বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[শিল্প]

[শিল্প]

অকর্মার ঢেঁকি

সন্দীপন নন্দী

photo

জেল থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে বলল,
- কোনও গরমিল নেই! দেখুন?
বলেই খাতাটা এগিয়ে দিল পরিমল। সন্ধ্যায় খবরটা দেখে তাজ্জব হয়ে গেল টিভিদর্শক!
- খুন তো করিনি, মানুষের গায়েও হাত তুলিনি! কটা জিনিস ভেঙেছি মাত্র! দোষ কিসের?
দশতলা হাসপাতালে থমথমে মুখের এ উত্তরই পেয়েছিলেন শহরসেরা মনোবিদ!
পেপারে স্টোরি হল। সবাই তাকে দেখতে ট্রেন-মেট্রো ধরে চলে এলেন। ভীড় সামলাতে পুলিস এল।
ঘটনার সূত্রপাত বছর কয়েক আগে। লিগম্যাচে পেনাল্টি মিস করে বাবার ফেয়ার ওয়েলের হাতঘড়ি ভেঙে শুরু। এরপর জীবনের ব্যর্থতার দিনে একের পর এক জিনিস ভেঙে শান্ত হতো পরিমল। শনিবারে জন্ম নয়। তিনকুলে দুর্বাসা টাইপ কেউ জন্মায়নি! তবু কিছু না কিছু ভেঙে শান্ত হতো সে।
তাই নাম হয়ে গেল ভাঙাপরু। বহু ডাক্তার দেখিয়ে, মেরে পিটে, কবজ ধরিয়েও ভাঙারোগ সারল না। বরং ভাঙার ফিরিস্তি পরম যত্নে একটা খাতায় টুকে রাখত সে। ঘড়ি, চশমা, টিভি, কাঁচের বাসন। সবের ফিরিস্তি পরমযত্নে লিখে রাখত পরিমল।
এভাবেই একটা ছেলের হতাশা, অভিমানের জবাব পেত পরিবার। একমাত্র সন্তান। রিহ্যাবে পাঠানোর সাহস হয়নি। পাগলও নয়। তাই মা-বাবা ছেলের অত্যাচার সহ্য করতেন। যে ছেলে স্কুলের গন্ডিও পেরোতে পারেনি। কিন্তু ফেল করেও ঝাঁপ নয়, গলায় দড়ি নয়, বেঁচে থেকেই ব্যর্থতাকে সামলে নেবার এক নতুন পন্থার স্রষ্টা ছিল পরিমল ওরফে পরু। রাগ জল করার যাদুকর।
রাগ উঠলে একে একে সব ভেঙে যেত। একসময় হাঁফিয়ে উঠত। তখন গোড়াকাটা লাউগাছের মত মেঝেতে শুয়ে হাউহাউ করে কাঁদতো। পাড়াপড়শিরা ছুটে আসতেন চিৎকারে। পরু বলতো,
- মা চিন্তা করো না।
পরুর মা চিন্তা করেননি। শুধু এই এককথা শুনতে শুনতে বছর কেটে গেছে তার। তবু সন্তানের মুখ চেয়ে সহ্য করতেন।
এভাবেই বাবা-মায়ের সহনশীলতার পরীক্ষা নিতো পরিমল। দেখতে দেখতে বয়স বাড়ল। সব চাকরির দরজা একে একে বন্ধ হয়ে গেল। তবু ঝিরঝির বৃষ্টিতে পরুর সাইকেল শোঁ শোঁ ছোটে। কুকুর ধাওয়া করলে দুরন্ত দৌড়ে নিরাপদে বাড়ি ফেরে! ফিউজ উড়ে যাওয়া সার্কিট সারিয়ে আলো ফেরায় ঘরে। মগডালের পাকা চালতা পেড়ে আনে নিমেষে! তখন কে বলবে এ ছেলেই সে লাস্টবয় পরিমল?
