বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[শিল্প]
এবছর ৩১ জুলাই ছিল ১২৪তম ‘কলম কা সিপাহি’ মুন্সি প্রেমচন্দের জন্ম দিবস। আধুনিক হিন্দি কথা সাহিত্যে মুন্সি প্রেমচন্দ ছিলেন একজন যুগ স্রষ্টা। তিনি নবচেতনার জনক এবং সর্বপ্রথম তাঁর প্রতিভা স্পর্শেই হিন্দি কথা সাহিত্য আধুনিকতার যথার্থ মর্যাদা লাভ করে। তিনি হিন্দি কথা সাহিত্যকে রূপকথা, ভোজবিদ্যার কল্পলোক থেকে ভারতীয় সমাজের বাস্তব প্রেক্ষাপটের উপর দৃঢ়ভাবে স্থাপন করলেন। তাঁর সাহিত্যে প্রতিফলিত হল শোষণ ক্লিষ্ট, অত্যাচারিত, নিপীড়িত, ধর্ম বর্ণ ভেদাভেদে লাঞ্ছিত জনসাধারণের জীবন সংগ্রাম। তাঁর চরিত্রগুলি কল্পলোকের অধিবাসী হবার পরিবর্তে হয়ে উঠলো ভারতীয় সমাজের গ্রাম নগরের পরিচিত রূঢ় বাস্তব জগতের বাসিন্দা। তাঁর সাহিত্য প্রতিভা সম্পর্কে বিশিষ্ট সমালোচক আচার্য হাজারী প্রসাদ বলেন, “প্রেমচন্দ এক শতাব্দীর ভারতীয় নিপীড়িত, অপমানিত, উপেক্ষিত মানুষের মানুষের কন্ঠকে ভাষা দিয়েছেন। প্রতি পদে শৃঙ্খলিত, লাঞ্ছিত, অসহায় নারী জাতির মহিমা ও মহত্ত্বকে রূপ দিয়েছেন সহানুভূতির সঙ্গে। উত্তর ভারতের সমস্ত জনতার আচার-বিচার, ভাষা-ভাব, আশা আকাঙ্ক্ষার, সুখ দুঃখের পরিচয় বুঝতে চাইলে তার পরিচয় পাওয়া যাবে প্রেমচন্দের সাহিত্যে।”
তাঁর জন্ম উত্তরপ্রদেশের বারাণসী জেলার লামহি গ্রামে। তিনি ছিলেন মা-বাবার চতুর্থ সন্তান। তাঁর প্রকৃত নাম ধনপত রাই শ্রীবাস্তব। পিতা আজাইব লাল এবং মাতা আনন্দী দেবী। তাঁকে সাত বছর বয়সে নিকটবর্তী লালপুর গ্রামে মাদ্রাসায় ভর্তি করা হয়। সেখানে তিনি হিন্দির সঙ্গে সঙ্গে উর্দু এবং ফারসি ভাষাও শেখেন মৌলবি সাহেবের কাছে। তাঁর প্রথম গল্প ‘সংসার কা সাবসে আনমাল রতন’ উর্দু ভাষায় ১৯০৭ সালে প্রকাশিত হয়। তখন তিনি নবাব রায় ছদ্মনামে লিখতেন। তারপর উর্দু ভাষাতেই স্বদেশপ্রেম মূলক পাঁচটি গল্পের সংকলন গ্রন্থ ‘সোজ এ বতন’ প্রকাশিত হয় ১৯০৮ সালে। এই গ্রন্থে তীব্র বৃটিশ বিরোধিতার বক্তব্য থাকায় সেই গ্রন্থ নিষিদ্ধ হয় এবং প্রেমচন্দকে বাধ্য করা হয় ৫০০ কপি বই পুড়িয়ে ফেলতে।
তারপর তিনি ‘নবাব রায়’ ছদ্মনাম বদলে ‘প্রেমচন্দ’ নামে লিখতে শুরু করেন। তিনি বন্দুক তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ করতে যাননি কিন্তু এমন মশাল নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন যে তার লেখার মধ্য দিয়ে কিসান মজদুর তাঁর সাহিত্য পড়ে উদ্দীপ্ত হয়েছেন। এইজন্য তাঁকে বলা হয় ‘কলম কা সিপাহি’।
বাবা ছিলেন পোস্ট ম্যান বেতন মাত্র ২০ টাকা। মাত্র ৭ বছর বয়সে মা মারা যান। বাবা দ্বিতীয় বিবাহ করেন। বিমাতার কাছে বড় হওয়া যে কী কষ্টের ব্যাপার তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন। ১৫ বছর বয়সেই বাবা বিয়ে দিয়ে দেন। এক বছর পরে বাবা মারা গেলে পুরো পরিবার বড় কষ্টের সম্মুখীন হন। তাঁর বৌ কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ছেড়ে চলে গেলে তিনি এক বিধবা রমণীকে বিবাহ করেন।
