বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[শিল্প]
১৮৬০এর দশক। রুশ সাহিত্যের স্বর্ণযুগ। তুর্গেনিভ, তলস্তয়, চেরনিসেভস্কি, দস্তয়েভস্কি প্রমুখ সাহিত্যিকের শাশ্বত সাহিত্য সৃষ্টি এই সময়টিকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে। তুর্গেনিভের “ফাদার আ্যন্ড সন্স” (১৮৬২), তলস্তয়ের “ওয়ার আ্যন্ড পিস” (১৮৬৯), চেরনিসেভস্কির “হোয়াট ইজ টু বি ডান” (১৮৬৩), দস্তয়েভস্কি’র “নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড” (১৮৬৪), “ক্রাইম আ্যন্ড পানিশমেন্ট” (১৮৬৬), “গ্যাম্বালার” (১৮৬৭) প্রভৃতি জগতবিখ্যাত উপন্যাস এই সময় রচিত হয়েছিল। রুশ সাহিত্যের এই উথালপাতাল সময়ের অন্যতম কথাশিল্পী ফিয়োদর দস্তয়েভস্কি (১৮২১ থেকে ১৮৮১) ২০০ বছর পূর্ণ করেছেন ১১ নভেম্বর, ২০২১। এই উপলক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাঁকে স্মরণ করা হচ্ছে নানান ভাবে। আমরা তাঁর জীবন এবং সাহিত্যসৃষ্টিকে আর একবার ফিরে দেখার চেষ্টা করব এই লেখায়। প্রথমেই বলে রাখি দস্তয়েভস্কি’র সব লেখার মূল্যায়ন করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। শুধু প্রতিনিধিস্থানীয় কয়েকটি লেখার একটা স্কেচ দাঁড় করানোর চেষ্টা করব। এই প্রবন্ধ পড়ে যদি নতুন প্রজন্মের পাঠক দস্তয়েভস্কি পড়তে আগ্রহী হয় তাহলে আমাদের প্রচেষ্টা সফল হবে।
অসংখ্য ট্রাজিক পরিণতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে দস্তয়েভস্কি’র জীবন। পিতা মিখাইল আন্দ্রেইয়েভিচ ছিলেন পেশায় একজন চিকিৎসক। প্রথম জীবনে তিনি পৌর দাতব্য চিকিৎসালয়ে চিকিৎসা করতেন। পরবর্তীকালে নিজের চেষ্টায় একটি ছোটখাটো জমিদারির মালিক হন। তবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কোপন স্বভাবের মানুষ। মা ছিলেন ধর্মভীরু এবং কোমল প্রকৃতির। স্বামীর ভয়ঙ্কর ঈর্ষাকাতরতা এবং সন্দেহবাতিক মানসিকতার জন্য প্রচন্ড কষ্টভোগ করে মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে মারা যান। ফিয়োদরের বয়স তখন মাত্র পনের বছর। মায়ের মৃত্যুর পর তাঁর জীবন আরো দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। নিদারুণ নির্যাতন এবং অত্যাচারের মধ্যে তাঁর শৈশব অতিবাহিত হয়। পিতার মদ্যপান এবং ব্যভিচারী জীবন ফিয়োদরকে চরম দুর্দশার মধ্যে ফেলে দেয়। অনেকে মনে করেন “কারমাজভের ভাইয়েরা” উপন্যাসের ভ্রষ্টাচারী জমিদারের চরিত্রটি বাবা মিখাইল আন্দ্রেইয়েভিচের ছায়া অবলম্বনে রচিত। মাত্র আঠারো বছর বয়সে নিজের চোখের সামনে পিতাকে খুন হতে দেখেন ভূমিদাসদের হাতে। অকথ্য অত্যচারের প্রতিশোধ নিতেই ভূমিদাসরা মিখাইল আন্দ্রেইয়েভিচকে তাঁরই জমিদারিতে নৃশংসভাবে খুন করে। অনেকের অনুমান এই ভয়ঙ্কর মানসিক অভিঘাতের ফলেই তিনি মারাত্মক মূর্ছারোগের শিকার হয়ে ছিলেন। যৌবনের শুরু থেকে শুরু হয় চরম অর্থ কষ্ট। ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে বাবার ইচ্ছাতেই পেতের্বুর্গে সামরিক ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় তাঁকে ভয়ঙ্কর আর্থিক অনটনের মধ্যে পড়তে হয়। শৈশব এবং যৌবনের নিদারুণ অভিজ্ঞতা সারা জীবন তাঁর পিছু ছাড়েনি।