বর্ষার মেঘ ডাকে। ব্যাঙ ডাকে। মাঠঘাট জলে ভরে ওঠে। অঝোর বৃষ্টিতে ভেজে পরিমল। জোরে জোরে প্যাডেল চালায়। কিন্তু একচুলো এগোতে পারেনা। যেটুকু এগিয়েছিল তার বর্ণনা নিম্নরূপ।
পাড়ার শপিংমলের ডোরকিপার জিনি। দূর থেকে পুলিস মনে হতো মেয়েটাকে। রাগি রাগি মুখ। শুধু দরজা খোলাবন্ধের কাজেই মাসে দশহাজার। শুনে চমকে গিয়েছিল পরিমল। সাবান কিনতে গিয়ে আলাপ। একজন ব্যর্থ ছেলেকে নিয়ে কেউ যে স্বপ্ন দেখতে পারে, এটাই ছিল পরুর কাছে মহাজাগতিক ব্যাপার।
- যদি কাজ করতে চাও ম্যানেজারকে বলব। করবে? কি গো?
পরিমল একটা ঢোঁক গিলে, চারপাশের আলো ঝলমল কাঁচের শো-কেসে তাকালো। দেখল এক শিসমহল। ভয়ে গুটিয়ে গিয়ে সোজাসুজি উত্তর দিল,
- আমায় দিয়ে হবে না।
কথাটা শুনেই জিনি ঠোঁট বেঁকিয়ে অভিযোগের সুরে বলল,
- কি হবে শুনি? একটা অকর্মার ঢেঁকি।
পরিমল ভাবল, এদ্দিনে একজন ঠিকঠাক তাকে চিনেছে। অকর্মার ঢেঁকি। কী সুন্দর নাম! ফুলের গন্ধ আসে। কী ফুল? ভাবার সময় দেয়নি জিনি। পরুর হাতটা বুকে টেনে বলেছিল,
- তুমি একটা ফালতু লোক।
জিনি পরুর মেলামেশা বাড়ল। পরিমল জীবনে প্রথম তালাচাবির প্রয়োজন অনুভব করল। কিন্তু একদিন জিনির দেওয়া কাঁচের ফুলদানিও মেঝেতে আছড়ে ফেলল।
- ভাল লাগে, ভালোবাসি না। মজা করে বলেছিল জিনি। ব্যস!
বাড়ি ফিরেই জিনির গিফটগুলো চুরমার করল। সে ছিল এক স্মরণীয় দিন। যেদিন জীবনে প্রথম নিজের জিনিস ভেঙেছিল পরিমল। প্রেমটাও ভেঙে গেল।
এরপর বিশ্বাসের অভাবে অনেক ছোটখাট কাজের অফার ছেড়ে পাকাপাকিভাবে বেকারখাতায় নাম লেখাল পরিমল। কারণ রাগ তো যে সে রাগ নয়। কোম্পানিগুলো যে রাগ দেখে তাড়িয়েই দিতনা, জেল খাটিয়ে ছাড়ত। ফলে কোনও কাজেটাজে না জড়িয়ে পরিমল জিনির অকর্মার ঢেঁকি হয়েই বাঁচতে চাইল।
এদিকে এক কাঠাবেকার ছেলের রাগ দেখার জন্য পাড়া এখন টুরিস্ট স্পট। লাইভ ভাঙচুর চাক্ষুষ করতে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসছেন প্রতিদিন। যে ভাঙচুরের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে গতকাল। সবমিলে এখন সে ফেমাসপরু। তাই কাজকর্ম না করেও দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল তার নাম। শ্রমের মূল্য অবশেষে হাতেনাতে পেল পরিমল।
শোয়ার ঘরে এসব সাত-সতেরো ভাবতে ভাবতেই আচমকা, বাতাস জানলা বন্ধ করে দেয়। বাইরে বৃষ্টি নামে। আকাশে তাঁবুর মত কালমেঘ। দূরের পাঁচিলে একটা কাক চুপচাপ বসে থাকে। কিছু পিঁপড়ে উঠে আসে। পরিমল দু’ বার তাড়ানোর চেষ্টা করেও পারে না।