তিনি রাজনৈতিক কারনে সরকারি অধ্যাপনার কাজ ছেড়ে দেন এবং গান্ধীজীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। ‘কর্মভূমি’ রাজনৈতিক উপন্যাসে ভারতের স্বদেশী আন্দোলন, শোষণ ও দাসত্বের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনমানসের ক্ষোভ ও প্রতিবাদ, ভারতীয় নারী- পুরুষের সম্মিলিত বিদ্রোহ ও আত্মবলিদানের পথে মুক্তির সন্ধান করা হয়েছে।
‘সেবা সদন’ উপন্যাসে মধ্যবিত্ত মানুষের বিড়ম্বনাময় জীবন, সমাজে গণিকা সংক্রান্ত সমস্যা, নারী শিক্ষা, অসবর্ণ বিবাহ, পণপ্রথা ইত্যাদি নানা বিষয় অসাধারণ দক্ষতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
‘প্রেমাশ্রম’ও ‘বরদান’ উপন্যাসে কিসান সমাজের উপর জমিদারি শোষণ নিপীড়ণের নির্মমতা উপস্থাপিত করেছেন প্রেমচন্দ।
‘নির্মলা’ ও ‘প্রতিজ্ঞা’ উপন্যাসে ভারতীয় সমাজের পণ প্রথা, অসবর্ণবিবাহ, বাল্যবিবাহ, বৃদ্ধ কুলিনের সঙ্গে বিবাহ ইত্যাদি বিচিত্র দাম্পত্য সংক্রান্ত সামাজিক সমস্যা দরদী মন নিয়ে লিপিবদ্ধ করেছেন লেখক।
ভারতীয় সভ্যতার সংস্কৃতির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র বারাণসী সন্ত কবীর, ভক্ত রবিদাস, সাহিত্য সাধক তুলসী দাসের জন্মভূমি কর্মভূমি। ব্রিটিশ শাসিত বারাণসী রাজ্যে অন্যান্য বহু এলাকার মতো হিন্দু মুসলিম যৌথভাবে ১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এই বিদ্রোহ দমন করার জন্য নির্বিচারে হত্যাকান্ড চালায়। হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতি ভাঙতে স্থানীয় পুরোহিত ও মসজিদের ইমামকে গাছের একই ডালে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেওয়া হয়। তাঁদের দেহ শেষকৃত্য করতে দেওয়া হয়নি। আরও জঘন্য কান্ড করা হয় তাঁদের দেহ নিয়ে, ইমাম সাহেবের দেহ শ্মশানের চিতায় পোড়ানো হয় এবং পুরোহিত মশাইকে কবরে সমাধিস্থ করা হয়। এই উত্তর ভারত ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ, আস্ফাকুল্লাহ, রামপ্রসাদ বিসমিল, সুকদেব, রাজগুরু প্রমুখ বিপ্লবীর স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আন্দোলন ক্ষেত্র।
১৯২১ সালে গান্ধীজি আসহযোগ আন্দোলন শুরু করলে তিনি সরকারি বিদ্যালয় পরিদর্শকের চাকরি ছেড়ে আন্দোলনে যোগ দেন।
১৯৩৬ সালে লক্ষ্নৌ শহরে প্রগতি লেখক সংঘের প্রথম সম্মেলন হয় এবং তিনি সেই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। এই সম্মেলনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন বিশিষ্ট লেখক মুলুক রাজ আনন্দ। সেই সম্মেলনে তিনি তাঁর মহামূল্যবান বক্তব্যে সমাজের নিপীড়িত মানুষের প্রতি লেখক শিল্পীদের দায়বদ্ধতার কথা তুলে ধরেন। সেই সঙ্গে হিন্দি ও উর্দু ভাষার গভীর সম্পর্ককে তুলে ধরেন। তিনি নিজেকে মজদুর হিসেবে পরিচয় দিতেন। লেখালেখির প্রতি দরদ প্রসঙ্গে তিনি জানান, যে যেদিন তিনি লিখতে পারতেন না সেইদিন তাঁর মনে হতো তাঁর রুটি খাবার অধিকার নেই।
