বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[শিল্প]
কেন লেখ? সমরেশ বসুকে লীলা রায় এই প্রশ্ন করেছিলেন ৬০ এর দশকে।
কোনও কিছু না ভেবেই তড়িঘড়ি উত্তর দিতে গিয়ে সমরেশ বলেছিলেন, মানুষকে জানার জন্য।
নিজেকে জানবার জন্য নয় কেন? লীলা রায়ের পরের প্রশ্ন ভাবিয়েছিল সমরেশকে।
মানুষকে জানার পাশাপাশি সমরেশ নিজেকে জানার কাজে নিরলস থেকেছেন আমৃত্যু। প্রথম উপন্যাস ‘উত্তরঙ্গ’ থেকে শুরু করে ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধান’ সহ শতাধিক গল্প-উপন্যাস জুড়ে রয়েছে বিচিত্র ধরনের মানুষ এবং তার নানান অভিব্যাক্তি। মানুষের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসাই তাঁকে মানুষের কাছে নিয়ে গেছে। মানুষের বিপন্নতায় তিনি উৎকন্ঠিত হয়েছেন বারবার। রক্তাক্ত হয়েছেন গোপনে গোপনে। আসলে নিজের জীবনের সঙ্কটের মধ্য দিয়েই খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের বিপন্নতাকে তিনি আত্মীকৃত করার চেষ্টা করেছেন। সারা জীবন সমাজের ভাগ্যহীন নিপীড়িত মানুষের সঙ্গে বেঁধে বেঁধে থাকার অপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। যাপন এবং সাহিত্য কর্মের মাঝখানের ফারাককে বাড়তে দেননি সচেতন ভাবেই। যশ খ্যাতি তাঁকে মাটি ও মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছিয়েও তিনি নৈহাটি-জগদ্দল-শ্যামনগরের মানুষের কাছে সমরেশবাবু নয়, সমরেশদা হিসেবেই আদৃত ছিলেন। নৈহাটির যে বস্তি থেকে তাঁর সাহিত্য সাধনা শুরু, পরবর্তীতে সেই বস্তি ত্যাগ না করে সেখানেই গড়ে তুলেছিলেন সাধের বাড়ি। তাঁর অধিকাংশ রচনায় গঙ্গার উভয় পাড়ের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের সুখ দুঃখের কথা স্বতঃস্ফূর্তভাবে উঠে এসেছে। এই মানুষের অধিকাংশই শ্রমিক, কৃষক, মুটে, মজুর। তাদের হাসি-কান্না, স্বপ্ন-স্বাদ,বাঁচা-মরা, লড়াই সংগ্রামের কথা তাঁর মরমী কলমে এঁকেছেন কোনও রকম আতিশয্য ছাড়া। প্রান্তজনের জীবন কথা জীবন্ত করে তোলার দিক থেকে তিনি তারাশঙ্করের উত্তরসূরি। তারাশঙ্কর আমাদের চিনিয়েছিলেন নিম্নবর্গের মানুষ, জমি, মাটি। আর সমরেশ চিনিয়েছেন কলকারখানার শ্রমিক মজুর যারা জমি থেকে উৎখাত হয়ে মজুর হয়েছে। গ্রামীণ নিম্নবর্গের মানুষের ভারতবর্ষকে তারাশঙ্কর তাঁর সাহিত্যে তুলে এনেছেন। সমরেশ আঁকাড়া ভারতবর্ষের চেহারা তুলে এনেছেন তাঁর লেখায়। যাপনশৈলী আর শিল্পীশৈলীর একাকার হয়ে যাওয়ার বীজ সমরেশের বেড়ে ওঠার মধ্যে নিহিত ছিল।
সমরেশ বসুর পূর্বপুরুষ বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ পাড়ের শুভাঢ্যা গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। পিতামহ সেখান থেকে বিক্রমপুরের রাজানগর গিয়ে বসবাস শুরু করেন। এই গ্রামেই ১৯২৪ সালের ১১ ডিসেম্বর সমরেশ বসু জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা মোহিনীমোহন বসু। মা শৈবলিনী বসু। বাবা মা নাম দিয়েছিলেন সুরথ। ডাক নাম তড়বড়ি। চার ভাইবোনের মধ্যে সমরেশ ছিলেন সবার ছোট। ছোটবেলায় পড়াশোনায় মনোযোগ ছিল না মোটেই। তার উপর অত্যন্ত দুষ্ট। ভীষণ চঞ্চল এবং দামাল প্রকৃতির সুরথকে নিয়ে বাড়ির লোকজন তটস্থ হয়ে থাকতেন। তাই মোহিনীমোহন বাধ্য হয়ে ১২ বছরের ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন তার বড় দাদা মন্মথ বসুর কাছে। কিন্তু সেখানেও সমরেশ পড়াশোনায় মন বসাতে পারলেন না। নৈহাটি এসে দূরন্তপনা আরও গেল বেড়ে। এই সময় প্রাণের বন্ধু দেবশঙ্করের স্বামী বিচ্ছিন্না বড়দিদি গৌরি বসুর সঙ্গে পরিচয় হয়। পরিচয় প্রণয়ে পরিণত হয় অচিরেই। প্রণয় থেকে পরিণয়। বয়সে চার বছরের বড় গৌরি বসুকে বিয়ে করে বেকার সমরেশ জগদ্দল এবং শ্যামনগরের মাঝে অবস্থিত আতপুরের বস্তিতে দেড় কামরার ভাড়া বাড়িতে সংসার পাতলেন। সংসার তো পাতলেন। কিন্তু চলবে কিভাবে! সমরেশ তখন পুরোপুরি বেকার। মুরগির ডিমের ঝাঁকা মাথায় নিয়ে সাহেব-বাবুদের দোরে দোরে ফেরি করে কিছুটা উপর্জন হতো। আবার কখনও সবজির বোঝা মাথায় নিয়ে সবজি বিক্রি করেছেন। স্ত্রী গৌরীর গানের গলা ছিল খুব ভাল। গানের টিউশনি করে কিছু পয়সা আসত সংসারে। কোনও রকমে চলতে লাগল সংসার। তিনি এক জায়গায় লিখেছেন, “সপ্তাহে তিনচার দিন আমাদের দু’ জনের খাওয়া জুটত।” এই সময় আলাপ হল শ্রমিক নেতা সত্যপ্রসন্ন দাশগুপ্তের সঙ্গে। জগদ্দল এলাকায় যিনি সত্য মাস্টার নামে পরিচিত। তাঁর কাছেই সাম্যবাদে দীক্ষিত হলেন সমরেশ। হয়ে উঠলেন পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী। চোখে তখন যৌথ পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন। দেওয়ালে ছবি এেঁকে, স্লোগান লিখে সেই স্বপ্ন পূরণে মসগুল ছিলেন তিনি। কখনও আবার স্ট্রিট কর্নারে গলা ফাটিয়ে গাইছেন, “হাম ভুখ সে লড়নেওয়ালে /ক্যা হাম মওত যে ডরনেওয়ালে/ আজাদি কো
ডঙ্কা বাজাও।” নিয়মিত পার্টির ক্লাস আর মিটিংয়ে অংশ গ্রহণ করার সুবাদে সমরেশ জেনে গেছেন পৃথিবীতে মাত্র দুটো শ্রেণী — শোষক আর শোষিত। আর যারা ধর্মীয় বিভাজন করে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে তারা মানবতার শত্রু। এদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। মানবতার স্বার্থে কলমকে শাণিত করতে হবে। এই ভাবনায় জারিত হয়ে সৃষ্টি হল ‘আদাব’। ১৯৪৪ এ পরিচয় পত্রিকায় প্রকাশিত সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী এই গল্প দিয়েই বাংলা সাহিত্যে সমরেশের আত্মপ্রকাশ।
তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। এদেশে তৈরি অস্ত্র যুদ্ধের চাহিদা মেটাচ্ছে। আঁকায় দক্ষ সমরেশ ইছাপুর বন্দুক কারখানায় চাকরি পেয়ে গেলেন। সংসারের অভাব কিছুটা ঘুচল। রাজনীতির সঙ্গে সংযোগ আরো বাড়ল। কমিউনিস্ট আন্দোলনে সরাসরি জড়িয়ে পড়লেন। ১৯৪৪ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি পার্টির সক্রিয় কর্মী ছিলেন। উত্তর চব্বিশ পরগণার শ্রমিক অধ্যুষিত নৈহাটি-আতপুর অঞ্চলে তিনি পার্টির কাজে নিযুক্ত ছিলেন। এই সময় পর্ব সমরেশের জীবন ও সাহিত্যে গভীর প্রভাব ফেলে। পরবর্তীকালে ‘প্রসঙ্গ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (অখন্ড) ও আমি’ গ্রন্থে লিখেছেন, “কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসার পরেই আমার চারপাশের জগত ও মানুষ সম্পর্কে দৃষ্টি সজাগ হয়। আমার অভিজ্ঞতার প্রসার ঘটে।” শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে কাজ করতে করতে যে অভিজ্ঞতায় তিনি ঋদ্ধ হয়েছিলেন, তা তাঁর সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে। কমিউনিস্ট কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো সমরেশ বসুও শ্রমিকজীবনের অন্তরঙ্গ অভিজ্ঞতা অর্জন করে শ্রমজীবী মানুষের কথাকার হয়ে উঠেছেন।
