বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[শিল্প]

[শিল্প]

বিশ্বকবিতার বিবেকী শ্রমণ, আপনাকে

সুশান্ত চট্টোপাধ্যায়

photo

১৬ ডিসেম্বর, ২০২০, শ্রমজীবী ভাষা– তখন সারা ভারতবর্ষ জুড়ে জরুরী অবস্থার অন্ধকার। ভারতবর্ষের অন্য ভাষাভাষী কবিদের সঙ্গে প্রতিবাদে কণ্ঠ মিলিয়েছেন বাংলার কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকেরা। সারা ভারতবর্ষ জুড়ে কবিদের প্রতিবাদী উচ্চারণগুলি পরে একসঙ্গে সংকলিত হয় জন অলিভার পেরি সম্পাদিত 'ভয়েসেস অফ ইমার্জেন্সি' (১৯৮৩) গ্রন্থে। এই গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছিলেন কবি আয়াপ্পা পানিক্কর। সেই অন্ধকার কঠিন সময়ে ১৯৭৬ সালে, প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায়, রাজভবনে কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের জন্য আহ্বান করেন। সেন্সরশিপের প্রতিবাদ হিসেবে কেউ কেউ যান না। কিন্ত অনেকের সঙ্গে সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। আর তারপর সেই সভায় যা ঘটেছিলো তা জানিয়েছেন অলোকরঞ্জন নিজে: রাজভবনে সত্যর দশকে ইন্দিরার আমন্ত্রিত চায়ের আসরে এক গোধূলি সন্ধ্যায় অতর্কিতে আমি তার আরোপিত ইমার্জেন্সির প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলাম, আর তক্ষুনি মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায় আমাকে বললে: সাবধান, যে কোনও মুহুর্তে কিন্ত আপনাকে গ্রেফতার করা যায়।' এই ছিলেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত।

মনে রাখা প্রয়োজন, তখন তিনি মধ্য চল্লিশ। 'যৌবন বাউল' কাব্যগ্রন্থের সূত্রে পঞ্চাশের কবি হিসেবে বাংলা কবিতার জগতে তিনি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছেন। প্রকাশিত হয়েছে আরো চারটি কাব্যগ্রন্থ: 'নিষিদ্ধ কোজাগরী', 'রক্তাক্ত ঝরোখা' , 'ছৌ-কাবুকির মুখোশ', 'প্রতিদিন সূর্যের পার্বণ'। ১৯৫৭ তে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনার শুরু। বিভাগীয় প্রধান ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। ১৯৬২ তে শেষ করেছেন তার গবেষণা কর্ম: The Lyric In Indian Poetry'। ১৯৬৪ তে শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে যুগ্ম সম্পাদনায় প্রকাশিত হচ্ছে আধুনিক বিশ্বকবিতার অনুবাদ গ্রন্থ' সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত'। ১৯৬৫ তে ঐ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগদান। ঐ বছরই যোগদান করছেন শঙ্খ ঘোষ। ১৯৭১ এ আলেকজান্ডার ফন হুমবোল্ট রিসার্চ ফেলোশিপ পাবার পর পশ্চিম জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারততত্ত্ব বিষয়ে অধ্যাপনা শুরু। ১৯৭৩ এ গ্যোয়টে ও রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের প্রকাশ।

