বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[শিল্প]

[শিল্প]

শাঁওলী মিত্র: স্মরণ

দেবাশিস রায়চৌধুরী

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২— ‘… আবৃত্তি শিখতে গিয়েও শুনেছি—মানুষের অন্তরের কথা প্রকাশ করতে তো সংকোচ বোধহয়, তাই সে আড়াল করে। অনেক কথা সে মিথ্যে দিয়ে ঢাকে। যেসব গভীর কথাকে সে মিথ্যে দিয়ে ঢাকে সেই ধরনের কথা উচ্চারণ করতে গেলে সে সত্য উচ্চারণ করতে পারে না, সংকোচ বোধ করে সেইসব অনুভব প্রকাশ করতে, আড়াল করতে চায়—আর তাই সেইসব গভীর কথা কৃত্রিম হয়ে যায়। অথচ অভিনয় শিল্প তো সত্যকে প্রকাশ করবার জন্যে। ...
... আমার বোধহয় আমার গড়ে তোলা স্বর ও শরীর দিয়ে আমি প্রকাশ করবার চেষ্টা করি জীবনকে, জীবনের সত্যকে। মঞ্চে’।
কথাগুলি শাঁওলী মিত্রের।
১৬ জানুয়ারি, ২০২২ (রবিবার) বিকেল ৩-৪০ মিনিটে তাঁর জীবনাবসান হল। গত দু-এক বছর নিউমোনিয়ায়  কষ্ট পাচ্ছিলেন, কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি হতে চান নি। তাঁর ইচ্ছাপত্র অনুযায়ী, ‘সামান্য ভাবে সাধারণের অগোচরে’ তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হল, হল ভারতীয় থিয়েটারের এক মহান শিল্পীর সমাপতন। 
বহুরূপীতে তাঁর ছোট্ট বয়সে অভিনয় শুরু হলেও, তিনি তৃপ্তি মিত্রর নির্দেশনায় একাধিক নাটকে অভিনয় করেছিলেন। শম্ভু মিত্রর নির্দেশনায় একটি নাটকেই অভিনয় করেন, বাদল সরকারের ‘পাগলা ঘোড়া’ (১৯৭১)। শম্ভু মিত্রর নির্দেশনায় অন্যান্য নাটকে অভিনয় করলেও সেগুলি সব ছিল চলতি প্রযোজনা। ‘পাগলা ঘোড়া’ নাটকে শাঁওলীর অভিনীত চরিত্রের নাম—‘মেয়েটা’। খুবই প্রশংসিত হয়েছিল তাঁর অভিনয়। আনন্দবাজার পত্রিকা (১২/৩/১৯৭১) লিখেছিলেন—নাটকের অন্যস্তরে অপূর্ব অভিনয় করেছেন শাঁওলী মিত্র— অচরিতার্থ বাসনার প্রতিরূপা যিনি একটি করুণ গানের কলি মাঝে মাঝে গেয়েছেন আর কখন যেন নিজেই হয়ে গিয়েছেন সেই সঙ্গীত। অনবদ্য তাঁর কন্ঠস্বর-যা মনে করিয়ে দেয় শ্রী শম্ভু মিত্রকে কখনও শ্রীমতী তৃপ্তিকে। এ নাটকের মহলায় একটি বিশেষ অংশে শম্ভু মিত্র, শাঁওলীর কাছে চাইছিলেন, তাঁর অভিনীত চরিত্র ‘মেয়েটা’-র কাছে একেবারে ক্ষেপে যাওয়ার মতো কোনও ভঙ্গি। অভিনয়ের দিন এসে গেল, কিন্তু কী যে করা হবে তা স্থির হল না। প্রথম অভিনয়ের বিষয়ে শাঁওলীদি লিখেছেন—ঢুকে পড়ে কথা বলতে বলতে তার কী হল, সে হাসতে থাকল,আর তারপর ঘুরতে লাগলো পাগলেরই মতো। প্রাণের দায়ে কিছু তো বার না করে উপায় নেই। তাই সে ‘পাগলা ঘোড়া ক্ষেপেছে/ বন্দুক ছুঁড়ে মেরেছে…’ ইত্যাদি বলে ঘুরতে শুরু করল এবং তারপরে আর্ত চিৎকারে ‘না! পাগলা ঘোড়া আসেনি, বন্দুক ছুঁড়ে মারেনি--!’ বলে ছুটে বেরিয়ে আসা। শম্ভু মিত্র তখন বাইরে দিককার সাজঘরের ছোট চৌকিটাতে চুপ করে শুয়েছিলেন। সারা নাটক জুড়ে দর্শকের প্রতিক্রিয়া খুব ভালো ছিল। ওই অংশটি এতই প্রশংসা পেল যে শেষাবধি ঐরকমই রয়ে গেল অভিনয়টা। এই তাঁর শম্ভু মিত্রর কাছে কাজ করবার প্রথম সুযোগ। একরকম শেষও বটে।
শাঁওলীদি লিখেছেন—বাবা তো থিয়েটার করতেন। খুব উঁচু মাপের ভালো-ভালো নাটকের মহলা চলত আমাদের বাইরের ঘরটিতে। ওইটিই ছিল তাঁদের নাট্যদল ‘বহুরূপী’র মহলা কক্ষ। বিকেল হতে না হতে সেখানে বহু লোকের আগমন। নাটকের মহলার সঙ্গে সঙ্গে গান আবৃত্তি—এসবেরও চর্চা হত। তাই আনমনে খেলা করতে করতে আমি শুনতে পেয়েছি—মরুবিজয়ের কেতন উড়াও হে শূণ্যে…, জয় হোক জয় হোক নব অরুণোদয় জয় হোক…, আজি প্রাতে সূর্য ওঠা সফল কার…, এইসব গান।…
পড়তে শেখার পরে তো বই-পড়ার বিরাম নেই। শরৎবাবুর সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’-র প্রথম খণ্ড  শেষ। আর ‘সহজ পাঠ’ ? রসে টইটম্বুর একেবারে। কী ভালো যে লাগত পড়তে।…
এরই মধ্যে মা একদিন ‘ডাকঘর’ নাটকটি পড়তে দিলে। বললে,--নাটকটা পড়ো। তোমায় অমল-এর পার্টটা  করতে হবে। এর বছর দেড়েক আগে ‘রক্তকরবী’ নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। কাজে-কাজেই মহলা শুনতে শুনতেই সে-নাটকটা মুখস্থও হয়ে গিয়েছে। বাচ্চাদের তো খুব তাড়াতাড়ি মুখস্থ হয়। 
একেবারে শিশুবেলা থেকেই তাঁর নাটকের সঙ্গে আত্মীয়তা, সেইসঙ্গে গান, আবৃত্তি। তাই তো আমরা ‘পাগলা ঘোড়া ‘নাটকে তাঁর মুখে গানও শুনেছি। বহুরূপীর ‘ছেঁড়াতার’ (১৯৫০) নাটকে ফুলজানের ছোট্টছেলে ‘বসির’-এর চরিত্রে শাঁওলীদির প্রথম মঞ্চে অভিনয় শুরু, নির্দেশক ছিলেন শম্ভু মিত্র। এ নাটকে ‘বসির’-এর তেমন কোনও ভূমিকা ছিল না। পরের নাটক রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ (১৯৫৭), তৃপ্তি মিত্রর নির্দেশনায় ‘অমল’-এর ভূমিকায়। শাঁওলীদি অভিনীত বহুরূপী প্রযোজিত তৃপ্তি মিত্র নির্দেশিত অন্যান্য নাটকগুলি হল—‘টেরোড্যাক্টিল’ (১৯৭২) [ইন্দ্র উপাধ্যায়]/ মীনা, ‘গণ্ডার’ (১৯৭২) [ইউজিন ইয়ানেস্কো/ বাংলা রূপান্তর: শাঁওলী মিত্র]/ দেইজি, ‘ঘরে বাইরে’ (১৯৭৪) [রবীন্দ্রনাথ, নাট্যরূপ তৃপ্তি মিত্র]/ বিমলা, ‘যদি আর একবার’ (১৯৭৬) [বাদল সরকার]/ বনলতা রায়, ‘পাখি’ (১৯৭৭) [মনোজ মিত্র]/ শ্যামা। কুমার রায় নির্দেশিত নাটক ‘গীতরত্ন’ [চিত্তরঞ্জন ঘোষ]/ শ্রীমতী। বাদল সরকারের আর একটি নাটক ‘ত্রিংশ শতাব্দী’(১৯৬৯) হিমাংশু চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় তিনি অভিনয় করেছিলেন মিসেস ইথারলী-র চরিত্রে। আলবেয়ার কাম্যু-র আর একটি নাটক ‘ওরা’ (১৯৭৮) [অনুবাদ ও নির্দেশনা: শঙ্করপ্রসাদ ঘোষ] শাঁওলী মিত্র অভিনয় করেন। বহুরূপীতে তাঁর অভিনয় চর্চার পাশাপাশি তিনি নিয়মিত গানের রেওয়াজ করতেন। তাঁদের পারিবারিক সঙ্গীত শিক্ষক ধীরেন দাসের কাছে তিনি নিয়মিত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিয়েছেন। তিনি যখন বহুরূপীর চলতি প্রযোজনা রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’ নাটকে ‘সুরঙ্গমা’ চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেলেন, সুচিত্রা মিত্রর কাছে সুরঙ্গমা চরিত্রের গানগুলি শিখেছিলেন। তাঁর আরও দুজন সঙ্গীত শিক্ষক হলেন দেবব্রত বিশ্বাস ও অর্ঘ্য সেন। তবে তাঁর শারীরিক অসুস্থতার কারণে সবসময় যে শিল্পচর্চার মধ্যে থাকতে পারতেন,তা নয়। কখনও কখনও কঠিন অসুখে গৃহবন্দী হয়েও থাকতে হয়েছে। বহুরূপী’র ‘চার অধ্যায়’ (১৯৫১) নাটকে প্রতিটি অধ্যায়ের মাঝে লাইভ কন্ঠসঙ্গীতের ব্যবহার ছিল আবহ হিসেবে। দেবব্রত বিশ্বাসের পরিচালনায় এই কন্ঠসঙ্গীতের দলে শাঁওলীদিও অংশ নিতেন। তারপর একদিন বহুরূপীর সংস্রব ত্যাগ করলেন। অনেক আগেই বাবা শম্ভু মিত্র বহুরূপী থেকে চলে গিয়েছেন। মা তৃপ্তি মিত্রও পরে বহুরূপীর সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখলেন না।
১৯৮০-তে ক্যালকাটা রেপার্টারি থিয়েটার তথা কলকাতা নাট্যকেন্দ্র (কলকাতার বেশ কয়েকটি নামী দলের সমন্বয়ে গঠিত)-এর নাট্যপ্রযোজনা ‘গালিলেওর জীবন’নাটকে শম্ভু মিত্র গালিলেওর ভূমিকায় অভিনয় করলেন, গালিলেও-র মেয়ে ভার্জিনিয়ার চরিত্রে অভিনয় করলেন শাঁওলী মিত্র। এরপর ১৯৮১-’৮২ সাল শম্ভু মিত্রর সঙ্গে পাঠ ও আবৃত্তির অনুষ্ঠানে, পাঠ করলেন নাটক ‘রক্তকরবী’-র নির্বাচিত অংশ আবার শম্ভু মিত্র বিরচিত ‘চাঁদ বণিকের পালা’, পালায় রচিত গানও বাবার ইচ্ছায় গাইলেন তিনি। মুম্বাই, পুণেতে খুবই সম্মান পেল তাঁদের এই আয়োজন। এর সঙ্গে তখন আকাশবাণী কলকাতার নাটকবিভাগে একের পর এক বেতার নাটকে