বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[শিল্প]
‘পশ্চিমবাংলার জন্মদিন’!
এক নতুন উৎসবের শলতে পাকানো চলছে! বিজেপি শাসিত ইউনিয়ন সরকার আর তৃণমূল কংগ্রেস শাসিত পশ্চিমবাংলার সরকার, দুই শাসকগোষ্ঠীর উদ্যোগেই। কোন তারিখে এই উৎসব করা ‘উচিত’, তা নিয়েই চলছে জোর গবেষণা।
অবিভক্ত বাংলাকে ভেঙে ‘পূর্ব’ ও ‘পশ্চিম’, দুই ‘আন্তর্জাতিক প্রতিবেশী’ গড়ে তোলা হয়েছিল কলমের এক খোঁচায়। ধর্মের কু-যুক্তিতে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে। শতশত বছরের প্রতিবেশী মুসলমান ও হিন্দু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যেকার স্বাভাবিক পার্থক্যকে অজুহাত হিসাবে দাঁড় করিয়ে। এই ‘পরিকল্পনা’ ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শয়তানদের। ভাগাভাগির ‘দাবি’ প্রকাশ্যে উত্থাপন করেছিলেন হঠাৎ-ইসলামি হয়ে ওঠা, মসজিদে না-যাওয়া, নামাজ না-পড়া, মুসলিম লীগ নেতা মহম্মদ আলি জিন্নাহ। প্রকাশ্যে আর ঘোমটার আড়াল থেকে ‘সমর্থন’ জুগিয়েছিল মুসলমান-বিদ্বেষী ‘হিন্দু’ এবং হিন্দু-বিদ্বেষী ‘মুসলিম’ – দুই তরফেরই রাজনৈতিক-সামাজিক-ঐতিহাসিক মোড়লরা।
বাংলাভাগের ফলে পশ্চিমবাংলায় যাদের অনেক কিছু রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক লাভ হয়েছে, তাঁরা ‘পশ্চিমবঙ্গ’ সৃষ্টিতে উল্লসিত। নানা ছলাকলার মাধ্যমে বাঙালির সর্বনাশা ‘বাংলাভাগ’-এর সমর্থক তাঁরা। এঁরা নানাভাবে মন্ত্রী-সান্ত্রী হয়েছেন; করেকম্মে খাচ্ছেন; কপর্দকশূন্য অবস্থা থেকেও নানা পদ্ধতিতে জমি-বাড়ি আর আর্থিক সম্পদ গড়ে তুলেছেন। পাশাপাশি যাঁরা শতশত বছরের ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়ে সবকিছুই হারিয়েছেন; আত্মীয়-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন; ঐতিহ্যগত সামাজিক-সাংস্কৃতিক শিকড় থেকে উপড়ে গিয়ে অপমানজনক আর ভাসমান শ্যাওলার জীবন যাপনে বাধ্য হয়েছেন— তাঁরা আরেকভাবে দেখেন। প্রথম গোষ্ঠী বহুকিছু প্রাপ্তির আনন্দে উৎফুল্ল। দ্বিতীয় গোষ্ঠী সব হারানোর যন্ত্রণায় পীড়িত। তাই ‘পশ্চিমবঙ্গের জন্মদিন’ সম্পর্কে এঁদের দুই পক্ষের অভিজ্ঞতা, দৃষ্টিভঙ্গী, মানসিকতা আর মতামত সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী।
দুই
বাংলাভাগের আগেই, বাঙালিদের নানা মহল থেকে দাবি উঠেছিল, ‘বাংলা যেন ভাগ না হয়।’ পরবর্তীকালে গড়ে ওঠা ‘সীমান্ত’ রেখার পূব ও পশ্চিম, দুই দিকেই শ্রমজীবী জনগণ এই দাবি তুলেছিলেন। কিন্তু মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (গুজরাটি), জওহরলাল নেহরু (কাশ্মীরি), সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল (গুজরাটি) প্রমুখ নিখিল ভারত কংগ্রেস দলের অবাঙালি রাজনৈতিক নেতৃত্ব বাংলাভাগের জন্যে অত্যন্ত তৎপর হয়ে উঠেছিলেন। ঘনশ্যাম দাশ বিড়লার মতো (মাড়োয়ারি) বেনিয়াও ‘পার্টিশান’-কে ‘লাভজনক’ বলে লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন গান্ধীকে। বিপরীতে, বঙ্গীয় কংগ্রেসের সভাপতি শরৎচন্দ্র বসু ছিলেন ‘অবিভক্ত স্বাধীন প্রজাতান্ত্রিক বাংলা’-র প্রবক্তা। সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের নেতা, পশ্চিমভারতীয় মহম্মদ আলি জিন্নাহ্ পূর্ব বাংলাকে ‘পাকিস্তান’-এ পাবার লোভে বাংলাভাগে অতি আগ্রহী ছিলেন। অথচ বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম-ও ছিলেন অবিভক্ত বাংলার দৃঢ় প্রবক্তা। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে হাজার হাজার মেহনতী মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ সে’সময়ে সংগঠিত হচ্ছিল বাংলাভাগের বিরুদ্ধে।
যেসব কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য বছরের পর বছর বাংলার শ্রমজীবী কৃষকসমাজের সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম সংগঠিত করছিলেন গ্রামাঞ্চলে পড়ে থেকে, তাঁরা ‘বাংলাভাগ’ মানেন নি। ‘বাংলার কৃষক’দের স্বার্থে তাঁরা নিজেদের কর্মভূমিকেই আঁকড়ে ছিলেন জীবন পণ করে।
কিন্তু পশ্চিমা রাজনৈতিক ও বেনিয়া নেতাদের কৌশলী চালে ‘বাংলাভাগ’ অনিবার্য হয়ে উঠলো! অদূরদর্শী আর ধান্দাবাজ বাঙালি মাতব্বররাও ‘পশ্চিমবাংলা’ গড়ে তুলতে ‘জোগাড়ে’ হয়ে উঠলেন! পরিণতি, ৭৬-বছরেও পশ্চিম ভারতীয় রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক আধিপত্য থেকে ‘এপার’ বাংলা মুক্তি পেল না!
বাংলাভাগে কী লাভ হয়েছে পশ্চিমবাংলার বাসিন্দা বাঙালিদের?
সরকারি-বেসরকারি কাজে ইংরেজির দাপট কমেছে? না।
কোটি কোটি বাঙালি এখানে কাজ পায়? না। বরং লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে, দশকের পর দশক যাবৎ দূরদূরান্তের বিভিন্ন অঞ্চলে যেতে হয় অসংগঠিত ও সাময়িক শ্রমিক/ দিনমজুর/ স্বর্ণকার ইত্যাদি হিসাবে কাজ করার তাগিদে।
সব বাঙালি শিশু-কিশোর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা করার সুযোগ পায়? না।
সব বাঙালি বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারেন? না।
সব বাঙালির স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার অবস্থা ঠিকঠাক আছে? একেবারেই না।
সব বাঙালি মর্যাদাপূর্ণ বাসস্থানে মাথাগোঁজার ঠাঁইটুকু পান? না।
পশ্চিমবাংলার অর্থনীতিতে ভূমিসন্তান বাঙালিদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? একবিন্দুও না। বিড়লা, গোয়েঙ্কা, জালান, মোদি, খৈতান ইত্যাদি মাড়োয়ারি বেনিয়াদের হাতেই আজও পশ্চিমবাংলায় অর্থনীতির হাল ধরা। বাঙালিরা আজও একটা পান-সিগারেটের কিম্বা ডিমের অথবা তেলেভাজার বা ঘুগনির দোকান দিতে পারলেই বর্তে যান! পশ্চিমবাংলার ‘বাঙালি’ শাসকগণ দশকের পর দশক ধরে বারবার এদেশ-সেদেশ দৌড়োদৌড়ি করে বেড়ান জনগণের টাকা উড়িয়ে, ‘বিদেশি শিল্পপতি’দের তেল দিয়ে এখানে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু প্রতিবারই ফলাফল অশ্বডিম্ব! বাঙালিদের হাল যেমন ছিল তেমনই থেকে যায়। ব্রিটিশ আমলেও তাঁরা শোষিত হতেন, ‘স্বাধীনতা’ আসার পরেও তাঁরা শোষিত হন – প্রতিদিন, প্রতি ঘন্টা, প্রতি মিনিট। পশ্চিম ভারতীয় রাজনৈতিক মোড়ল আর অর্থনৈতিক বেনিয়ারাই আজও পশ্চিমবাংলার ভাগ্যবিধাতা!
