বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[শিল্প]
স্বাধীনতার ৭৫ বছরের পূর্তির সঙ্গে সঙ্গেই পালিত হচ্ছে তেভাগা কৃষক আন্দোলনের ৭৫তম বার্ষিকী। স্বাধীনতার আগে অবিভক্ত বাংলায় আনুমানিক ৬০ লক্ষ ভাগচাষী তাদের উৎপাদিত ফসলের তিনভাগের দু ভাগ আদায়ের জন্যে জমিদার- জোরদারদের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম শুরু করেছিল সেটাই হল তেভাগা কৃষক আন্দোলন। প্রথম পর্বে ১৯৪৬ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৪৭ সালের মার্চ পর্যন্ত ছ'মাসে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল বর্ধমান ও মুর্শিদাবাদ ব্যতিরেকে বাংলার ২৯টি জেলায়। স্বাধীনতার পরে ১৯৪৮-৪৯ সালে দ্বিতীয় পর্বেও তেভাগার দাবিতে সংগ্রাম হয়েছিল বটে কিন্তু সেই সংগ্রাম সীমাবদ্ধ ছিল পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগণা জেলার দক্ষিণ অংশে কাকদ্বীপ-সুন্দরবনে। অবশ্য তখন ওই সংগ্রামের চরিত্র আর শুধুমাত্র তেভাগা কেন্দ্রিক ছিল না।
প্রথম পর্বের তেভাগা আন্দোলনের কারণ ও পটভূমিতে নানা ধরন ছিল। তবে একথা ঠিক, ব্রিটিশ শাসনে থাকা ভারতের ইতিহাসে শ্রেণী চেতনার আর্দশে উদ্বুদ্ধ এধরনের জঙ্গি কৃষক আন্দোলন আগে কখনো সংগঠিত হয়নি। এখানে মনে রাখা দরকার তেভাগার সংগ্রাম ছিল যর্থাথভাবেই ধর্মনিরপেক্ষ। এই সংগ্রামের প্রধান চালিকাশক্তি ছিল কমিউনিস্ট পার্টি ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভা। তেভাগা কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে সকলেই বুঝতে পারবেন কৃষক আন্দোলনের এই সংগ্রামের স্বকীয়তা যেমন ছিল, তেমনি ছিল স্বত:স্ফূর্ততা। স্বাভাবিকভাবে এই কথা উত্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে এসে পড়বে আরো কিছু জিজ্ঞাসা যেমন, তখন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন ছিল, কৃষকদের মনস্তত্ত্বে কিসের প্রভাব ছিল, এই লড়াইয়ে আদিবাসী ও নারী সমাজের ভূমিকা কি ছিল, কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা কি ছিল ইত্যাদি।
জাতীয় কংগ্রেস জন্মলগ্নের থেকেই নব্য বুর্জোয়া ও জমিদার শ্রেণীর প্রতি দায়বদ্ধ ছিল। তাই তারা তেভাগার সংগ্রামে সামন্তশ্রেণীর জমিদার জোতদারদের সঙ্গে সংঘাত চায়নি, চেয়েছিল মিত্রতা। সেই কারণেই গরীব কৃষকদের সংগ্রামের পাশে দাঁড়ায়নি। বরং বিরোধীতা করেছিল অনেক ক্ষেত্রে। কৃষক-প্রজা পার্টিও একই কারণে ভাগচাষীদের পক্ষে ছিল না। হিন্দু মহাসভা, স্বরাজ পার্টি ও মুসলিম লীগ এরা ধর্মীয় মৌলবাদী আর্দশের প্রতি আনুগত্যের কারণে তারাও ছিল জমিদারদের পক্ষে। তাছাড়া কৃষকের শ্রেণী আন্দোলনকে ভয় পেয়েছিল ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনৈতিক শক্তিরা।
কমিউনিস্ট পার্টির দৃষ্টিতে এই কৃষক আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার কারণ তারা মনে করে শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী রাজনীতির প্রধান মিত্র এবং শক্তি হিসেবে কৃষকদের সংগঠিত করা।
কোন নির্বাচনী লক্ষ্যে তারা কৃষক আন্দোলনে যুক্ত হয়নি। আর সে কারণেই তাঁরা সক্ষম হয়েছিলেন গ্রাম্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে জঙ্গি কৃষক আন্দোলনকে পরিচালনা করতে। এই সংগ্রামের পর্ব শুরুর অনেক আগে কমিউনিস্ট পার্টিই কৃষক সভার মাধ্যমে শ্রেণী রাজনীতিতে কৃষকদের সংগঠিত করার জন্য স্থানীয় বিভিন্ন ইস্যুতে সলতে পাকানোর কাজ শুরু করেছিল। যেমন, কোথাও “খাস জমির দখলের আন্দোলন”, কোথাও আবার “আড়তদারের ঋণ মুকুবের আন্দোলন”, কোথাও “ক্যানেল কর বাতিল করার আন্দোলন”!