অসাধারণ সব চরিত্রে অভিনয় করতে লাগলেন। সে সময়ে নাটকবিভাগে অন্যান্য প্রযোজকদের সঙ্গে জগন্নাথ বসুও রেডিও নাটক নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করছিলেন আর তাতে শামিল হয়েছিলেন শাঁওলীদি। জগন্নাথ বসুর সঙ্গে নাটক পাঠ করতে লাগলেন মঞ্চে, তিনিই নাম দিলেন ‘শ্রুতি নাটক’—যে নামটি এখন সকলের কাছে খুব পরিচিত। হঠাৎ তাঁর মনে হল, আবৃত্তি ও শ্রুতিনাটকে অভিনয় করতে গিয়ে তিনি তাঁর কণ্ঠস্বরকে ব্যবহার করছেন বটে, কিন্তু তিনি তো তাঁর হাত-পা-চোখ-ঠোঁট, তাঁর শরীর—সবটুকু দিয়ে অভিনয় করতে সক্ষম, তা তো কই হচ্ছে না। তাঁর মনোগত ভাবনা জানার পর শম্ভু মিত্র তাঁকে কথকতার আঙ্গিকটি নিয়ে ভাবতে বললেন এবং ইরাবতী কার্ভে’র ‘যুগান্ত্’ বইটি পাঠিয়ে দিলেন। বইটি পড়ে তিনি তো মুগ্ধ, ঠিক করলেন ‘দ্রৌপদী’র চরিত্র তাঁর ভালো লেগে গেল। শুরু হয়ে গেল লেখন, সংশোধন ও  পুনর্লিখন। রচিত হল নাটক ‘নাথবতী অনাথবৎ’। এবার তার অভিনয় শুরু হবে, কিন্তু তাঁর না ছিল অর্থবল, না ছিল লোকবল। এগিয়ে এলেন পার্থ মুখোপাধ্যায় ও তাঁর আবৃত্তি সংস্থা ‘সারথী’ আর এলেন সেই তাঁর  উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের শিক্ষক ধীরেন দাস। তিনিও সঙ্গীত নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করলেন। নাটক শুরুর এক  অসাধারণ সঙ্গীতের আবহ সৃষ্টি করলেন। বহুদিন পর আমাদের থিয়েটার এত সুন্দর সঙ্গীতের স্বাদ পেল। এরপর তৈরি হল তাঁর নিজের দল, পঞ্চম বৈদিক। ১৯৮৩ সালে শম্ভু মিত্র প্রযোজিত ও শাঁওলীমিত্র নির্দেশিত নাটক ‘নাথবতী অনাথবৎ’ প্রথম মঞ্চস্থ হল।
সমগ্র নাট্যকলা সম্পর্কে একটি শিক্ষার ক্ষেত্র স্থাপনা করবার জন্য তৈরি হল পঞ্চমবেদ চর্যাশ্রম ১৯৮৪ সালে, যা ’৯০ সাল পর্যন্ত চলেছিল, অবশ্য মধ্যপথে চর্যাশ্রমের যাত্রা স্থগিত হলেও, নতুন শিক্ষার্থীদের আগ্রহে তা আবার শুরু হয় ২০০০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে, মনে হয় বেশিদিন আর এর অস্তিত্ব ছিল না। পঞ্চমবৈদিক, ভোপালের গ্যাস দুর্ঘটনা-পীড়িতদের জন্য ও বাংলাদেশের ঘূর্ণীঝড় পীড়িতদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে অর্থ প্রদান করবার কারণে ১৯৮৫ সালে জানুয়ারির এক সন্ধ্যায় শম্ভু মিত্রর ‘রাজা অয়দিপাউস’ পাঠ ও ‘নাথবতী ও অনাথবৎ’ নাটকের অভিনয়ের আয়োজন করে এবং ঐ বছরেই নান্দীকার, থিয়েট্রন ও সংস্তব নাট্যদলের প্রত্যক্ষ সহায়তায় শম্ভু