১৯৪৬ সাল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রক্তাক্ত কলকাতা। হিন্দু-মুসলমান রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জর্জরিত। ঘোলা জলে মাছ ধরার জন্য এই সময় মুসলিম লিগ ঘোষণা করে ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’। জাতিদাঙ্গার এই বীভৎসতা সমরেশের মনে গভীর রেখাপাত করে। তার ফলস্বরূপ সমরেশ ‘আবাদ’ লেখেন। দু’ জন শ্রমজীবী মানুষের গল্প। একজন সুতোকলের হিন্দু মজুর। অন্যজন মুসলিম মাঝি। ভয়াবহ এক দাঙ্গার রাতে তারা আস্তাকুঁড়ে আবর্জনা ফেলার টবের দু’পাশে আশ্রয় নিয়েছে। আতঙ্কিত। সন্ত্রস্ত। অসহায়। ভয়, সংশয়, পারস্পরিক সন্দেহ কাটিয়ে দু’ জনের মধ্যে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। বুড়ি গঙ্গা সাঁতার দিয়ে ওপারে ফিরতে চায় মাঝি। কারণ রাত পোহালেই ঈদের পরব। নতুন পোশাক বউ সন্তানের কাছে পৌঁছে দিতে চায়। একা থাকার ভয়ে সুতো কলের শ্রমিক তাকে আটকাতে চায়। কিন্তু মাঝি তার নিষেধ মানে না। সে উঠে দাঁড়ায়। আবাদ জানায়। মজুরও পাল্টা আবাদ জানায়। মাঝি বেরিয়ে যায়। একটু পরেই ভারী বুটের আওয়াজ এবং বন্দুকের শব্দ শোনা যায়। গল্প শেষ হয় “সুতা-মজুরের বিহ্বল চোখে ভেসে উঠল মাঝির বুকের রক্তে তার পোলা-মাইয়ার, তার বিবির জামা, শাড়ি রাঙা হয়ে উঠেছে।”
১৯৫০ সাল। যুগ-সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ভারতীয় সমাজ। সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে জন্ম নিচ্ছে বুর্জোয়া যুগ। কৃষি নির্ভর গোষ্ঠীবদ্ধ গ্রামীণ জীবন দখল নিচ্ছে যন্ত্র সভ্যতা। পাল্টে যাচ্ছে গ্রামের কৃষি ও হস্তশিল্প নির্ভর অর্থনীতিতে। এই প্রেক্ষিতে সমরেশ লেখেন ‘উত্তরঙ্গ’। বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের শ্রমজীবী মানুষের রক্ত ঘাম মিশে আছে এই উপন্যাসের পরতে পরতে। সাহিত্য সমালোচক শ্রীসনৎ বসু লিখেছেন, “যে চাষী জমি হারিয়ে তার সমাজ জীবনের ঐতিহ্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে এগিয়ে যেতে বাধ্য হল চটকলে কাজ করার জন্য, যে তাঁতী তার বংশগত জীবিকার প্রাণ তাঁত উঠিয়ে... ভিন গাঁয়ের পথ ধরতে পা বাড়াল”, সেইসব মানুষের জীবন চিত্র তুলে ধরে সমরেশ যুগজীবনের জীবন্ত ছবি এঁকেছেন। মুখ্যত শিল্পশ্রমিকদের জীবন সংগ্রাম নিয়ে ১৯৫২ সালে লেখেন ‘বিটি রোডের ধারে।’ চটকল শ্রমিক, মিল শ্রমিক, ভবঘুরে, ম্যাজিকওয়ালা পাঁচ রকমের কাজ করে দিন গুজরান করা নানান ভাষাভাষীর মানুষ বসবাস করে বিটি রোডের ধরে নয়া সড়কের পাশ ঘেঁষে গড়ে ওঠা শ্রমিক বস্তিতে। ঔপন্যাসিকের কথায়, “সারা বাংলার বৃহত্তর শিল্পকেন্দ্র এই রাস্তা।গঙ্গার তীরে তীরে, রেল লাইনের ধারে ধারে অসংখ্য কারখানা ইমারৎ। তারই ছত্রছায়ায় আবর্জনা স্তূপের মতো বস্তি”। এই বস্তির অধিকাংশ বাসিন্দা কারখানার শ্রমিক। অথচ কারখানা জীবন এই উপন্যাসে মুখ্য হয়ে ওঠেনি। শোষক-শোষিতের সমাজ সম্পর্কের ছবিটি এই উপন্যাসে আঁকার সুযোগ থাকলেও সমরেশ সে সুযোগ কাজে লাগান নি। এছাড়া ‘গঙ্গা’, ‘টানাপোড়েন’, ‘বাথান’, ‘দুই অরণ্য’, ‘পদক্ষেপ’, ‘ছিন্নবাধা’ উপন্যাসে শ্রমিক ও গ্রামীণ জীবনের চিত্র ফুটে উঠেছে।