিস্তান, চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইরাক … আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অন্যাযের বিরুদ্ধেই বাঙালি জনগণ তাঁদের সংবেদনশীলতা বারবার প্রকাশ করেছেন। পাঞ্জাব, দিল্লী, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, অন্ধ্র, ঝাড়খন্ড, উত্তরপ্রদেশ ইত্যাদি বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী জনগণের উপর অত্যাচার-অবিচারের বিরুদ্ধেও বাঙালি-সংবেদনশীলতার নমুনা ইতিহাসে বারবার নথিবদ্ধ হয়েছে। বাঙালি জাতির নিজস্ব স্বার্থেও তেমনি বাঙালির সংবেদনশীলতার প্রকাশ জরুরি।
যত তাড়াতাড়ি সে’দিন আসে, ততই ভাল॥

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.