বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[শিল্প]

[শিল্প]

“পরিযায়ী কথা”— সময়ের দর্পণ

কবিতা রায়চৌধুরী

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ এপ্রিল, ২০২২— ‘পরিযায়ী’শব্দটি আমাদের অজানা ছিল না। শীতকালে শীতলতম দেশগুলো থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখিরা ভারতবর্ষের মত অপেক্ষাকৃত উষ্ণ দেশে উড়ে আসে সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিয়ে। কলকাতার আলিপুর চিড়িয়াখানার বিল ভরে যায় তাদের কলকাকলিতে। নাম না জানা এই পাখির ঝাঁক যোজন যোজন আাকাশপথ পাড়ি দেয় কেন? কেবলমাত্র একটু উষ্ণতা ডানায় মেখে নিতে, বেঁচে থাকার উত্তাপটুকু গায়ে জড়িয়ে নিতে। আমরা জানতাম, পাখিরাই পরিযায়ী হয়, উষ্ণতার অন্বেষণে তাদের যাত্রা দূর-দূরান্ত থেকে।

একবিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষের এক বিশাল সংখ্যার মানুষ ‘পরিযায়ী’ হয়ে উঠেছে জীবিকার অন্বেষণে। দেশের অর্থনীতির বেহাল অবস্থায়, বেকারি, উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাবে যখন শ্রমজীবী প্রান্তিক মানুষ সপরিবারে খেয়ে পরে জীবনযাপনের সুস্থ স্বাভাবিক পথটুকু খুঁজে পায় না, দু’বেলা দু’মুঠো অন্নের সংস্থান করা কঠিন হয়ে পড়ে, তারা দলেদলে বেরিয়ে পড়ে নিজের রাজ্য ছেড়ে দূরে অন্য রাজ্যে কাজের সন্ধানে। অপেক্ষাকৃত বেশি কাজের সুযোগ আছে যে সমস্ত রাজ্যে যেমন, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, কেরালা, তামিলনাডু বা পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের পথে তাদের যাত্রা। প্রধানত নির্মাণকাজে বা ক্ষেতে–খামারে, ছোট ছোট কল-কারখানায় নিজের রাজ্য থেকে কিছু বেশি পারিশ্রমিকের আশায়। পরিসংখ্যানহীন অসংগঠিত এই শ্রমিকশ্রেণীর খবর আমাদের অগোচরই ছিল। অতিমারির অভিঘাতে উন্মোচিত হল এই পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবনযুদ্ধের করুণ আখ্যান। অতিমারি এবং হঠাৎ ঘোষিত লকডাউনের ফলে বন্ধ হয়ে গেল কাজ। অসংগঠিত শ্রমিকদের একটা বড় অংশ বাধ্য হল কর্মস্থান ত্যাগ করে ঘরে ফেরার পথ ধরতে। ঘরে ফিরতে পারলে হয়ত দু’বেলা দু’মুঠো অন্নের সংস্থান করা যাবে, ভুখা মরতে হবে না। কিন্তু কীভাবে ফেরা যায় ভিন রাজ্য থেকে নিজ রাজ্যে? লকডাউনে সমস্ত যানবাহন নিয়ন্ত্রিত, বন্ধ। পায়ে হাঁটা পথ ধরলেন দলে দলে পরিযায়ী শ্রমিকেরা। কঠিন পথশ্রমে নির্বাপিত হল অসংখ্য প্রাণ। মারির অভিঘাত থেকে বাঁচতে চাওয়া মানুষগুলো ক্ষুধার তাড়নায়, পথশ্রমে, উপযুক্ত ট্রেন-বাসের অভাবে অনেকেই পথেই লুটিয়ে পড়লেন। রেলপথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অবসন্ন মানুষগুলো চলে গেলেন রেলের চাকার তলায়, চিরশান্তির দেশে। ছোট্ট জামলো থেকে শুরু করে অমৃত-ইয়াকুব, খুরশীদের মায়ের কথা আমরা জানতে পারলাম। একই সঙ্গে ধেয়ে এল ‘আমফান’। দরিদ্র মানুষের জীবন-জীবিকাকে তছনছ করে, তাদের প্রাণধারণের লড়াইকে পর্যুদস্ত করে হাজার হাজার মানুষকে গৃহহীন নিরন্ন করে তুলল এই ভীষণ ঝড়।

