বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[শিল্প]
আমার বাবার পদবী বন্দ্যোপাধ্যায়, আর আমাদের আদি বাড়ি ছিল হুগলি কৃষ্ণনগরে। ছেলেবেলায় শুনতাম, রামমোহন রায় নাকি কী এক সূত্রে আমাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন। তাঁরও তো পারিবারিক পদবী বন্দ্যোপাধ্যায়, বাস হুগলির রাধানগরে। তখন তা শুনে ভারী পুলকিত হতাম। পড়ার বইয়ে যাঁর ছবি, যাঁর নামের আগে রয়েছে ‘রাজা,’ তাঁর সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক রয়েছে, এ কি কম কথা? কথাটা অবশ্য শোনা কথাই হয়ে রয়ে গিয়েছে, তথ্যের কষ্টিপাথরে পরখ করার চেষ্টা কেউ কখনও করেনি, আর এখন তো বাবা-কাকাদের সেই তর্পণের কাগজটা পর্যন্ত হারিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাতে কী? জিনের সম্পর্ক থাকুক আর না থাকুক, আত্মার সম্পর্কে তিনি আমার পূর্বপুরুষ। কালের ব্যবধান যাঁদের সঙ্গে কম, এমনকি যাঁরা সমসাময়িক, তাঁদের অনেকের থেকেও অনেক কাছের সম্পর্ক আমার, রামমোহন রায়ের সঙ্গে। দু’শো বছর আগে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যে ‘আত্মীয়সভা,’ আমিও কি তার এক কোণে জায়গা পেতে পারি না? তিনি বাংলার প্রতিটি মেয়ের আত্মীয়, আর মেয়ে সাংবাদিকদের তো পরমাত্মীয়, কারণ সংবাদের স্বাধীনতাকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন মেয়েদের জীবনের অধিকার, মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার পক্ষে সওয়াল করতে। সে দিন তাঁর মতো কথা বলার সাহস কেউ করেনি, আজই বা ক’জন করে?
অবশ্য আজকের সাংবাদিক রামমোহনের সভার সদস্যপদ পাওয়ার যোগ্য কিনা, সে-ও একটা প্রশ্ন। সাংবাদিকতার যে আদর্শের কথা তিনি বলেছিলেন, নিজে করে দেখিয়েছিলেন, তার কাছাকাছি কি আসতে পেরেছে ভারতের সাংবাদিকতার জগত? আজ সংবাদের স্বাধীনতার সূচকে ভারতের স্থান ১৮২টি দেশের মধ্যে ১৫০, মিডিয়ার একটা বড় অংশ সরকারের প্রতি আনুগত্যের শর্তে টিকে আছে। ঔপনিবেশিক শাসনে বাস করেও সেই সব শর্ত স্বীকার করেননি রামমোহন। বরং তাঁর কাগজগুলি সক্কলকে চটিয়ে দিয়েছিল। তাঁর ‘সম্বাদ কৌমুদী’ লাগাতার সতীদাহের বিরোধিতা করে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের চক্ষুশূল হয়েছিল, এ কথা মোটামুটি জানা আছে। কিন্তু তারও আগে রামমোহন চটিয়েছিলেন খ্রিস্টানদের, ‘হোলি ট্রিনিটি’-র ধারণাকে আক্রমণ করে। তাঁর ‘দ্য ব্রাহ্মনিক্যাল ম্যাগাজ়িন’ বা ‘ব্রাহ্মণ সেবধি’ ১৮২১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম বের হয়, সম্বাদ কৌমুদীরও আগে (প্রথম প্রকাশ ডিসেম্বর, ১৮২১)। ব্রাহ্মণ সেবধির মাত্র তিনটে সংখ্যা বের হয়েছিল, কিন্তু অগ্নিবর্ষী উল্কার মতো ছিল কাগজটি, লিখেছেন রেভারেন্ড জেমস লঙ। ওই কাগজে রামমোহন ‘দ্য হোলি ট্রিনিটি’ বা ত্রিতত্ত্ববাদকে খারিজ করে বেদান্তের একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হিন্দুধর্মকে খাটো করে দেখানো অন্যায়, লোভ দেখিয়ে দরিদ্র মানুষকে ধর্মান্তরিত করা অনুচিত, এ কথাগুলো ঝলসে উঠেছে তাঁর কলমে। অন্য দিকে, ইসলাম ধর্মে তাঁর গভীর পাণ্ডিত্য এবং অনুরাগের কথা সবাই জানতেন, তবু তাঁর ক্ষুরধার যুক্তিবাদ সনাতনপন্থী মুসলিমদের খুশি করতে পারেনি। ‘সম্বাদ কৌমুদী’ সতীদাহ প্রথাকেই কেবল খারিজ করেনি, বহুবিবাহ প্রথার নিন্দা করেছে, দুর্দশাগ্রস্ত বিধবাদের জন্য একটি তহবিল গঠনের আবেদন করেছে সকলের কাছে। এর বিপরীতে রাখতে হবে আজকের সংবাদ তথা সাহিত্যের জগৎকে, যেখানে পণপ্রথার বিরুদ্ধে যুক্তি, ধিক্কার, কান পেতেও শোনা কঠিন। পণের জন্য মেয়েদের নির্যাতন বা হত্যাকে অন্য যে কোনও ফৌজদারি অপরাধের সঙ্গে সমান করে দেখা হচ্ছে।
রাজনৈতিক মতবাদ প্রকাশেও রামমোহন ছিলেন তেমনই আপসহীন। আয়ারল্যান্ডের চাষিদের উপর ইংরেজ অভিজাতশ্রেণীর অত্যাচারের কথা তিনি স্পষ্ট লিখেছিলেন তাঁর ফার্সি কাগজ ‘মিরাৎ উল আখবর’-এ, একটুও রাখঢাক করেননি। সেই সময়ে ওই কাগজের সব লেখার ইংরেজি অনুবাদ বেরোত ‘ক্যালকাটা জার্নাল’ কাগজে। সেখানে মেলে রামমোহনের কলমের আঘাত, “ইংল্যান্ডের রাজারা ন্যায়ের প্রতি চোখ বন্ধ করে নিজেদের পরজীবীদের মধ্যে আইরিশ অভিজাতদের জমিগুলো বিলিয়ে দিচ্ছেন।” এই অভিজাত শ্রেণী আয়ারল্যান্ড থেকে প্রাপ্ত টাকা সেখানে খরচ না করে ইংল্যান্ডে বিলাসব্যসনে খরচ করছেন, আর কেবলই দরিদ্র আইরিশ কৃষকদের খাজনা বাড়িয়ে চলেছেন, লিখছেন রামমোহন। উপনিবেশে বাস করে প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাকে এমন আক্রমণ করেছিলেন তিনি। ক্ষমতাসীনের প্রতি সাংবাদিকের এই চ্যালেঞ্জ আজও বিরল।
রামমোহন ভারতীয় সংবাদপত্রের প্রাণপুরুষ, ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং সমাজ সংস্কারের লক্ষ্যে জনমত গঠনের জন্য তিনিই সংবাদপত্রকে পরিকল্পিত ভাবে ব্যবহার করেন। সংবাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধেরও তিনি পথিকৃৎ। ১৮২৩ সালে ব্রিটিশরা ‘কালা কানুন’ তৈরি করল — হুকুম হল, সংবাদপত্র বার করতে হল প্রকাশক, সম্পাদক ও মুদ্রককে সরকারের কাছে হলফনামা দাখিল করে লাইসেন্স নিতে হবে। প্রতিবাদে করে রামমোহন ‘মিরাৎ উল আখবর’ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ৪ এপ্রিল, ১৮২৩, কাগজের শেষ সংখ্যায় হাফিজের একটি কবিতা উদ্ধৃত করলেন রামমোহন — “হৃদয়ের শতবিন্দু রক্তক্ষয়ের বিনিময়ে যে সম্মান অর্জন করেছ, রাষ্ট্রের অনুগ্রহের আশায় তা বিক্রি কোরো না।” আজকের ‘গোদি মিডিয়া’-র কানে এ মন্ত্র কে দিতে পারে? এক দিকে সাংবাদিকরা রক্ত ঝরিয়ে যাচ্ছে — কেবল ২০২১ সালেই সারা বিশ্বে ৪৬ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে চারজন ভারতীয়। অন্য দিকে সারা বিশ্বেই বড় বড় সংবাদ সংস্থাগুলি ক্রমশ সরকারের প্রতি আনুগত্যের দিকে ঝুঁকছে। সেগুলির মালিকানা স্বাধীনচেতা, চিন্তাশীল, সংস্কারমনস্ক ব্যক্তিদের হাত থেকে সরে চলে যাচ্ছে বৃহৎ বাণিজ্যিক সংস্থার হাতে।
