বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[শিল্প]
একেই গরিবের হেলা-ভাঙা বাড়ি, খসা টালি-ধসা দেওয়ালে ছুঁচো-ইঁদুরের কিত্তন, তার উপর রাতভর ঝড়জলে সব ভিজে চুবড়ি, জমা জলে পথ-ঘর একাকার। কীসে উনুন ধরাব, কোথায় কাপড় মেলব ভেবে ভেবে যখন মরছি, তখন দুয়ারে এসে দাঁড়াল কি না তুমি, রাজরানির মতো! ও মা, আমার কী হবে গো? এ বার কী দিয়ে বরণ করে ঘরে তুলি?কোথায় শাঁখ, কোথায় প্রদীপ, কোথায় একটু ধানদুব্বো পাই? শুনছ অষ্টমীদিদি, তোমার ঘরে কিছু থাকে তো একটু দাও না! এসো এসো, দু’জনে মিলে ধরি ছোট কুলোটা। তোমার বোতলের শেষ তেলটুকু, আর আমার বাক্সের শেষ দেশলাই কাঠিখানা দিয়ে প্রদীপটা জ্বালো দেখি। বলিহারি তোমাকেও মেয়ে — দেশের বড় বড় শহরে আজ এত উৎসব হচ্ছে, কত গানবাজনা, কামান-কুচকাওয়াজ, আর তুমি কি না এলে এখানে? আমার ঘরে কি আর কোনও আয়োজন আছে? ওই ক্লাবের ওরা একটা পতাকা দিয়ে গিয়েছিল বটে। টালিতে গুঁজে দিয়েছিলাম, তারপর রাতে এমন জোরে হাওয়া দিয়েছে, কোথায় উড়ে গেল কে জানে? আরে ছি ছি,ওই দেখো কাদায় পড়েছে, ও ছুটকি তোল তোল! ভাল করে কেচে একটু পাটের ফেঁসো দিয়ে বেঁধে দে না কাপড় মেলার বাঁশটায়। ওই দেখ, ধুতে গিয়ে লাল-সবুজ রঙ উঠে গিয়ে সাদা জায়গাটাতে ছোপ-ছোপ লেগে গেল। কিছু মনে কোরো না গো মা, গরিবের সব কিছুই ছন্নছাড়া, পতাকার রঙ কি আর ফুটফুটে থাকে?
এসো তবে, পা টিপে সাবধানে এসো, উঠোন বড় পিছল হয়েছে। বোসো এই ভিজে বিছানা-গুটনো ন্যাড়া তক্তপোষে। আহা, আমার ভাঙা ঘরে যেন চাঁদ উঠল গো। দেখো অষ্টমীদি, দেখ। গায়ে একটাও গয়না নেই, কাপড় এই তোমার-আমার মতো, তবু কী রূপ, কী রূপ, যেন ভিতর থেকে ঠিকরে পড়ছে বাইরে। চুপ করে আছে, তবু মনে হচ্ছে যেন হাসছে,কত কী বলছে। তোমার-আমার মতোই রোগাসোগা, তবু মনে হচ্ছে যেন গায়ে খুব জোর। কী বলছ, তুমি একে কখনও দেখোনি? আমিও দেখিনি অষ্টমীদি, তবু চেনা-চেনা লাগছে। যেন কখনও দেখেছি, একটুখানির জন্য, এক পলক। যেমন করে ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ একটা মুখ দেখে চেনা-চেনা মনে হয়। ছেলেবেলায় শোনা গান অনেক দিন পরে শুনলে বুকের মধ্যেটা যেমন করে, তোমায় দেখে তেমন করছে যেন। তুমি কি আমার ইস্কুলের দিদিমণি ছিলে? স্বাধীনতার দিন পতাকা তুলত হেড দিদিমণি, একটা টান দিলেই মোড়া পতাকার ভিতর থেকে ছড়িয়ে পড়ত ফুলের পাপড়ি, অমনি