তাহলে, কী কারণে ‘পশ্চিমবাংলার জন্মদিন’ নিয়ে বাঙালি আহাম্মকদের এত আদিখ্যেতা? একটাই, ‘আমরা শাসকের গদিতে বসেছি’! হ্যাঁ, এটাই এবং একমাত্র এ’টুকুই। যদিও বাঙালি সমাজের মৌলিক সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর এতটুকুও সুরাহা হয়নি। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শয়তানদের মর্জি মাফিক ‘বাংলাভাগ’ করে, আর অবাঙালি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মাতব্বরদের সেবাদাস হয়েই এঁরা নিজেদের ধন্য মনে করেন! ব্রিটিশ রাজের প্রতি আপোষপন্থী দাসত্বের মানসিকতা নিয়ে চলার অনিবার্য পরিণাম এটাই।
তিন
যদি এমন হতো – বাংলা অবিভক্তই থাকলো। মুসলমান-হিন্দু-খ্রিস্টান-শিখ-বৌদ্ধ নির্বিশেষে, সব বাঙালিই ঐক্যবদ্ধ রইলো। কারো সংস্কৃতি, কারো ধর্মবিশ্বাসকে কেউই অসম্মান করে না। সকলের সামাজিক পার্বনে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আর ধর্মীয় উৎসবে সকলেই আনন্দের সঙ্গে অংশ নেন। প্রতিটি পরিবারের মধ্যেই সদ্ভাব ও সুসম্পর্ক বজায় আছে। ‘বিদেশি’ কিম্বা ‘দেশি’, যে কোনও শক্তিই বাঙালি জাতির উপর শোষণ-আধিপত্য চালাতে দুঃসাহস দেখালেই বাঙালি শ্রমজীবী মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। ‘সকলের তরে সকলে আমরা/ প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’- এই মহত্তম ভাবনাই বাঙালির অন্যতম জাতিগত বৈশিষ্ট্য। তাঁরা নিজেরা ইজ্জৎ ও অধিকার নিয়েই বাঁচে, অন্যান্য জাতিসত্তার/ আদিবাসীদের প্রতিও ইজ্জৎ আর অধিকার নিয়ে বাঁচার গ্যারান্টি দেয়।
এরকম হল না কেন!
বাঙালির শিক্ষাগত অর্জন, মেধাগত যোগ্যতা, অর্থসম্পদ, শ্রমশক্তি, সবকিছুই যদি সমগ্র বাঙালি জাতির কল্যাণে কাজে লাগতো! রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রশান্তচন্দ্র মহালনবীশ, তারকচন্দ্র দাশ, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, মেঘনাদ সাহা, আলামোহন দাশ, যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (বাঘাযতীন), বিনয়-বাদল-দীনেশ, সূর্য সেন, অনন্ত সিংহ, শরৎচন্দ্র বসু, সুভাষচন্দ্র বসু, কাজী নজরুল ইসলাম, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, শওকত ওসমান, আব্দুল মতিন, আহমদ রফিক, আলাউদ্দিন খাঁ, আলি আকবর খাঁ, উদয় শঙ্কর, অমলা শঙ্কর, রবি শঙ্কর, নিখিল বন্দোপাধ্যায়, শম্ভু মিত্র, বিজন ডট্টাচার্য, উৎপল দত্ত, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, নির্মলেন্দু চৌধুরী, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য, জয়নুল আবেদিন, সোমনাথ হোড় … ভারতরাষ্ট্রে অন্য কোনও জাতির ইতিহাসেই এত বহুমুখী প্রতিভার নক্ষত্রপুঞ্জ পাওয়া যাবে না। বাঙালি সমাজে সাহিত্য, রাজনীতি, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, নাটক, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত, চিত্রকলা ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়ে যে বিস্ময়কর চেতনা-ভান্ডার, তা যদি অবিভক্ত বাঙালি সমাজের কাজে লাগত? কী দুরন্ত সামাজিক অগ্রগতি ঘটতে পারতো বাঙালি জাতির, তা গদির মদে নেশাগ্রস্ত আহাম্মক ‘বাঙালি’ মাতব্বররা কল্পনাও করতে পারেননি/ পারেন না। আত্মশক্তি আর আত্মমর্যাদা সম্পর্কে অসচেতন বাঙালি শাসকরাই পশ্চিমবাংলা শাসন করার দায়িত্ব পালন করে চলেছেন দশকের পর দশক! ফলে, সার্বিক অবক্ষয় ও অধঃপতনের অনিবার্য উদাহরণ তৈরি হয়েই চলেছে নিত্যদিন!