কিন্ত শিক্ষক হিসেবেও ছাত্রদের সঙ্গে ছিল তার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিল তিমিরবরণ সিংহ। শঙ্খ ঘোষ এবং অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের প্রিয় ছাত্র ছিল সে। শঙ্খ ঘোষ তিমিরকে নিয়ে লিখেছিলেন 'তিমির বিষয়ে দু-টুকরো'। কিন্ত অলোকরঞ্জনও তিমিরকে নিয়ে লেখেন দুটি কবিতা : 'অমৃতধামযাত্রী' (১৯৭৭) "লঘুসংগীত ভোরের হাওয়ার মুখে" এবং 'তিলতর্পণ'(১৯৭৮) "গিলোটিনে আলপনা"। এই কবিতাদুটি বিষয়ে তিনি লিখেছেন: কবিতাদুটির কেন্দ্রীয় বিভাব তিমির। তিমিরের মৃত্যু হয় ১৯৭১-র ২৪শে ফেব্রুয়ারি। মৃত্যু সংক্রান্ত খবর আমার কাছে পৌঁছেছিল অনেক পরে... তিমির ছিলো এক ধরণের অরব শ্রোতা। সে যেন চারপাশ থেকে, এমনকি আমাদের থেকে সংগ্রহ করে নিচ্ছিলো তার সংবেদনের সায়কগুলি, যেগুলিকে সে ধীরে সুস্থে তূণে ভরে রাখছিলো। এইখান থেকে তার বিপ্লবী মানসের শুরু।... নকশালবাড়ি আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত হবার পরও এমন কোনো ধারা ওরা তৈরি করেনি যেটা মূল্যবোধে স্বনির্ভর হয়ে থেকে গেছে। অর্থাৎ চিরায়ত নকশাল সাহিত্য, বোধ হয় গড়ে ওঠেনি। ধারাবাহিত ও আধুনিক শিল্পসাহিত্যের কাজে তাদের অনিচ্ছা বা সুধীন্দ্রনাথের কথায় অনীহা কাজ করছে। কিন্ত সব সময়ই, যতবার কথা বলেছি তারা এটিকে বরবাদ করে দেবার কথা কখনই বলেন নি, তিমির তো নয়ই।... নন্দনচিন্তার যে সব প্রবাহ আছে সেগুলিকে ওরা ঘাটায়নি সেভাবে। ওরা চেয়েছিলো তার প্রতিসাম্যে নিজেদের একটা ধারা তৈরি করে নিতে। আগে তো ভিত হবে তারপর মালঞ্চ।তারা ভিতটা তৈরি করেছিলো, প্রথমে ভাঙছে, তারপর গড়বে; তারপরে তো শিল্পের ব্যাপার তৈরি হবে- সময় পায়নি তারা।'

শঙ্খ ঘোষ তার আত্মস্মৃতিমূলক রচনায় লিখেছেন: পঞ্চাশের দিনগুলিতে বাংলা কবিতার যেন যুবরাজ ছিল অলোক। 'যৌবন বাউল' ছাপা হয়ে বেরিয়েছে ১৯৫৯ সালে, বেরোবার সঙ্গে সঙ্গেই 'কৃত্তিবাস'এর সম্পাদকীয়তে লেখা হচ্ছে যে সে-বছরের ঘোষিত অকাডেমি পুরস্কারের জন্য সেটাই হতে পারত যোগ্যতম বই, কিন্ত তার অনেক আগে থেকেই সাত-আট বছর জঙড়ে তার একেবারে নিজস্ব ভাষা আর জগৎ নিয়ে গমকে গমকে কবিতা লিখছিল অলোক, তার আলংকারিক ছটায় তখন মুগ্ধ সবাই।'
১৯৭১ এ স্টুটগার্টে কারারুদ্ধ বিপ্লবীদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার পথে জা পল সার্তের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। সার্ত অলোকরঞ্জনকে বলেছিলেন : কবিতায় অন্যভাবে কাজ করা যায়। কিন্ত গদ্য লিখতে গেলে সামাজিক দায়িত্ব নিতে হয়।' সার্তের কথাটি সারাজীবন মনে রেখেছিলেন অলোকরঞ্জন। তাই শুধু কবিতার মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ রাখেন নি। বিশ্বকবিতার অনুবাদ ছিল তার জীবনের এক আরব্ধ চর্যা। একই সঙ্গে তিনি সুরদাসের সঙ্গ ব্রেশট, গ্যোয়টে, বীয়ারম্যান, হ্যোল্ডারলীন প্রমুখের কবিতা অনুবাদের পাশাপাশি বাংলার কবিদের জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। সত্তরের দশক থেকে তিনি হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। অথচ স্বদেশের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল সবসময়। কৃত্তিবাস ও শতভিষা দুটি পত্রিকায় নিয়মিত লিখেছেন। বড়ো পত্রিকার পাশাপাশি লিটল ম্যাগাজিনে লিখেছেন নিয়মিত। মনে পড়ছে ২০০৭ এ নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়ও ছিল তার একই ভূমিকা। "গোলাপ এখন রাজনৈতিক" নামে দু ফর্মার পুস্তিকায় তিনি তার নিজের কথা বলেছেন- কবিতা ও গদ্যের আখরে। ব্রেশটকে মনে করে তিনি লিখেছে: আজ যখন এই বাংলার অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী সরকারি রাজচ্ছত্রের ছায়া থেকে নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছেন, মনের মধ্যে আশা ও অহংকার জাগে।' ঐ পুস্তিকার 'একটি কান্না' শীর্ষক রচনায় তিনি লিখেছেন গুজরাত ঘটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সম্ভবত প্রথমতম বিক্ষোভ জানিয়েছিলাম আমি।' অন্যদিকে কবিতায় তিনি লেখে: সত্তায়-জড়িয়ে-থাকা ম্যান্ডোলিন খোয়ানো সত্ত্বেও/ লিটল ম্যাগাজিনের মর্যাদা অটুট রাখতে চাওয়া/ অধুনা ওদেরই সঙ্গে পথ চলি, পুলিশেরা ভাবে/ চলমান এ সংসার মিছিলে নেমেছে নন্দীগ্রামে!' (ক্ষয়িষ্ণু হয়েও হেঁটে-যাওয়া)।
১৯৭১ এ প্রকাশিত হয়েছিল তার 'শিল্পিত স্বভাব' যে বই সম্পর্কে শঙ্খ ঘোষ বলে: ‘এই সেই বই, আজও পর্যন্ত যার যোগ্য মর্যাদা দেওয়া হয়েছে বলে মনে হয় না’। তার গদ্যের বইয়ের সংখ্যা ২৫টির মতো। কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৪০ টির মতো।
বিশ্বকবিতার বিবেকী শ্রমণ এই কবির কারুবাসনার জগৎ ক্রমশই বিবর্তিত হয়ে যায়। ১৯৯৬ এ এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন: ‘যেটা হচ্ছে না সেটা হল লিটারেচার অফ ইকোলজি। আমরা যেন ভাবছিই না এটা নিয়ে। কেবল দিন আনা দিন খাওয়ার মধ্যে আটকে পড়ে গেছি আমরা।’ এই প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন সারা কীর্শের কবিতার কথা যার কবিতায় ইকোলজি একটা প্রধান ভাবনা হিসেবে স্থান পেয়েছে।

