বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[শিল্প]

[শিল্প]

আধুনিক ভারতীয় চলচ্চিত্রে চিন্তার স্বাধীনতা

শরণ্য বৈদ্য

photo

হীরক রাজার অত্যাচারের কথা শুনতে শুনতে রাজার একশো পেয়াদার একশো জোড়া চোখ এড়িয়ে ক্রমাগত পালিয়ে বেড়ানো উদয়ন পন্ডিতের দুরবস্থা দেখে সহানুভূতির সুরে গুপী-বাঘা বলল “আমরা তোমার ভাল চাই”; শত বিপদের মধ্যেও উদয়ন পন্ডিত সোচ্চারে বলে উঠলেন, “আমার ভাল বড় কথা নয়, দেশের ভাল, দশের ভাল।”
দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছর বয়সে উদয়ন পন্ডিতের কথাগুলো বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। দেশের স্বাধীনতা মানে দশের স্বাধীনতা। দশ মানে এক এক করে প্রতিটি নাগরিকের ধর্ম, লিঙ্গ, সম্প্রদায় নির্বিশেষে, প্রতিটি ব্যক্তির জীবনযাপনের এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা।
প্রশ্নগুলো এখন যথেষ্ট ভাবাচ্ছে। স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবের আড়ালে দেশের বাস্তব অবস্থা কিন্তু সেলুলয়েডের ‘হীরক রাজার দেশে’-র মতো হয়ে উঠছে দিনকে দিন। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে সংবাদ স্বাধীনতার সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৫০-এ। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১১৬টি দেশের মধ্যে ভারাতের স্থান ১০১ (২০২১)। সুইডেনের ভি-ডেম ইন্সটিটিউট ভারতের বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আখ্যা দিয়েছে ‘ইলেক্টোরাল অটোক্রেসি’ অর্থাৎ নির্বাচন প্রক্রিয়ার অনুমোদিত স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এই অসহিষ্ণু আবহে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা। দেশের পাশাপাশি ‘দশ’-এর ধারণাকে ভুলিয়ে দিতেই স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপনে দেশপ্রেমের উগ্র প্রকাশ। কিন্তু এই সাম্প্রতিক কালেও বিক্ষিপ্তভাবে কিছু প্রশ্ন তোলা হচ্ছে বিভিন্ন পরিসরে, স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে মুক্তচিন্তাকে পাথেয় করে চলেছে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা – যাতে সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের কঠোর ও যথাযথ সমালোচনা করা যায়। বলা বাহুল্য, এই সৎ প্রচেষ্টায় পিছিয়ে নেই চলচ্চিত্রও। আজকের ভারতের স্বাধীন চলচ্চিত্র পরিচালকেরা তাঁদের নিজেদের মতো করে স্বতন্ত্র, স্বকীয় চিন্তাকে পরিবেশন করছেন— খুঁজে চলেছেন ব্যক্তি স্বাধীনতার সত্ত্বাকে বিভিন্ন আঙ্গিকে। এই নিবন্ধ আধুনিক ভারতীয় চলচ্চিত্রে, বিশেষত বিগত একদশকের চলচ্চিত্রে স্বাধীন জীবনজাত ভালবাসার স্বর খোঁজার চেষ্টা মাত্র।
স্বাধীন চলচ্চিত্রের স্বরূপ
স্বাধীন চলচ্চিত্রের ধারণাটি ভারতীয় সিনেমায় কিছুটা হলেও নতুন। সত্তরের দশকের প্যারালাল সিনেমা নব্বইয়ের দশকে মুক্ত অর্থনীতির ধাক্কায় দিশেহারা হয়ে পড়ে। মুক্ত অর্থনীতি নব্য ভোগবাদের জন্ম দিয়েছিল। সেই নব্য ভোগবাদের মোহমায়ায় ক্রমশ ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজ নির্মাণের প্রবণতা গড়ে ওঠে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনচর্চ্চায়। ভোগবাদী ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজ ক্রমশ যেন সামাজিক রাজনৈতিক অব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলে। ফলে প্যারালাল সিনেমায় মানুষের যে সংগ্রামী সত্ত্বা ৭০-৮০-র দশক দেখেছিল তাও কোথায় যেন হারিয়ে যায়! আশার কথা, রঙীন বুদবুদের ঘোর পুরোপুরি না কাটলেও সেটা যে তেমন রঙীন নয়, বা আসলে সেটা বুদবুদ মাত্র — এই ঘোর কিছু স্পষ্টচিন্তার মানুষের মধ্যে কাটতে থাকে। ফলে সিনেমায় আবার মানুষের সংগ্রামের কথা ফিরে আসছে— প্যারালাল সিনেমা মুভমেন্ট ফিরে না এলেও এক ঝাঁক তরুণ পরিচালক এসেছেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমা নিয়ে। অনেকেই মনে করেন চলচ্চিত্রের এই নতুন ধারায় ৭০-৮০-র সেই তেজ নাকি আর নেই! আন্দোলনের ধাঁচে তা দেশ ও দশকে আর আলোড়িত করতে পারে না! পাশাপাশি তাঁরা এটা অবশ্য স্বীকার করেন যে ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমা এখনও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতায় অটল। কে না জানে স্বাধীনতা আর প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার সম্পর্ক গভীর!
