বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[শিল্প]

[শিল্প]

দুর্ভাগ্য এটাই শ্রেণী ও দলিত রাজনীতির দুই ধারা এখনো হাত ধরল না

সন্তোষ রাণা

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ অক্টোবর, ২০২১— পুঁজিবাদী সমাজে যেহেতু পণ্য উৎপাদনই প্রাধান্য পায় তাই সামাজিক পণ্যগুলি অন্যরূপ গ্রহণ করে। এই সমাজে শ্রমশক্তিও পণ্য এবং পুঁজির সঙ্গে বিনিময়ে সে বেঁচে থাকে। এই পুঁজিবাদী সমাজের বৈশিষ্ট্য সব দেশে মোটামুটি একরকম।

প্রাক পুঁজিবাদী সমাজে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় উৎপাদনের ধরন, শোষণের রূপ, উদ্বৃত্ত কেড়ে নেওয়ার প্রকৃতি – একরকম ছিল না। উৎপাদনের চরিত্র দ্বান্দ্বিক হলেও উৎপাদন সম্পর্কগুলো ছিল স্থানিক। ইউরোপ-আরব-ভারতে সেই সমাজ ছিল এক এক রকম। প্রাক পুঁজিবাদী সমাজ ভিন্ন ভিন্ন দেশে ছিল ভিন্ন ভিন্ন রকম। তাই কেবলই উৎপাদনের মালিকানা আর মালিকানাহীনতা — এটা দিয়ে এই সমাজের শ্রেণী শোষণ বোঝার চেষ্টা করলে ভুল হবে। এটা পুঁজিবাদী সমাজে হয়ে থাকে। কিন্তু ভারতে প্রাক-পুঁজিবাদী সমাজের বিশিষ্ট হল, শ্রেণী প্রক্রিয়ার ধরনে মালিকানার প্রশ্নটা প্রধান নয়। সেই সময়ে শ্রেণীর চরিত্রটাও পরিষ্কার ছিল না।

হরপ্পা সভ্যতা কয়েকশো বছরে ধ্বংস হয়। লোকেরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এক অর্ধ–বর্বর পশুচারক জাতি উত্তরপূর্ব দিক থেকে ভারতে ঢোকে। তারা সবাই হরপ্পায় আস্তানা গাড়ে। সিন্ধু নদীর আববাহিকায় তাদের ঘোরাফেরা। সেই সমাজে শ্রেণী বিভাজন ছিল।

একটা সময়ে বর্ণ–বিভাজন দেখা যায়। বর্ণ ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক শোষণ, এগুলি লিখিত অবস্থায় আছে। অশোকের শিলালিপির সঙ্গে অর্থশাস্ত্র পড়লে শ্রেণী শোষণ, বিভাজন, উদ্বৃত্ত আহরণ করার চিত্রগুলি পরিষ্কার বোঝা যায়।

অর্থশাস্ত্র অশোকের সময়ে ছিল, একথা জোর দিয়ে বলা যায় না। তবে এই বৈশিষ্ট্যগুলি অশোকের আমল থেকেই দেখা যেতে থাকে যে, জমির মালিক রাজা। মানে রাষ্ট্র। তখন দু’ ধরনের চাষ দেখতে পাচ্ছি। এক ধরনের কৃষি ব্যবস্থা হচ্ছে, উর্বর জমি রাষ্ট্রীয় মালিকানায় চাষ হতো। রাষ্ট্র ক্ষেতমজুরদের দিয়ে খাটাত, মজুরি দিত। রাষ্ট্রই তাঁত, কামার, অস্ত্র, কারখানা ইত্যাদি চালাতো। এগুলি পরিচালনার জন্য রাষ্ট্র নানারকম যোগ্যতাসম্পন্ন সুপারিন্টেনডেন্ট নিয়োগ করতো। যেমন সুপারিন্টেনডেন্ট অফ অ্যানিম্যাল হাজব্যান্ডরি, সুপারিন্টেনডেন্ট অফ মেটালারজি – এরকম। অর্থাৎ চাষ বা কারখানার মালিক হচ্ছে রাজা, সে এখনকার আইএএস/ আইপিএসদের মতো একাধিক প্রশাসক, ম্যানেজার নিয়োগ করে পুরো ব্যবস্থা চলতো। এখনকার মতই এই প্রশাসক এবং ম্যানেজারদের নিয়োগের জন্য পরীক্ষা হতো। বেশ কঠিন পরীক্ষা। রাষ্ট্রীয় কর্মচারী বা আমলারা ছিলেন যথেষ্ট গুণী, লেখাপড়া জানা। পশুর অধ্যক্ষ, কৃষির অধ্যক্ষ, হাতিশালের অধ্যক্ষ, তাঁতের অধ্যক্ষ – এইরকম সব পদ ছিল। গোটা উৎপাদনটাই ছিল রাষ্ট্রের হাতে।

