বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[শিল্প]
বিশ্বের ক্ষুধার্ত জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ রয়েছে ভারতে। এই সময়ে ২০ কোটির বেশি মানুষ গভীর অপুষ্টিতে ভুগছে কারণ তাদের দৈনন্দিন পুষ্টির চাহিদা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত খাবারের অভাব রয়েছে। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের অর্ধেকের বেশি রক্তাল্পতায় ভোগে। ১৫ থেকে ৫০ বছর বয়সী মহিলাদেরও শতকরা ৫০ ভাগের বেশি রক্তশূন্যতার কারণে অসুস্থ। এদেশে সবুজ বিপ্লবের বয়স ষাটের ঘরে হলেও খাদ্য-রাজনীতি পরিসংখ্যানের এই বাস্তবতাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়ে চলে আজও।
ভারতে সবুজ বিপ্লবের সরকার ঘোষিত লক্ষ্য ছিল দেশের দ্রুত ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাকে খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করা এবং খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে দেশের স্বয়ম্ভরতা। সেই কারণে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে চাওয়া কৃষি বিজ্ঞানীদের প্রধান লক্ষ্য ছিল ধান, গম ইত্যাদিল ফলন বৃদ্ধি করা। যদিও সবুজ বিপ্লবের অংশ হিসেবে উচ্চ-ফলনশীল মনোহাইব্রিড শস্য প্রবর্তন করা হয়েছিল, তবে দেশীয় বীজের প্রধান সমস্যা এটা ছিল না যে তারা উচ্চ ফলনশীল নয়। বরং ব্যবহৃত রাসায়নিক সার গ্রহণে দেশীয় বীজগুলির অন্তর্নিহিত অক্ষমতাই ছিল তাদের সরিয়ে দেবার প্রধান কারণ। বিপরীতে নতুন সঙ্কর বীজের প্রজাতিগুলো বরং তৈরি করাই হয়েছিল রাসায়নিক সার এবং ব্যাপক সেচের সাহায্যে খাদ্যের উচ্চ ফলনের জন্য — ‘মিলে সুর তুমারা হামারা’। সে সময় “আমরা কখনই অপুষ্টি নিয়ে ভাবার মতো অবস্থায় ছিলাম না”, এই হচ্ছে কৃষি-বিজ্ঞানীদের বৃহদাংশের মত। তাই আমাদের দেশ, স্বাধীনতার পর আরো ৩০ বছরের বেশি (১৯৮০) অতিক্রম করেই কেবলমাত্র অপুষ্টি বিষয়ে প্রথম সরকারি প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। তা সত্ত্বেও ১৯৮০-এর দশকের পর, উৎপাদনের লক্ষ্য স্থানান্তরিত হয় শস্যজাতীয় খাদ্যের সেইসব প্রজাতি উদ্ভাবনে যা কীটপতঙ্গ ও রোগ প্রতিরোধী এবং লবণাক্ততা, আর্দ্রতা এবং খরার চাপ সহনশীল। ফসল মাটি থেকে যথাযথভাবে পুষ্টি গ্রহণ করছে কি না তা ভাবার ‘বিলাসিতা’তাঁদের আশির দশকেও ছিল না। তাই, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, আমরা এখন দেখছি, উচ্চফসলশীল প্রজাতিগুলি মাটি থেকে পুষ্টিকর অনুখাদ্য গ্রহণের ক্ষমতা ক্রমে হারিয়ে ফেলেছে।
গত ৫০ বছরে, চালে দস্তা (জিঙ্ক) এবং লোহার (আয়রন) মতো প্রয়োজনীয় পুষ্টির পরিমাণ যথাক্রমে ১৯ শতাংশ এবং ২৭ শতাংশ এবং গমে যথাক্রমে ৩০ শতাংশ এবং ১৯ শতাংশ কমেছে।
পরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে ধান এবং গমের আধুনিক প্রজাতিগুলি যা সবুজ বিপ্লবেরই অবদান, এদেশের মাটিতে থাকা দস্তা এবং লোহার মতো পুষ্টি উপাদানগুলিকে আলাদা করে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে ক্ষমতা হারাচ্ছে।
এখনও কৃষিবিজ্ঞানীরা “ল্যান্ডমার্ক” উচ্চ ফলনশীল ধান এবং গমের যা ১৯৬৭ সালে সবুজ বিপ্লব শুরু হওয়ার পর থেকে পরবর্তী দশকগুলিতে চালু হয়েছিল, তারই বিভিন্ন ধরণের সংখ্যাবৃদ্ধিতে প্রধানত ব্যস্ত।