জলপাইগুড়িতে ওঁরাও অংশের ভাগচাষীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তেভাগা কৃষক আন্দোলনে মুসলমান জোতদারের বিরুদ্ধে। দিনাজপুরের কালিগঞ্জ,কুশমন্ডি,ইটহার থানা অঞ্চলে ভুজু টুডু্র নেতৃত্বে তীব্র ধনুক বাহিনী তেভাগার লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় উদ্যোগে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, কোন সাঁওতাল মাঝি বা মোড়লের পরোয়া তারা করেনি। কৃষকদের শ্রেণী আন্দোলনের জন্যই ১৯৪৬ সালের আগস্ট সেপ্টেম্বরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা গ্রাম বাংলাকে স্পর্শ করতে পারেনি। সম্পূর্ণত স্বত:স্ফূর্ত এই আন্দোলন না হলেও এই সংগ্রাম কখনই চাপিয়ে দেওয়া সংগ্রাম ছিল না। বরং কৃষক সমাজের পক্ষ থেকে একটা চাপ ছিল লড়াই সংগঠিত করার। ড: সুনিল সেন, ভবানী সেন,অবনী লাহিড়ী, কংসারি হালদার, কৃষ্ণবিনোদ রায়, সুশীল সেন, হেমন্ত ঘোষাল প্রমুখ তৎকালীন নেতাদের মধ্যে এই আন্দোলন শুরু করা ও পরিচালনা করা নিয়ে দ্বিধা ছিল। এই সংগ্রামে ৮০ জন কৃষক শহীদ হন। এর মধ্যে দিনাজপুরেই শহীদের মৃত্যু বরণ করে ৪০ জন। জোতদার, পুলিশের মতো কোনও রাষ্ট্রীয় শক্তিই তাদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। তেভাগার দাবি আদায় করেই ছাড়ে কৃষকরা।
তেভাগা কৃষক আন্দোলনের পরিস্থিতি এমন স্তরে পৌঁছেছিল যে, হিন্দু ও মুসলমান হিসেবে পরিচিত কৃষকরা কংগ্রেস ও মুসলিম লীগকে নিজেদের শত্রু বলেই মনে করতো। এটা সম্ভব হয়েছিল তখনকার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির কারণে ও কমিউনিস্ট পার্টির সময়োপযোগী কর্মসূচির গ্রহণের জন্যে। শুধুমাত্র জাতপাত নয়, অন্ধকারাচ্ছন্ন গ্রাম বাংলার কৃষক সম্প্রদায়ের অর্ধেক অংশ যে মহিলারা তারাও যে ব্যাপক সংখ্যায় তেভাগার লড়াইয়ে মাঠে নেবে ছিলেন তা বাংলা অথবা ভারতের গণআন্দোলনের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না। কৃষক-রমনীরা শত শত বছরের অপমান, লাঞ্ছনা, অত্যাচার ও কালিমার পঙ্ক থেকে এই আন্দোলনে উঠে এসেছিল মহাশক্তিময়ী রূপে।
তেভাগার কৃষক আন্দোলনে সমাজের উপেক্ষিত এইসব মানুষদের তুলনাহীন সাহসিকতা দীপ্ত আর্দশবোধ, সঙ্গবদ্ধ প্রতিরোধের ক্ষমতা ও উন্নততর গণ-সংস্কৃতিক চেতনায় নতুন দীপ্তিতে ভাস্বর হয়ে উঠেছিল। প্রখ্যাত শিল্পী সোমনাথ হোড় মহাশয় তেভাগা আন্দোলনের দিনগুলোতে বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরেছিলেন। তাঁর তেভাগার ডায়রিতে তিনি লিখেছেন, কৃষক সমাজের কাছে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ উভয়েই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। কোনও রকম অর্থ লালসা, গোষ্ঠীগত আনুগত্য বা সাম্প্রদায়িক চেতনা'র ধার ধারেনি তেভাগার লড়াই। দিনাজপুরে রাজবংশী জোতদারদের বিরুদ্ধে রাজবংশীয় কৃষকরা সমস্ত চোখ রাঙানিকে অগ্রাহ্য করেই ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী রূপনারায়ণ রায়কে জয়ী করেছিল। এই আন্দোলন চলাকালীন শাসক ব্রিটিশদের মুখপত্র “দি স্টেটসম্যান” পত্রিকার বিশেষ সংবাদদাতা বিবরণে। লিখেছেন,”বিগত শতকের পর শতক ধরে যে মানুষগুলো মূক ছিল তারা আজ মাঠে ভেঙে এগিয়ে আসছে। তাদের প্রত্যেকের কাঁধে রাইফেলের মতো করে ধরা লাঠি আর মিছিলের সামনে একটি লাল পতাকা -এই ছবি দেখে অনুপ্রাণিত হতে হয়। বাঁশঝাড়ের নিরবতার মধ্যে মুষ্টিবদ্ধ হাত কপালের কাছে তুলে তারা নীচু স্বরে একে অপরকে সম্বোধন করছে “ইনকিলাব কমরেড”, এই শুনে কেমন যেন ভয় ভয় করে।” ১৯৪৭ সালের ৪ঠা জানুয়ারি চিরির বনদোরে (দিনাজপুরে) খেতমজুর সমিরুদ্দীন শেখ ও সাঁওতাল বর্গাদার শিবরাম মাঝি পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার পর থেকে ২৯শে মার্চ পর্যন্ত আবদুল্লাহ রসুল সাহেবের হিসাব মতো ৭৩ জন নারী ও পুরুষ তেভাগা সংগ্রামে শহিদ হয়েছিল। সাহিত্যিক সৌরি ঘটক লিখেছেন,” শুধু যে তারা পুলিশ ও মিলিটারিদের সঙ্গে খন্ডযুদ্ধ করল,বন্দুক কেড়ে নিল,লাঠি হাতে ধান পাহারা দিল, বন্দুকের সামনে বুক পেতে প্রাণ দিল তাই নয়, তাদের সমগ্র অস্তিত্বের চেতনায় ঘটে গেল এক নিঃশব্দ ক্রান্তি। এই সংগ্রামের ফসলেই গণ-সংস্কৃতিতে সংযোজিত হল...