সামর্থ্য ও সম্ভাবনা– মলায়লম ছবি
এই যে দেশে এক ঝাঁক প্রতিভাবান ছবি-করিয়ে বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে সমাজ ও ব্যক্তিজীবনের সূক্ষ্ম এবং তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়বস্তু নিয়ে ফিল্ম বানাচ্ছেন, এ ব্যাপারে কেরল তথা মালয়ালম ছবি অনেক এগিয়ে। আদুর গোপালকৃষ্ণন, জি. অরবিন্দন ও শাজী নীলকান্তন করুণের দেখানো পথ ধরে বিচিত্র, অভিনব বিষয় নিয়ে ছবি তৈরি করেছেন অনেকে। যেমন জয়ন কে চেরিয়ানের ‘পাপিলিও বুদ্ধ’ (২০১৩) — আম্বেদকরের আদর্শে অনুপ্রাণিত দলিত-বৌদ্ধধর্মের প্রভাব বিষয়ে যত ছবি হয়েছে, তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। লক্ষ্যণীয় বিষয়, দলিত-বৌদ্ধধর্মের প্রসঙ্গ ছবির প্রথমে নাটকীয়ভাবে, অথচ অনেক নীচুস্বরে উত্থাপিত হয়েছে, বিশেষত পরিবেশ রক্ষায় গণ-উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলনে হিন্দুত্ববাদী প্রতিপক্ষকে বড়সড় ধাক্কা দিতে। এই ছবিতে গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলনকে ও একইসঙ্গে দেশের বামপন্থী আন্দোলনের পীঠস্থান কেরলের কমিউনিস্টদেরও ছেড়ে কথা বলেননি পরিচালক। দেখিয়েছেন, কেরলের দীর্ঘ বামপন্থী ঐতিহ্যের আবহে বাস করেও জাতপাত, লিঙ্গ বৈষম্যের বদলে শুধুমাত্র শ্রেণীসংগ্রামের প্রতি কমিউনিস্টদের বিশেষ ঝোঁক। এ ছবিতে বিক্ষোভকারীরা, আরো আশ্চর্য, কেরলের ওয়েনাডে নিজেদের সংঘবদ্ধ করে যে বিরাট দল বানিয়েছেন তাতে দলিত, আদিবাসী, মহিলা এমনকি একজন রূপান্তরকামীও সামিল হয়েছেন, যেন এক ক্ষুদ্র ভারত – দেশের মধ্যে গড়ে ওঠা আরেক দেশ – যেখানে তাঁরা হতে পারেন প্রান্তিক, তবু তাঁদের স্বতন্ত্র স্বর শোনাতে চাইছেন দর্শককে।
জিও বেবি পরিচালিত ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন’ (২০২১) আমার বিবেচনায় আরেকটি অভিনব প্রয়াস। রান্নাঘরে নারীকে অন্তরীণ করে রাখার পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চিরাচরিত কৌশলের প্রতিবাদ এই ছবি। শুধু সমাজ কেন, পরিবার, ধর্ম, কুসংস্কার কিভাবে নারীর স্বাধীন সত্ত্বাকে হরণ করে — এই ছবি তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। লিঙ্গ-অসাম্যের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত এই ছবির প্রোটাগোনিস্ট প্রতিবাদের সাহস পায় শবরীমালা মামলায় আদালতের রায় ঘোষণায় … পুরুষতন্ত্র, পরিবার আর রান্নাঘরের মশলা-আনাজের খোসা আর উচ্ছিষ্টের থেকে মুক্ত হয়ে সে স্বাধীন সত্ত্বা অর্জন করার সাহস পায়।