তবে স্বাধীনচেতা সংবাদসংস্থার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রশক্তির আঘাত শুরু হয়ে গিয়েছিল একেবারে গোড়ায়। ভারত তথা এশিয়ার প্রথম সংবাদপত্র, জেমস অগস্টাস হিকি প্রকাশিত ‘বেঙ্গল গেজেট’ (১৭৮0) সালে শুরু হয়েছিল। কাগজ চলেছিল দু’বছর, আর ওয়ারেন হেস্টিংসের মানহানির দায়ে হিকি জেল খেটেছিলেন তিন বছর। হিকির এক সহযোগী শুরু করলেন ‘বেঙ্গল জার্নাল’, তা-ও তুলে দিল কোম্পানি। ‘দ্য ওয়ার্ল্ড’ কাগজের সম্পাদক উইলিয়াম ডুনেকে কর্নওয়ালিস সেপাই দিয়ে পাকড়ে জাহাজে তুলে দিলেন, ইংল্যান্ডে না পৌঁছনো পর্যন্ত কেবিনবন্দি করে রাখার নির্দেশ দিলেন জাহাজের ক্যাপটেনকে। এক বছরে (১৭৯৯) তিনজন সাংবাদিকের ‘ডিপোর্টেশন’ করেছিল কোম্পানির কর্তারা।
হিকি আমেরিকার স্বাধীনতার আন্দোলন সমর্থন করে লিখতেন, ডুনে জয়গান গাইতেন ফরাসি বিপ্লবের, রামমোহন রায় লিখলেন আয়ারল্যান্ডে ইংরেজদের দ্বিচারিতা নিয়ে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঘুষ-লোলুপতা নিয়ে ‘ক্যালকাটা জার্নাল’ রিপোর্ট ছাপতেই কর্তারা হুকুম দিলেন, সম্পাদক জেমস বাকিংহামকে ফিরতে হবে ইংল্যান্ডে। রামমোহন ইংল্যান্ডের রাজাকে, সুপ্রিম কোর্টকে চিঠি দিলেন এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। টাউন হলে ইংরেজ-নেটিভ সবাইকে নিয়ে সভা করলেন। সংবাদের স্বাধীনতার সওয়াল করে লিখলেন, স্বৈরাচারী শাসক স্বভাবতই বাকস্বাধীনতা দমন করতে চায়। কিন্তু সাম্রাজ্যের কোথায় কী ভ্রান্তি ঘটছে, তা শাসকের অগোচর থাকবে, যদি না ব্যক্তির মতপ্রকাশের বাধাহীন স্বাধীনতা থাকে। রামমোহন দাবি করলেন, সম্পাদকের ‘ডিপোর্টেশন’-এর আদেশ দিয়ে কোম্পানি বস্তুত নাগরিক অধিকারের লঙ্ঘন করেছে।
তাতে লাভ হল না, কিন্তু সংবাদের জন্য আদালতে লড়াইয়ের সেই শুরু হল। ২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্টে সাংবাদিকদের হয়ে আবেদন করেছেন ‘কাশ্মীর টাইমস’ কাগজের সম্পাদক অনুরাধা ভাসিন। টেলি-সংযোগ ছিন্নপ্রায় করে গোটা একটা রাজ্যকে দীর্ঘ দিন সংবাদ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল ভারত সরকার। এ বছর অনুরাধা এবং মেঘালয়ের ‘শিলং টাইমস’ কাগজের সম্পাদক প্যাট্রিশিয়া মুখিম রাজদ্রোহিতা আইন বাতিল করার অনুরোধ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন, কারণ বারবার সাংবাদিকদের কারারুদ্ধ করা হচ্ছে, অযথা হয়রানি করা হচ্ছে ব্রিটিশ যুগের এই আইন প্রয়োগ করে। আপাতত সে আইন প্রয়োগ করাকে স্থগিত করেছে আদালত। কিন্তু এ কথা এক মুহূর্তের জন্যও বিস্মরণ হওয়া চলে না যে নারী মর্যাদা এবং সংবাদ স্বাধীনতার পথিকৃৎ রামমোহন রায়ের আড়াইশোতম