দিদিমণিরা গান ধরতেন, জনগণমন...। আমি তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে গাইতাম, জয় হে, জয় হে, মনে হতো সকালের আলো পড়ে তাদের রাগ-রাগ মুখগুলো যেন আলো-আলো হয়ে উঠছে, যেন ওরা চাইলে সব পারে। আর দিদিমণি আমাদের ছুঁয়ে দিলে আমরাও সব পারি, কেউ কিছু করতে পারে না। তুমি ছিলে, ওই দিদিদের মধ্যে? ক্লাস ফাইভের পরে আর দেখিনি তো, তাই যেন বুঝতে পারছি না।
না, আর একবার যেন দেখেছি তোমাকে। সেই যে বার আমাদের গাঁয়ের সব মেয়েরা গিয়েছিলাম নিত্যানন্দের চোলাই ঠেক ভাঙতে। তখন আমি তিন-চার বছর এসেছি এ গাঁয়ে বিয়ে হয়ে, লক্ষ্মীদিদি-চাঁদনিদিদিরা এসে বলল, রোজ মদ খেয়ে গা কালি করে দেবে, তোরা কিছু বলবি না? আমরা বউমানুষ, বললেই বা শুনবে কে? তারপর তো গ্রুপের মিটিঙে সব ঠিক হল, আমরা গেলাম দল বেঁধে, তখন সন্ধ্যার ঝোঁক। দিদিরা বলল, নিতাই খুড়ো, বন্ধ করো তো ভাল, না হলে তোমার হাঁড়ি-কুড়ি ওই পুকুরের পাঁকে পুঁতে দেব। সে কি গালাগাল করল ওরা। যেমন খুড়ো, তেমনই মাতালগুলো। তাদের মধ্যে লক্ষ্মীদিদির দেওর-ও ছিল। নিজের বউদিকে কি না বলল গো মা, কানে আঙুল দিতে হয়। চাঁদনিদিদি সে ব্যাটাকে এক চড় কষিয়ে লাথি মেরে হাঁড়ি উল্টে দিলে। অমনি আমরাও ঘরে ঢুকে, বাঁশ-ছাউনি ভেঙে, ড্রাম উলটে, শিশি-বোতল সব আছড়ে ভেঙে, পুকুরে ফেলে সে যা দক্ষযজ্ঞ করেছি সেদিন, এখনও মনে হলে বুকের মধ্যে থেকে হাহা করে হাসি উঠে আসে। তখন মনে হচ্ছে, আসুক পুলিশ, আসুক প্রধান, কে আটকাবে? সবাইকে দেখে নেব। ভাল ভাল মানুষগুলো এই বোতল খেয়ে অন্য মূর্তি হয়ে যায়, মাজা-কাঁকালে লাথি মারে, ভাতের থালা ছুঁড়ে ফেলে দেয়, টাকা কেড়ে নেয়, আমরা ছেড়ে দেব? চেঁচামেচি শুনে আশপাশের পাড়ার মেয়েরাও ছুটে এসে আমাদের সঙ্গে দুড়দাড় ভাঙতে লেগে গেছে। তাদের মধ্যে যেন তোমাকেও দেখেছিলাম মাগো। তুমি কি এসেছিলে সেদিন?
তারপর তো পুলিশও এল, আমাদের কত ‘দিদি, দিদি’ করে কথা বলল। ভুঁড়ো দারোগার কত মিষ্টি মিষ্টি কথা — ‘আপনারা না চাইলে এ দোকান খুলবে না।’ ওমা, দু’মাস না যেতে বিশ-বাইশ ফুট দূরে আবার বসল নিতাইখুড়ো। তবে এ গাঁয়ে ঢোকার সাহস আর হয়নি। আমাদেরও জোর বাড়ল — মামণির বর মেরে ওর হাত ভেঙে দিতে সবাই গিয়ে খুব পিটিয়েছিলাম বরটাকে। সে বার অঞ্চল প্রধানকেও জোর করে টেনে আনলাম আমরা — সঙ্গে থাকবে না মানে? আমরা কি গ্রামের কেউ নই?