‘পাপিলিও বুদ্ধ’ ও ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন’ দুটো ভিন্ন সমাজে অন্যায় অসহায়তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের কথা বলে। গত এক দশকে মালয়ালম ভাষায় আরও অনেক অচিরাচরিত বিষয় নিয়ে ছবি তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিককালের বহুচর্চিত ইস্যুগুলোও এই ছবি-করিয়েদের নজর এড়ায়নি। আদিবাসী জমি আইন সংশোধন বিল-এর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ মূর্ত হয়ে ওঠে কে. এম. কামালের অসামান্য ছবি ‘পদ’(২০২২)-তে। সিদ্ধার্থ শিবা-র ছবি ‘ভারতমনম্’ (২০২১)-এর বিষয় সাম্প্রতিক উগ্র দেশপ্রেম এবং ছাত্রসমাজ। দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা কেরলের এক সংখ্যালঘু ছাত্রীকে ‘দেশবিরোধী’ প্রতিপন্ন করার প্রচেষ্টা এবং এর বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই আমাদের মনে করিয়ে দেয় উগ্র জাতীয়তাবাদী ছাত্র সংগঠনকে সামনে রেখে সাম্প্রদায়িক শক্তির ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টির ঘৃণ্য প্রচেষ্টা। ববি সঞ্জয় পরিচালিত ‘উইয়েরে’ (২০১৯) ছবির প্রতিপাদ্য বিষয় এক অ্যাসিড আক্রান্ত কিশোরীর বেঁচে ফেরার সংগ্রাম শুধু নয়, একজন সফল বিমানচালক হওয়ার স্বপ্ননির্মাণও বটে।
সংঘাতের আবহে তৈরি করা এই ছবিগুলো মানুষের স্বাধীন সত্ত্বা ও আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার কথা বলে। ছোট পরিসরে, একক প্রচেষ্ঠায় অন্যায়ের প্রতিবাদের কথা বলে। গণতন্ত্র যাতে ইলেক্টোরাল অটোক্রেসি না হয়ে ওঠে সে বিষয়ে দর্শকদের সচেতন করে।
নারীকন্ঠ : হিন্দী ছবি
কেরলের পরে মুম্বাই তথা হিন্দী ছবির প্রসঙ্গ। পূর্বতন প্যারালাল সিনেমায় নারীর সমস্যা নিয়ে যেসব ছবি তৈরি হয়েছে তার চেয়েও ভিন্ন স্বাদের আরো গভীর, ব্যপ্ত অথচ সূক্ষ্ম বিষয় নিয়ে নারী সমাজ নিজেকে মেলে ধরেছে সাম্প্রতিক চলচ্চিত্রে। হিন্দী ছবি বিষয় নির্বাচনে এবং চিন্তায় অনেক বেশি সাবালক হয়েছে। এখানে লীনা যাদবের ‘পার্চড্’ (২০১৫) এবং অলঙ্কৃতা শ্রীবাস্তবের ‘লিপস্টিক আন্ডার মাই বুরখা’ (২০১৭) ছবি দুটোর কথা বলব। প্রথমটির প্রেক্ষিত আদ্যন্ত গ্রামীণ সমাজ এবং পরেরটির প্রেক্ষিত একান্ত নাগরিক সমাজ। দুটো ছবির প্রেক্ষিত আলাদা হলেও মধ্যযুগীয় চিন্তাধারায় সমাজে অবদমিত নারীর স্বাধীনতা স্পৃহা এবং তার প্রবল বহিঃপ্রকাশ এই দুটো ছবিকে এক সূত্রে বেঁধে দিয়েছে।
‘পার্চড্’ এবং ‘লিপস্টিক আন্ডার মাই বুরখা’ ছবি দুটিই নারী অধিকারের প্রশ্নটি এক সম্মিলিত চেতনার (collective consciousness) আতসকাঁচে বিচার করে। নারী এখানে কোনও একক চরিত্র নয় — একজন নারীর অস্তিত্বের সঙ্কট তুলে ধরাটা পরিচালকের মূল উদ্দেশ্য নয়। ‘লিপস্টিক আন্ডার মাই বুরখা’-য় দেখা যায় কীভাবে নাগরিক সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে উঠে আসা নারীরা তাঁদের সীমিত সামর্থ্যে আপাত তুচ্ছ, অথচ অবদমিত আকাঙ্ক্ষা পূরণের মাধ্যমে স্বাধীনতার স্বাদ পেতে চাইছে। অন্যদিকে ‘পার্চড্’ ছবিটি পশ্চিম ভারতের রুক্ষ মরুপ্রায় গ্রামীণ পরিসরে নারীর দৈনন্দিন যন্ত্রণা আর পরাধীনতার এক নির্মম উপস্থাপনা। নাগরিক সমাজের চেয়ে গ্রামসমাজ আকারে আয়তনে ছোট হওয়ায় শহরের মতো নানাবিধ সমস্যা এক ফ্রেমে ধরা হয়নি এখানে। পুরুষতন্ত্র বা সামন্ততন্ত্র উপড়ে ফেলাও সম্ভব হয় নি। ছবিটি শেষ হয়েছে স্বাধীনতার আনন্দের হাতছানিতে মেয়েদের গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। কিন্তু তার মর্মার্থ জীবন থেকে পলায়ন নয়, বরং জীবনের কঠোর বাস্তবকে স্বীকার করেই তার থেকে উত্তরণের আহ্বান এই ছবি।