সাধারণ শ্রমিক বেতন পেতেন দিনে ১–২ পণ। তাঁতি পেতেন ১০০-১৫০ পণ। নানা মর্যাদার রাজকর্মচারীদের মধ্যে বেতন বৈষম্য ছিল। যেমন, রাজপুরোহিত পেতেন ৮৪,০০০ পণ, সেনাধ্যক্ষ ২৪,০০০ পণ, অধ্যক্ষ ১২,০০০ পণ। ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয়রা হতেন রাজকর্মচারী। নিম্নবর্ণ শূদ্ররা হতেন ক্ষেতমজুর। তারাই লোহা কাটা আর চামড়ার কাজ করতেন। নানান উৎস থেকে উদ্বৃত্ত জমা হত রাষ্ট্রের কোষাগারে। সেখান থেকে মর্যাদা অনুযায়ী বণ্টন করা হতো। মানে রাজপুরোহিত থেকে ক্ষেতমজুর কেউই মালিক নয়, কিন্তু দু’জনে ভাগ পাচ্ছে আকাশপাতাল। কেবলমাত্র উচ্চবর্ণের লোকেরাই পরীক্ষা দিয়ে রাজকর্মচারী হতে পারতো।

আরেক ধরনের কৃষি ব্যবস্থা হচ্ছে চাষিদের জমির লিজ দিয়ে চাষ করানো। লিজ টিকিয়ে রাখার জন্য চাষি রাষ্ট্রকে খাজনা দিত। উৎপন্ন ফসলের ৬ ভাগের ১ ভাগ হতো খাজনার পরিমাণ। আনকোরা জমির খাজনা ছিল ১০ ভাগের ১ ভাগ। চীনের প্রাক-পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কিন্তু এই রকম ছিল না। সেখানে মিং রাজবংশের যে লিখিত ইতিহাস আছে সেখানে দেখছি জমিদার থেকে ক্ষেতমজুর – সবাই হুন জাতির লোক। বাগদি, বাউরি, ব্রাহ্মণ – এইরকম কোনও ভাগ নেই। ভারতে সামাজিক স্তরে পিরামিড আকারে কার কোন অবস্থান – সেই অনুযায়ী ছিল সামাজিক ভাগ। ভারতে শ্রেণীগুলিকে বুঝতে গেলে তাই কেবল মালিকানার ধরন দিয়ে বোঝা যাবে না।

প্রাক-পুঁজিবাদী ভারতীয় সমাজে উদ্বৃত্ত আহরণের প্রক্রিয়ায় ছিল সামাজিক অধিকার আর মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চনা। শুধু জন্মগত পরিচয়ের কারণে পড়াশুনার অধিকার, বৌদ্ধিক শ্রমের অধিকার থেকে বঞ্চনা ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। একলব্য, শবরী অনেকেরই নাম করা যায়। শূদ্র শম্বুক নিজ কণ্ঠে বেদ পাঠ করেছেন। পুরোহিতরা রামকে বললেন, এতে রাজ্যে অনাচার দেখা দেবে। রাম গিয়ে শম্বুকের গলা কেটে দিলেন। রামায়ণের গল্প। এটাকেই গ্লোরিফাই করেছে, হাইলাইট করেছে ভারতীয় সমাজ। এই সামাজিক বৈষম্যই বর্ণ বৈষম্য। এটাই ভারতীয় ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য। এটা চীনা সমাজ বা ইউরোপীয় সমাজে দেখা যায় না। সেখানে বিভাজনটা ছিল শ্রেণী বিভাজন, আমাদের দেশের মত জাতি বিভাজন ছিল না সেখানে। সেখানে ক্ষেতমজুরের ছেলে পড়াশুনার সুযোগ পেলে তার আপওয়ার্ড মবিলিটি (উলম্ব সচলতা) ঘটত।