১৯৯৯এ প্রকাশিত তার একটি কাব্য গ্রন্থের নাম হয় “এখনও নামেনি, বন্ধু, নিউক্লিয়ার শীতের গোধূলি।” এই কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতায় তার গভীর অনুভব: 'নিরুপম আমাকে বলল : 'এই বোমা বিজ্ঞানী,/ নিউট্রন নাম, মানুষ এবং অপরাপর প্রাণী/ ধ্বংস করেও অটুট রাখবে তাদের বাড়িঘর,/ খেলার মাঠ, আর অন্তত একজন ঈশ্বর।' (নিউট্রন)
তার দীর্ঘ সৃজনী সংরাগে আকীর্ণ জীবনে তিনি নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। সুধা বসু পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, শিরোমণি পুরস্কার, রবীন্দ্র পুরস্কার এবং সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (মরমী করাত কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯৯২ সালে)। এছাড়া ১৯৮৫ সালে বিশ্বনাগরিকতা, জার্মান-বাংলা ভাষার পারস্পারিক অনুবাদ ও দুই দেশের সংস্কৃতির মেলবন্ধনের জন্য গ্যোয়টে পুরস্কার লাভ করেন।
ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্পষ্টবাক। নিজের বিশ্বাস বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন: আমি ঈশ্বরবিশ্বাসী। তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের নানান জায়গায় আমরা দেখতে পাই, এমনকি পোল্যান্ডের মতো দেশেও ঈশ্বরভাবনা তথা ঈশ্বরবিশ্বাস রাজনৈতিক প্রত্যয়ের আড়ালে প্রচন্ডভাবে কাজ করছে। সেখানে বিপ্লব ও ভক্তির মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। আমার দিক থেকে এই কথাটা আমি অন্যত্রও বলেছ, ঈশ্বরবিশ্বাস সরাসরি কবিতায় প্রতিফলিত হোক এটা এখন আমি চাই না। কেননা কবিতা তো সবসময় বক্তব্যের বাহন নয়, এখন আমি বক্তব্যের কবিতায় নয়, কবিতার বক্তব্যে বিশ্বাস করি।' এই কথা বলবার পরও প্রায় ঘোষণার মতো করে তিনি বলেছেন: আমি বিশ্বাস করি না মার্কস বা এঙ্গেলসের ভাবনাকে উপেক্ষা করে এই শতকের কোনও মানুষের উত্তরণ সম্ভব। এমনকি ধর্মাশ্রিত শিল্পীকেও মার্কসের রচনা পড়তে হবে।'

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের মুক্তমন মানসজগতের উত্তরাধিকারী হিসেবে আমরা যদি তাঁর রচনাবলির মনোযোগী পাঠে ব্রতী হতে পারি, তবে সেই হবে তার প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.