আয় রে ও আয় রেভাই ও ভাই রেভাই বন্ধু চল
যাই রেও রাম রহিমের বাছাও বাঁচা আপন
বাঁচা চলো ধান কাটি আর কাকে ডরি নিজ খামার
নিজে ভরি, কাস্তেটাশানাই রে। এই চাষী হবে জমির
মালিকস্বরাজ হলে শুনি এখন মালিক যত ঘুঘু
শালিকপেশাদারি খুনী আর নেতা বড়ো বড়ো
সব বক্তৃতাতে দড় এখন নিজ হাতে ভাগ্য
গড়ার এসেছে সময় রে। লাল বাঁদরের পোষা
হাতির অত্যাচারে কত এই ভেঙ্গেছে ঘর মরেছে
ভাই মা-বোন লক্ষ শত ঐ কমলাপুর বড়া,
আর কাকদ্বীপ ডোঙ্গাজোড়া এসেছে ডাক চলো না
সবাই সোনা তুলি ঘরে। ও গাঁয়ের যত মা-বোন
আছে, তোমরা থেকো ঘরে ঐ আশবটি আর
কাটারিটা রেখো হাতে করে যেন দালাল বেইমান
যত,পায় শিক্ষা উচিত মতো এই বাংলাদেশের মা-
বোন কতশক্তি হাতে ধরে।
এই স্বাভাবিকতাতেই গণ সংস্কৃতির নানান দিকে তেভাগার আন্দোলনের প্রভাব পড়েছে, যেমন- গল্প, কবিতা,গান, নাটক ও চলচ্চিত্র ইত্যাদিতে। তাই আমরা পেয়েছি কথাকার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে “হারানের নাতজামাই”, ছোটো বকুলপুরের যাত্রী “ এবং আরও কয়েকটি গল্প। নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়ের থেকে”বন্দুক” গল্প। তেভাগার ওপরে সবচেয়ে সফল একাঙ্ক নাটক পেয়েছি অনিল ঘোষের কাছ থেকে, নাম “নয়ানপুর”! সলিল চৌধুরীও এই তেভাগা আন্দোলনের ওপরে লিখলেন ও গাইলেন অনেকগুলো কালজয়ী গান। যেমন, “পৌষালী ধানের পাকা বাসে..”, “কৃষক সেনাদের মুষ্টি তোলো আকাশে...”, “ তোমার বুকে খুনের চিহ্ন খুঁজি এই আঁধারের রাতে...”! বিনয় রায় লিখলেন,”আর কতকাল বল আর কতকাল...”। সমরেশ বসুর গল্প পেলাম “প্রতিরোধ”, মহাশ্বেতা দেবীর “বন্দোবস্তী” উপন্যাস থেকে সৌরি ঘটকের “কমরেড”, শিশির দাসের “শৃঙ্খলিত মৃত্তিকা”, আরও আছে।কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা “দুর্মর”, “দুভিক্ষ”থেকে বিষ্ণু দে'র “মৌভাত”, সলিল চৌধুরীর হাত ধরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে শোনা “হেই সামালো ধান হো/ কাস্তেটা দাও শান হো...”, বা “আয় রে ও আয় রে/ ভাই রে ও ভাই রে...” গান আজও কানে বাজে! কিন্তু সমস্যা হল আজ বিশ্বায়নের আগ্রাসী সংস্কৃতির বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাস আমাদের উত্তর প্রজন্মের সকলকে বিকলাঙ্গ করে তুলেছে। এমনকি বামপন্থাকেও। তাই তরুণ যুবকযুবতীদের কাছে শ্রেণী আন্দোলনের মতাদর্শ প্রচার করতে হবে। বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনে সামিল করে ওই গণসংস্কৃতিতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
গণসংস্কৃতি জন্য সংগ্রাম গণআন্দোলনের থেকে বিছিন্ন নয় বরং গণসংস্কৃতি শ্রেণী সংঘর্ষের হাতিয়ার।