আজ হাতের কাছে কিছুই নেই। সব ইভেন্টে হেরে যাওয়া পরিমল এক খোলা জানলার ধারে বসে থাকে। ব্যর্থপুরুষ। ব্যর্থ সন্তান। ব্যর্থ প্রেমিক। তাই পৃথিবীর যে কোনও পরাভব উপাখ্যানের সঙ্গে এজীবন হুবুহু মিলে যায়। অথচ যে হেরে গিয়েও হারেনি। হাজার গালমন্দ, লজ্জাশরম সয়েও গভীর রাতে বাড়ি ফিরতো। কাপুরুষের মত পালিয়ে যেতো না। পাড়ার একনম্বর হেরো হয়েও রাস্তায় বেরোতো, বাবা-মাকে ওষুধ এনে দিতো। অন্যের সাফল্যে হিংসে করতো না।
এটাই পরিমল।
যে হাজার চেষ্টাতেও ভাঙচুর ছাড়তে পারল না। ফলে একদিন মিটিং করে পাড়ায় একঘরে করে দেওয়া হল ওদের। সকলের প্রাণের মায়া আছে। কোনদিন মাথায় কি পোকা কামড়ায় কে জানে! পরিমলকে রাস্তায় দেখলেই এখন সবাই দূরত্ব রেখে চলতে থাকল। বেকা রপরিমল আসছে, সাবধান। সতর্কবাণী মুখে মুখে ঘুরতে লাগল। যে মুখ দেখলেই দিনখারাপ। পরীক্ষায় কম নম্বর। বাড়িতে অশান্তি। তাই আড়ালে পরিমলের আরেকটা নাম হয়ে গেল, অপয়া পরিমল।
গতকাল থেকে তাই পাড়ার মূল রাস্তা ছেড়ে পুকুরপাড়ের ঘুরপথে যাতায়াত শুরু করল সে। সকলের মঙ্গল কামনায় নিজেকে গর্তে লুকিয়ে নিল। লোক দেখলেই রুমালে মুখ ঢাকে। যেন এক পাক্কা কয়েদি সে।
কিন্তু এত সাবধানে চলেও যখন পাড়ায় একের পর এক অঘটন ঘটল, তখন ভয়টা মহামারির মত ছড়িয়ে পড়ল। অপয়া বিশ্বাসের ভিতটা মজবুত হল সকলের। ঘরে ঘরে বিপত্তারিণী, মঙ্গলচণ্ডী পুজোর হিড়িক পড়ল। সব কুলক্ষণের মূলে নকি বেকার পরিমল। খবরটা দোকানে, বাজারে আগুনের মত ছড়াল। বিপদ বাড়ল পরিমলের।
মহালয়ার রাতে সুহৃদ লেনের এক বাড়িতে তালা ভেঙে গয়না লোপাট। লকার ভাঙার কায়দা দেখেই বাড়ি মালিক সোজা পরুর নামে ডায়েরি দিলেন। প্রথম জেলের মুখ দেখল পরিমল।
সেবার দুর্গাপুজোর ডোনেশন না পেয়ে মিশ্রবাড়ির কাঁচের জানলায় ঢিল দিল বিপ্লবী সংঘ। পরদিন পরিমলের বাবা-মাকে শাসিয়ে গেল আস্তপাড়া।
একবার রথতলা প্রাইমারি স্কুলের মিড-ডে মিলের চালচুরির প্রতিবাদে পথ অবরোধ হল। উত্তেজিত জনতা গাড়ির কাঁচ ভাঙল, আগুন ধরাল। সবাই পালিয়ে গেল। বাড়ি থেকে পরিমলকে ধরে নিয়ে গেল পুলিসের জিপগাড়ি।
এভাবেই পাড়ার সকল কুকর্মের টার্গেট হয়ে গেল অসহায় পরিমল। একটা বেনিয়ম নিয়ম, হয়ে গেল সরকারি খাতায়।
যেকোন ভাঙচুরের ঘটনায় ভিক্টিমকে খুঁজে না পেলেই এবার থানায় নিমন্ত্রণ পেতে লাগল সে । যেন সে এক আহত ফাঁদের ঘুঘু! যার পালাবার পথ নেই।তাই প্রতিবার সব কথা হজম করে মাথা নিচু করে প্রিজনভ্যানে উঠে বসত পরু!মুখ ঢেকে নিত রুমালে।এরপর জেরা চলত। মাথার ওপর হাইপাওয়ার হ্যালোজেন। গ্লাসের ঠান্ডাজল ছিটকে আসত মুখে। লকআপে কান পাতলেই শোনা যেত,
- খুব ভাঙার শখ না? হাত ভেঙে দেব শালা!
