বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[শিল্প]

[শিল্প]

হাসান আজিজুল হক: জীবন ও সাহিত্য

কমল কুমার দাশ

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ ডিসেম্বর, ২০২১— বাংলাদেশের অন্যতম সেরা কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক গত ১৫ নভেম্বর না ফেরার দেশে চলে গেছেন। সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যে তিনি একটি গৌরবময় স্থান অধিকার করে আছেন। দেশভাগ, মন্বন্তরের প্রেক্ষিতে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের জীবন সংগ্রামের কথা নিপুণভাবে তুলে এনেছিলেন তাঁর কথাশিল্পে। সুঠাম এবং মর্মস্পর্শী বর্ণানায় হাসান সাহিত্যে এঁকেছেন জীবনের সংবেদ। এক রহস্যময় জগত সৃষ্টি করে পাঠককে মুগ্ধ রাখতে সক্ষম হন। আদায় করে নেন সমীহ।
ওপার বাংলায় জীবনের বেশির ভাগ সময় অতিবাহিত করলেও তিনি জন্মেছিলেন এপার বাংলায়। ১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বর্ধমান জেলার যবগ্রামে তাঁর জন্ম। মাধ্যমিক শিক্ষাজীবন পর্যন্ত (১৯৫৪) তিনি সেখানে থাকেন। এরপর তিনি তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের খুলনা জেলার দৌলতপুরে চলে যান। জন্মভূমির সঙ্গে বিচ্ছেদ ও পরিবর্তিত রাষ্ট্রভূমির সঙ্গে খাপ-খাওয়ানোর ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা তাঁর ব্যক্তিমানসকে স্বতন্ত্রভাবে গড়ে তুলেছে। ১৯৬০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর পাশ করেন। পরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন। ছাত্রাবস্থায় তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন।সক্রিয় রাজনীতি করার অপরাধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে তিনি জঘন্যভাবে নিগৃহীত হন। ছাত্রজীবনে তিনি সমাজবাদী ছাত্রসংগঠন ‘ছাত্র ইউনিয়নে’র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৭ সালে ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপ-এর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। সেই থেকে মৃত্যুর আগের মহূর্ত পর্যন্ত তিনি ব্যক্তি ও লেখক হিসেবে সামাজিক দায়বদ্ধতার নানান স্বাক্ষর রেখে গেছেন। ১৯৬৮ সালের ২০ ও ২১ অক্টোবর ‘আফ্রো-এশীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি’ অনুষ্ঠানে হাসান আজিজুল হক ‘আফ্রিকা-এশীয়ার গণমুখী সাহিত্যের ভূমিকা’ শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন। এই প্রবন্ধে তিনি বলেন লেখকদের একমাত্র সাধনা শোষণমুক্তির সাধনা।
কলেজ জীবন থেকেই তাঁর লেখালেখির শুরু। রাজশাহী কলেজে হাসানের সহপাঠী ছিলেন মিসবাউল আজীম। তাঁর উদ্যোগে প্রকাশিত হতো ভাঁজ পত্র "চারপাতা"। এই পত্রিকাতেই হাসানের প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়। রাজশাহীর আমের মাহত্ম্য নিয়ে তিনি একটি অনবদ্য লেখা লেখেন এই পত্রিকায়। এরপর সিকন্দর আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় ১৯৬০ সালে ‘শকুন’ গল্পটি প্রকাশিত হয়। এটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্প। এই গল্পে সুদখোর মহাজনের অর্থ পিশাচ চরিত্রটি চমৎকারভাবে তুলে এনেছেন।তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ সমুদ্রের স্বপ্ন, শীতের অরণ্য প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে। এখানেই শকুন গল্পটি অন্তর্ভুক্ত হয়। এই গল্পে তিনি লিখেছেন: ‘ছেলেদের কথায় শকুনটাকে দেখে তাদের রাগ লাগে, … সুদখোর মহাজনের কথা মনে হয় ওকে দেখলেই। নইলে মহাজনকে লোকে শকুন বলে কেন।’ এই সংক্ষিপ্ত অথচ সারগর্ভ বক্তব্যের মধ্যে লেখকের জীবনদৃষ্টির গুরুত্বপূর্ণ দিকটি উদ্ভাসিত হয়েছে, যা তার আর্থসামাজিক অভিজ্ঞানের দ্যোতক। এই ধারণা আরো দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা হয়, যখন লেখক বলেন, ‘কিন্তু শকুন শকুনের মাংস খায় না।’ এইভাবে তিনি সমাজের তলদেশকে উন্মোচিত করেছেন।শকুন গল্পটি প্রকাশের আগেই ১৯৫৬ সালে নাসিরউদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত ‘মুকুল’ পত্রিকায় তার ‘মাটি ও পাহাড়’ শীর্ষক একটি গল্প প্রকাশিত হয়েছিল। সাহিত্যচর্চার প্রথম দিকে হাসান আজিজুল হক কয়েকটি কবিতা রচনা করেছিলেন। বিনতা রায়: আমি, নিরর্থক, গ্রামে এলাম, দিনাবসান, কথা থাক, রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতি তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য । ১৯৬০ সালে ‘পূর্বমেঘ’ পত্রিকায় ‘একজন চরিত্রহীনের স্বপক্ষে’ গল্পটি প্রকাশিত হওয়ার পরই তিনি একজন স্বতন্ত্র গল্পকার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। বিষয়, চরিত্র ও নির্মাণ কুশলতায় হাসান আজিজুল হক অনেক উল্লেখযোগ্য গল্প রচনা করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগুলি হল তৃষ্ণা, উত্তরবসন্তে, বিমর্ষ রাত্রি, প্রথম প্রহর, পরবাসী, আমৃত্যু, আজীবন, জীবন ঘষে আগুন, খাঁচা, ভূষণের একদিন, ফেরা, মন তার শঙ্খিনী, মাটির তলার মাটি, শোণিত সেতু, ঘরগেরস্থি, সরল হিংসা, খনন, সমুখে শান্তির পারাবার, অচিন পাখি, মা-মেয়ের সংসার, বিধবাদের কথা, সারা দুপুর ও কেউ আসেনি।
হাসান আজিজুল হকের গুণমুগ্ধ পাঠকের আপসোস ছিল যে তিনি রসোত্তীর্ণ অসংখ্য ছোটগল্প লিখলেও খুব বেশি উপন্যাস লেখেননি। পাঠকের সেই দুঃখ দূর করে অবশেষে ২০০৬ সালে হাসান লেখেন আগুন পাখি। উপন্যাসের মূল উপজীব্য দেশভাগ। সাধারণভাবে দেশভাগ নিয়ে আমরা যে সমস্ত গল্প-উপন্যাস পড়ি তাতে বাংলাদেশ থেকে বাস্তুচ্যুত ছিন্নমূল হিন্দু বাঙালিদের জীবন যন্ত্রণার কথা বেশি করে পাই। এখানে হাসান তুলে এনেছেন এপার বাংলা থেকে ওপার বাংলায় চলে যেতে বাধ্য হওয়া একটি মুসলমান পরিবারের বাস্তু হারানোর হাহাকার। গল্পটির প্রেক্ষাপট আছে ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার করুণ কাহিনি। গল্পটি উত্তম পুরুষে লেখা। গল্পের কথক একজন গ্রাম্য বধূ। তার চোখ দিয়ে আমরা দেশভাগকে দেখি। স্বাধীনতা একদিকে যেমন আমাদের কাছে আনন্দের বার্তা বয়ে আনে, তেমনি যন্ত্রণারও জন্ম দেয়। দীর্ঘদিনের সম্প্রীতি-সহাবস্থানের ইতিহাস ভুলে হিন্দু-মুসলমান পরস্পরের প্রতি অস্ত্র তুলে ধরে। নিদারুণ দুঃখে কথক প্রত্যক্ষ করেন তার প্রতিবেশী হিন্দু-মুসলমানেরা, যারা এতদিন পরস্পরের পাশে দাঁড়িয়েছে সবসময়, হয়েছে সুখ-দুঃখের সঙ্গী, তারাই কীভাবে রামদা, ছুরি নিয়ে লিপ্ত হচ্ছে মারামারিতে। নুয়ে পড়ে ভ্রাতৃত্বের কেতন, জয় হয় সাম্প্রদায়িকতার। দু'টুকরো হয়ে যায় ভারতভূমি। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র বলে: "একই দ্যাশ, একই রকম মানুষ, একই রকম কথা, শুধু ধম্মো আলাদা, সেই লেগে একটি দ্যাশ একটানা যেতে যেতে একটো জায়গা থেকে আলেদা আর একটো দ্যাশ হয়ে গেল, ই কি কুনোদিন হয়? এক লাগোয়া মাটি, ইদিকে একটা আমগাছ, উদিকেও তেমন একটা আমগাছ, একটি তালগাছ। তারা দুটো আলেদা দ্যাশের হয়ে গেল!"