এই তো গত শতকের ঘটনা। আম্বেদকর স্কুলে যাচ্ছে। ছাত্ররা মাটির কলসি থেকে জল ঢেলে খায়। আম্বেদকরের সেই মাটির কলসি ছোঁয়ার অধিকার নেই। ছোট জাত, কলসি ছুঁয়ে ফেললে পুরো জলটাই অপবিত্র হয়ে যাবে। তেষ্টা পেলে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। কোনও ছাত্র সদয় হয়ে তার মুখে জল ঢেলে দিলে তবে সে জল পাবে। এই যে বৈষম্যটা সেটা কোন সম্পত্তির মালিকানা থেকে আসছে?

৬০-৭০ বছর আগে আমরা যখন স্কুলে গেছি প্রচুর বাগদি ছিল আশেপাশে। ব্রাহ্মণ আর মধ্যবিত্তরাই পড়তে আসত। বাগদি আর বাউরিরা আসতই না। পাশে বসতই না। এটা ২০১৭–১৮ সালেও ঘটেছে।

২০১৭ সালের ঘটনা। এক দলিত রাজপুতদের মতো গোঁফ রেখেছিল। উত্তর ভারতে সেই দলিতকে গোঁফ রাখার অপরাধে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। বলুন তো, গোঁফ কোন উৎপাদনের মালিকানায় লাগে? যান্ত্রিকভাবে দেখলে তো মিলবে না।

বর্ণব্যবস্থার নীচের স্তরে আছ মানে সব দিক দিয়ে তুমি নিম্ন, নিচু, ছোট – তাই ছোটলোক। তুমি জুতো পরে জমিদারদের বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে পারবে না। এই তো সেদিন, এক দলিত ছেলেকে রাজপুত গ্রামের ভিতর দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে বিয়ে করতে যাবার জন্য এসডিও-এর কাছে অনুমতি চাইতে হয়েছিল। রাজপুতরা বাধা দেয়। সংঘর্ষ, দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। কার্ফু ঘোষিত হয়। মামলা গড়ায় এলাহাবাদ হাইকোর্টে। সেখান থেকে রায় নিয়ে তবে সেই দলিত ছেলে বিয়ে করতে যাওয়ার ছাড়পত্র পায়। এই লড়াইটাকে আপনি কীভাবে দেখবেন?

আরেকটা লড়াই দেখুন, না হলে এটা আংশিক হবে। ১৯৭৮ সাল। বাংলায় খুব জোরদার বর্গা আন্দোলন হচ্ছে। বর্গাদার, বর্গচাষির নামে জমির মালিকানার নথিভুক্তি হচ্ছে। চাষি ফসলের ৪ ভাগের ৩ ভাগ পাবে। আইনটা সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের আমলে পাশ হয়ে গেছিল। কিন্তু দাবি করা যেত না। আইনি লড়াইয়ের জন্য চাষির কোনও কাগজপত্র ছিল না। উকিল, মোক্তার কোথায় পাবে সে? ফলে আইন প্রয়োগ হতো না।

বাম আমলে যখন বর্গা নথিভুক্তি শুরু হল তখন দলে দলে কৃষকরা বিডিও অফিসে লাইনে দাঁড়ালো। জমি বণ্টন শুরু হল। কোনও অঞ্চলে খাস জমি মিলল হয়ত ২০ বিঘা। ভূমিহীন ২০০ জন। কাকে দেবেন, কাকে দেবেন না? সবাই ভাগে কত পাবেন? বিধানসভায় খুব হইচই হতো। এত ছোট ছোট প্লটে জমির খণ্ডীকরণ হচ্ছে - তাতে ক্ষেতমজুর না হচ্ছেন চাষি না থাকছেন ক্ষেতমজুর। এটা তোমাদের ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতি। জনতা পার্টির নেতা কাশীকান্ত মৈত্র এই বিতর্কটা লিড করতেন।