- স্যর লাগছে। ছেড়ে দিন।
- ভাঙার সময় মনে ছিল না। শালা অপয়া, বেকার। অকর্মার ঢেঁকি ।
মারতে মারতে পুরো পাড়ার মত থানার বড়বাবুও কিচ্ছু বিশ্বাস করতেন না। শেষরাতে এক্সরে করার কটা টাকা পকেটে গুঁজে দিয়ে বলতেন,
- ভাগ!
তারপর রাত বাড়লে পুকুরপাড়ের রাস্তা ধরে সোজা ঘরে ঢুকতো পরিমল। এই রোজকার রুটিন। তার কর্মহীন জীবনে দিবারাত্রির কাব্য বলতে এটুকুই।
আজ থানা থেকে বেরিয়েই বাড়ির পথ ধরল পরিমল। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। কুকুর কাঁদছে। দূরের ঝিঁঝিঁপোকাগুলোও পরিহাস করছিল এ পরিস্থিতিকে।
ধীরপায়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির জংধরা গেটের কাছে এসে দাঁড়াল একজন।
- মা, দরজা খোলো। তখনই উঠোনে একটা মানুষের ছায়া তৈরি হল। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিল না পরিমল। দরজা খুলে মা বেরোতেই, পরু চিৎকার করে উঠল।
- অপয়ার ছায়া। মাড়িওনা মা। সর্বনাশ হবে।
- সর্বনাশের আর কী আছে বাবা?
শুনেই মাকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগল পরিমল। তারপর খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঘরে গেল। প্রবল রাগে কিছু ভাঙতে চাইল। কিন্তু লকআপের ব্যথাটা যাবতীয় ইচ্ছেকে থামিয়ে দিল। তারপর মাঝরাতে মরার মত ঘুমিয়ে পড়েছিল পরিমল। মরাই তো। জীবিতমৃত এক মানুষ।
পাক্কা সাতদিন শয্যাশায়ী থাকার পর আবার পথে নামল পরু। রেশনের লাইনে হঠাৎ একটা হাত এসে কাঁধটা ঝাঁকিয়ে দিল তার।
- খুব ব্যথা নারে? ব্যথা বুঝি!
একহাতে চিনির ব্যাগ অন্যহাতে কেরোসিন। পেছন ফিরতে একটু সময় লাগল পরিমলের।
- বঙ্কাদা না!
- কাজ করবি?
- আমি তো অপয়া। বেকার দাদা। একটা অকর্মার ঢেঁকি! কোন কাজ পারি না।
মুখটা লাল করে বঙ্কা বলল, পারতে হবে না। অকর্মার ঢেঁকি বেচেই না হয় খাবি!
কথার মানে না বুঝে বোকার মত হেসে উঠল পরিমল। বঙ্কা যোগ করল, রীতিমতো বেতন পাবি। শুধু সময়মতো স্পটে পৌঁছে যাবি। বাকিটা আমরা বুঝে নেবো। মানে তোর অফিস বুঝে নেবে!
পরিমল আর প্রশ্ন করেনি।
সব শুনে বঙ্কার বাইকের পেছনে বসে হাওয়ায় উড়তে উড়তে বাইপাসের দিকে এগিয়ে গেল দু’ জন। ট্রেনিং পিরিয়ডেই একদম চোস্ত কর্মী হয়ে উঠল পরিমল। এই প্রথম কোনও কাজ প্রশংসা পায় সে।
এখন কোনও জায়গায় গন্ডগোল হলেই গাড়ি এসে নিয়ে যায়। বিভিন্ন ঘটনায় ভাঙচুরের পর সবাই পালিয়ে যায়, একা পরিমল থেকে যায়। উদম মার খেয়ে ফিরে আসে অফিসে। ডাক্তার থাকে। একটু চেকআপ করেই ছেড়ে দেয়। এটাই এখন পরিমলের অফিসরুটিন। এক বেকার ছেলের কাজে ফেরার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা।
তাই আপাততথেকে যাওয়াটাই পরিমলের কাজ। দিনশেষে টেষ্ট ক্রিকেটে ক্রিজে থেকে যাবার মতো। বলেছিল টোটনদা।
কখনও ভোররাতে পুলিসের জিপ বাড়ি নামিয়ে যেত। তখন বিড়বিড় করত পরিমল। মা বলতেন, এতো দেরি যে!