এদের বিপরীতে উঠে আসে আরো দুটো ছবি – অশ্বিনী আইয়ার তিওয়ারির ‘নীল বাটে সন্নাটা’ (২০১৬) ও অবিনাশ দাসের ‘আনারকলি অফ আরা’ (২০১৭)। এই দুটিও নারী অধিকারের, তাঁদের আত্মসম্মানের কথা বলে। কিন্তু এই ছবি দুটিতে নারীর চেতনার স্বাধীনতা অনেকটাই একক চেতনার (individual consciousness) প্রকাশ।
‘নীল বাটে সন্নাটা’-র বিষয়বস্তু একজন একাকী মায়ের সঙ্গে তাঁর মেয়ের সম্পর্ক। মা এক বাড়িতে বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করেন। উদয়াস্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে টাকা রোজগারের উদ্দেশ্য মেয়েকে মানুষ করবেন, মেয়ে লেখাপড়া শিখে সসম্মানে মাথা উঁচু করে বাঁচবে। সবচেয়ে বড় কথা তাঁর একটা স্বাধীন নিজস্ব পরিচিতি হবে – এই আশায়। এও এক প্রতীকী লড়াই। আর মেয়েকে লেখাপড়ায় নিবিষ্ট করতে চেয়ে সে নিজেই মেয়ের সঙ্গে পড়তে শুরু করে। কিছুটা স্বপ্নবিলাস হলেও বিশ্বায়নের যুগে আত্মপ্রতিষ্ঠার এও এক বিশিষ্ট প্যাটার্ন।
‘আনারকলি অফ আরা’-র লড়াই কিন্তু প্রতীকী নয়, প্রকৃত সংগ্রাম। অস্ত্বিত্বের জন্য। এ ছবি আবর্তিত হয়েছে একজন নিম্নবর্গীয় প্রান্তিক দুঃস্থ মহিলা শিল্পীকে ঘিরে, যার চটুল গান ও উদ্দাম নাচ দেখানোকে এলাকার শুচিতাপন্থীরা প্রায়শ-ই ধিক্কার দেয় ‘গন্দা গানা’, ‘নাঙ্গা নাচ’— এইসব কটাক্ষে। এরই সঙ্গে যখন যুক্ত হয় যৌন হেনস্থার অপচেষ্টা তখনই শুরু হয় সহায় সম্বলহীন শিল্পীর একাকী লড়াই। তাঁর নামে দেওয়া হয় অপহরণের মিথ্যা অপবাদ। তাঁকে চরিত্রহীন প্রমাণ করতে কোমর বাঁধেন এলাকার স্বঘোষিত সমাজরক্ষকেরা। শিল্পীকে প্রাণভয়ে এলাকা ছাড়তে বাধ্য করা হয়। এরপরই তাঁর ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই শুরু হয়।
দলিত লড়াই – মারাঠি ছবি
স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণে হিন্দি ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই মারাঠি ছবিও। মারাঠি ছবির একটা বড় অংশ বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছে মহারাষ্ট্রের দলিত-ব্রাহ্মণ সম্পর্ককে। বলা বাহুল্য অনেক সময়-ই এই সম্পর্ক সংঘাতের আকার নিয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই মনে পড়ে নাগরাজ মঞ্জুলের ‘ফান্ড্রে’ (২০১৪)। দলিত নিম্নবর্গীয় কিকাড়ি সম্প্রদায়ের মানুষের কথা বলেছে এই ছবি। সেখানকার মানুষের যন্ত্রণা, জীবনের খিদে, প্রেমের আখ্যানে গল্পটি বাঁধা হলেও তথাকথিত দলিত কিকাড়ি সম্প্রদায়ের মানুষজনকে বারবার যেন তাড়া করে বেড়াচ্ছে