বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[শিল্প]
মধু’র পোষাকি পরিচয় ছিল সাংবাদিক বিশ্বজিৎ রায়। দাপুটে রাজনৈতিক সংবাদদাতা। কখনও হয়তো আজকাল, কখনও আনন্দবাজার পত্রিকা, কখনও দ্য টেলিগ্রাফ, কখনও আবার টাইমস অব ইন্ডিয়া। কর্মস্থল কখনও কলকাতায়, কখনও দিল্লীতে, কখনও গৌহাটি বা শিলং, বা অন্যত্র। কিন্তু যতদিন সাংবাদিকতার পেশায় ছিল, মালিকপক্ষের অন্যায় চাহিদা নিয়ে ঝামেলা বাধানো ছিল মধু’র স্বাভাবিক চরিত্র। কখনোই মাথা নত করেনি; নিজের শিরদাঁড়া টানটান রেখেছে। বহু ‘বিপ্লবী’ সাংবাদিক যে ব্যাপারে কুপোকাত! শেষমেশ আনন্দবাজার থেকে ওঁর চাকরি হারানোর এটাই ছিল প্রধান কারণ। রাজ্য বা ইউনিয়ন স্তরের এমন কোনও তাবড় রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল না, যাঁরা সাংবাদিক বিশ্বজিৎ রায়কে চিনতেন না।
অফিসের দেওয়া কাজে কোনওদিনই আটকে থাকতো না মধু। ভূপালে ইউনিয়ন কার্বাইডের দ্বারা সংগঠিত গণহত্যা; ছত্তিশগড়ে ধীরেশ (শঙ্কর) গুহনিয়োগীর নতুন ধারার শ্রমিক আন্দোলন; পশ্চিমবঙ্গে কানোরিয়া জুটমিলে শ্রমিকদের সাড়া জাগানো আন্দোলন; ইত্যাদি। সব জায়গাতেই মধু হাজির। দিনের পর দিন, কোথাও মাসের পর মাস। নিছক সাংবাদিক হিসাবেই শুধু না। সামাজিক দায়বদ্ধ কর্মী হিসাবে। মধু’র বেলেঘাটার বাড়িতে ওঁর ঘরে বসে, সারা দিন এবং সারা রাত জেগে আমরা দু’জনে লিখেছি “জীবনের জয়গান” — কানোরিয়া আন্দোলনের দলিল।
সাংবাদিক হবার ইচ্ছে মধু’র কখনও ছিল না। ওঁর অন্তরের তাগিদ ছিল সর্বক্ষণের কমিউনিস্ট কর্মী হবার। সেই লক্ষ্যে রাজনৈতিক উদ্যোগ, ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠিত করা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন, সব কাজেই মধু ছিল অন্যতম অগ্রণী। তবে সেই সবকিছুরই মূলে ছিল গভীর রাজনৈতিক অঙ্গীকার। কিন্তু কমিউনিস্ট রাজনীতির পরিমণ্ডলে সংকীর্ণতা, গ্রুপবাজি, মিথ্যাচার ইত্যাদির দাপটে মধু শেষপর্যন্ত রাজনীতিতে টিঁকতে পারেনি! জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মধু সেই যন্ত্রণা বয়ে বেড়িয়েছে।
সৎ, সহজ-সরল, জনদরদী, আবেগী মানুষ ছিল মধু। কোনও প্যাঁচপয়জার ওঁর ধাতে ছিল না। ওঁর ভাবনার জগৎ হয়তো অনেকটাই ছিল ইউটোপিয়ান। ফলে ঘরে-বাইরে নানারকম মানসিক আঘাত ছিল ওঁর নিত্যসঙ্গী। মধু’র চিন্তাভাবনায় হয়তো কিছু ফাঁক ছিল, কিন্তু মানুষটার মধ্যে বিন্দুমাত্র ফাঁকি ছিল না।
আমাকে ওঁর লেখা কিছু লাইন উদ্ধৃত করেই লেখা শেষ করা যাক। “আজ আমার বাড়ি ছাড়ার এক বছর পূর্ণ হল। ১০ দিন তোমার ও বৌদির সাহচর্য ও শুশ্রুষায় একটু সুস্থ হয়ে ২৩ অগাস্ট শান্তিনিকেতন এসে পৌঁছলাম। বাগানপাড়ায় তোমাদের বাড়িতে একটা মাস তোমার সঙ্গে কথা বলে, রবি ঠাকুরের গান শুনে আমার দগ্ধ স্নায়ুগুলো কিছুটা শান্ত হল। শঙ্কর সান্যাল ছাড়া রাজনৈতিক জীবনের আর কোনও বন্ধু-কাম দাদার উপরে এতটা নির্ভরশীল হইনি। হৃদয় ও মননের মেলবন্ধনে আত্মার আত্মীয়তা অনুভব করিনি। তোমার স্নেহ সেই অধিকারবোধ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। তুমি চলে যাওয়ার পর বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা অনেকগুলো অঝোর শ্রাবণ সন্ধ্যা একা একা কাটাবো তোমাদের ‘শেষ সপ্তক’-এর বারান্দায়। সাপের ভয় নিয়েই অন্ধকারে বসে থাকবো। আশেপাশের সাঁওতাল বাচ্চাগুলো সকালে পড়তে আসতে শুরু করবে। ওদের দাদু ডাকে আমার ঘুম ভাঙবে। ওদের পড়িয়ে আমার সকালগুলো ভরে উঠবে।”
“কয়েক মাস আশ্রয় এবং সাহচর্য দিয়ে নিজেকে একটু সামলাতে সাহায্য করার জন্য তোমাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা অপরিসীম। তুমি ও বৌদি যে concern দেখিয়েছ তার জন্য সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকব।”
“এখানে আমার কয়েকজন নানা বয়সের বন্ধু জুটেছে।
বেশিরভাগই স্কুল কলেজের তরুণ মাস্টার।”
“লাইব্রেরিতে সারাদিন কাটানোর সুযোগ না থাকলে আমার শান্তিনিকেতনে বেঁচে থাকা মুশকিল। লাইব্রেরিয়ান ডক্টর নিমাই চন্দ্র সাহার শ্রদ্ধা ভালবাসা অযাচিত ভাবে পেয়েছি, তার সঙ্গে অন্য কয়েকজন স্টাফের। এঁরা আমাকে নিজের মতো লেখাপড়া করার সুযোগ দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ এবং আদিবাসী সমাজ নিয়ে গবেষণার কাজ কিছুদূর এগিয়ে আটকে আছে। সাঁওতাল পল্লীগুলোতে ক্ষেত্র সমীক্ষার কাজে এগোতে পারিনি বলে। গরমে বেরোনো যেত না। বর্ষাতেও তাই। এখন শীতের অপেক্ষায় আছি।”
“বৃদ্ধাশ্রমই হয়তো আমার অগতির গতি! এই দুঃস্বপ্নের তাড়া খেতে খেতেই বছর পেরিয়ে গেল। এর ধারা বিবরণী তোমায় লিখলাম তুমি আমার আত্মার আত্মীয় বলেই। অনেকদিন পরে অনেক লিখে ফেললাম। ভাল থেকো।”
মধু, তোর মতো মানুষের যা প্রাপ্য – সেই ‘লাল সেলাম’ জানাই।