জবাব দিয়েছিলেন তৎকালীন ভূমিসংস্কার মন্ত্রী বিনয় চৌধুরী। কথাটা মনে গেঁথে গেছে। তিনি বলেছিলেন, একটা লোক ৫ কাঠা জমি পাচ্ছে দেখছ, দেখছ না ওই লোকটার চোদ্দপুরুষে কেউ এক কাঠা জমিরও মালিক ছিল না। আমার গ্রামেও দেখেছি, কোনও বাগদির কোনও জমি ছিল না। অবস্থাপন্নরা দয়া করে থাকতে দিতো আর বেগার খাটাতো। অল্প মজুরি দিতো, বা দিতো না। মালিকানার প্রশ্ন ছিল না তা নয়। আসলে ভূমিহীনতা এবং নিম্ন সামাজিক অবস্থান – এই দুটো শর্তই আন্তঃসম্পর্কিত (ইন্টিগ্রেটেড) ছিল। যেখানেই একটাকে ধরে আন্দোলন হয়েছে, অমনি আরেকটা সামনে চলে এসেছে।

চারু মজুমদার আমাদের বলেছিলেন, ভূমিহীন চাষিদের ঘরে থাকবে। আমরা সেটা মেনে চলেছিলান। দেখলাম সামাজিক বাস্তবতা অনুযায়ী বিভিন্ন জাতগুলো কেমন নিজেদের পরিবর্তিত করে নিচ্ছে। ভোলা গ্রামে আমি তখন কাজ করছি। তেলিরা ক্ষেতমজুর। আমার শেল্টার হল মালদের ঘরে। শ্রেণী রাজনীতি করছি। অথচ মানুষ কিন্তু সংগঠিত হচ্ছে প্রথমে মাল, তারপরে ডোম, সাঁওতাল, মুণ্ডা – এইভাবে। আমাদের স্লোগান ছিল জমি। কিন্তু সবাই সংগঠিত হল জাতি হিসাবে (আজ কাস্ট) নকশালবাড়ির শ্রেণী রাজনীতি আমাদের তোয়াক্কা না করে নিজের বাস্তবতা অনুযায়ী কেমন পরিবর্তিত হয়ে গেল – সেটাই উপলব্ধি করলাম।

বিহারের ভোজপুরে লিবারেশন জমির অধিকার নিয়েই আন্দোলনটা শুরু হয়। কিন্তু তারপরে জাত (কাস্ট) অনুযায়ী প্রতিবাদ চলতে থাকে। ভারতীয় বামপন্থীরা এদিকটা দেখেননি। শ্রেণী দেখতে গিয়েই বামেরা অবদমিত জাতিসত্ত্বাগুলির পক্ষে ছিল। উচ্চবর্ণের আধিপত্যের বিরুদ্ধে তারা লড়াই করেছে। কিন্তু জাতি এবং শ্রেণীর মধ্যে কোনও সমীকরণ টানতে পারেনি।

এই পরিস্থিতির বদল ঘটাতে ব্রিটিশ আমল থেকেই আরেকটা আন্দোলনের সুচনা হয়েছিল। বর্ণসাম্যের – সমান অধিকার। এতদিন ধরে পিছনে ফেলে রাখার জন্য বিশেষ অধিকারের দাবি। সরকারি চাকরি, লেখাপড়ার ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা। ফলে বামেদের নেতৃত্বে জমির আন্দোলন আর কেরালা সহ দক্ষিণ ভারত জুড়ে জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন – এই দুটি ধারা সমান্তরালভাবে চলেছে দীর্ঘদিন। দুর্ভাগ্য এটাই এই দুটো ধারা এক জায়গায় এসে মিলল না, হাত ধরল না।

১৯৭৮-এ এসে বামেরা ভূমিসংস্কার করেছে। তার ফলে ভূমিহীন অন্ত্যজ জাতগুলির দর কষাকষির ক্ষমতা বেড়েছে, তাদের সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে জমির অধিকার ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু পাশাপাশি মণ্ডল কমিশন এই সরকারের কাছে অবদমিত জাতিগুলির পরিসংখ্যান চাইলে বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য এক সদস্যের একটি কমিটি তৈরি হয়। সেই কমিটি এক মাসের মধ্যে গোটা বিষয়টি পর্যালোচনা করে এক লাইনের একটি প্রতিবেদন জমা দেয়। সেই প্রতিবেদনের অসাধারণ বাক্যটি ছিল “দেয়ার আর নো ব্যাকওয়ার্ড কাস্ট ইন বেঙ্গল।” এটাই বামেদের বৈপরীত্য।