পড়াশোনা শেষ করে সরকারি অফিসে নকশা শিল্পীর কাজে যোগ দিলেও তাঁর মন পড়ে থাকে সাহিত্য চর্চার অঙ্গনে। ফলে এক বছরের মধ্যে চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি পুরোপুরো সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। এই সময়ের মানসিক অবস্থার কথা লিখতে গিয়ে তিনি এক জায়গায় বলেছেন— “নিজেকে কবি বলে মনে হতো, ইঞ্জিনিয়ার বলে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না।”
১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে দস্তয়েভস্কি’র প্রথম উপন্যাস ‘পুওর পিউপিল’ প্রকাশিত হয়। বাংলায় যা অনুদিত হয় ‘গরীব লোক’ নামে। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র মাকার দেভুশকিন সরকারি অফিসের একজন সামান্য বেতনভুক কেরানি। অত্যন্ত দরিদ্র দুঃখী এই মানুষটি সবসময় হীনম্মন্যতায় ভুগতেন। কখনও তার মনে হতো অন্যেরা তার আংরাখা দিয়ে নিজেদের পায়ের ধূলো মুছবে। এর বেশি তার যোগ্যতাই নেই। এরপর একদিন তার সঙ্গে পরিচয় হয় তারই মত এক হতদরিদ্র মহিলা ভারভারা দব্রসিয়োলভারের সঙ্গে। এই পরিচয় অচিরেই প্রণয়ে পরিণত হয়। এই প্রণয়জাত অনুভূতি তার মধ্যে জন্ম দেয় আত্মমর্যাদাবোধ। প্রেমিককে লেখা চিঠিতে মাকার নিজের সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে লিখছে “হৃদয়-মনের দিক থেকে আমিও মানুষ”। ‘গরীব লোক’ তাঁকে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল। বিখ্যাত সাহিত্য সমালোচক বেলেনস্কি দস্তয়েভস্কি’র উপন্যাসটিকে ‘শিল্পের সত্য’ আখ্যা দিয়ে মন্তব্য করেন তরুণ লেখকের মধ্যে ‘মহৎ লেখকের সম্ভাবনা’ আছে। কাহিনি গড়ে উঠেছে মাকার দেভুশকিন এবং তার বান্ধবী ভারাভারা দব্রসিয়োলভার মধ্যে লেখা কয়েকটি চিঠির আদান-প্রদানের মাধ্যমে। সমাজের গরীব, দুঃখী মানুষের আহত মর্যাদাকে বস্তুনিষ্টভাবে লেখক এই উপন্যাসে উপস্থিত করেছেন। গণতান্ত্রিক চেতনা এবং মনুষ্যত্ববোধের সার্থক ভাষারূপ হয়ে উঠেছে এই উপন্যাস।
প্রথম উপন্যাস অল্প দিনের মধ্যে তাঁকে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা এনে দেয়। বৌদ্ধিক মহল সাদরে গ্রহণ করেন তাঁকে। পাঠকের অকুন্ঠ প্রশংসা পেয়ে অত্যন্ত উৎসাহিত হন তিনি এরপর খুব দ্রুততার সঙ্গে তিনি লিখে ফেলেন কয়েকটি গল্প ও উপন্যাস। ১৮৪৬ এ প্রকাশিত হয় দুটি উপন্যাস— পুওর ফোক (অভাজন) ও ডাবল। ১৮৪৭ এ প্রকাশিত হয় ল্যান্ডলেডি। ১৮৪৮ এ হোয়াইট নাইটস। এই কালপর্বে লিখে ফেলেন অসংখ্য গল্প । এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মিস্টার প্রোখারচিন (১৮৪৬), নভেল ইন নাইন লেটারস (১৮৪৭), অ্যানাদার্স ম্যানস ওয়াইফ (১৮৪৮), এ জেলাস হাসবেন্ড (১৮৪৮), এ উইক হার্ট (১৮৪৮), পোলজুনকফ (১৮৪৮), অ্যান অনেস্ট থিফ (১৮৪৮), এ ক্রিস্টমাস ট্রি অ্যান্ড এ ওয়েডিং (১৮৪৮), এ লিটল হিরো (১৮৪৯) ইত্যাদি। এই পর্বে ডাবল ও হোয়াইট নাইটস এই দুটি দুটো উপন্যাস এবং দুর্বল চিত্ত গল্পটি আলোচনা করব।
ডাবল বা দ্বৈত উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র গলিয়াদকিন ছিলেন দ্বৈত সত্তার অধিকারী। একদিকে, সে লোকসমাজে, বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করা, মেরুদণ্ডহীন, লাজুক স্বভাবের মানুষ। অন্যদিকে সে মিশুকে, সাহসী, মহিলামহলে অতীব জনপ্রিয় একজন সপ্রতিভ মানুষ। কালক্রমে তার মধ্যে জন্ম নেয় সমাজের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি হয়ে ওঠারথ বাসনা। এই বাসনা এতোটাই তীব্র ছিল যে সে দিবাস্বপ্ন দেখতে থাকে যে, সে সত্যি সত্যি সমাজের একজন হোমরাচোমরারা হয়ে উঠেছে। এইভাবে সে দ্বৈতব্যক্তিত্ব অর্জন করে ফেলে। শুরু হয় তার দ্বৈত জীবন। এক এক সময় তার মনে হয় যে সে স্রোতের মুখে খড়কুটোর মতো ভেসে যাওয়া সামান্য মানুষ। অন্য সময় সে হয়ে ওঠে স্বার্থান্ধ, ধূর্ত, খল প্রকৃতির মানুষ। উপন্যাসের শেষে লেখক পাঠককে নিয়ে যান পাগলাগারদে। গলিয়াদকিনের শক্তিমান ব্যক্তিত্বটি তার দুর্বল, ভীরু অর্ধসত্তাকে একটা গাড়িতে চাপিয়ে পাগলাগারদে পাঠিয়ে নির্লজ্জ নীতিবিগর্হিত কাজে নিজেকে নিয়োজিত করছে। অতিনাটকীয় পরিণতি দেখানো হলেও এই উপন্যাসের বিষয় এবং আঙ্গিকে একটা অভিনবত্বের জন্ম দেন লেখক। এই পর্বের অসাধারণ বাস্তবধর্মী রচনা হল “হোয়াইট নাইট” (১৮৪৮) যার বাংলা তর্জমা করা হয়েছে “শুক্লা যামিনী”। উপন্যাসের প্রেক্ষাপট হিসেবে লেখক ব্যবহার করেছেন সাংকত পেতের্বুর্গের বিষাদময় চিত্র যা “দস্তয়েভস্কি’র পেতের্বুর্গে” নামে রুশ সাহিত্যে পরিচিত। এই মহানগরের এক অন্ধকার গলি ঘুপচির মধ্যে বাস করে আখ্যানের নায়ক। তার সুন্দর জীবনের উদগ্র বাসনা, অবাস্তব কল্পনা অপূর্ব কাব্যময়তায় ফুটিয়ে তুলেছেন দস্তয়েভস্কি। লিরিক রচনার নৈপুণ্যে এবং সমাজবাস্তবতার প্রাখর্যে এই উপন্যাস অন্য এক মাত্রায় পৌঁছে গেছে। “হোয়াইট নাইট” উপন্যাসে লেখক দেখিয়েছেন মহানগরের জীর্ণ পরিবেশে থেকে যারা সুখস্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাকে তাদের বিনাশ অনিবার্য।