উপন্যাসের শেষে পরিবারের সবাই চলে যেতে চান পাকিস্তানে। কিন্তু গল্প কথক কিছুতেই শ্বশুর বাড়ির ভিটে ছেড়ে অন্য দেশে যেতে রাজি হয় না। তিনি থেকে যেতে চান শ্বশুরবাড়ির ভিটেতেই। স্বামীর চোখ রাঙানি, পুত্র-কন্যার কাতর আবেদন কিছুই তাকে নিরস্ত করতে পারে না। সে বলে, "আমি কি ঠিক করলাম? আমি কি ঠিক বোঝলাম? সোয়ামির কথা শোনলম না, ছেলের কথা শোনলম না, মেয়ের কথা শোনলম না। ... শ্যাষে একটি কথা মনে হলো, আমি আমাকে পাবার লেগেই এত কিছু ছেড়েছি।আমি আর আমার সোয়ামি তো একটি মানুষ নয়, আলেদা মানুষ। খুবই আপন মানুষ, জানের মানুষ, কিন্তুক আলেদা মানুষ।” দেশভাগের ভ্রান্ত রাজনীতির বিরুদ্ধে নিজের অজান্তেই প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন সে। এই প্রতিবাদ কেবলই নিজের জন্য, আপন অস্তিত্বের জন্যে। এভাবেই একটি পরিবারের উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে লেখক আঁকেন গোটা সমাজের উত্থান-পতনের চিত্র।
শুধু মানুষ নয়, রাঢ় অঞ্চলের রুক্ষ প্রকৃতিও তাঁর লেখায় বিশিষ্ট জায়গা জুড়ে আছে। তাঁর কাছে প্রকৃতি কোনও পেলবতার আবেশ নিয়ে হাজির হয়নি কখনো। বরং প্রকৃতির ভয়ংকর চোখ রাঙানির মধ্যে মানুষের জীবন সংগ্রামকে তিনি দেখেছেন নির্মোহ দৃষ্টিতে। প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে লেখক বলেছেন: “কোনও লেখায় খানিকটা প্রকৃতি বর্ণনাকালে এক সময় আমার মনে হতো লেখকের মনে বেশ খানিকটা দয়ামায়া আছে। কিন্তু উত্তরাঞ্চলের এই এলাকায় প্রকৃতির দিকে চেয়ে আমার রক্ত শুকিয়ে ওঠার উপক্রম। এক হাত দূরে ছোরা হাতে ভয়ানক আততায়ীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেও যেন এমনভাবে আগাগোড়া শিউরে উঠতে হয় না। চারদিকে খোলা, বিবর্ণ, ধুলোটে। শুকনো মাটিতে এক ফোঁটা রস নেই, ঘাস পুড়ে প্রায় ছাই হয়ে গেছে।"
হাসান একজন উদ্বাস্তু বাঙালি মুসলমান। পশ্চিমবাংলার গ্রামে তাঁর বাল্য কৈশোর কেটেছে। এরপর তিনি থেকেছেন পূর্ববাংলার মফঃস্বল শহরে। এই সুবাদে দুটো স্পষ্ট রকমের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়েছেন তিনি। প্রথমত, রাঢ়-অঞ্চলের বিত্তহীন মানুষের জীবনযাপন সম্পর্কে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। দ্বিতীয়ত, ভারতবিভাগকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের অস্বস্তিকর জটিলতা। পরবর্তী জীবনে এই অভিজ্ঞতাগুলো তাঁর অর্জিত জ্ঞানের সংস্পর্শে আরও সংহত এবং শাণিত হয়েছে। ফলে তাঁর উপজীব্য রচনার লক্ষ্য কেবল শিল্পসৃজনে সীমাবদ্ধ থাকেনি, সেটা সামাজিক দায়বদ্ধতাকেও সমান মূল্য দান করেছে। ১৯৮১ সালের ১৬ জানুয়ারি কুষ্টিয়ায় প্রদত্ত এক ভাষণে হাসান আজিজুল হক বলেন: ‘আমি যাদের কথা বলতে চাই তারা হচ্ছে আমাদের দেশের শতকরা ৯৫ ভাগ। আমার রাজনৈতিক বিশ্বাসটা তাহলে কী? এই ৯৫ ভাগ মানুষকে মুক্ত করতে হবে। আমার রাগের কারণ কী? এই ৯৫ ভাগ মানুষের প্রতিভা ও কর্মশক্তির কোনও বিকাশ নেই এই সমাজে। ৯৫ ভাগ মানুষ এদেশে চাপা পড়ে আছে। এত বড় অন্যায় ও অমানবিকতা একজন লেখক যদি অনুধাবন করতে না পারেন তবে তিনি কিসের লেখক?’
৯৫ শতাংশ মানুষের মুক্তির সংকল্প নিয়ে হাসান আজিজুল হক কলম ধরেছিলেন। তাই তাঁর প্রতিটি লেখা হয়ে উঠেছে শৃঙ্খলিত মানুষের শৃঙ্খল মুক্তির কথকতা।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.