আমরা মণ্ডল কমিশন নিয়ে আন্দোলন করেছি। সিপিআইএম থেকে বিভিন্ন ঘরানার নকশালরা আমাদের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। শ্রেণী সংগ্রামকে লঘু করে দিচ্ছি – এই ছিল আক্রমণের মূল কথা। কিন্তু ভারতীয় সমাজে শ্রেণীর গঠনে যে বৈশিষ্ট্য রয়েছে – সেটা ওরা বুঝতে অস্বীকার করেছিল।

আজ ভিন্ন পরিস্থিতি। মণ্ডল কমিশনের প্রস্তাবনাগুলিকে বামেরা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু চিন্তার ক্ষেত্রে, আন্দোলনের কর্মসূচি তৈরির প্রশ্নে যে একটা পরিবর্তন দরকার – সেটা কোথাও দেখা গেল না। ভারতে বামপন্থীদের পুনর্জাগরণে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রতি মনোযোগ দেওয়া, বিশেষ জোর দেওয়া প্রয়োজন। ফলে বামেদের যারা সামাজিক ভিত হতে পারতো তারা কেউ বহুজন পার্টির সমর্থক, কেউ বা মতুয়া আন্দোলনের ভক্ত হয়ে গেল। তাই বামেদের অনুপস্থিতিতে জাতপাত–কেন্দ্রিক আন্দোলনে সংরক্ষণ কোটার বাইরে জাতির সমানাধিকারের প্রশ্ন, জমির অধিকারের প্রশ্ন, অন্যান্য সাম্যের প্রশ্ন, গণতন্ত্রের প্রশ্ন – এগুলিকে যুক্ত করার কাজগুলি আর হয়নি।

ফলে ভূমিহীন আর নিম্নবর্গ – এই দুই কমিউনিটিকে এক সঙ্গে দেখা, এক সঙ্গে মেলানোর কাজটাও হয়নি। বাংলায় সিপিআইএম এতদিন কোনও কাস্ট সংগঠন, আদিবাসী সংগঠন বানায়নি। এবার বানিয়েছে।

১৯৬৪ সালে হুগলির বড়শুলে সিপিআইএমের নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলনের রূপরেখা কী হবে – এ নিয়ে প্লেনাম হয়েছিল। নকশাল আন্দোলনের শুরুতেই বলা হয়েছিল, ওই কর্মসূচিকেই আমরা অনুসরণ করেছি। বড়শুল প্লেনামের কোনও আপডেটেশন হল না। আবার এই সেদিনও ১৭ পার্টির সেই একই কথা শুনলাম। ১৯৬৪ থেকে ২০১৭ – ভারতের জমি সম্পর্কে কেউ কোনও পরিবর্তন খুঁজে পেল না। ভারতের জাতপাত তো স্বয়ম্ভূ নয়। অর্থনৈতিক শ্রেণী সম্পর্ক কোথায়, কীভাবে বর্ণবৈষম্যকে পুষ্ট করে চলেছে তার এক স্বাধীন বামপন্থী অনুসন্ধান বাদ দিয়ে ভারতে বামপন্থার নতুন সৃজন সম্ভব নয়।

৩২৭ খ্রীস্ট পূর্বাব্দে আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করেন। তারপর চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, বিন্দুসার, অশোক। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র। প্রাক-পুঁজিবাদী ভারতীয় সমাজের অর্থনৈতিক-সামাজিক নীতিমালা হল মনুসংহিতার নীতিমালা। সোজা কথায় সমাজ আর রাষ্ট্র চালাবেন উচ্চবর্ণের লোকেরা আর শারীরিক শ্রম দেবেন নিম্ন বর্ণের লোকেরা। এক একটা রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বৈষম্য। জন্মসূত্রকে ধরে সামাজিক ও অর্থনৈতিক শ্রম বিভাজন ও উৎপন্ন বণ্টনের ভিন্ন ভিন্ন ভাগ।