জবাব আসত, এখন অফিসে বড্ড কাজের চাপ মা! সব সময় ফিল্ডওয়ার্ক। আজ এদিক তো কাল ওদিক। বলতে বলতেই যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে নিস্তেজ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ত পরিমল।
পরদিন আবার সাতসকালে গাড়ি এসে নিয়ে যেত পরিমলকে।
বিধানসভা ভোট এগিয়ে আসে। রাজ্যে অশান্তি বাড়ে। খুন, হাঙ্গামা আকছার। পরুরও ব্যস্ততা বাড়ে। এখন বাড়িতে গাড়ি এলেই পাড়াপড়শি বলাবলি করে, ঐ দ্যাখ পরুর অফিসের গাড়ি। হয়তো অবাক হয়, রূপকথার মতো এক অকর্মণ্য ছেলের সিঁড়ি ভাঙা গল্পে।
কিন্তু নমিনেশনের পর ওর ব্যস্ততা তিনগুণ বেড়ে গেল। মডেল কোড অব কন্ডাক্ট চারদিকে। পুলিসি টহল। তার মাঝেও পরুর কাজ জারি থাকে।
এমাস থেকে টিএ, ডিএ সব বেতনে যোগ হবে। ঘুরে ঘুরে ঝুঁকির কাজ। তাই সদর অফিসে অর্ডার এসেছে গতকাল। সামনের মাস থেকে মেডিক্যাল অ্যালাউন্সও দেবে, বলেছে, অফিস। শর্ত একটাই ভেঙে পড়া চলবেনা। সব সহ্য করতে হবে। সব। পরিমল পরমোৎসাহে অফিসের হয়ে কাজ করে। মনে পড়ে বঙ্কাদার ধ্রুবমন্ত্র।
- ট্রেনি পিরিয়ডেই যা কষ্ট! তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। পরিমল সব ঠিক হয়ে যাবার অপেক্ষায় থাকে।
সেদিন বিকেলে সবশুনে পরিমলের বাবা বহুদিন পর ছেলের জন্য একটু স্বস্তি অনুভব করলেন। হয়তো খানিক গর্বও। আর পাড়াশুদ্ধ লোকের বিস্ময়ের শেষ থাকল না। একটু হিংসেও যে হল না, তাও নয়। সবমিলে ভাঙাপরুর উত্থানে পুরো পাড়া চমকে গেল। কিন্তু কাকপক্ষীতেও টের পেল না,পরিমলের কাজটা আসলে কি?
প্রথম বেতনের টাকায় বাবার একখানা হাতঘড়ি আর মায়ের ছাপাশাড়ি কিনে আনল। সেদিন বাড়িটা যেন আনন্দের জ্যোৎস্নায় স্নান করছিল। পরুর বাবা উঠোনে হাঁটতে হাঁটতে বলেছিলেন, শুনছো গো? তোমার অপয়া পরিমল, কম্ম করছে! আমাদের কপাল ফিরছে পরুর মা! কপাল ফিরেছে। বুঝলে?