লক্ষ্নৌ শহরেই ১৯৩৫ সালে সারা ভারত কৃষক সভার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
১৯৩৪ সালে বোম্বাইয়ের দাদারে থাকার সময়ে প্রেমচন্দ ‘মজদুর’ সিনেমার চিত্রনাট্য রচনা করেন। এখানেও তিনি তাঁর নিজস্ব সমাজ ভাবনার পরিচয় রেখেছেন।
প্রখ্যাত ভজন গায়ক জগজিৎ সিং হিন্দি ভাষার সঙ্গে উর্দু ভাষার সম্পর্ক প্রসঙ্গে বলেন, Urdu is the ornament of Hindi poetry অর্থাৎ উর্দু ভাষা হল হিন্দি ভাষার কবিতার অলঙ্কার।
রেডিও শিলং ২০০০ সালের গোড়ার দিকে হিন্দি সেরা ভজন সংগীত নিয়ে এক সমীক্ষা চালায়। ভজন হল বিভিন্ন দেবদেবীর ভক্তি বা মাহাত্ম্য সঙ্গীত। এর মধ্যে কয়েকটি মেহবুব সাহেবের ছবি থেকে এসেছে, যার গীত লিখেছেন শাকিল বাদৌনি সাহেব, সঙ্গীত দিয়েছেন নওশাদ সাহেব, গায়ক ছিলেন মোহাম্মদ রফি সাহেব, আর সিনেমার পর্দায় যার মুখে আমরা সেই গান গাইতে দেখি তিনি হলেন বিখ্যাত হিন্দি চলচ্চিত্র নায়ক ইউসুফ খান বা দিলীপ কুমার।
“সুখ মে সব সাথি, দুখ মে কোই নেহি।”
প্রভু রামকে নিয়ে গাওয়া সেই গান। এই আমাদের সম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শিকড় বা ঐতিহ্য।
এই ভাবনার উপরে লেখা ‘পঞ্চ পরমেশ্বর’ গল্প। এই গল্পের কাহিনী ফল্গু চৌধুরী ও জুম্মান শেখের অকৃত্রিম বন্ধুত্বকে নিয়ে রচিত। এই প্রেম বন্ধুত্ব ভালোবাসা ছোটবেলা থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অটুট থাকে।
‘মুক্তি মার্গ’ গ্রন্থে প্রেম চাঁদ দেখিয়েছেন সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষের মধ্যে ঐক্য না থাকায় দিন দিন সমস্যা তাদের বাড়ছে। অথচ ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্য হল বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান বা বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য। প্রখ্যাত পপ গায়ক পিট সিগার ভারতীয় সংস্কৃতির এই ঐতিহ্যকে বলেছেন ‘My Rainbow race’। এই ঐতিহ্য বহু কাল থেকে চলে আসছে। তার নিদর্শন রয়েছে ভারতের সর্বত্র।
পুরীর রথ মন্দির থেকে মাসির বাড়ি দিকে যাত্রাপথে প্রখ্যাত সুফি সাধক সালেহ বেগের মাজারে বা সমাধি স্থলে বিরতি দেন এবং বহু ভক্ত সেখানে ভক্তি নিবেদন করেন। তারপর আবার শুরু হয় রথযাত্রা। এই প্রথা চলে আসছে কয়েক শতাব্দী ধরে ভক্তি। কখনো কোনও ধর্মীয় ভেদাভেদ বা হিংসা বিদ্বেষ দেখা যায়নি।
অমরনাথ মন্দিরের দরজা খোলার পরে জুন মাসে প্রথম দীপটি যিনি প্রজ্জ্বলিত করেন তিনি একজন সেই এলাকার উপজাতি সম্প্রদায়ের মুসলিম প্রবীণ মানুষ। কয়েক বছর ধরে এই দায়িত্ব নিষ্ঠা সহকারে পালন করে আসছেন মেষ পালক বুটা মালিক।