১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রাথমিক স্কুলগুলির শিক্ষক পদে প্রচুর নিয়োগ করা শুরু হয়। ১৯৯৫ সালে স্কুল সার্ভিস কমিশন গঠনের আগে পর্যন্ত জেলার প্রাথমিক স্কুলগুলিতে শিক্ষক পদে নিয়োগ হতো জেলা স্কুল বোর্ডের মাধ্যমে। বলাই বাহুল্য সিপিআইএমের জেলা সম্পাদকেরা সেই বোর্ডের প্রভাবশালী সদস্য হিসেবেই থাকতেন। পার্টির শিক্ষিত বেকার কমরেডদের একরকম অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের একটা মাধ্যম ছিল এই শিক্ষকদের চাকরি। এই চাকরি দেওয়ার ক্ষমতার সূত্রে পার্টিতে ছাত্র-যুবদের মধ্যে জেলা সম্পাদকের প্রভাব ছিল প্রশ্নাতীত। এর তালিকা তৈরি হতো লোকাল কমিটিগুলির মাধ্যমে। জেলা সম্পাদকের কোটা ছিল। পরে লোকাল কমিটি থেকে নাম উঠে আসার পদ্ধতিটা বন্ধ করে পুরো ক্ষমতাটাই চলে যায় জেলা নেতৃত্বের হাতে। যেমন, মেদিনীপুরের দীপক সরকার। পার্টিই চাকরি দিত। এমনকি মুসলমান কমরেডদের জন্যও কোটা ছিল। তারপরেও কতজন মুসলমান শিক্ষক বাম জমানায় প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছেন? এই সরকার চলে যাওয়ার সময়, সাচার কমিটি বলছে, এই রাজ্যে যেখানে মোট জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ মুসলিম, সেখানে প্রাথমিক শিক্ষকদের মধ্যে মাত্র আড়াই থেকে তিন শতাংশ মুসলিম শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছেন। এটা কেউ ভাবেননি। অন্ত্যজ জাতিভুক্তদের নিয়ে যেমন ভাবেননি, তেমনি সংখ্যালঘুদের নিয়েও ভাবেননি। সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য নিবেদিতপ্রাণ পার্টি, কিন্তু সরকারি চাকরিবাকরিটা বামুন, কায়েতদের জন্য। এর ফলে একটা ক্ষোভ যখন তৈরি হল, তখন সিপিআইএম বলল, সংবিধানে ধর্ম অনুযায়ী সংরক্ষণের কোনও ব্যবস্থা ছিল না। কোনও কমিশন এমন কথা বলেননি। এই বলে তারা একটা নীতি ঘোষণা করল যার ফল ২০১১ সালে মুসলমানদের কয়েকটি সম্প্রদায়কে ওবিসি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

কিন্তু কোনও কমিশন ধর্ম অনুযায়ী সংরক্ষণের কথা বলেনি একথা সত্য নয়। রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশন মুসলমানদের জন্য সরকারি চাকরিতে ১১ শতাংশ সংরক্ষণের কথা বলেছে। কেরালা, এমনকি তামিলনাড়ু আর বিহারের সরকারগুলিও মুসলমানদের জন্য সরকারি চাকরিতে ১২ শতাংশ সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আর সিপিআইএম তার গুরুত্বটাই উপলব্ধি করতে পারেনি। তাই সাচার কমিটির পর্যবেক্ষণ হল, ১৯৭৭ সালে বাম সরকার যখন ক্ষমতায় আসছে, তখন সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের অংশগ্রহণ ৭ শতাংশ। ২০০৭ সালের শেষদিকে এসে এটা কমে দাঁড়ায় ২.৫ শতাংশে। ক্ষমতা থেকে চলে যাবার আগে এদিকটা দেখেনইনি কমরেডরা।