অতিমারি এবং ঝঞ্ঝা পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবনে যে ভয়াবহ বিপর্যয় এনে দিয়েছে তারই এক সার্বিক চিত্র নিখুঁতভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন সুতপা ভট্টাচার্য চক্রবর্তী তাঁর ‘পরিযায়ী কথা’ কাব্যগ্রন্থে। সুতপা আমাদের রাম-সীতার কথা শুনিয়েছেন। ‘এই রাম-সীতা বাল্মিকীর নয় আজকের’। কবিতার সমাপ্তিতে তিনি লিখছেন ‘গাঁ-ঘর-নিকোনো উঠোন সব ছেড়ে দিগন্তের পথে পা বাড়ানো সীতার সঙ্গে অথবা সর্বহারা রামের সঙ্গে কোনো বাল্মিকীর দেখা হয়েছিল কিনা জানা নেই। কিন্তু এই রামসীতারা আজ হোক কাল হোক ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্ম দেবে। দেবেই। সেই ভবিষ্যৎ কিন্তু একদিন না একদিন তার বাপমায়ের প্রতি সামাজিক অনাচারের হিসাব ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বুঝে নেবে।’ তাঁর রাম বলছে, ‘হামি রাম বুলছি বটেক/ উসব মন্দির টন্দির লাইগবে না হামার/ মুরে একঠো ঘর দাও, একটুখানি উঠান/ আর একটা ছোট্ট জানলা/ যিথায় ধুয়ার লগে স্বপন আইসে—’ পরিযায়ী শ্রমিকদের এক আশ্চর্য বন্ধুতার কথা লেখেন তিনি অমৃত-ইয়াকুব গাঁথায়— ‘পথ — পথই ওদের চিনিয়েছিল/সুরাট থেকে উত্তরপ্রদেশ/ কাপড়ের কারখানার কাজ হারিয়ে/ ঘরে ফিরছিল ওরা—/ কিন্তু ঘর কোথায়!/ পথের ক্লান্তি আর ধুলোমাখা দহন/ কেড়ে নিল প্রাণ, জান, মান— / ইয়াকুবের কোলে মাথা রেখেই/ অমৃতের পথযাত্রা—/ ধর্ম নয়, বর্ণ নয়, বন্ধুতা—’।

সুতপা এরই সঙ্গে সায়রাবানু, রুক্মিনী, পূণ্যলক্ষ্মীর মতো নারীদের ঘর ভেসে যাওয়ার, নিরন্ন দিনযাপনের ছবি এঁকেছেন আশ্চর্য দক্ষতায়। লিখেছেন ‘গরম ভাতের মঙ্গলকাব্য’ কবিতা। কবিতায় কবিতায় উঠে এসেছে মায়েদের কথা- ‘বিপ্লবী মা’-মায়েরা বিপ্লবী হয়েছে/ সভ্যতার সেই আদিম কাল থেকে/ কি যুদ্ধ, কি মহামারী/ মায়েদের লড়াইটা জারি থাকেই। উপেনের বৌ, দশরথের মেয়ে, দুর্গাবুড়ি সকলের কঠিন আত্মত্যাগ এবং জীবন সংগ্রামের বর্ণনা কবির বিবেকের দর্পণে প্রতিফলিত হয়ে আমাদের ভাবিত করে। তাঁর কবিতায় ‘সর্বহারার পদসঞ্চার’ আমরা শুনতে পাই। ‘মঞ্জু যাদব’ বা ‘জামলো মকদম’ কবিতায় নির্মম সত্য বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাটির প্রথম স্তবকে সুতপা লিখছেন—‘পাখিরা পরিযায়ী হয়/ মানুষ পরিযায়ী নয়’। একই কবিতার শেষ স্তবকে এসে তাঁর অনুভব পরিবর্তিত হয়, ‘পাখিরা পরিযায়ী হয়/ এবার মানুষও বাদ নয়’। কবির অনুভূতির সঙ্গে আমরাও সহমত না হয়ে পারি কি?

‘পরিযায়ী কথা’ কাব্যগ্রন্থটিতে সুতপা আমাদের আঠাশটি কবিতা উপহার দিয়েছেন। হৃদয় নিঙরানো বাস্তব অনুভূতির প্রতিফলন সেইসব কবিতা। সময়ের দর্পণে ফুটে ওঠা শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম ও হাহাকারের কাহিনী। উত্তরণের স্বপ্নও এঁকেছেন একইসঙ্গে। বিশিষ্ট সাহিত্যিক কপিল কৃষ্ণ ঠাকুরের লেখা মুখবন্ধ ‘কিছু কথা’ অত্যন্ত সুচারুভাবে কবি এবং কবিতাগুলির সঙ্গে পাঠকসমাজকে পরিচিত করে দেয়। কয়েকটি বানান ভুল চোখে পড়েছে। কাব্যের ব্যাকরণ অনুসারে, ছন্দের গতিপ্রকৃতির বিচারে কবিতাগুলি কতটা ঋদ্ধ তা পাঠকরাই নির্ধারণ করবেন। আমরা শুধু কবিকে ধন্যবাদ জানাই সময়োচিত এমন একটি কবিতা সংকলন আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য।

পরিযায়ী কথা
সুতপা ভট্টাচার্য চক্রবর্তী
প্রকাশক- শ্রীসুন্দরম প্রকাশণা
দাম- ৯৯.০০

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.