বি আর চোপড়ার ‘মহাভারত’ সিরিয়ালের কথা আমরা সবাই জানি। সেই সময় রবিবার সিরিয়াল চলাকালীন সময়ে সকাল ৯টা থেকে এক ঘন্টা বাজার হাট প্রায় সব বন্ধ হয়ে যেত। মুসলিম এলাকাও এর বাইরে থাকত না। ক্লাবে ক্লাবে ক্লাবে ভিড় জমতো বেজায় এই সিরিয়াল দেখার জন্য। এই সিরিয়ালের চিত্রনাট্য রচনা করেন বিখ্যাত উর্দু কবি এবং সিনেমার স্ক্রিপ্ট রাইটার ড. রাহি মাসুম রেজা। তার বিভিন্ন চরিত্রের মুখে মাতাশ্রী, পিতাশ্রী ভ্রাতাশ্রী ইত্যাদি সম্বোধন মানুষকে আকৃষ্ট করতে বেশ। এমনকি কুন্তি চরিত্রে নাজনীন, অর্জুন চরিত্রে ফিরোজ খান অভিনয় করে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
এই সময়ে বি আর চোপড়ার বিরুদ্ধে মুসলিম শিল্পীদের যুক্ত করায় অনেকেই পোস্ট কার্ডে সমালোচনার ঝড় তোলেন কিন্তু মুগ্ধ দর্শক শ্রোতার চিঠি এত বেশি ছিল যে নিন্দুকেরা পাত্তাই পাননি।
মহরম বা শোক পালনের অনুষ্ঠান একান্তভাবেই নবীজী হজরত মোহাম্মদের দৌহিত্র হাসান হোসেনের কারবালা যুদ্ধে নিহত হবার শোক পালন। কিন্তু ভারতে হোসেনী ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় মহররমের দিনে শোক দিবস রূপে পালন করেন। তাঁদের মধ্যে একটি পরিবার হল প্রখ্যাত হিন্দি চলচ্চিত্রের অভিনেতা সুনীল দত্তের পরিবার। এই হোসেনী ব্রাহ্মণরা চন্দ্রগুপ্তের নির্দেশে কারবালার মাঠে হোসেনের হয়ে যুদ্ধ করতে যান কিন্তু তার আগেই হোসেন নিহত হয়ে যাওয়ায় তারা অনেকে শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করে শহীদের মর্যাদা লাভ করেন। এঁদেরই বংশধরদের বলা হয় হুসেইনি ব্রাহ্মণ। এমন অজস্র দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে আছে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে রাজ্যে নানা ধর্ম সম্প্রদায়ের লোকাচার ভাবনায়।
এ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে বর্তমান প্রেক্ষাপটে। আজকের দিনে দেশের কোটি কোটি মানুষের অন্নবস্ত্র কর্মসংস্থানের জ্বলন্ত সমস্যাগুলিকে আড়াল করতে ভারতবাসীর মধ্যে ধর্ম বর্ণ জাতপাত ভাষা নিয়ে ঘৃণ্য ভেদাভেদ সৃষ্টির চক্রান্ত চলছে। আমরাও সেই ফাঁদে পা দিচ্ছি অনেকেই। আজকের দেশের শাসকশক্তি মানুষের ভালবাসা বন্ধুত্ব ও একতাকে ভয় পাচ্ছে। এই পরিস্থিতিকে বদলাতে হবে।
প্রেমচন্দের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘গোদান’ প্রকাশ পায় ১৯৩৬ সালে। নায়ক হরি দুঃখের মধ্যে জন্ম নিয়ে দুঃখে লালিত এবং চূড়ান্ত দুঃখের মধ্যেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। সুখ নামক বস্তুটি আমৃত্যু তার কল্পনাতেই থেকে যায়। হরির জীবনের এই দুঃখময়তাকে প্রেমচন্দ ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যা হিসেবে দেখেননি। হরি এখানে নিম্নবিত্ত মানুষেরই প্রতিনিধিত্ব করেছে, তার চরিত্রের মধ্য দিয়ে প্রেমচন্দ কৃষক সমাজের দারিদ্র লাঞ্ছনা