বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[শিল্প]
১ জানুয়ারি, ২০২১, শ্রমজীবী ভাষা– আর কোনও কাজ পারি না বলেই কবিতা লিখি। অন্য কিছু পারলে কি আর লিখতাম।
অসুস্থ হয়ে পড়বার অল্প কয়েকমাস আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘরোয়া এক সমাবেশে বলেছিলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। অথচ আমরা যারা সত্তরের দশকের নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলের আবহাওয়ায় কবিতার ঘ্রাণ নিতে শিখেছিলাম তাদের কাছে আজও ভেসে ওঠে সেই ছবি :
১৯৭৭ এ রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি আন্দোলনে তিনি ছিলেন সর্বাগ্রে। তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু অতীন্দ্র মজুমদার লিখেছেন : কোনও সভাসমিতি করে নয়, কোনও দলের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে নয় - একলা একমাত্র কবিতার অমোঘ শক্তিতে সে এই অসাধ্য সাধন করেছিল। ভারতবর্ষে, শুধু ভারতবর্ষে কেন, সমগ্র পৃথিবীর বামপন্থী প্রগতিবাদী মানবিক অধিকারের আন্দোলনে এমন নজীর আর আছে কিনা সন্দেহ।
আমাদের মনে পড়বে ১৯৭৪ সালের ২০ জুন কার্জন পার্কে প্রবীর দত্ত হত্যার ঘটনার কথা। সেদিনও উপস্থিত ছিলেন কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ঘটনাটি অন্যভাবে প্রচারিত হওয়ার জন্য আনন্দবাজার পত্রিকায় চিঠিও লেখেন কবি।
তাহলে কবিতা লেখা ছাড়া আর কিছু করতে পারেন না এমন কথা বলেছিলেন কেন? মনে রাখা প্রয়োজন, শতবর্ষীয় এই কবির আজো পর্যন্ত কোনও জীবনী রচিত হয়নি। তাই নির্বাচিত কয়েকটি কবিতার বাইরে তার সামগ্রিক পরিচয় অনেকটাই আড়ালে থেকে গেছে। তার সময়ে সম্ভবত তিনিই একমাত্র কবি যার প্রায় সবকটি কবিতার বই প্রকাশ করেছেন তিনি নিজে। শুধু তাই নয়, সেই বইগুলির বিক্রেতাও ছিলেন তিনি। প্রিয়জন ও বন্ধুদেরকে লেখা চিঠিপত্রেও দেখতে পাই তিনি তার কবিতার বই বিক্রির বিষয়ে অকপট ছিলেন। স্ত্রী রানী চট্টোপাধ্যায় লিখছেন : নিজের ঝোলায় বই ভর্তি করে করা ওর অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।
তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখি, ১৯২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর বিক্রমপুর ঢাকায় তাঁর জন্ম হয়। পিতা হরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ও মাতা সুরবালা দেবী। জগবন্ধু ইনস্টিটিউশন, রিপন কলেজিয়েট স্কুল ও রিপন কলেজে তাঁর শিক্ষাজীবন। ১৯৪৪ সালে রানী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিবাহ। কবির বয়স তখন ২৪ বছর। যদিও তার আগেই প্রথম কবিতার বই ‘গ্রহচ্যুত’ (১৩৪৯ ) এবং ‘পেট্রল ও অন্যান্য কবিতা’ (১৩৫০) প্রকাশিত হয়েছে। কবি তখন 'ঢাকু্রিয়া ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশনে' চাকরি করেন যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কবির বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ। অল্প দিনের মধ্যেই সেই ব্যাঙ্কও ফেল করে। ইতিমধ্যে প্রথম কন্যা সন্তান অর্চনা ও বুদ্ধদেবের জন্ম হয়েছে। এই সময় কবিকে একজন পরামর্শ দেন রিফিউজি কার্ডটা করিয়ে নেওয়ার জন্য। তাহলে চাকরির সুবিধা হবে। কবি বলেন :
আমি বিক্রমপুরে জন্মেছি সেটা আমার গর্ব, কিন্ত মানুষ হয়েছি কলকাতায়। সেটা আমার দ্বারা হবেনা। এই ছিলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
১৩৬১ বঙ্গাব্দে বাঘাযতীন স্কুলে পড়ানোর চাকরি করেন কিছুদিনের জন্য। এরপর পারিবারিক চা বাগান ‘টিপারা টি কর্পোরেশন’ এ চাকরি। বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন : আমার বাবা যখন চাকরি থেকে অবসর নেন ১৯৭৮ সালে, তখন সবচেয়ে বেশি মাইনে পেতেন আটশো টাকা।
কিন্ত এইসবের মাঝেও তার কবিতাযাপনের দিনরাত্রির ভিতরে কোনও ছন্দপতন ঘটে নি। পাশাপাশি ১৯৬৭ সালে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা ভাঙার বিরুদ্ধে আন্দোলন চলাকালীন মিছিলে যোগ দিয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কারাবরণ করেন। এ বিষয়ে শোভন সোমকে একটি চিঠিতে লিখেছেন :
গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে যে অমানুষিকতা ঘটে গেল তাতে মানুষ হিসেবে স্থির থাকা সম্ভব ছিল না। কিন্ত এর মধ্যেই কলকাতার কবি-সাহিত্যিকেরা ভালো আছেন। তারা যেভাবে দানবীয় কার্যকলাপ গুলি অবলীলাক্রমে মেনে নিলেন ( অবশেষে তাদের পিঠে সত্যি লাঠি বা বন্দুকের কুঁদো পড়েনি) তা দেখার মতো। এদের মধ্যে অনেক Humanist কবি-সাহিত্যিক আছেন। আপনি জানেন, কলকাতার অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে আমার বনে না। এর কারণ এই নয় যে আমি রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখি। এর কারণ আমি এখনো মনুষ্যত্বকে কিছু মূল্য দিই।
আর ঠিক এই কারণেই সত্তরের দশকের অগ্নিময় দিনগুলিতে কবি স্থির থাকতে পারেন নি। মুন্ডহীন ধড়গুলি আহ্লাদে চীৎকার করে এই কবিতা রচনার প্রেক্ষাপট জানাতে গিয়ে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন : আমাদের এখানে গত কয়েকবছর অত্যন্ত যারা কিশোর ছেলে, বাচ্চা ছেলেপেলে, তাদের খুব দুর্দিন কেটেছ। সেই দুর্দিনটা হচ্ছে এই ধরনের যে, তাদের অনেকেরই জীবনের কোনো নিরাপত্তা ছিল না, যখন তখন যাকে তাকে রাস্তায় পুলিশ ইচ্ছে করলে গুলি করে মেরেছে। আমার নিজের সেইসময় খুব - নিজেকে এবং সমস্ত দেশকে খুব অসহায় বলে মনে হয়েছে। এবং এটাও মনে হয়েছে যে আমরা এই দেশের রাজনৈতিক নেতা যারা - কবি সাহিত্যিক ইত্যাদি - আমরা কেউ এই ভয়াবহ অবস্থার কোনও প্রতিবাদ করিনি। - আর এই অনুভূতি থেকেই লেখাই কবিতা :
মুন্ডহীন ধড়গুলি আহ্লাদে চিৎকার করে, রঙ্গিলা, রঙ্গিলা
কী খেলা খেলিস তুই
যন্ত্রণায় বসুমতী ধনুকের মত বেঁকে যায় -
বাজারে মহান নেতা ফেরি করে কার্ল মার্কস লেনিন স্টালিন
গান্ধী এক এক পয়সা...
জীবন আর শিল্পের কারুবাসনার অন্বেষা তাঁকে শেষপর্যন্ত এই মানসভূমিতে পৌছে দেয়।আর তাই তিনি মন্ত্রের মতো লিখতে পারেন সেই অমোঘ কবিতা :
ছত্রিশ হাজার লাইন কবিতা না লিখে
যদি আমি সমস্ত জীবন ধ'রে
একটি বীজ মাটিতে পুঁততাম
একটি গাছ জন্মাতে পারতাম
যে গাছ ফুল ফল ছায়া দেয়
যার ফুলে প্রজাপতি আসে, যার ফলে পাখিদের ক্ষুধা মেটে
কবিতা না লিখে
যদি আমি মাটিকে জানতাম।'
এ কবিতা আমাদের সাধক কবি রামপ্রসাদের একটি বহূশ্রুত গানের কথা মনে পড়িয়ে দেয় :
মন রে কৃষিকাজ জান না
এমন মানবজমিন রইল পতিত
আবাদ করলে ফলত সোনা ...
এবং সেই সঙ্গে স্কটল্যান্ডের কবি রবার্ট বার্নসের একটি কবিতার কথা মনে পড়িয়ে দেয় :
Man's inhumanity to Man
Makes countless thousands mourns!
(Man was Made to Mourn, A Dirge)
তার অনুজ কবি শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন : কবিতার কাছে মানুষ তো কেবল শিল্পসৌকর্য খুঁজতে যায় না, সেখানে সে যায় তার দু:খ আনন্দের একটা ভর পেতে, সংকটমুহূর্তেও সাহস পেতে।মানুষ হিসেবে একটা সংযোগ খুজতে। পাঠকেরা জেনেছিলেন , বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় সেই সংযোগের ব্যাপকতা, সংযোগের সহজতা আছে। সেইসঙ্গে যা কিছু এই সহজ সংযোগের বাধা বা প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াতে চায় , সেই সামাজিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ধিক্কার আর প্রতিবাদ আছে সেখানে। সমস্ত অর্থেই বাংলার সবচেয়ে প্রতিবাদী এই কবি, তাঁর কবিতা যেন আমাদের সামনে একটা সম্পূর্ণ ইতিহাস তুলে ধরে, আমাদের হৃদয়ের ইতিহাস আর আমাদের সময়ের ইতিহাস ।
শঙ্খ ঘোষ তাঁর কবিতায় আবিস্কার করেছিলেন আমাদের হৃদয়ের ইতিহাস আর আমাদের সময়ের ইতিহাস। আজ এই সময়ের দিকচক্রবালের দিকে তাকিয়ে আমরা যদি ভাবি, ভাবতে চাই যে বন্দীমুক্তি আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সেই আন্দোলন আজ কোথায় দাড়িয়ে, তাহলে দেখব তার কাজ আজো অপূর্ণই থেকে গেছে। বারাসতের এপিডিআর কর্মীর তথ্য জানার অধিকার আইনের আবেদনপত্রের (৫.১১.২০১৮) উত্তরে জানা গেছে ভয়াবহ তথ্য। ১৪ বছর কারাবাসের পরও পশ্চিমবঙ্গের কারাগারগুলিতে রয়েছেন ২৭১ জন। (Life Behind Bars : West Bengal, March 2019)
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম শতবর্ষে এই হোক আমাদের আরব্ধ অভিজ্ঞান।