জন্মবর্ষে এক সাংবাদিক জেলবন্দি হয়ে রয়েছেন, কারণ একটি মেয়ের উপর নির্মম নির্যাতন ও হত্যার উপর খবর করতে চেয়েছিলেন তিনি। ধর্ষণ, হত্যা ও বলপ্রয়োগে দাহ শুধু পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কীর্তি নয়, আজ এ কাজ করা হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহায়তায়। ঔপনিবেশিক ভারতের চাইতেও কি তবে স্বাধীন ভারত মেয়েদের প্রতি নিষ্ঠুর? হাথরাসে পৌঁছনোর আগে, একটাও রিপোর্ট লেখার আগে, গ্রেফতার করা হয়েছিল সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানকে। তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছে রাজদ্রোহের এবং সন্ত্রাসবাদের ধারায়। এটা স্বাধীন ভারতের লজ্জা। সিদ্দিকের হয়ে কথা বলার তেমন লোক যে পাওয়া যাচ্ছে না, এমন কি সাংবাদিকদের মধ্যেও অনেকে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খোলার দায় এড়িয়ে চলছেন, তা মনে করিয়ে দেয় রামমোহন রায় কী অসীম আত্মপ্রত্যয়ের অধিকারী ছিলেন। তিনি নির্বাসিত সম্পাদকের পক্ষে নাগরিক সমাজের জনমত গঠন করতে চেয়ে একাকী এক মহাশক্তিধর বাণিজ্যিক তথা রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন একই সঙ্গে সমাজের পচা-গলা সংস্কারগুলিকে বর্জন করতে চেয়ে রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন সর্বশক্তিতে। ভারতে মানবাধিকার, নারী অধিকারের আন্দোলনের তিনিই পথিকৃৎ। এ সব যুদ্ধের কোনওটির সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত স্বার্থের বিন্দুমাত্র সংযোগ ছিল না, বরং সব দিক থেকে আহত, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। আজকের স্বার্থসর্বস্ব, নির্লজ্জ রাজনীতির সামনে দাঁড়িয়ে এই কথাটাও কম আশ্চর্য করে না।
এই জন্যই হয়তো রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মহাত্মা গান্ধীর মতো মানুষেরা কালের নিরিখে যত দূরে যাচ্ছেন, তত যেন আরও কাছের মানুষ হয়ে উঠেছেন। আমরা অনুভব করছি, তাঁরা আমাদের অতীত নন, আমাদের নিতান্ত সমসাময়িক। অন্যায় প্রতিহত করার জন্য, নিপীড়িতের মর্যাদার জন্য, মননশীল ও সংবেদী সমাজ তৈরির জন্য যে লড়াই তাঁরা শুরু করেছিলেন, আজও সেই যুদ্ধ চলেছে আমাদের আশেপাশে। প্রবলের আধিপত্যের বাসনার বিরুদ্ধে ব্যক্তির মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই, ধর্ম-জাতের দোহাই দিয়ে লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে বুদ্ধিদীপ্ত, প্রেমময়, সাম্যময় মানবধর্ম প্রতিষ্ঠার লড়াই এখনও তেমনই তীব্র, অকরুণ। প্রতিটি নৈতিক, রাজনৈতিক সংকটে রামমোহনের দিকে আমরা তাকাই, যে ভাবে মানুষ চেয়ে দেখে প্রিয় বন্ধু, প্রিয় শিক্ষকের মুখপানে — দিকনির্দেশের জন্য, আশ্বাসের জন্য, সাহস আর সান্ত্বনার জন্য। তাঁদের কথা, তাঁদের কাজ, পরমাত্মীয়ের স্পর্শের মতো আমাদের ঘিরে থাকে।