বঞ্চনার কথাকে তুলে ধরেছেন। প্রেমচন্দ তাঁর নায়ক হরির মধ্যে দেখিয়েছেন কিভাবে তার জমি, বাড়ি ঘর সব কিছু মহাজনের কব্জায় চলে যাচ্ছে। শরৎচন্দ্রের মহেশ গল্পের গফুর জোলার মতো কিসান থেকে হরি মজদুরে পরিণত হয়েছে এবং মজদুরি করতে করতে সে মারা গেছে। আজকের দিনে আরো খারাপ অবস্থা ভারতের কিসানদের। হাজার হাজার কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন। সমস্ত সাম্প্রদায়িক বিভেদ ভুলে যখন কৃষকরা লড়াইয়ে নামছে তখন তাদের গায়ে আতঙ্কবাদীর কলঙ্ক লেপন করা হচ্ছে। তাদের রাস্তায় কাঁটাতার দিয়ে অবরুদ্ধ করা হচ্ছে, জলকামান দিয়ে জমায়েতকে ছত্রভঙ্গ করছে কেন্দ্রের পুলিশ বাহিনী।
ন্যায়পালিকা দরিদ্র মানুষের জন্য কাজ করতে পারছে না। মানুষ বড় অসহায়, বহু ক্ষেত্রেই বিচারের নামে প্রহসন হচ্ছে। যিনি জনসাধারণের অধিকারের বিরুদ্ধে রায় দিচ্ছেন বেআইনিভাবে, তিনি তার অল্পকাল পরে হয় সাংসদ বা কোনও রাজ্যের রাজ্যপাল হয়ে যাচ্ছেন। এটা তাঁর পুরস্কার না উপঢৌকন। কবিগুরুর ভাষায়, ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’।
‘নমক কা দারোগা’ গল্পে এই ধরনের দুর্নীতি অপশাসনের পরিচয় দিয়েছেন প্রেমচন্দ। আদর্শবাদী যুবক বংশীধর লবণের দারোগা পদে ন্যায় পরায়ণতার সঙ্গে কাজ করতে থাকেন। তাঁর কঠোর পাহারায় একদিন ধরা পড়ে গেল গ্রামের বিত্তশালী জমিদার আলোপিদিন। ক্ষমতা প্রতিপত্তির ভয় ও অর্থলোভ দেখিয়েও বংশীধরকে নিরস্ত করা গেল না। আলোপদিনের বিরুদ্ধে চোরাকারবারের মামলার রুজু করা হল। কিন্তু প্রশাসনের কর্তাদের উদ্দেশ্য প্রণোদিত অবহেলায় আদালতের রায় ন্যায়ের পরিবর্তে ক্ষমতাবানের পক্ষে চলে যায়। গল্পের পরিণতিতে দেখা যায়, আলোপদিনের সাজা হওয়ার পরিবর্তে চাকরি গেল বংশীধরের।
‘সোয়াসের গেহু’ গল্পে একদিকে দরিদ্র কিসান সমাজের ধর্মভীরতা আর অন্যদিকে সামন্তবাদী ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের নিষ্পেষণের চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে। দরিদ্র কুর্মী কৃষক শংকর দেবভক্ত, ব্রাহ্মণ ভক্ত। একদিন তার ঘরে এক সাধু উপস্থিত হলে তাঁর সেবার জন্য স্থানীয় বিপ্রজির কাছ থেকে মাত্র সোয়া সের গম ধার করে শংকর। সে গায়ে গতরে খেটে সেই দেনা শোধ করে। কিন্তু কয়েক বছর পরে মহাজন বিপ্রজি শংকরকে জানায় যে, সুদে আসলে সাড়ে পাঁচ মন গম দেনা আছে। শংকরকে এই দেনার দায়ে গোলামী খাটতে হয়েছে বেশ কয়েক বছর। এমনকি তার মৃত্যুর পর তার পুত্রকে বংশপরম্পরায় ঋণের বোঝা বহন করতে হয়েছে। আজকের দিনেও মহাজনি শোষণের নির্মমতার চিত্র আমরা পাই নানাভাবে।