আসলে অবিভক্ত বাংলার পশ্চিম অংশে ছিল শিক্ষিত মুসলমানদের বাস। দেশভাগের পরে তারা সব বাংলাদেশে চলে যান। বদরুদ্দিন উমরের বাবা ছিলেন বর্ধমানের লোক। অবিভক্ত মুসলিম লিগের সম্পাদক। তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদী, বামপন্থীদের কাছাকাছি। আরেকজন গুণী মুসলিম আব্দুল হাসিম বামপন্থীদের কাছাকাছি ছিলেন। এঁরা সব বাংলাদেশে চলে যান। আর বাংলাদেশের শিক্ষিত হিন্দুরা চলে এলেন এপাড়ে। ওপাড়ে পড়ে থাকল নমশূদ্ররা আর এপারে মূলত কৃষিজীবী, পড়াশুনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত মুসলিমরা। পরবর্তীকালে উদ্বাস্তু আন্দোলনের হাত ধরে শিক্ষিত হিন্দুরা কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন, নেতা হন, গ্রামে গিয়ে মুসলিম ক্ষেতমজুরদের সংগঠিত করেন। জমির অধিকারের আন্দোলন ছড়িয়ে দেন। কিন্তু শিক্ষিত মুসলিম সমাজের অনুপস্থিতির কারণে পার্টির পলিসি নির্ধারণে মুসলিমদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনার প্রশ্নটা অবহেলিতই থেকে গেল।

ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, অপারেশন বর্গা একটা পরিমাণ খাস জমি বণ্টন – এইসবের মাধ্যমে বাম সরকার গ্রামের ক্ষেতমজুর, বাগদি, বাউরি, অন্ত্যজ মুসলিমদের মধ্যে গণতন্ত্রের বিস্তার ঘটিয়েছিল। ১৯৭৮ সালের পরের দশ বছর পঞ্চায়েত খুব সামান্য পরিমাণ টাকাই আসত। কিন্তু দেখা যেত গ্রামের গরীবগুর্বোরা পঞ্চায়েত অফিসে ভিড় জমাচ্ছেন, গ্রামের কোথায় কীভাবে সেই টাকা বরাদ্দ করা হবে – এইসব বিষয়ে মতামত দিচ্ছেন, বিতর্ক করছেন। সরকারি উন্নয়নে অংশগ্রহণ করছেন উৎসবের মত। কিন্ত অপারেশন বর্গা আটকে গেল। সমবায় আন্দোলনকে গ্রামীণ কায়েমী স্বার্থের হাত থেকে মুক্ত করে বামপন্থীরা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলেন না। ক্ষমতাচ্যুত কংগ্রেসি এবং কুলাক শ্রেণী (যারা এখন তৃণমূলের গ্রামীণ সামাজিক ভিত) ভোল বদলে সিপিআইএমের মেম্বার হয়ে ওই সমবায়গুলোর চেয়ারম্যান হয়ে বসল। সমবায় হয়ে গেল দুর্নীতির আখড়া। সে দাদন দেয়। ভাগচাষী, ছোট কৃষক জমি ধরে রাখতে পারল না। মুখ থুবড়ে পরল অপারেশন বর্গা। আর তখন থেকেই পঞ্চায়েতে পঞ্চায়েতে মোটর সাইকেলের ভিড় বাড়তে শুরু করল। পরে ঠিকাদারেরাই নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করল পঞ্চায়েত। মানুষের সক্রিয়তা কমে গেল। ছোট কৃষকদের জমির ওপর অধিকার হ্রাস আর নিম্নবর্গীয়দের পঞ্চায়েত থেকে দূরত্ব ঘটতে শুরু করল। তারপরেও মার খেয়ে, রক্তাক্ত, অবদমিত হয়েও সেই পঞ্চায়েত নির্বাচনে নমিনেশন জমা দেওয়ার লড়াই করতে করতে মরে যাওয়ার স্পিরিটটা কিন্তু এই বামপন্থী শক্তিগুলির মধ্যেই আছে। খেয়াল করে দেখুন, এই পঞ্চায়েত নির্বাচনে যত মানুষ মারা গেছেন, আহত রক্তাক্ত হয়েছেন তাদের প্রায় পুরোটাই মূলত শ্রেণীগত ভাবে গ্রামীণ গরীব, বামপন্থীদের শ্রেণীমিত্র এবং জাত ও বর্ণ পরিচিতগতভাবে মুসলিম আর নিম্নবর্ণের হিন্দু।

অনুলিখন: সন্দীপ মুখোপাধ্যায়।
১ জুন, ২০১৮ শ্রমজীবী ভাষায় প্রকাশিত।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.