বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[শিল্প]
গত ১৫ মে ২০২৫ চলে গেলেন কবি-অনুবাদক-নাটককার ও গল্পকার মানস চৌধুরী। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ২০১৮ সালে শিলচরের ‘রূপম সাংস্কৃতিক সংস্থা’ আয়োজিত সর্বভারতীয় একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতায়। আমরা দুজনেই কলকাতা থেকে বিচারক হিসেবে শিলচরে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের সেই প্রথম পরিচয় ক্রমশই এক প্রগাঢ় বন্ধুত্বে রূপান্তরিত হয়েছিল। মনে রাখা দরকার, ২০১৮-তে আসামে নাগরিকপঞ্জি নিয়ে উত্তাল হয়েছিল বরাক উপত্যকা। প্রথম দিনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেই আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্য আমাদের পরের দিন গণ-ধর্ণা কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকার আহ্বান জানান। মানসবাবু ও আমি দু’জনেই যাই। ধর্ণা মঞ্চে যাবার পর মানসবাবু ও আমাকে বক্তব্য রাখার জন্য বলা হয়। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম যে মানসবাবু কোনওরকম প্রস্তুতি ছাড়া এই নাগরিকপঞ্জি বিষয়ে একটি তথ্যপূর্ণ নাতিদীর্ঘ ভাষণ দিলেন। ফিরে আসার পর ‘শ্রমজীবী ভাষা’ পত্রিকার (১ মে ২০১৮) সংখ্যায় আসামে বাঙালির নাগরিকত্বের বিষয়ে যে লেখাগুলি প্রকাশিত হয় তার নেপথ্যে মানসবাবু ও আমার সক্রিয় সংযোগ ছিল।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অর্থনীতির কৃতী অধ্যাপক। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করেছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছেন আর্জেন্টিনা, পর্তুগাল, মরক্কো ও চীনে। Exim Bank Award Committee জুরিদের বিচারে ২০১০-১১ সালের অন্যতম সেরা গবেষণামূলক কাজের স্বীকৃতি লাভ করেন। ‘একুশ শতক’ পত্রিকায় অর্থনীতি বিষয়ে নিবন্ধ লিখেছেন। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অর্থনীতির অধ্যাপক এই পরিচয়ের বাইরে পরিচিত হতেই ভালোবাসতেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালিখি করেছেন। পেশাগত জীবনে তাঁর অধ্যাপনার শুরু বিদ্যানগর কলেজে। সেখানে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করতেন ষাটের দশকের বিশিষ্ট কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়। অগ্রজপ্রতিম এই সহকর্মীর সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। কবিতার প্রতি ছিল তাঁর নিবিড় আকর্ষণ। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মায়াবন্দর’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে। নব্বই দশকের প্রথম ভাগে ‘শব্দের অশ্বারোহী’ নামে আর একটি কাব্যগ্রন্থ নরসিংহ দত্ত কলেজের সহকর্মী-বন্ধু কুন্তল চট্টোপাধ্যায় ও সঞ্জীব সাহার সঙ্গে যৌথভাবে প্রকাশিত হয়। চলচ্চিত্র ও নাটকের প্রতি ছিল তার গভীর অনরাগ। দেশ-বিদেশের ধ্রুপদী চলচ্চিত্রগুলি নিয়ে চর্চার পাশাপাশি বিদেশি নাটককারদের রচনা পড়েছেন গভীর আগ্রহে। লু সুনের ‘আমার পুরোনো বাড়ি’ গল্পের ছায়ায় ‘ভাঙা বাড়ি’ নামে একটি নাটক লেখেন ‘অপরাজিত’ পত্রিকার লু সুন সংখ্যায়। (জানুয়ারি-মার্চ ১৯৮২)। ১৯৮৮ সালে জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’ উপন্যাসটি বাংলা নাট্যরূপ দিয়েছিলেন সম্পূর্ণ নিজস্ব আগ্রহে। এছাড়া আর্থার মিলারের একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক অনুবাদ করেছিলেন। এই দুটি অনুবাদ/রূপান্তর পাণ্ডুলিপি আকারেই থেকে গেছে। প্রয়াণের পূর্বে তিনি গভীরভাবে মগ্ন ছিলেন শিশিরকুমার ভাদুড়ীর জীবনী-বিষয়ক একটি নাটকের ভাবনায়। এই নিয়ে নানা সময়েই কথা হয়েছে। বছর কয়েক আগে নিজের উদ্যোগে ‘কোন্নগর যাযাবর’ নামে একটি নাট্যদল করেছিলেন থিয়েটার ওয়ার্কশপের বর্ষীয়ান অভিনেতা দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সঙ্গী করে। দুটি নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন ‘মহাপ্রস্থান’ ও ‘ছেদবিন্দু’। নাটককার হিসেবে তিনি ধ্রুপদী ঘরানার নাটক লিখতেই পছন্দ করতেন। বিভিন্ন নাট্যপ্রতিযোগিতায় বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তার মধ্যে শিলচরের ‘রূপম’ আয়োজিত সর্বভারতীয় একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতায় বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ‘শ্রমজীবী ভাষা’ পত্রিকায় নিয়মিতভাবে না হলেও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা লিখেছিলেন। তার মধ্যে ‘গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক সংস্কার: ভারতের কৃষি ও কৃষক’। (১ ফেব্রুয়ারি ২০২১) তাঁর কয়েকটি অনুবাদ-কবিতাও ‘শ্রমজীবী ভাষা’-তে প্রকাশিত হয়। নাটক রচনার পাশাপাশি তিনি গল্পও লিখেছেন। ‘অপরাজিত’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি চলে গেছেন। পড়ে রইলো তাঁর অনেকগুলি সারগর্ভ প্রবন্ধ সম্ভার, কয়েকটি নাটক, কয়েকটি অনুবাদ নাটক ও গল্প। আমাদের দায়িত্ব তাঁর সেই রচনাগুলিকে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করার। প্রয়াণে বাংলার সংস্কৃতি জগৎ একজন একনিষ্ঠ সংস্কৃতি কর্মী-কবি-গল্পকার-নাটককারকে হারালো।