বর্ণ বৈষম্য ও অমানবিক শোষণের জ্বলন্ত চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে ‘সদগতি’ গল্পে। দুঃখী চর্মকার ধর্মভীরু মানুষ হলেও ধনী অভিজাত ব্রাহ্মণের কাছে সে অস্পৃশ্য। মাঙ্গলিক ক্রিয়াকর্মে পুরোহিত তাদের সাংসারিক কল্যাণ করে বলে তাদের দৃঢ় বিশ্বাস। কন্যার বিবাহের শুভ দিন নির্ধারণের জন্য দুঃখী ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ঘসিরামের কাছে যায়।এই সুযোগে ঘসিরাম দুঃখীকে দিয়ে বিনা পয়সায় ঘরের অনেক কাজ করিয়ে নেয়। উঠোন ঝাট দেওয়া, গোয়াল ঘরের ভুষির বস্তা বয়ে আনা, কাঠের গুঁড়ি চেরাই করা নানা কাজ করিয়ে নেওয়া হয়। অথচ সামান্য খাবার পর্যন্ত তাকে দেয় না। ক্ষুধার্ত অবস্থায় এতসব কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে দুঃখী মারা যায়। এই গল্পের ইঙ্গিতবাহী দিক হল, দুঃখীর এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণে সমগ্র চর্মকার সম্প্রদায়সহ বহু নিচু তলার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ধনী পুরোহিত ঘসিরামের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হয়। এই ঘটনা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে অন্যায় অবিচার মেনে নেওয়া নয়, তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদে সামিল হওয়াই বাঁচা।
বুধিয়া গর্ভবতী মহিলা চিকিৎসার অভাবে ছটফট করে মারা যায়। আজকে আপনি বাংলা তথা ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়ে দেখুন সাধারণ মানুষের একই দুর্দশার চিত্র। প্রায় বিনা চিকিৎসায় মরছে সাধারণ গরিব দুর্বল অংশের মানুষ। এই অবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করারই বার্তা পায় প্রেমচন্দের সাহিত্যে। এই লড়াই করার বীজ প্রেমচাঁদ তাঁর সাহিত্যে ধীরে ধীরে রোপন করে গেছেন। তিনি নিজেই বলতেন, এমন সাহিত্য রচনা করা উচিত যা জনসাধারণকে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে বিচলিত করে তুলবে। বেশি ঘুমিয়ে থাকার লক্ষণ হল মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া। ‘কলম কা সিপাহী’ প্রেমচন্দের সাহিত্যে আমরা সেই পথে এগিয়ে যাওয়ার শিক্ষা পাই।
‘পঞ্চ পরমেশ্বর’ গল্পে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদ্দেশ্যে তাঁর বিখ্যাত উক্তি, “বিগড় কে ডর সে ঈমান কা বাত না কহোগে?”
আজকে আমরা কী দেখছি, ভয়ে বা সামান্য স্বার্থের কারণে কত কী লেহন করছি।
‘নির্মলা’, ‘সেবা সদন’ উপন্যাসে দেখি মেয়েরা রুটি আর ইজ্জতের জন্য লড়াই করে চলেছে। আমাদের বর্তমান সমাজে সারা ভারত জুড়ে বিভিন্ন রাজ্যে নারী নির্যাতন ধর্ষণ হত্যা চলছে অবাধে। মণিপুর, উন্নাও, হাথরাস, পাটনা, পার্ক স্ট্রিট, কামদুনি কাটোয়া, হাঁসখালি, জয়নগর নানা ঘটনা মানব সভ্যতার কলঙ্ক। আর জি কর কাণ্ডে ডাক্তার ছাত্রীকে গণধর্ষণ ও হত্যা দিল্লির নির্ভয়া কান্ডকেও হার মানায়। পুলিশ প্রশাসনসহ রাজ্যের শাসক এই জঘন্য কান্ডের পেছনে যারা দায়ী তাদের আড়াল করতে চাইছেন। তাই দিকে দিকে উঠেছে আওয়াজ। শুধু বিচার নয়, তাদের পদত্যাগের দাবি উঠছে।