সম্প্রতি এইসব দানা-শস্যের পুষ্টি-চিত্রের মূল্যায়ন করে দেখা গেছে যে, চাল এবং গম যা ভারতের মানুষের দৈনিক শক্তির চাহিদার ৫০ শতাংশ পূরণ করে, গত ৫০ বছরে তাদের খাদ্যগুণের ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত হারিয়েছে। এই হারে চললে, দানাশস্যগুলি ২০৪০ সালের মধ্যে মানুষের ব্যবহারের জন্য অযোগ্য হয়ে যাবে। কৃষি-বিজ্ঞানীদের বড়ো একটা অংশ এমনটাই আশঙ্কা করছেন ।
সবুজ বিপ্লবের আগে দেশে জন্মানো ঐতিহ্যবাহী ধান এবং গমের প্রজাতি ও জমির বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল। কৃষকদের দ্বারা বাছাইয়ের মাধ্যমে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিকশিত, আঞ্চলিক নানা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এই ফসলগুলি শুধুমাত্র স্থানীয় কৃষিকার্যের জন্য অত্যন্ত উপযোগী ছিল তাই না, এই শস্যে পুষ্টি উপাদানও ছিল যথেষ্ট ।
সবুজ বিপ্লবের দীর্ঘ সময় জুড়ে দেশীয় প্রজাতিগুলির (ল্যান্ডরেসের) সঙ্করায়িত-প্রজননগতি বাড়ানোর কারণে মূল প্রজাতিগুলি প্রজনন প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়তে শুরু করে; শস্যের দ্বারা অধিক পুষ্টি গ্রহণের বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে। দেশ উচ্চ ফলনশীল জাতের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করায় স্থানীয়, বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যগত জিনগুলিও ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছে। তা হারিয়ে গেছে অথবা দৈতাকার কর্পোরেটের অধিনস্ত হয়েছে দেশের কৃষকের হাতে থাকা বীজের পরম্পরাগত উত্তরাধিকার। ইতিমধ্যে, সবুজ বিপ্লবের আগে ব্যবহৃত বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী ধানের প্রজাতিগুলি লুপ্ত হয়ে গেছে এবং স্থানীয় ধানের লভ্য প্রজাতিগুলির সংখ্যা লক্ষাধিক থেকে মাত্র ৭০০০-এ নেমে এসেছে। এবং এই প্রজাতিগুলির সবকটিই যে চাষের অধীনে রয়েছে এমনও নয়। এইভাবে, ভারত ১৯৭০-এর দশকের পর দেশীয় ধানের এক লক্ষেরও বেশি প্রজাতি হারিয়েছে যা বিবর্তিত হতে বেশ কয়েক হাজার বছর লেগেছিল। প্রজাতির এই ক্ষতি প্রধানত ভর্তুকিযুক্ত উচ্চ-ফলনশীল হাইব্রিড শস্য উৎপাদনে মনোযোগ দেওয়া এবং সরকার কর্তৃক মনোকালচারের উপর জোর দেওয়ার কারণেই ঘটেছে। এদেশে জৈব-বৈচিত্র্যের উজ্জ্বল উত্তরাধিকারকে কর্পোরেট সংস্থাগুলির হাতে সমর্পণ করতে সম্প্রতি ঘোষিত হয়েছে বায়োডাইভারসিটি (এমেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট। এই প্রেক্ষিতেই সবুজ বিপ্লবের অন্যতম ক্ষতিকারক দিকটি, ফসলের পুষ্টিহানির বিষয়টি, বিশেষভাবে আলোচ্য হওয়াটা সময়েরই দাবি।
কৃষিব্যবস্থাকেই কর্পোরেট সংস্থার হাতে তুলে দিতে কৃষি আইন তৈরি করেছিল কেন্দ্রিয় সরকার। আন্দোলনের প্রবল চাপে আপাতত তা স্থগিত রয়েছে। অন্যদিকে সবুজ বিপ্লবের পথে হেঁটে আধুনিক প্রজনন কর্মসূচির অধীনে ক্রমাগত জেনেটিক টেম্পারিংয়ের মধ্যে, উদ্ভিদগুলি বিষাক্ত পদার্থের বিরুদ্ধে তাদের প্রাকৃতিক বিবর্তনীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যা লক্ষাধিক বছরের জৈব বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে, শস্যগুলি তাও হারিয়েছে। অর্থাৎ একদিকে মাটি-জল যথেষ্টই দূষিত, অন্যদিকে ধান-গমের মতো প্রধান খাদ্যগুলি খাদ্যগুণ নিঃস্ব ও দূষিত।