শাসক ব্রিটিশ শয়তানদের তৈরি ‘সীমান্ত’ যাঁদের ভাগ করে রেখেছে, দুই পারের সেই সাতাশ কোটি বাঙালি (পূবের সতেরো আর পশ্চিমের দশ), যদি তাঁদের বিবিধ ও সামগ্রিক সম্পদ নিয়ে ‘অবিভক্ত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলা’ গড়তে ঝাঁপিয়ে পড়তেন? তাহলে কোন স্বপ্নের বাংলা তৈরি হতে পারতো, ক্ষমতালোভী আর সংকীর্ণচিত্ত বাঙালি মোড়লরা তা আর কী করে বুঝবেন! যদি বুঝতেন, তবে ‘পশ্চিমবাংলার জন্মদিন’ পালনের মতো বাঙালি জীবনে দুঃসহ যন্ত্রণার দিনকে ‘উৎসব’-এর দিন হিসাবে পালনের প্রস্তুতি করতে পারতেন না।
চার
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা বিলক্ষণ জানতো, রাজনৈতিক শক্তিকে রাজনৈতিক ভাবেই মোকাবেলা করতে হবে। ‘গুলি বন্দুক বোমার আগুনে’ যে রাজনীতির পথ আঁকা হয়েছে, বোমা-বন্দুক-ফাঁসি-অত্যাচারের নির্দয় পথেই তার সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হবে। কিন্তু শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলা, সঙ্গীত, নৃত্য, নাটক, প্রভৃতির সাংস্কৃতিক সম্পদে বলিয়ান যে জাতি, তার মেরুদন্ড অপরিসীম শক্তিশালী। যেনতেনভাবে তাদের বিভক্ত ও দুর্বল করতে না পারলে, তাঁদের মানসিক জগতকে আঘাত দিতে না পারলে, বিপদ অনিবার্য। বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবী তেজকে ক্ষতিগ্রস্ত করার সাম্রাজ্যবাদী কৌশল ছাড়াও, ‘বাংলাভাগ’-এর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল বাঙালির সাংস্কৃতিক মেরুদন্ডকেও আঘাত করা।
পূর্ববাংলার ও পশ্চিমবাংলার মাঝখানে যখন গণশত্রুদের নেতৃত্বে ‘আন্তর্জাতিক সীমানা’ গড়ে ওঠা সরকারিভাবেই ঠিক হয়ে গেল, কোনও বাংলার জনগণের জীবনেই তখন আনন্দের ঢেউ খেলে যায়নি। পূর্ব থেকে কোটি কোটি হিন্দু যেমন ভিটেমাটি ছেড়ে পশ্চিমে পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছেন, পশ্চিম থেকেও লক্ষ লক্ষ মুসলমান তেমনি ভিটে ছেড়ে চলে গিয়েছেন পূবে। এঁদের কারও কাছেই ‘পশ্চিমবাংলার জন্মদিন’ কোনও সুখের দিন না।
শাসকের তাঁবেদার সবসময়ে ও সবজায়গাতেই থাকে। তারাই শাসকের সামাজিক খুঁটি হিসাবে কাজ করে। ‘বাংলা’ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। শ্রমজীবী সমাজের ঘাড়ে বসে খাওয়া পরগাছা মাতব্বররা বাংলাভাগের সমর্থক ও সহযোগী হয়ে উঠেছিল। কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা, কমিউনিস্ট পার্টি – সব দলের প্রতিনিধিরাই একযোগে ‘বাংলাভাগ’-এর পক্ষে স্বাক্ষর করেছিলেন। ইতিহাস সত্যিই বড় নির্মম! ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পরিবর্তে, পশ্চিম ভারতীয় আধিপত্যবাদী রাজনীতিবিদ আর শোষক বেনিয়াদের উৎপাত সহ্য করাই হয়ে উঠল পশ্চিমবাংলায় বসবাসকারী বাঙালিদের ভবিতব্য!
‘পশ্চিমবাংলার জন্মদিন’ আসলে বাঙালি জাতির ‘নয়া-পরাধীনতা’ দিবস। ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতির পক্ষে পুঞ্জিভূত যন্ত্রণা ও ঘৃণাকে বুকে নিয়ে, মহত্তম আশা ও স্বপ্নকে ছিনিয়ে আনার প্রতিজ্ঞা গ্রহণের দিন। ‘গণতান্ত্রিক পথ’এ শুধুমাত্র ‘শাসক’ বদলের অনন্ত গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেতে থাকলে, বাঙালি শ্রমজীবীদের মুক্তি অনন্তকালেও আসবে না। তাঁরাই তো বাঙালি সমাজের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। তাঁদের জীবনযন্ত্রণাই বাঙালি সমাজের আয়না। ইতিহাস-বিকৃত ‘তথ্য’, কিম্বা ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি’র দোহাই – কোনও কিছুই বাঙালি সমাজকে সমস্যামুক্তির পথ দেখাতে পারবে না। একথা নিশ্চিত।
বাংলায় বসবাসকারী সকল শ্রমজীবী মানুষকে এক করে, বাঙালি সমাজ যদি আগামি দিনের ‘শোষণমুক্ত’ এবং মর্যাদাপূর্ণ ‘বাংলা’ গঠনের লক্ষ্যে এগোতে পারেন, তাহলেই কাম্য লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব।