বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[শিল্প]

[শিল্প]

জোরাম : বিভ্রান্ত রাজনীতির সাবলীল সিনেমা-ভাষ্য

শান্তনু চক্রবর্তী

photo

ছবির শুরুতেই শূন্য পর্দা, ভয়েস ওভার-এ কোনও যুবতীর খিলখিল হাসি, আদিবাসী লোকসুরে দু’এক কলি গান শোনা যায়। তারপরেই ‘ফ্রেম ইন’ করে দু’জন নারী-পুরুষ। উচ্ছ্বল, সতেজ, উজ্জ্বল। মেয়েটি গাছের ডাল থেকে টানানো দড়ির ‘ঝুলা’ বা দোলনায় দুলছে। পুরুষটি মাটির উপর থেবড়ে উবু হয়ে বসে মেয়েটিকে দেখছে। তার দু’চোখে গাঢ় হয়ে আছে প্রেম, আদর, মায়া। লোকটি হাসছে। বেসুরো গলায় গানও গাইছে। মেয়েটি হাসতে হাসতেই তার গানের সুর ঠিক করে দিচ্ছে। তার ঝুলন্ত শরীর গাছের অনেক উঁচু ডাল অবধি পৌঁছেই আবার নেমে আসছে মাটিতে বসে থাকা মানুষটির খুব কাছাকাছি। গোটা ফ্রেমটাই যেন খুশিতে দোল খাচ্ছে। পেছনে একটা টিলা পাহাড়, জঙ্গলের আভাস, লালচে ধূসর পাথরের জমিন, ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের কথা মনে করায়। পর্দায় সুপার-ইম্পোজ করা ঠিকানাটাও সে কথাই জানাচ্ছে — ঝিনপিড়ি, ঝাড়খন্ড। সঙ্গে গানের সুর। নারী ও পুরুষটির চুলে দস্তার ক্লিপ, মেয়েটির গা-ভর্তি এথিনিক গয়না, শান্ত প্রকৃতি — সবটা মিলিয়ে একটা কেতাবি আদিবাসী গ্রামীণ জীবনের এক ঝলক শো-কেস। একটু হয়তো সাজানো, স্টাইলাইজড। কিন্তু সেটা সচেতন ভাবেই। কারণ পর্দায় গোড়াতেই আমরা যে দৃশ্যটা দেখেছি সেটা আসলে বাস্তবতা নয় আদর্শ আদিবাসী জীবন-যাপনের গল্প বাস্তব, ফ্যান্টাসি, স্বপ্ন। আদিবাসী মনের অবচেতনে সেই সব স্বপ্নের গোড়ায় সার-জল-নিড়ানি, ভালোবাসা যত্নের ছায়া দেয় বাপ-পিতিমোর কয়েক হাজার বছরের লড়াই আর বেঁচে থাকার ইতিহাস।
এরপরের সিকোয়েন্সেই আমরা দেখি মুম্বাই মহানগরীর একটা কনস্ট্রাকশন সাইট। যন্ত্র সভ্যতার প্রবল বিক্রমে সেখানে একটা বহুতল তৈরি হচ্ছে। উন্নয়নের সেই বিপুল দানবিক উদ্যোগের পেটের ভেতরেই আমরা খুঁজে পাই ঝাড়খণ্ডের সেই দুই আদিবাসী নারী-পুরুষকে। তাদের পোশাক সাজগোজ পাল্টে গেছে। গায়ে উঠে এসেছে নির্মাণ শ্রমিকের মার্কামারা ক্যাটক্যাটে কমলা রঙের ফ্লুরোসেন্ট জ্যাকেট আর মাথায় হলদেটে হেলমেট। দিনের শেষে কাজ ফুরোলে, ওইসব ধরাচুড়ো ঠিকাদারের লোকের টেবিলে জমা করে আসার সময় জানা যায়, ওই আদিবাসী নারী, যার নাম ভান্নো বা বান্নো। সে এখন তিন মাসের একটি শিশু কন্যার মা। বাচ্চাটাকে প্রায় পুঁটুলি বানিয়ে, নিজের পিঠে শক্ত করে বেঁধে নিয়েই সে সারাদিন ভারা বেয়ে, বিপজ্জনক উচ্চতায় চড়ে, আকাশ ছুঁইছুঁই উন্নয়নের যোগানদারির কাজ করে। তার মতো অসংগঠিত ক্ষেত্রের অসংখ্য যুবতী মা শ্রমিককে যেমনটা করতে হয়। করতে হবেই। কারণ সে আর তার স্বামী দাসরু তাদের এই সেই হাজার হাজার বছরের আদিম পুরনো ঝিনপিড়ি গ্রাম ছেড়ে এখন মুম্বাইয়ে পরিযায়ী ঠিকা শ্রমিক। ওই সাইটের ভেতরেই একটা ঘুপচি ঘরে তাদের আড়াই জনের নতুন সংসার সেখানে বাচ্চাটির জন্য শাড়ি দিয়ে একটা দোলনা টানানোরও জায়গা নেই। দম আটকে আসা সেই কামরায়, দাসরু আর বান্নোর শ্রান্তি আর অবসাদ মাখা দাম্পত্যের মধ্যে সাউন্ডট্র্যাকে আচমকা আরেকবার আলতো করে ভেসে আসে পলাশ আর মহুয়ার গন্ধ মাখা সেই আদিবাসী গানের সুর। হঠাৎই যেন ঢুকে পড়ে এক টুকরো ঝাড়খন্ড।
দেবাশিস মাখিজার প্রযোজিত ও পরিচালিত ‘জোরাম’ কিন্তু নিজেদের সমাজ-গ্রাম-ভিটে ছেড়ে আসা পরিযায়ী শ্রমিকের পেটের দায় বনাম নাড়ির টানের আবেগ নাটক নয়। সাইট থেকে ঢালাইয়ের পর ফেলে দেওয়া কাঠ-কুটো কুড়িয়ে এনে তার গায়ে লেগে থাকা পেরেকগুলো ছাড়িয়ে নেওয়ার মতো যত্ন আর ধৈর্য নিয়েই বান্নো আর দাসরু, নতুন জায়গায় তাদের নতুন ঘরকন্না গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেও, তারা ঠিক আর পাঁচটা পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারের মতো নয়। তাদের ভিটে মাটি ছেড়ে আসার পেছনে স্রেফ রুজি-রুটির টান ছিল না। একটা ভয়ানক অতীত ছিল, যার পায় পায়ে রক্তের দাগ, প্রতি নিঃশ্বাসে বারুদের গন্ধ। সেই অতীতের জের টেনেই ছবির পাঁ নম্বর দৃশ্যে বান্নো তাদের ঝুপড়ি-ঘরের মধ্যেই নৃশংস ভাবে খুন হয়ে যায় — আর সেই ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ আততায়ীদের হাত থেকে নিজেকে আর তাদের তিন মাসের শিশু কন্যা জোরামকে বাঁচাতে দাসরু ফেরার হয়। ওদিকে দাসরুকেই তার স্ত্রীর খুনি হিসেবে চিহ্নিত করে মুম্বাই পুলিশ তার পিছু ধাওয়া করে। আর সেই অপারেশনের দায়িত্বে যে পুলিশ অফিসার রত্নাকর, সে গত তিনদিন টানা ডিউটি করছে। দেহে মনে ভীষণ ক্লান্ত রত্নাকর কোনওমতে বাড়ি গিয়ে ঘুমোতে চাইছে অথচ উপরওয়ালার হুকুম, সাংঘাতিক ‘খুনি-অপরাধী প্রাক্তন মাওবাদী’কে পাকড়াও না করে তার ছুটি নেই। আর এখান থেকেই দেবাশিস মাখিজা তাঁর চিত্রনাট্যে একটা খুব অন্যরকম থ্রিলারের প্লট বুনে দেন, যেটা ফ্ল্যাশব্যাক আর ফরওয়ার্ডে বারবার আগুপিছু করতে করতে ক্রমশ সন্তানহারা এক মায়ের ভয়ঙ্কর বদলা বনাম সদ্য মাতৃহারা শিশুকন্যাকে সমস্ত আঘাত আক্রমণ থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এক বাবার সর্বস্ব পণ লড়াইয়ের ন্যারিটিভ হয়ে ওঠে।
কিন্তু ‘জোরাম’ শেষ অবধি এই ব্যক্তিগত যুদ্ধের আখ্যানেই নিয়ে আসে এই সময় স্বদেশ রাজনীতি অর্থনীতির অনেক পরত। ওই যে মা ফুলো কারমা, যার ছেলে বেসরকারি ইস্পাত কোম্পানির দালাল হয়ে আদিবাসীদের জমি দখল করতে গিয়ে মাওবাদীদের হাতে খুন হয়েছিল, তার প্রতিহিংসার গল্পটা তো আর শুধু ব্যক্তিগত থাকে না — সেটা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বা প্রতিশোধেরও কাহিনী হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে সেটা ‘স্থানীয়’ রাজনীতির ‘জাতীয়’ হয়ে ওঠার গল্প। সেখানে আঞ্চলিক দলের নেতৃত্ব, জনজাতি এলাকায় বেসরকারি পুঁজির আগ্রাসনকে নিরুপদ্রব ও সুরক্ষিত করার জন্য কেন্দ্রের শাসক দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ঝাড়খণ্ডের বনাঞ্চলে ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’ চালায়। কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনী, রাজ্যের পুলিশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এলাকার সমস্ত মাওবাদী নিকেশ করে। আর সেইসব এনকাউন্টারের ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করে স্থানীয় বিধায়ক ফুলো কারমা। এভাবেই রাষ্ট্রের ক্ষমতা, পুঁজির অভিসন্ধি সঙ্গে আর ব্যক্তিগত ভেনডেটা-র এক বিন্দুতে একাকার হয়ে যায়। উল্টোদিকে যে দাসরুকে রাষ্ট্রের পুলিশ আর ফুলো কারমার প্রতিশোধের আগুন হন্যে হয়ে খুঁজছে, ছ’ বছরের অজ্ঞাতবাসের পর মেয়েকে নিয়ে সে নিজেই ঝাড়খন্ডে ফিরে আসে। এখানে তার ব্যক্তিগত শোক-বিপন্নতা যেন গোটা আদিবাসী জনগোষ্ঠী, কৌম সমাজের অস্তিত্বের সংকট হয়ে ওঠে। উন্নয়নের নামে সেখানে তার জল জঙ্গল জমি অধিকার ছিনতাই হয়ে গেছে। তার ক্ষেতের উর্বরতা নষ্ট হয়ে গেছে। সেই মাটি আজ আর ফসল দেয় না। ইস্পাত কোম্পানির জন্য শুধু লৌহ- আকরিক সরবরাহ করে।
দাসরুর ভূমিকায় মনোজ বাজপেয়ীর আশ্চর্য পরিমিত সংবেদনশীল অভিনয় যেন সেই ঘনিয়ে আসা সংকটকে মানবিক মুখ, অভিব্যক্তি আর অনুভব দেয়। নিজের স্বভূমি শিকড়ে ফিরে আসার পথে তিনি যখন স্বগতোক্তির মতো বলেন, "এই জায়গাটায় আগে অনেক গাছ ছিল — এখান দিয়ে একটা নদীও বইতো, নিশ্চয়ই সরকার কোথাও বাঁধ বানিয়ে নদীর মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে" — তখন সেটা নিছক পরিবেশ রাজনীতির বয়ান থাকে না, ধ্বস্ত সভ্যতার দীর্ঘশ্বাস হয়ে ওঠে। আবার তিনি যখন একটা চৌরাস্তার মোড়ে, গোলচক্করের বেদীতে বসে, কোলের শিশুটিকে মাটির ভাঁড়ে দুধ খাওয়ান আর তাঁর মাথার পেছনে প্রাচীন শিলালিপির মতোই মস্ত একটা পাথরের গায়ে রঙিন হরফে সংবিধানের মৌলিক অধিকারগুলি লেখা থাকে — তখন তিনি যেন আজকের ভারতেরই প্রতীক — যে স্বদেশ তাঁর মতোই সন্ত্রস্ত, দিশাহীন-- কোথায়, কোন দিকে গেলে মুক্তি বা আশ্রয় জানা নেই। ‘জোরাম’ এই বিভ্রান্ত রাজনীতিই সাবলীল সিনেমা-ভাষ্য। তবে একটু খটকা থেকে যাচ্ছে। ছবির একটা সংলাপে দাসরু বলেছিল সে নিজের গ্রাম থেকে নয় বন্দুকের রাজনীতি থেকে পালাতে চেয়েছিল। ছবির ক্লাইম্যাক্সে তাঁর হাতে আবার বন্দুকই উঠে আসে। পরিচালক কি তাহলে বলতে চাইলেন, প্রান্তিক মানুষের ক্ষমতার উৎস তবে বন্দুকের নল? ছবিটা এতক্ষণ যে বার্তা দিতে চাইল, এমন কি জনজাতি মানুষের গণপ্রতিরোধের এক ঝলক দৃশ্য সমেত, ক্লাইমেক্সের শেষে এই হিংসা-হননে তার স্ববিরোধ থেকে গেল।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.