ভয়। তাঁরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আক্রমণ করছে অপরকে, কোনও এক অদৃশ্য শত্রুর ভয়ে – অনুমান করা শক্ত নয়, এই অদৃশ্য শত্রু ব্রাহ্মণ্যবাদ – তার কাছে পদানত থেকে বাকি জীবন নিশ্চিন্তে নিরাপদে কাটিয়ে দিতে চায় তাঁরা। পরাধীনতা যে কতটা গ্লানিময়, নিজভূমে পরবাসী হয়ে থাকার যন্ত্রণা যে কী মারাত্মক, পঁচাত্তু্রে স্বাধীনতার প্রাক্কালে ‘ফান্ড্রে’ তা আমাদের চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয়।
‘ফান্ড্রে’ ছাড়া-ও দলিত ইস্যুকে কেন্দ্র করে আরো অনেক সূক্ষ্ম অথচ বিচিত্র বিষয় নিয়ে ছবি তৈরি হচ্ছে মারাঠি ভাষায় – যেমন চৈতন্য তামহানের ‘কোর্ট’ (২০১৫)। এক গায়ক তথা সমাজকর্মীকে পথে পথে ঘুরে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী গান গাওয়ার অপরাধে মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। আসলে রাষ্ট্রশক্তি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থাকে চাইলেই কিভাবে কব্জা করতে পারে আর বিচার ব্যবস্থা অসংবেদনশীল হয়ে পড়লে মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেটাই দেখার মতো বিষয় এই ছবিতে।
অরুণোদয় — উত্তর-পূর্বের ছবি
ভারতের মূলস্রোত থেকে উপজাতি অধ্যুষিত উত্তর-পূর্ব ভারতকে সাধারণত ‘বিচ্ছিন্ন’ হিসেবেই দেখা হয়। তথাকথিত মূল ভারতভূমির বাসিন্দারা উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষকে সন্দেহের চোখে দেখেন – সংবিধানবলে তাঁরা বহু অন্যান্য সরকারি সুবিধা পাচ্ছে এই অভিযোগে। উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজনৈতিক বিন্যাসও বড় গোলমেলে। হরেক সুযোগসুবিধা পেলেও উপজাতিদের মধ্যে গোষ্ঠী সংঘর্ষ, মাদক কারবার, বিচ্ছিন্নবাদী আন্দোলন আজও অব্যাহত। স্বাধীন দেশে উপদ্রুত অঞ্ছলে শান্তি ফেরানোর নামে জারি ‘আফস্পা’-র মতো অগণতান্ত্রিক আইনের ফাঁস থেকে আজও মুক্ত হতে পারেনি উত্তর-পূর্ব ভারতের একাধিক রাজ্য।
উত্তর-পূর্ব ভারতের বিষয়ে আমাদের অনেক কিছুই, বিশেষত সেখানকার উপজাতিদের সমাজজীবন, অজানা। স্বাধীন চলচ্চিত্র সে অভাব তার যথাযথ সামর্থ্য দিয়ে পূরণ করেছে। যে অভাবনীয় গতিতে একের পর এক উপজাতি ভাষায় উত্তর-পূর্বের সমাজ রাজনীতি ধরা পড়েছে চলচ্চিত্রে তা এককথায় শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রে অভিনব। উত্তর-পূর্বের ছবিগুলি উন্মোচন করেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ভারতের, মূল ভূখন্ড যার চূড়ান্ত অবমাননা করে এসেছে এতদিন।