দুর্বল চিত্ত গল্পের নায়ক ভাসিয়া শুমকোভ পেশায় একজন কপি-লেখক ছিলেন। সে তার প্রভুর কয়েকটি দরকারি কাগজ সময়মত কপি করে উঠতে পারেনি। তাই সে ভয়ঙ্কর উদ্বিগ্ন। ভয়ে ভাবনায় সে সব সময় সিটিয়ে থাকে। আর মনে মনে ভাবে তার “পরম হিতৈষী” কর্তা রেগে গিয়ে তাকে কঠিন শাস্তি দেবেন। এমন কি আর্মিতেও পাঠিয়ে দিতে পারেন। কারণ ভাসিয়া তাঁর ক্রীতদাস। শুধু ভয় নয়, তীব্র অপরাধবোধ তাকে গ্রাস করে। প্রভুর নির্দেশ অমান্য করে বাগদত্তার সঙ্গে সময় কাটিয়ে সে চরম অকৃতজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে। আত্মধিক্কার, বিবেকের দংশন এবং সীমাহীন ভীতির ফলে সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। অথচ ভাসিয়া যে কাজের কথা ভেবে পাগল হয়ে গিয়েছিল, সেটা আদৌ গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। বিষয়টি তার প্রভুর নজরেও পড়ত না। একজন “ক্ষুদ্র মানুষ” কিভাবে মহানগরের ইট, কাঠ, পাথরের স্তূপের মধ্যে চাপা পড়ে যায় তার মর্মস্পর্শী বর্ণনা আছে এই কাহিনিতে। চ্যেখভের “কেরানির মৃত্য” গল্পের সঙ্গে এই গল্পের অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সামাজিক বাস্তবতা এবং মনোবিকলনের বিভিন্ন স্তরকে অত্যন্ত সাবলীলতায় উপস্থিত করে তিনি পাঠক ও বুদ্ধিজীবী মহলে অল্প সময়ে পরিচিতি লাভ করেন।
বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এই সময় থেকে তিনি ফরাসি ও ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক চর্চায় মনোনিবেশ করেন। বিপ্লবী গণতন্ত্রী সমালোচক বেলেনস্কির সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্র ধরে আলাপ হয় রাজধানীর রাজনৈতিক বিপ্লবীদের সঙ্গে। ১৯৪৮ সালের কোনও একটা সময় থেকে তিনি বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী পেত্রাশেভস্কির প্রগতিশীল পাঠচক্রে যাতায়াত শুরু করেন। পরে পেত্রাশেভস্কির জনৈক সহযোগী পরিচালিত গোপন বিপ্লবী সংগঠনে যোগদান করে নিষিদ্ধ সাহিত্য ছাপিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজে উৎসাহিত হয়ে পড়েন। এক বছর এই কাজ করার পর ১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাসে পেত্রাশেভস্কির পাঠচক্রের অন্য ২১ জন সদস্যের সঙ্গে দস্তয়েভস্কি গ্রেপ্তার হন। বিচারাধীন বন্দি হিসেবে তাঁকে পিটার-পল কারাদুর্গের নির্জন ঘরে আট মাস বন্দি করে রাখা হয়। বিচারে অন্যদের সঙ্গে তাঁকেও প্রাণদন্ডে দন্ডিত করা হয়। ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর। হাড়কাঁপানো শীতের ভোরে দস্তয়েভস্কিকে বধ্যভূতিতে উপস্থিত করা হয়। কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে মন্ত্র পাঠ করিয়ে তাঁকে বন্দুকের সামনে দাঁড় করানো হয়। জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে মাত্র কয়েক মহূর্তের ব্যবধান। এই সময় জার প্রথম নিকোলাইয়ের দূত ঘোড়া ছুটিয়ে হাজির হয় ফায়ারিং স্কোয়ারের সামনে। জারের নির্দেশে সমস্ত বুদ্ধিজীবী রাজদ্রোহীদের মৃত্যুদন্ড রদ করে সশ্রম কারাদণ্ডে দন্ডিত করা হয়। দস্তয়েভস্কিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সাইবেরিয়ার বন্দি শিবিরে। সেইদিন সন্ধ্যায় দাদা মিখাইলকে লেখা চিঠিতে তিনি লেখেন—