একটি উদ্ভিদে, ভাল এবং খারাপ উভয় খনিজ উপাদান একই চ্যানেলের মাধ্যমে শোষিত হয়। তাই উদ্ভিদ শরীরের কান্ডে বিষাক্ত উপাদান পৌঁছানো স্বাভাবিক। বিবর্তনের ধারায় ধান একটি ‘বুদ্ধিমান’ উদ্ভিদ। এটি তার জিনগত বৈশিষ্ট্য ব্যবহার করে মাটির সেই উপাদানগুলিকে বাছাই করে যেগুলি হয় নিজের জন্য বা মানুষের জন্য ভাল নয় এবং উপাদানগুলিকে শস্যদানা পর্যন্ত গাছটি পৌঁছতে দেয় না। উদাহরণস্বরূপ, আর্সেনিক উদ্ভিদের জন্য খুব ক্ষতিকর নয় কিন্তু মানুষের জন্য খুবই ক্ষতিকর। প্রধান শস্যে প্রয়োজনীয় পুষ্টির এধরণের ক্ষয়প্রাপ্তি স্নায়বিক, প্রজনন ও পেশী-তন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত রোগের প্রকোপ বাড়াচ্ছে। পরীক্ষায় আরও দেখা গেছে যে চালে আর্সেনিক, এই বিষাক্ত উপাদানের পরিমাণ বিগত দু’-এক দশকে ১৪৯৩ শতাংশ বেড়েছে। মাটিতে উচ্চ মাত্রায় আর্সেনিক থাকলে ধান গাছ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেই উপাদানটি গ্রহণ করা বন্ধ করে দেয়। অথবা এটি উদ্ভিদের কিছু অব্যবহৃত অংশে, (যেমন কোষগহ্বরে) বিষাক্ত ধাতু জমা করার জন্য অন্য একটি প্রক্রিয়া চালু করে। উদ্ভিদের এই সহজাত প্রক্রিয়াটির এখন অনেকটাই অবনতি ঘটেছে। চালে আর্সেনিকের মাত্রা বৃদ্ধি এই কারণে।
ক্ষতির এই ধরনটি ভারতের জন্য অনন্য নয়। অন্যান্য বেশ কয়েকটি দেশের বিজ্ঞানীরাও উচ্চ ফলনশীল প্রজাতি প্রবর্তনের পর থেকে খাদ্যশস্যে পুষ্টির স্তরে অনুরূপ হ্রাসের কথা জানিয়েছেন। দস্তা, লোহা, তামা এবং ম্যাগনেসিয়ামের ঘনত্ব ১৮৪৫-১৯৬০এর দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত স্থিতিশীল ছিল, কিন্তু তারপর থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে ২০-৩০ শতাংশ যা খর্বকার, উচ্চ-ফলনশীল প্রজাতিগুলির প্রবর্তনের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। তুলনামূলকভাবে, এই সময়কালে মাটিতে মৌলগুলির ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে বা স্থিতিশীল রয়েছে।গত চার দশকে দস্তা এবং লোহার ঘাটতিতে ভুগছে বিশ্ব জনসংখ্যার বড় একটা অংশ। এই বৃদ্ধি সবুজ বিপ্লব-পরবর্তী যুগে প্রচলিত উচ্চ ফলনশীল দানাশস্য চাষের বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণের সঙ্গে মিলে যায়। এবার এই মুদ্রার উল্টো পিঠটা দেখা যাক।
“ব্যর্থ” পাইলট প্রকল্প এবং বিশেষজ্ঞ, সরকারি কর্মকর্তা, ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া (এফএসএসএআই) এবং নীতি আয়োগের একাধিক সতর্কতা সত্ত্বেও দেশের বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার খাদ্য নিরাপত্তা আইনের অধীনে ফর্টিফায়েড চাল তৈরি ও বিতরণের ব্যবস্থা করেছে।
আইসিএমআর, ভারতের প্রধান চিকিৎসা গবেষণা সংস্থা, এই চালের কার্যকারিতা সম্পর্কে গুরুতর সন্দেহ প্রকাশ করেছে। নীতি আয়োগ-এর ন্যাশনাল টেকনিক্যাল বোর্ড অন নিউট্রিশনের সদস্য অনুরা কুরপ্যাড় লোহা-ফর্টিফায়েড চাল শিশুদের মধ্যে রক্ত-সিরামে ডায়াবেটিসের মাত্রা বৃদ্ধি করছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। নরেন্দ্র মোদির সরকার ৮০ কোটি উপভোক্তার স্বাস্থ্যের উপর লোহা ও ভিটামিন যুক্তকরা চালের ক্ষতিকর প্রভাবগুলি নিরূপণ না করেই গণবন্টন ব্যবস্থার (পিডিএস) অধীনে এই চাল চালু করেছে। নির্ধারিত মাইক্রো-নিউট্রিয়েন্ট সমৃদ্ধ ফোর্টিফায়েড চাল সরবরাহের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তাড়া এবং বিদেশি সংস্থা রয়্যাল ডিএসএমের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক সন্দেহজনক। দেশে ফর্টিফায়েড চাল বিতরণের জন্য একটি বড় চুক্তি পেয়েছে রয়্যাল ডিএসএম। সবুজ বিপ্লব সাপ হয়ে কামড়ালো আর ফর্টিফায়েড চাল এলো ওঝা হয়ে ঝাড়তে। পরন্তু এই ওঝা আবার সর্ষের (চালের) মধ্যেই ভূত।