শেরদুকপেন ভাষায় সাঙ্গে দোর্জি থোঙডোকের তৈরি ‘ক্রসিং ব্রিজেস্’ (২০১৩) এবং বোড়ো ভাষায় রজনী বসুমাতারির তৈরি ‘জুইলউয়ি- দ্য সিড্’ (২০১৯) ছবি দুটির কথা এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে। ‘ক্রসিং ব্রিজেস্’ উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে মূল ভুখন্ডের সেতুবন্ধন। কাজের সন্ধানে অরুণাচল প্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে – যেখানে সেলফোনের টাওয়ার পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার — মুম্বাই যাওয়া আইটি কর্মীর কাজ হারিয়ে ফিরে আসার কাহিনী। সেইসঙ্গে পাল্টে যাওয়া মানুষজন, ভুলে যাওয়া নিজের শিকড়, নিজের আত্মপরিচিতি, সব কিছু ছেড়েছুড়ে আবার মুম্বাই ফিরে গিয়ে নতুন করে যে কোনও কাজে যোগ দেওয়ার করুণ আর্তি – সব মিলিয়ে কাজ হারানো পরিযায়ী শ্রমিকের যন্ত্রণা ও পাশাপাশি গ্রামজীবনে উপজাতিদের নানা রকম লোকাচারের অনবদ্য সংমিশ্রণ এই ছবি।
উত্তর-পূর্বে মানুষের অস্তিত্বের সংকট আরো তীব্রভাবে ঘনিয়ে এসেছে ‘জুইলউয়ি- দ্য সিড্’ ছবিতে। সেই অস্তিত্বের সংকটের সঙ্গে জুড়ে আছে সন্ত্রাসের ধারণা। আফস্পায় ভুয়ো সংঘর্ষে সেনার গুলিতে নিরীহ নিরপরাধ পথচারীর মৃত্যু কীভাবে তাঁর ছেলেকে বানিয়ে তুলল নির্দয় জঙ্গি তার বিস্তারিত বিবরণ এই ছবি। আফস্পার অপব্যবহারে সাধারণ মানুষের মৃত্যু উত্তর-পূর্বে এমন কিছু নতুন ঘটনা নয়। সম্প্রতি তার বিকট নখদন্তময় প্রকাশ আমরা দেখেছি নাগাল্যান্ডে, নিছক জঙ্গি সন্দেহে সেনার গুলিতে ১৩ জন আম নাগরিকের মৃত্যুতে। কিন্তু এই ছবিতে যা দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে তা আফস্পার থেকেও ভয়ানক। কীভাবে একটা অগণতান্ত্রিক আইন একদিকে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করার অধিকার দেয়। শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে প্রিয়জনকে হারানোর শোক কীভাবে মানুষের মনের গহীন কোনে প্রতিশোধ স্পৃহা উস্কে দেয় – এই ছবিটি তার দৃষ্টান্ত। আফস্পা আস্তে আস্তে এই ছবিতে শুধুমাত্র আইন হিসেবে পরিচিত থাকে না, সে হয়ে ওঠে এক সোশাল এঞ্জিনিয়ারিং-এর চালিকাশক্তি। সাধারণ মানুষকে ক্রমে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন থেকে ঠেলে দেয় সন্ত্রাসবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদের পথে।
প্রশ্নহীনতা — বাংলার ছবি
স্বাধীন চলচ্চিত্র তার সীমিত প্রয়াসে ধীরে ধীরে একটি বিচিত্র বিরাট ইনক্লুসিভ ইন্ডিয়া তুলে ধরার চেষ্টা করছে যখন, সেই ভারতকে দেখতে দেখতে অবাক লাগে বাংলা এখানে কোথায়? গত দশ-পনের বছরে এমন একটাও বাংলা ছবি হয়নি যা সামগ্রিকভাবে ভারতকে নতুন করে চিনতে সাহায্য করবে। বরং ‘আপনারা বাংলা ছবি দেখুন’- মার্কা অনুরোধ আর্জি করেই দায় সেরেছেন অনেকে। রাজনীতিপ্রিয়, সমাজসচেতন বাঙালি সিনেমায় কোনও সংকট মুহূর্ত – ব্যক্তির বা সমষ্টির, দেখাতে পারছে না কেন? এই অবক্ষয়ের পেছনে তিনটি কারণ ব্যাখ্যা করা যায় –