“আমি হতাশ হইনি, ভেঙে পড়িনি। জীবন সর্বত্রই জীবন, বাইরের নয়, আমাদের নিজেদের ভিতরের জীবন। আমার আশেপাশে মানুষজন থাকবে, মানুষের মাঝখানে মানুষ হয়ে থাকা, যত বড় সংকটই দেখা দিক না কেন, চিরকাল মানুষ হয়ে থাকা, হতাশ না হওয়া, ভেঙে না পড়া— এই হল জীবন, এই হল জীবনের লক্ষ্য।” পরবর্তী কালের সমস্ত লেখায় তাঁর এই জীবন অভিজ্ঞতা গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। চার বছর নির্বাসন দন্ড ভোগ করার পর ১৮৫৪ সালে দস্তয়েভস্কিকে পাঠানো হয় বাধ্যতামূলক সৈনিকের চাকরিতে। ১৮৫৭ সালে তিনি ইসায়েভাকে বিয়ে করেন। ১৮৫৯ সালে তাঁর সৈনিক জীবন শেষ হয়। আবার তিনি সেন্ট পিটার্স বুর্গে পাকাপাকিভাবে বসবাসের অনুমতি পান।
শুধু দস্তয়েভস্কিই নয়, রুশ সাহিত্যের অসংখ্য প্রতিভাবান সাহিত্যিকের জীবনে নেমে এসেছিল ট্রাজিক পরিণতি। বিখ্যাত রুশ কবি পুশকিন এবং ল্যেরমন্তভ দ্বন্দ্বযুদ্ধে অকালে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। কবি রিলেইয়েভকে প্রাণদন্ডে দন্ডিত করা হয়। বিপ্লবী ও চিন্তাবিদ চের্নিশ্যেভস্কিকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দীর্ঘ কুড়ি বছর সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত করা হয়। নির্বাসন দন্ড ভোগ করতে হয়েছিল হেরৎসেন ও সালতিকোভশ্চেদ্রিনকেও। এছাড়াও সেই মধ্যযুগ থেকে সমকালের অসংখ্য কবি-সাহিত্যিককের ভাগ্যে জুটেছে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও লাঞ্ছনা। সে দিন থেকে দেখলে দস্তয়েভস্কির ট্রাজিক জীবন কোনও ব্যতিক্রমী বিষয় নয়।
সামরিক জীবন থেকে ফিরে আসার পরে দস্তয়েভস্কি নতুন উদ্যোমে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। ভায়ের সঙ্গে যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশ করেন “ভ্র্যেমিয়া” পত্রিকা। পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয় লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত (১৮৬১)। উপন্যাসটি লেখা শুরু করেন ১৮৬০ সালে যখন তাঁর বয়স উনচল্লিশ বছর। শেষ করেন ১৮৬১ সালের ৯ জুলাই। এই উপন্যাসে সেন্ট পিটার্সবুর্গের বঞ্চিত-লাঞ্ছিত মানুষের বাস্তব জীবনের ছবি ফুটে উঠেছে। নামকরণের মধ্যেই বিধৃত আছে সমগ্র উপন্যাসের বিষয়বস্তু। প্রথম উপন্যাস “গরিব লোক” (১৮৪৫)-এ মানুষের আহত মর্যাদার প্রতি যে গভীর সহানুভূতি জ্ঞাপন করেছিলেন তারই ধারাবাহিকতার ফসল “লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত”। তবে আঙ্গিক ও পরিকল্পনার দিক থেকে এই উপন্যাস সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। উপন্যাসটি লেখা হয়েছে উত্তমপুরুষে। উপন্যাসে বর্ণিত ঘটনাবলির সময়কাল ১৮৪৫ থেকে ১৮৪৯ সাল পর্যন্ত। আত্মজৈবনিকের আঙ্গিকে রচিত এই উপন্যাস। কেন্দ্রীয় চরিত্র “অসফল সাহিত্যিক” ইভান