আর একবার খুব বাওয়াল হয়েছিল, যে বার রেশনের চাল-চুরি ধরতে গেলাম। বাড়ি ঘিরে ধরতেই ভূষণ নন্দী বন্দুক বার করে আকাশে গুলি চালাল। আর যায় কোথা, গ্রাম ভেঙে লোক চলে এল। আমরা মেয়েরা ঘরের পুরুষগুলোকে বললাম, তোমরা ওর দোকানে ঢুকলেই পুলিশ তোমাদের তুলবে, আমরা যাব। দোকান ভেঙে সব বার করে এনে চাল-গম বিলিয়ে দিলাম, দু’হাত ভরে ভরে। ভূষণকে বললাম, তবে যে বলো মাল আসেনি, এগুলো কী তবে? তোমার মাঠের ধান-চাল? সারা দিন বিলিয়েও শেষ হয়নিকো। পাশের শহর থেকে কত লোক ক্যামেরা নিয়ে ছুটে এল সে দিন। বিন্তির মা খেতে পায় না, থলে-ঝুড়ি কিছু নেই। দোকানেরই একটা বস্তায় ভরে তার হাতে চাল দিতে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল বুড়ি। সবাই এসে দাঁড়াচ্ছে, আর আমরা চাল দিচ্ছি — বুকের মধ্যে কী জোর, কী আনন্দ! পুলিশ দাঁড়িয়ে রইল, কিছু বলল না। কয়েকটা মেয়েপুলিশও ছিল। তোমাকে কি তাদের মধ্যে দেখেছিলাম সে দিন? তুমি কি দেখছিলে আমায়?
না না, তুমি বোধহয় সেই মেয়ে বিডিও, শহর থেকে এসেছিলে সেই কী যেন দিবসের ফাংশানে। সে বার আমাকে ওরা জোর করে উপপ্রধান করেছিল। আমি ফাইভ পাশ, এসসি, সিট রিজার্ভ, আমাকে নাকি দাঁড়াতেই হবে। ‘ভয় কি বউমা, আমরাই সব করব, তুমি ডাকলে এসো,’ বলেছিল মোহন গড়াই। এক দিন ডেকে নিয়ে গিয়ে তুলে দিল মস্ত মঞ্চে, সেখানে সব শহর থেকে আসা লোকেরা বসে, কাউকে চিনি না। মাইকের কী বলছে, কিছুই বুঝছি না। ভয়ে গা দিয়ে ঘাম ঝরছে। শ্বশুর, বর ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে, আমি কাপড়-ঢাকা চেয়ারে বসে, ও মা গো। আবার মোহন বলে, ‘এখন উপপ্রধান মহাশয়া কল্পনা নাইঞা কিছু বলবেন।’ অ্যাঁ, কল্পনা নাইঞা তো আমার নাম! হাত-পা ছেড়ে আসছে, হঠাৎ দেখি, মহিলা বিডিও আমার দিকে চেয়ে হাসছে। সেই হাসি দেখে কী যে সাহস এল মনে, ঝট করে দাঁড়িয়ে উঠে বললাম, “আমাদের গাঁয়ের লোকের অনেক কিছু বলার আছে, কিন্তু কেউ আমাদের কথা শোনে না।” তারপর মণ্ডলপাড়ার ভাঙা পুকুরঘাটে মুরারীর বউয়ের আছাড় খাওয়া, ছোট ইস্কুলের মাস্টারের কামাই, স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মেয়েদের সঙ্গে ব্যাঙ্কের লোকেদের ঝগড়া, সব বলে দিলাম গড়গড় করে। পুলিশ যে ডায়রি লিখে দিতে ঘুষ চায়, তা-ও কখন বলেছি, জানিই না। এত কথা যে ছিল আমার মধ্যে, আমিই কি জানতাম? ‘ধন্যবাদ, নমস্কার’ বলার পরে দেখি সবাই হাততালি দিচ্ছে, অনেকে দাঁড়িয়ে উঠেছে। আমার ভিতর থেকে তখন যেন হাজার হাজার পাখি ঝটপট করে উড়ে যাচ্ছে আকাশে। পরে বাড়ি এসে সেই বিডিওর মুখ মনে করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সব যেন ঝাপসা তখন। তুমি কি সে?
সেই থেকে গড়াইবাবু আর আমাকে পার্টির মিটিং-এ ডাকেনি। আমার নাকি মুখ পাতলা, মাথার ঠিক নেই। তারপর তো আমাদের পার্টি হেরে গেল, অনেক দিন ঘরছাড়া রইলাম আমরা। ফিরে এসেও মাথা নিচু করে বেঁচে ছিলাম মাগো। যে পতাকা যারা হাতে ধরিয়ে দিয়েছে তা-ই লাগিয়েছি, যে মিছিলে যারা যেতে বলেছে, সে মিছিলেই গিয়েছি। জনসভায় সারা বেলা রোদে তেতে-পুড়ে বসে থেকেছি, হাতে দু’টো টাকা দেয়নি, দু’গাল মুড়ি দেয়নি। তবু আমাদের পাড়ার টিউবকলে ঘোলা জল ওঠে, আমাদের রাস্তায় আলো নেই, সন্ধের পর যেতে-আসতে মেয়েদের গায়ে হাত পড়ে।
এখন আর সইতে পারি না। সে দিন আবার এ পাড়ার মেয়েরা মিটিং করেছি। বলে এসেছি, জব কার্ডে আর সই দেব না। তোরা কাজ দে, নইলে সই পাবি না। বলেছি, ভূতের ধান বেচার টাকা ঢুকতে দেব না আমাদের ব্যাঙ্কে, ভাল চাস তো আমার ধান বিকোতে দে। তোরা যা যা বন্ধ করবি কর, পারিস তো শ্বাস বন্ধ করে দে, আমাদের মুখ বন্ধ করতে তোরা পারবি না। রেখে দে তোদের এই কার্ড, ওই কার্ড, এই কাগজ, ওই কাগজ। তোদের ভিক্ষে আমাদের চাই না। গলা তুলে বলে এসেছি, যে চুরির মাল ভাগ করে দেয়, আর যে নেয়, সব চোর। আমাদের অভিযোগ জমা দিয়ে এসেছি থানায়, বিডিও অফিসে।
সেই থেকে পাইকার আমাদের ধান কিনতে চায় না, পঞ্চায়েত কাজ দিতে চায় না। খেতমজুরি করি, এর-ওর বাড়ি কাজ করি, তা-ও টাকা বাকি রেখে দেয়। আমাদের তৈরি শালপাতার থালা-বাটি নিয়ে গেলে বসতে দিতে চায় না হাটে-বাজারে। টাকার বড় টানাটানি গো মেয়ে। অষ্টমীদি এক একদিন ভাত রেঁধে খাইয়ে যায়, এক এক মাসে বড় মেয়ে কিছু টাকা পাঠায়, তাই এক রকম আছি। ঘরদোর বড় ভেঙে গিয়েছে, মুড়ির টিনে, মোয়ার হাঁড়িতে কত দিন কিছু নেই। তবু আমার বাড়িতে তুমি আজ এলে, হাসলে আমার দিকে চেয়ে। ওই শোনো, সাঁপুইদের বাড়ি থেকে টিভির গান আসছে, ‘জনগণমন...।’ ওমা, তোমার মুখখানা আবার আমার ইস্কুলের দিদিমণিদের মতো লাগছে যে! কী বলছ অষ্টমীদি, আমার মুখের সঙ্গে মিল আছে ওর? মরণ আমার, তোমার চোখদুটো একেবারেই গেছে। না, ঠিক বলেছ, বেশ করে চেয়ে দেখলে মনে হয়, একটু একটু যেন আমার মতো। তুমি কি আমার কেউ? এ বাড়িতেই থাকো তবে, যেও না। যার কিছু নেই, তার কাছে থাকো। — শ্রমজীবী ভাষা, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২২