মিত্রর নির্দেশনা ও অভিনয়ে নাটক ‘দশচক্র’ (মূল রচনা: হেনরিক ইবসেন) পুনরভিনয়ের আয়োজন করে। দিল্লীতে সঙ্গীত নাটক আকাদেমি আয়োজিত রবীন্দ্র নাট্যোৎসবে পঞ্চমবৈদিক প্রযোজিত শাঁওলী মিত্র নির্দেশিত রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’ (১৯৮৭) নাটকটি প্রশংসিত হয়েছিল। কলকাতা দূরদর্শনের আমন্ত্রণে শাঁওলীদির পরিচালনায় পঞ্চমবৈদিক-এর প্রযোজনায় রবীন্দ্রনাথের গল্প অবলম্বনে ‘সুভা’ টেলিফিল্মটি তৈরি হয়। এই ছবিটি সমস্ত সার্ক দেশগুলিতে দেখানোর জন্য নির্বাচিত ও প্রদর্শিত হয় ১৯৯০ সালে। আর একটি অসাধারণ কাজ শাঁওলীদি করেছিলেন, তা হল- তদানীন্তন পশ্চিমবঙ্গ সরকার তৃপ্তি মিত্রকে তাঁর নাট্যশিক্ষা চর্চাকেন্দ্র, ‘আরব্ধ নাট্য বিদ্যালয়’-এর জন্য যে ফ্ল্যাটটি (পার্ক সার্কাসে বাজারের উপর) দিয়েছিলেন, তৃপ্তি মিত্রের প্রয়াণের পর, শাঁওলীদি সরকারের অনুমোদনক্রমে ‘তৃপ্তি মিত্র স্মরণ’ এই নাম দিয়ে একটি সংগ্রহশালা গড়ে তোলেন ১৯৯৩ সালে। এই সংগ্রহশালাটিতে তৃপ্তি মিত্রের ব্যবহৃত সামগ্রী, আসবাব, পুরস্কার এবং ব্যক্তিগত জীবনের ও অভিনয়ের অসংখ্য ছবি সাজিয়ে রাখা আছে। এছাড়াও শ্রীমতী মিত্রর সাক্ষাৎকার, অভিনীত নাটক, আবৃত্তি ইত্যাদির কিছু অডিও ক্যাসেট এখানে সংরক্ষিত আছে যা দর্শকের অনুরোধে তাঁদের শোনানো হয়। এই সংগ্রহশালার ডিজাইনটি করেছিলেন বিশিষ্ট শিল্পী রঘুনাথ গোস্বামী।
এরপর আবার শাঁওলীদি মহাভারতের বিষয় নিয়ে আর একটি নাট্যপ্রযোজনা প্রস্তুত করেন—‘কথা অমৃতসমান’ (১৯৯০)। এইসময় থেকেই শাঁওলীদির মনে হচ্ছিল অনেকদিন তো একক প্রযোজনা হল, এবার সম্মিলিত অভিনয়ে নাট্যপ্রযোজনা প্রয়োজন। তাঁর একক অভিনয়ে যাঁরা জুড়ির দলে ছিলেন, তাঁরা অভিনয়ে অংশ নিলেন, অনেক নতুন সদস্যও দলে এলেন। শুরু হল একের পর এক নাট্যপ্রযোজনা—‘ত্রিংশ শতাব্দী’ (১৯৯০ ও ১৯৯৩), ‘বিতত বিতংস’ ( ১৯৯৬ ), ‘অগ্নিমন্থ’ ( ১৯৯৮ )— এই তিনটি নাটকের প্রথমটি বাদল সরকারের, পরের নাটক দুটির নাটককার সুপ্রীতি মুখোপাধ্যায়, আবার তার মধ্যে দ্বিতীয়টির নির্দেশক শাঁওলিদি, পরেরটি সুপ্রীতির। ১৯৯১ সালে তাঁর ‘নাথবতী অনাথবৎ’ নাটকটি হিন্দি ভাষায় প্রযোজিত হয়ে ভারতবর্ষের অন্য ভাষাভাষী দর্শকদের মধ্যে সাড়া ফেলে দেয়। তারপর যখন তিনি বহুরূপী’র বহু প্রশংসিত নাটক ‘পুতুল খেলা’ (মূলরচনা: হেনরিক ইবসেন) মঞ্চস্থ করবেন ঠিক করলেন, তখন তিনি ভীষণভাবে নিজস্ব মঞ্চ খুঁজছিলেন। টালিগঞ্জের রাণীকুঠির কাছে অরবিন্দ আশ্রম কেন্দ্রের ফিউচার ফাউন্ডেশন স্কুলের ছোট্ট প্রেক্ষাগৃহটি নেওয়া হল তখন, একশ’ বা দেড়শ’ আসন বিশিষ্ট হলটিতে শুরু করলেন নাটক ‘পুতুল খেলা’ (২০০২)। এ নাটকে ‘বুলু’-র চরিত্রে অভিনয় করতেন শাঁওলী মিত্র আর ‘তপন’-এর চরিত্রে বাবু দত্তরায়। সপ্তাহে একদিন বা কখনও কখনও দুদিন অবশ্যই ছুটির দিনে নাটকটি অভিনীত হত। টিকিটের মূল্য ছিল পঞ্চাশ টাকা। প্রেক্ষাগৃহটি ছোট হওয়ায় এবং অল্প সংখ্যক দর্শক হওয়ায় দর্শকের সঙ্গে সরাসরি কমিউনিকেট করা সহজ হত। এই মঞ্চে পরের নাটক ‘রাজনৈতিক হত্যা?’ নাটকটির কয়েকটি অভিনয় হয়েছিল। অবশ্য ‘রাজনৈতিক হত্যা?’ নাটকটির প্রথম অভিনয় হয় বালীগঞ্জ শিক্ষা সদনে ২০০৪ সালে। শাঁওলীদি যখন নির্দেশক হিসেবে অন্য অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করছেন, কেমন ছিল তাঁর কাজের ধরন, সেই প্রসঙ্গে বাবু দত্তরায় বলেছেন— শাঁওলী মিত্র ভীষণ ডিসিপ্লিন মেইনটেইন করতেন, কাজ করতে করতে ক্রমাগত কেউ ভুল করতে থাকলে একটা সময় তো বিরক্তি আসে, কিন্তু শাঁওলীদি সেটা এমন ভাবে প্রকাশ করতেন, এত নম্রভাবে, এত বিনয়ের সঙ্গে যে ঐ না পারা অভিনেতাটির কোনও অস্বস্তি হত না তাঁর সঙ্গে কাজ করতে। তিনি ডিসিপ্লিন এই অর্থে, চরিত্ররা অভিনয়ের দিন যে যা পোশাক পরবে, যা যা জিনিস সে ব্যবহার করবে, নাটকের মহলার প্রথম দিন থেকেই অভিনেতাদের তাই তাই করতে হত। ‘রাজনৈতিক হত্যা ?’ নাটকটির নির্দেশক ছিলেন শাঁওলী মিত্র, নাটকটির অনুবাদ করেছিলেন অর্পিতা ঘোষ। ‘রাজনৈতিক হত্যা ?’ জাঁ পল সার্ত্রের নাটক, ‘ক্রাইম পাশিওনাল’ (মূল ফরাসী নাটক: ‘লে ম্যাঁ সাল’)। তারপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চণ্ডালিকা’ গদ্যনাট্য ও ওই একই নৃত্যনাট্য থেকে সাহায্য নিয়ে শাঁওলীদি নিজে রচনা করেছিলেন ‘চণ্ডালী’—তাঁরই নির্দেশিত নাটকটিতে অভিনয় করলেন তিনি নিজে ও সঙ্গে নিলেন অর্পিতাকে। পঞ্চম বৈদিক-এ তাঁর শেষ অভিনয় জর্জ অরওয়েল-এর উপন্যাস অবলম্বনে অর্পিতা ঘোষ নির্দেশিত নাটক, ‘পশুখামার’ (২০০৬/ মূল উপন্যাস: অ্যানিম্যাল ফার্ম)-এ একটি ছোট চরিত্রে। শাঁওলীদি খুব বেশি ছবিতে কাজ করেননি, তবে ঋত্বিক ঘটকের ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ ছবিতে ‘বঙ্গবালা’র চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসিত হন।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.