পেত্রোভিচের মধ্যে দিয়ে ঔপন্যাসিক তাঁর প্রথম জীবনের সাহিত্য সাধনার নানান স্মৃতি এবং লেখক বৃত্তির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা দুঃখ কষ্ট এবং কৃচ্ছসাধনার কথা বলেছেন। গল্প কথক ইভান উপন্যাসে একই সঙ্গে সমকালীন ঘটনায় অংশ নিচ্ছেন আবার অতীতের কথা স্মরণও করছেন। স্মৃতি হাতড়ে তুলে আনা ঘটনার পাশাপাশি সমসময়ের ঘটনাও পাঠককে জানাচ্ছেন। আবার কখনও কখনও অতীতের সম্ভাব্য ঘটনাসমূহকে উপস্থিত করে নিজের মন্তব্যও জানিয়ে দিচ্ছেন। এর ফলে উপন্যাসে বর্ণিত আনুপূর্বিকতা ধাক্কা খাচ্ছে। প্রকরণের মধ্যে তৈরি হচ্ছে একটা জটিলতা। এই জটিল প্রকরণ রুশ সাহিত্যে প্রথম দেখা গিয়েছিল টলস্টয়ের “শৈশব” (১৮৫২) এবং “যৌবন” (১৮৫৪) এই দুটি গ্রন্থে। টলস্টয়ের রচনায় চরিত্রটি সমসময়ের যে ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছে আর স্মৃতিচারণ করছে তার মধ্যে শিশুবয়স এবং বয়স্ক বয়সের ব্যবধান আছে। দস্তয়েভস্কি ক্ষেত্রে এই ব্যবধান মাত্র এক বছরের। ক্রিয়ার তীব্রতা, ঘটনার কেন্দ্রীভূতিকরণ এবং স্থান কালের প্রেক্ষিতে কালব্যবধানের হ্রস্বতা পরিপূরণ করা হয়েছে এই উপন্যাসে। ইভান পেত্রোভিচ একবার সক্রিয় চরিত্র হিসেবে গল্পে উপস্থিত হচ্ছেন, গল্পকথক হিসেবে তাকে আবার অন্য ভূমিকাতেও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় চরিত্রের এই দ্বৈততা রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে তার পেশাদারি লেখক সত্তার জন্য। তাঁর মানবিক অনুভূতি এবং সাহিত্যিক অনুসন্ধিৎসা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে এই উপন্যাসে। ভাগ্যপীড়িত, লাঞ্ছিত মানুষের প্রতি বাড়িয়ে দেওয়া তাঁর সহানুভূতির হাত আসলে “ভ্রোমিয়া” পত্রিকায় ঘোষিত দস্তয়েভস্কি’র মানবতাবাদী কর্মসূচির দ্যোতক। এই চরিত্রের বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে আছে প্রিন্স ভালকোভস্কি। তার মুখ দিয়ে তিনি বলিয়ে নেন নির্লজ্জ নীতিবিগর্হিত এক মতবাদ। ভালকোভস্কি মনে করে যে সে সমাজের সকল মানুষের দন্ডমুন্ডের কর্তা। তার কথায়— “আমি কিন্তু অনেক কালই হল শৃঙ্খল থেকে, এমনকি সমস্ত রকম বাধ্যবাধকতা থেকে নিজেকে মুক্ত করেছি। নৈতিক বাধ্যবাধকতা আমি তখনই স্বীকার করি, যখন দেখি তাতে আমার লাভ আছে।... জীবন এক ধরনের লেনদেন।”
এইভাবে গোটা উপন্যাসে দেখা যায় নির্দোষ, লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত চরিত্রগুলির ভাগ্যে প্রভাব বিস্তার করছে খলনায়ক প্রিন্স ভালকোভস্কি। দুই বিপরীত চরিত্রের উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে আসলে দস্তয়েভস্কি ব্যক্তিমানুষের আত্মসর্বস্ব, স্বার্থান্ধ মানসিকতার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। বঞ্চিত মানুষরা তাদের উৎপীড়নের জন্য জন্য দায়ী মানুষের প্রতি আক্রোশ বোধ করলেও তাদের মত অন্যান্য বঞ্চিত লাঞ্ছিতদের প্রতি ক্ষমাশীল। সমবেদনায় কোমল। দস্তয়েভস্কি বোঝাতে চাইছেন নারকীয় নির্যাতনও মানুষের মনের কোমল প্রবৃত্তিগুলিকে ধ্বংস করতে পারে না।
