বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[শিল্প]

[শিল্প]

সলিল চৌধুরী : শতবর্ষে ফিরে দেখা

সিদ্ধার্থ সেন

photo

বাংলা তথা ভারতীয় সঙ্গীতের অন্যতম এক সাংস্কৃতিক উপহার সলিল চৌধুরীর জন্মশতবর্ষ পার হল গত বছরের শেষে। তিনি জন্মেছিলেন ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১৯ নভেম্বর দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার রাজপুর সোনারপুর অঞ্চলের মধ্যবর্তী গাজিপুরে আর শৈশব কাটে হরিনাভি অঞ্চলে। ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৫ তাঁর জীবনাবসানের সময় বয়স হয়েছিল তিয়াত্তর বছর। তাঁর জীবনকথার বিস্তৃত আলোচনার সুযোগ এই রচনায় সম্ভব নয় পত্রিকার পরিসরের কথা ভেবে। আগ্রহী পাঠকেরা তাঁদের চোখ রাখতে পারেন ‘জীবন উজ্জীবন’ নামে সলিলের অনবদ্য আত্মকথায় যেখানে তাঁর জীবনের প্রথম দিকের কয়েকটি অধ্যায় তিনি বর্ণনা করেছেন। আট ভাই বোনের মধ্যে মধ্যম সলিল ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় ভাল, পাশাপাশি অল্প বয়সেই জ্যাঠতুতো ভাই নিখিল চৌধুরীর কাছে নানা বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শিখেছেন। তাঁর বাবা জ্ঞানেন্দ্রনাথ ছিলেন অসমের চা-বাগানের ডাক্তার। ছুটিতে অসমে গেলে বাড়িতে গানের আসর বসত আর সেই আসরে কিশোর সলিল হারমোনিয়াম বাজিয়ে সেই সময়ের জনপ্রিয় সিনেমা ও রেকর্ডের গান — কৃষ্ণচন্দ্র দে, মৃণালকান্তি ঘোষ, কমলা ঝরিয়ার গান হুবহু নকল করে গাইতেন। বাবার সঙ্গীতপ্রীতি এবং মা বিভাবতী দেবীর সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ সলিলের মধ্যে উত্তরাধিকার সূত্রে বর্তেছিল।
শিল্পী হিসেবে সলিলের আবির্ভাবের ক্ষণটি গত শতকে সংগঠিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নানা ঘটনা সংঘাতে উথালপাথাল। ১৯৪১-৪২ থেকেই সলিল বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন, পরে বৃহত্তর গণআন্দোলনের সঙ্গেও। তখন বংশীবাদক হিসেবে তাঁর বেশ কিছু খ্যাতি জুটেছে। সম্ভবত ১৯৪৫ সালে রংপুরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র সম্মেলনে গায়ক হিসেবে তাঁর স্বীকৃতি জুটল, ডাক আসতে লাগল দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। গণসঙ্গীতে সুর ও কথার সম্মিলনে এক নতুন জোয়ার আনলেন তিনি। যেমন, আন্দামানে অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের যাবজ্জীবন কারাবাস থেকে মুক্তির দাবিতে কলকাতায় ছাত্র মিছিলের উপর পুলিশের লাঠিচার্জকে উপেক্ষা করে প্রতিবাদী মিছিলে সলিল সুরের আগুনে ভেলা ভাসালেন, ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে সেই জনতা’। একের পর এক সৃষ্টি হতে লাগল জনপ্রিয় সব গান— (১) ধন্য আমি জন্মেছি মা তোমার ধূলিতে, (২) আমার প্রতিবাদের ভাষা/ আমার প্রতিবাদের আগুন/ দ্বিগুণ জ্বলে যেন দারুণ প্রতিশোধে চূর্ণ (৩) হেই সামালো ধান হো, কাস্তেটা দাও শান হো ইত্যাদি। তখন কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-যুবক-মহিলা সব ফ্রন্ট মিলিয়ে জমাট বাঁধছিল তীব্র গণ-আন্দোলন। উদ্বাস্তুদের সংগ্রাম, কাকদ্বীপ-চন্দনপিঁড়ি-ডোঙাজোড়া-বড় কমলাপুর