পরদিন দুপুরে মিটিং শেষে অফিসে কানের কাছে মুখ এনে টোটনদা ফিসফিস করে কথাটা বলল।
- বেশি সময় নেই। ভালোয় ভালোয় বেরিয়ে পড়। আজ প্রাণ দিয়ে কাজটা করলেই, চাকরি কনফার্মড। কেউ ঠেকাতে পারবে না।
কাঁঠালতলার চৌমাথায় গাড়ি এসে নামিয়ে গেল পরুকে। একা দাঁড়িয়ে থাকে ও। বসন্ত বাতাসে কিছু অহেতুক পাতা উড়ে আসে। আকাশের মেঘরাশি ঝুমকো ফুলের মত ঝুলে থাকে মাথার ওপর। তার নীচেই ক্রমশ হাতের মুঠি শক্ত করতে থাকে পরিমল। আর পাঁচ মিনিট। তারপরেই দাঁতে দাঁত চেপে থেকে যেতে হবে। পাগলাকুকুর তাড়া করলেও আজ ছুটবে না সে। সব সহ্য করতে হবে। শত বিপদেও নিস্পৃহ পাথর হয়ে থাকলেই আজ চাকরি পাকা।
বঙ্কাদা কেন, জিনি কেন? পুরো পৃথিবীকে আজ দেখিয়ে দেবে।
- আমি অপয়া? অকর্মার ঢেঁকি! ঠোঁট নড়ে ওঠে পরুর।
আগপাছ ভাবতেই প্রায় একশো লোক লাঠি হাতে এগিয়ে আসে ওর দিকে। চাকরির সঙ্গে যার কোনও যোগ নেই। জীবনে টিকে থাকতে এই প্রথম পালাতে ইচ্ছে করে পরিমলের। মায়ের মুখ মনে পড়ে। বাবার কথা ভেবে প্রাণপণে ছুটতে থাকে পরিমল। মাঠ, অফিস, নদী, ধানক্ষেত পেরিয়ে যায়। পরিমলের দৌড় আর শেষ হয় না। প্রত্যেকের হাতে লাঠি। অনেকের হাতে পাথর।
- দাঁড়া। বাঁচতে চাইলে দাঁড়া। শেষবার বলছি। চাকরি চলে যাবে। লাইফও শেষ হবে। পালাস না ।
কে শোনে কার কথা। গলা শুকিয়ে আসে। অলিগলি পেরিয়ে পাড়ার কাছে এসে হাঁফাতে থাকে পরিমল। পেছন ফেরে। প্রথম দূর থেকেও লক্ষ্য করে। কী আশ্চর্য! এদ্দিন যাদের সঙ্গে উঠল বসল, এক টেবিলে খেল, তারাই ওর ওপর হামলা চালাতে

দৌড়চ্ছে। এ কেমন পাকা কাজ? ও বোঝে এটা কাজ নয় ফাঁদ।
শ্লোগান ওঠে, পরিমলের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও। চয়নদার মূর্তি ধ্বংসকারী অপয়া পরিমলের শাস্তি চাই, শাস্তি চাই। চিৎকার এগিয়ে আসে।
বাবা-মায়ের কথা ভেবে গতি বাড়ায় পরিমল। ছুটতে থাকে। একটা পাকা চাকরির লোভ তুচ্ছ করে, এই প্রথম জিতে যাচ্ছে পরিমল। নিজের কাছে। মায়ের কাছে। দেশের কাছে।
বাতাসে চুল উড়তে থাকে। পায়ে কে যেন আজ কল ফিট করে দিয়েছে ওর।
- প্রাণের ভয় থাকলে থেমে যা পরিমল। একটা সমবেত সঙ্গীতের মত বাজতে থাকে কথাগুলো।
কিন্তু কে শোনে কার কথা? পাড়া, শহর, জেলা ছাড়িয়ে পুরো দেশের অলিগলিতে ছুটতে থাকে পরিমল। কিন্তু অফিস কলিগরা ওর নাগাল পায় না আর!

সন্ধ্যায় হেড অফিসের সিদ্ধান্তে পরিমলের সন্ধানে, কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়। রাত হয়। পরিমল ছুটতেই থাকে। এটাই আজ থেকে ওর নতুন কাজ। দেশের অকর্মা বেকার পরিমলদের নিয়ে একটা ছুটে বেড়ানো নতুন কাজের নেতৃত্ব দেওয়া।
সকাল সকাল সব কাগজেই বিজ্ঞাপনটা বেড়ল। কিন্তু পরিমলরা চোখ ফিরেও দেখল না। — শ্রমজীবী ভাষা, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.