একদিকে লাঞ্ছিত নিপীড়িত মানুষের মানবিকতা ও কষ্ট সহিষ্ণুতা অন্যদিকে ধনী ও অভিজাতদের স্বার্থপরতা ও নিষ্ঠুরতার ছবি এঁকে দস্তয়েভস্কি সমাজ জীবনে চলমান সংঘাত এবং বিরোধকে তুলে ধরেছেন অনন্য মুন্সিয়ানায়। এই উপন্যাসে লেখক দেখিয়েছেন একজন মানুষ নিজের ব্যক্তিত্ব রক্ষা করতে না পেরে, নিজের মতো হয়ে উঠতে না পেরে কিভাবে শেষমেশ কঠিনতায়, অসামাজিকতায় অথবা মস্তিষ্কবিকৃতিতে পৌঁছে যায়। এই শ্রেণীর মানুষ শেষ পর্যন্ত জীবন যুদ্ধে হেরে গিয়ে নিজের মানব প্রকৃতিকে দমন করতে করতে মানুষ্যেতর প্রাণীতে
পর্যবসিত হয়। মনুষ্যত্বের এই চরম অবমাননা দস্তয়েভস্কি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। “লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত”কে লেখকের সামাজিক উপন্যাসে প্রত্যাবর্তন হিসেবে ধরা হয়। বস্তুনিষ্ঠ
সামাজিক উপন্যাস রচনার সমস্ত রসদ মজুত থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসের কাহিনি অতিনাটকীয়তা আক্রান্ত হয়েছে। ভালকোভস্কির ছেলে আলিয়োশা পিতার আজ্ঞা শিরোধার্য করে তার প্রেমিকা নাতাশাকে ছেড়ে চোখের জল ফেলে ধনী পরিবারের কন্যা কাতিয়ারকে বিয়ে করে। উপন্যাসের অন্য একটি দুর্বল দিক হল ভালকোভস্কির মতো একজন নৃশংস ও স্বার্থপর মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে অতিরিক্ত মনোযোগ দিতে গিয়ে ঔপন্যাসিক সমাজ বাস্তবতাকে উপেক্ষা করেছেন। ফলে উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় সমাজ থেকে সরে গিয়ে সাধারণ নরনারীর প্রেমকাহিনীতে পর্যবসিত হয়েছে। এই দুর্বলতাটুকু বাদ দিলে “লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত” হয়ে উঠেছে অত্যাচার, উৎপীড়ন ও অমানবিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের জোরালো হাতিয়ার যা সমাজতান্ত্রিক মতবাদের প্রতিধ্বনিও বলা চলে।
দস্তয়েভস্কি’র অন্যতম সেরা উপন্যাস ক্রাইম আ্যন্ড পানিশমেন্ট প্রকাশিত হয় ১৮৬৬ সালে। এরপর প্রকাশিত হয় জুয়াড়ি (১৮৬৭), ইডিয়ট (১৮৬৮), ভূতগ্রস্ত (১৮৭২), ছেলেমানুষ ((১৮৭৫) ও কারমাজভ ভাইয়েরা (১৮৮০)। প্রতিটি উপন্যাস বিশ্বসাহিত্যের সেরা সৃষ্টি। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগের রাশিয়ার অবক্ষয়ী সমাজের প্রেক্ষাপটে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত অসংখ্য চরিত্রের ও বিচিত্র ঘটনার সমন্বয়ে গড়ে তোলা প্রত্যেকটি উপন্যাস কালজয়ী। অন্য কোনও অবসরে এই উপন্যাসগুলি নিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি। — শ্রমজীবী ভাষা, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২২