(১) স্বাধীন চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য স্পেশালাইজেশন। নাগরাজ মঞ্জুল দলিত ইস্যু নিয়ে ছবি করেন। আবার লীনা যাদব, অলঙ্কৃতা শ্রীবাস্তবের ছবির বিষয় নারীদের অবস্থান। সাম্প্রতিক বাংলা ছবিতে এই স্পেশালাইজেশন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ঋতুপর্ণ ঘোষের দু-একটি ছবিতে সমকামিতা সংক্রান্ত বিষয় বিক্ষিপ্তভাবে উঠে এসেছে। অপর্ণা সেন নারীদের সামাজিক অবস্থান নিয়ে অনেক ছবি করেছেন; কিন্তু পরবর্তীকালে আমরা তরুণ প্রজন্মের এমন আর কোনও বাঙালি মহিলা পরিচালককে পাইনি যিনি শুধুমাত্র নারীদের জীবনের দৈনন্দিন সূক্ষ্ম সমস্যা নিয়ে ছবি তৈরি করেন। স্পেশালাইজেশনের অভাবে নির্দিষ্ট কোনও বিষয়, স্থানীয় কোনও সমস্যা নিয়ে বাংলা ছবি তৈরি সম্ভব হচ্ছে না। বরং কখনো ইতিহাস, কখনো অ্যাডভেঞ্চার, কখনো বায়োপিক্অথবা ঘরোয়া মান-অভিমান, রাগ-অনুরাগের আবর্তেই ঘুরে যাচ্ছে বাংলা ছবি।
(২) বাংলা ছবি বরাবরই সাহিত্যনির্ভর। সাধারণত কোনও উপন্যাস বা ছোটগল্প থেকে ছবির প্লট গ্রহণ করে এসেছে বাংলা ছবি। খুব কম ছবিই সাহিত্যের নির্ভরতা কাটাতে পেরেছে। ভাল বাংলা গল্প খুঁজতে না পেরে বাংলা ছবি আজ দিশেহারা।
(৩) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, বাংলা সংস্কৃতিতে সেই উনিশ শতকের নবজাগরণের সময় থেকেই উচ্চবর্ণীয় হিন্দুদের প্রবল আধিপত্য। সে ধারা আজও অব্যাহত। এই তথাকথিত ভদ্রলোক-সংস্কৃতি বাংলার রাজনীতি এমন কি কৃষ্টিকেও প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে। দীর্ঘ তিন দশকের বাম জমানাতেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। বামপন্থী কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকেরা মূলত উচ্চবর্ণীয়, তাঁরা শ্রেণীর সমস্যা নিয়ে যেভাবে সোচ্চার হয়েছেন, জাতপাত, জনজাতি, নিম্নবর্গীয় এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সমস্যায় ততোটা সোচ্চার হননি। বাংলার শিল্পসাহিত্যে প্রান্তিক মানুষের যথেষ্ট প্রতিনিধিত্ব না থাকায় তাদের সমস্যা তেমন আলোচনার পরিসর পায় নি। এমন কোনও চলচ্চিত্র পরিচালক উঠে আসেননি যিনি দলিত-আদিবাসী-জনজাতি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করবেন। তাদের স্বতন্ত্র স্বর ছবিতে আনবেন।
সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের যথেষ্ট প্রতিনিধিত্বের অভাবে নতুন নতুন বিষয় উঠে আসছে না বাংলা ছবিতে। আর শুধুমাত্র উচ্চবর্ণীয় উচ্চমধ্যবিত্ত হিন্দুদের একচেটিয়া আধিপত্য খুব স্বাভাবিকভাবেই ছবির বিষয়কে সীমায়িত করে ফেলেছে একটা নির্দিষ্ট ধাঁচে। বহুবর্ণের ভারত আজকের বাংলা ছবিতে অনুপস্থিত।
শেষের কথা
স্বাধীন চলচ্চিত্র প্যারালাল সিনেমার মতো সারা ভারতব্যাপী আন্দোলনের আকারে ছড়িয়ে পড়বে কি না তা সময়ই বলবে। তবে আশা করা যায় ফিল্মে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার স্বাধীন মনন অগণতান্ত্রিকতার ক্রমপ্রসারিত পরিসরের মধ্যেও ব্যক্তিমনের প্রত্যন্ত অনুভূতির কথা বলতে চাইবে। এভাবেই চেতনার স্বাধীনতার প্রকৃত উদযাপন হতে পারে। — শ্রমজীবী ভাষা, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.