অঞ্চলে যে কৃষক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল সেইসবের নেপথ্যে তাঁর রচিত গণসঙ্গীতগুলি বিদ্রোহের বহ্নি সঞ্চারিত করেছিল। যেমন, ‘নাকের বদলে নরুন পেলুম টাক ডুমাডুম ডুম’ এর মতো গানে তীব্র শ্লেষে বিদ্রূপে তিনি ফালাফালা করে দেন সমাজের বৈষম্যের চেহারাটিকে। শুধু দেশ-ই নয়, বিশ্বের দিকেও সচেতন দৃষ্টি তাঁর। তাই বিশ্ব জুড়ে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে তাঁর প্রতিবাদী সত্তা গান বাঁধে: ‘আর যুদ্ধ নয় নয়/ আর ধ্বংস নয় নয়/ আর নয় মায়েদের শিশুদের কান্না/ রক্ত কি ধ্বংস কি যুদ্ধ আর না।’
১৯৫১ সালে বাবার মৃত্যু সলিলের জীবনে এক বিরাট সংকট হয়ে দেখা দিল। তখন তাঁর প্রিয় দলের সঙ্গেও খানিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর কথায় “… পার্টির সাংস্কৃতিক নীতি ও নেতৃত্ব সম্বন্ধে মোহমুক্তি ঘটছিল বেশ কিছু বছর ধরেই। বাবার মৃত্যু তাতে সিলমোহর লাগিয়ে দিল।” এখানে একটা কথা না বললেই নয় যে, দল থেকে দূরে চলে গেলেও কোনও দিন ভাবাদর্শ থেকে তিনি বিচ্যুত হননি। ১৯৫২ সালের মাঝামাঝি থেকে তিনি বোম্বাইয়ে (অধুনা মুম্বই) ডেরা বাঁধলেন। কিন্তু কলকাতার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিন্ন হল না। এর আগে ১৯৪৯ সালে তিনি প্রথম সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে তিনি কাজ করেছিলেন ‘পরিবর্তন’ ছায়াছবিতে। এছাড়া ‘বরযাত্রী’ (১৯৫১) ও ‘পাশের বাড়ি’ (১৯৫২)-র মতো চলচ্চিত্রে। পরবর্তী কালে অনেক বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে তিনি সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সেইগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘দো বিঘা জমিন’ (১৯৫৩), ‘মধুমতী’ (১৯৫৮), ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ (১৯৫৯), ‘গঙ্গা’ (১৯৬০), ‘কাবুলিওয়ালা’ (১৯৬১), ‘হাফ টিকিট’ (১৯৬২), ‘লাল পাথর’ (১৯৬৪), ‘চেম্মিন’ (১৯৬৫), ‘আনন্দ’ (১৯৭০) প্রভৃতি। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় বাংলা, হিন্দি সহ তামিল, তেলেগু, কন্নড়, মালয়ালম, গুজরাতি প্রভৃতি চৌদ্দটি ভাষার ছবিতে তিনি সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। শুধু মালয়ালি ভাষাতেই পঁচিশটি ছবিতে সুর করেছেন তিনি। তার সুর করা কয়েকটি উল্লেখ করা যেতে পারে— ‘গঙ্গা আয়ে কঁহা সে’ (হেমন্তকুমার/ কাবুলিওয়ালা), ‘ছোটা সা ঘর হোগা’ (কিশোরকুমার ও ঊষা মঙ্গেশকর/ নৌকরি), ’কঁহি দূর যব দিন ঢল যায়ে’ (মুকেশ/ আনন্দ), ‘এই দুনিয়ায় ভাই’ (মান্না দে/একদিন রাত্রে), ‘বাজে গো বীণা’ (মান্না দে/ মর্জিনা আবদাল্লা) ইত্যাদি। মুম্বইয়ে সলিল নিজের প্রতিভার জোরে সকলের সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছিলেন। তাঁর প্রয়াণের পর বিখ্যাত সুরকার নৌশাদ বলেছিলেন: ‘One of the seven notes of music has been lost.’ গানের জগতে সলিল এসেছিলেন সরস্বতীর সাক্ষাৎ বরপুত্র হয়ে। বাংলা অনেক কবিতায় তিনি কালজয়ী সুরসৃষ্টি করেছেন। যেমন, মধুসূদন দত্তের ‘রেখো মা দাসেরে মনে’ ও ‘আশার ছলনে ভুলি’ (দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়), সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘রাণার’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে’ (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়), সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘পাল্কির গান’ (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়), বিমলচন্দ্র ঘোষের ‘উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা’ (সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়)। পাশাপাশি বাংলা গানের বিশিষ্ট শ্রোতাদের মনে পড়তে পারে রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গান ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’কে মনে রেখে সলিলের অনবদ্য সৃষ্টি ‘সেই মেয়ে’ (সুচিত্রা মিত্র)-র মতো গানটির কথা। গানের মুড অনুযায়ী সঠিক গায়ক-গায়িকাদের নির্বাচনে সুরকার ও গীতিকার হিসেবে এক আশ্চর্য দক্ষতার প্রমাণ তিনি বারবার রেখেছেন। তাঁর সব সৃষ্টি-ই মানুষকে ভালবেসে। বাংলা গানের গতানুগতিক স্রোতে তিনি এনেছেন ব্যঙ্গ, শানিত কথা ও বিভিন্ন সুরের বৈচিত্র্যে নানা স্বাদের গানের ডালি। তাঁর অজস্র সৃষ্টির জগতে প্রবেশ করলেই তা উপলব্ধি করা যায়। এই ব্যঙ্গাত্মক অভিব্যক্তি তাঁর কলমে সহজাত
বৈশিষ্ট্যের একটি। মনে রাখতে হবে তিনি একজন স্বভাবকবি, ছড়াকার, গল্পকার, প্রাবন্ধিক। রসিক শ্রোতাদের অনেকেই হয়তো তাঁর লেখা বিখ্যাত রচনা ‘কানকাটার ছড়া’ রচনাটির পাঠ রেকর্ডে তাঁর স্বকন্ঠে শুনেছেন। সেই ছড়ার শেষাংশে আছে: ‘তখনও দেশ হয়নি স্বাধীন মন্ত্রী ছিলেন ডানকান/ একবার কানপুরে এলেন কিনতে তার বাঁ কান/ একানড়ে বললে দেখুন সময় দিতে হবে/ মন্ত্রীর কান আনতে গেলে দিল্লী যেতে হবে।’ কিন্তু ছ’ দিন পরে বিফল মনোরথ একানড়ে ‘বল্লে কেঁদে নিন ফিরিয়ে অ্যাডভান্স টাকাটা/ দিল্লী গিয়ে দেখি ওদের সবার দু’কান কাটা।’ সময় বদলেছে রাজনীতির নামে যাঁরা নানা সাংবিধানিক পদ আঁকড়ে দীর্ঘকাল বসে আছেন তাঁদের বেশির ভাগই দু’ কান কাটা। ‘ড্রেসিং টেবিল’, ‘গুণময় গুঁইয়ের জীবনচরিত’এর মতো গল্প, ‘অরুণোদয়ের পথে’র মতো নাটক, ‘সুর সৃষ্টি সম্পর্কে’, ‘আধুনিক ভারতীয় সঙ্গীতে বিবর্তন’ ইত্যাদি রচনা এখনো স্তব্ধ করে রাখে! তাঁর সব ধরনের লেখার মধ্যেই এক অসাধারণ স্বতঃস্ফূর্ততা লক্ষ্য করা যায়, অনুভব করা যায় এক সৎ শিল্পচর্চার অঙ্গীকার। চলচ্চিত্রের আবহসঙ্গীতের ক্ষেত্রেও তাঁর বিশেষ ভাবনা ছিল।
আসলে সলিল চৌধুরীর মতো বহুমুখী এক প্রতিভা সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে কথা শেষ করা কঠিন। তাঁর গানের ভাষাতেই বলা যায় ‘আজ তবে এইটুকু থাক, বাকি কথা পরে হবে।’ তাঁর মতো সঙ্গীতবোধের এত বিস্ময়কর ব্যাপ্তি নিয়ে খুব কম বাঙালি সঙ্গীত পরিচালকই এসেছেন। তিনি চিরকালীন। রাগ-রাগিণী, লোকজ সুর তাঁর আগেও বাংলা গানে কিন্তু ব্যবহৃত হয়েছে কিন্তু তিনি অভিনবত্ব এনেছেন প্রয়োগ বা ট্রিটমেন্টে। তাই ‘সলিল সঙ্গীত’ শুধু একটি যুগ নয়, যুগাতীত। অফুরন্ত প্রাণশক্তি তাঁর সৃষ্টির উৎস।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.