বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[শিল্প]

[শিল্প]

মহাভারতে নারী

শামিম আহমেদ

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ মার্চ, ২০২২— মহাভারত ভারতের দ্বিতীয় মহাকাব্য, সেখানে নারী সম্পর্কে যে সমস্ত কথা পাওয়া যায় তা অনেক সময় পরস্পরবিরুদ্ধ। কখনও নারীকে স্বর্গের সিঁড়ি বলা হয়েছে, আবার কোথাও নারীকে নরকের দরজা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মহাকাব্য পড়লে বহু জায়গায় নারীর অধিকার পুরুষের সমকক্ষ বলেই মনে হয়। যুধিষ্ঠিরের অর্থমন্ত্রী হিসাবে দ্রৌপদী, ধৃতরাষ্ট্রের অমাত্য বা মন্ত্রণাদাতা হিসাবে গান্ধারীর ভূমিকা এ ক্ষেত্রে স্মরণীয়। কন্যাসন্তান ভূমিষ্ঠ হলে ভারতের বহু পরিবারে দুঃখের ছায়া নেমে আসে, মহাভারত কিন্তু তার ব্যতিক্রম। গঙ্গা, সরস্বতী, গান্ধারী, কুন্তী, দ্রৌপদী, সুভদ্রা, সত্যভামা, বিদুলা, সুলভা প্রভৃতি চরিত্র বিচার করলে মহাকাব্যের নারীর প্রকৃত চিত্র কিছুটা পাওয়া যায়। আমরা এখানে তিনটি চরিত্র বিষয়ে কিছু কথা বলবো- দ্রৌপদী, সুলভা ও সরস্বতী।
বনপর্বে দেখা যায়, বনবাসের সময় প্রচণ্ড দুঃখ কষ্টের মুখোমুখি হয়ে দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে বেশ কিছু কথা বলেছিলেন, যার মধ্যে নাস্তিক নীতিতত্ত্বের আভাস আছে বলে পণ্ডিতরা মনে করেন। ভগবানের পক্ষপাতিত্ব সম্পর্কে দ্রৌপদী বলেন,
ন মাতৃপিতৃবদ রাজন্ধাতা ভূতেষু বর্ত্ততে।
রোষাদিব প্রবৃত্তোহয়ং যথায়মিতরো জনঃ।। (বনপর্বঃ ৩০/৩৮)
দ্রৌপদীর কথা শুনে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন,
বল্গু চিত্রপদং শ্লক্ষং যাজ্ঞসেনি ত্বয়া বচঃ।
উক্তং তচ্ছ্রুতমস্মাভির্নাস্তিক্যন্তু প্রভাষসে।। ৩১/১ (বনপর্ব)
“তোমার বাক্যগুলি খুব শোভন এবং সুকুমার হলেও নাস্তিক-মতবাদ প্রকাশ পাচ্ছে।”
যাজ্ঞসেনী এখানে তৈর্থিক মতাবলম্বী। কপিল, কণাদ, বুদ্ধদেব ও মহাবীর ছাড়াও যে কয়েকজন সংখ্যালঘু (Minor) তৈর্থিকদের পরিচয় পাওয়া যায়, তা দেখে মনে হতে পারে যে এঁরা সকলেই বেদ, বেদোক্ত কর্মকাণ্ড ও ব্রাহ্মণ বিরোধী ছিলেন। মহাভারতে পঞ্চপাণ্ডবের ঘরণী দ্রৌপদীর একটি উক্তিতেও তৈর্থিক মতের আভাস পাওয়া যায়। বনপর্বে যুধিষ্ঠির-দ্রৌপদীর বাদানুবাদে দ্রৌপদী যে নাস্তিক মতের উপস্থাপনা করেন, তাকেই অনেকে তৈর্থিক মত বলে উল্লেখ করেছেন। একটি জায়গায় দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন, “মহারাজ, বিধাতা প্রাণীগণকে মাতা-পিতার দৃষ্টিতে দেখেন না। তিনি রুষ্ট ইতর জনের ন্যায় ব্যবহার করেন। তোমার বিপদ আর দুর্যোধনের সমৃদ্ধি দেখে আমি বিধাতারই নিন্দা করছি, যিনি এই বিষম ব্যবস্থা করেছেন। যদি কৃত কর্মের ফল কর্তারই ভোগ্য হয়, অন্যের ভোগ্য না হয়, তবে প্রবৃত্তিদাতা ঈশ্বর নিশ্চয় কর্মজনিত পাপে লিপ্ত হন”। এই কথা শুনে যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর বাক্য সমূহকে নাস্তিকের যোগ্য বলে আখ্যা দেন। তিনি দ্রৌপদীকে উত্তরে বলেছেন, “কল্যাণী, তুমি মূঢ় বুদ্ধির বশে বিধাতার নিন্দা ক’রো না, সর্বজ্ঞ সর্বদর্শী ঋষিগণ যার কথা বলেছেন, শিষ্টজন যার আচরণ করেছেন, সেই ধর্মের সম্বন্ধে সংশয়াপন্ন হয়ো না।”
দ্রৌপদীকে এখানে নাস্তিক বা তৈর্থিক, যাই বলা হোক না কেন তিনি যে ধর্ম সম্পর্কে তর্কশীল ও সংশয়াপন্ন হয়ে পড়েছিলেন, সে বিষয়ে কোন সংশয় নেই। যুধিষ্ঠির তাঁকে ক্রোধ সংবরণ করতে বলেছেন, এমনকি দ্রৌপদী যে মাত্রা ছাড়িয়ে তর্ক করছেন, এই সাবধান বাণীও যুধিষ্ঠিরের দ্বারা উচ্চারিত হয়েছে। যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর যে প্রশ্নের বা ক্ষোভের উত্তর দেননি, এটা বোধহয় তারই প্রতিক্রিয়া। দ্রৌপদী কথোপকথনের মধ্যে যুধিষ্ঠিরকে জানিয়েছেন, “তুমি বহুপ্রকার মহাযজ্ঞ করেছ তথাপি বিপরীত বুদ্ধির বশে দ্যুতক্রিয়ায় রাজ্য, ধন, ভ্রাতৃগণ আর আমাকেও হারিয়েছ। তুমি সরল মৃদুস্বভাব বদান্য লজ্জাশীল সত্যবাদী, তথাপি দ্যুতব্যসনে তোমার মতি হল কেন?... মানুষ যেমন অচেতন নিশ্চেষ্ট কাষ্ঠ-পাষাণ-লৌহ দ্বারাই তদ্রূপ পদার্থ ছিন্ন করে, তোমার ঈশ্বর সেইরূপ জীব দ্বারাই জীব হিংসা করেন।
দ্রৌপদীর মতকে তৈর্থিক মত বা তৈর্থিক মতের অনুগামী বলে স্বীকার করতে কোন বাধা নেই। এখানে যেটা লক্ষণীয় তা হল, তৈর্থিক মতের বিরোধিতা করতে গিয়ে মহাভারতকার কখনওই সেই মতকে বা মতাবলম্বীকে নিশ্চিহ্ন করে দেননি। অন্যান্য ধর্মীয় দর্শনের ইতিহাসে তৈর্থিক বা হেরেটিক, অন্য ভাষায় ধর্মদ্রোহীদের, যে ভাবে সমূলে উৎপাটন করা হয়েছে, হিন্দু দর্শন বা মহাভারতীয় দর্শনের ক্ষেত্রে তা কখনওই করা হয়নি। হেরেটিক বলতে অন্যান্য ধর্মীয় দর্শনে ‘অবিশ্বাসী’ বা ‘ধর্মদ্রোহী’ প্রভৃতি বোঝানো হলেও তা যেন এক অসহিষ্ণু ও অনুদার দৃষ্টিভঙ্গিতে গৃহীত। তাই কেউ কেউ মনে করেন, ধর্মদ্রোহী বা হেরেটিক যেমন অন্যান্য ধর্মীয় দর্শনে আছে, ভারতীয় দর্শনে তা একেবারেই অনুপস্থিত। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা জরুরি, সভাপর্বে দেবর্ষি নারদ মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে রাজনীতিশাস্ত্রের পাঠ দিতে দিতে প্রশ্ন করলেন, হে কুন্তিনন্দন, তুমি চোদ্দোখানা রাজদোষ বর্জন করে থাকো তো? যুধিষ্ঠির কিন্তু তখনও রাজা হননি, রাজা হবেন বলে সেই সমস্ত বর্জনীয় রাজদোষের কথা তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলেন নারদ মহারাজ। কী কী সেই চোদ্দো দোষ? প্রথমটি খুব মারাত্মক, তা হল নাস্তিক্য। নাস্তিকতার যে লক্ষণ দেওয়া হয়েছে মহাভারতে, তা হল পরলোকে অবিশ্বাস। বেদ বা ঈশ্বর কিংবা আত্মা ও পুনর্জন্ম নয়। পরলোক বললে অবশ্য এসব এসে যাবে। নাস্তিক্যকে বর্জন করতে হবে, এটা মহাকাব্যের সিদ্ধান্তী পক্ষের মত। দ্রৌপদী তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন।
মহাভারতে কয়েকজন আন্বীক্ষিকী-আচার্যের কথা আলোচিত হয়েছে। তাঁরা হলেন—নারদ, অষ্টাবক্র এবং সুলভা। আন্বীক্ষিকী-আচার্য মানে যুক্তিবিজ্ঞানী। যুক্তিবিজ্ঞানের চর্চা সে সময়ের অধ্যাত্মবাদীদের কাছে নিন্দিত ছিল। প্রথা ভেঙে ‘সুলভা’ নামের এক নারী সেই নাস্তিক্য যুক্তিবিদ্যার চর্চা করেছিলেন। জনক রাজা নিজেও আন্বীক্ষিকী বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞানবান ছিলেন। রাজার যথেষ্ট খ্যাতিও ছিল। সুলভা নামক ওই ভিক্ষুকী (সন্ন্যাসিনী) রাজর্ষি জনকের খ্যাতি শুনে তাঁকে পরীক্ষা করার সংকল্প নিলেন। সুলভাকে জনক বললেন, “যদি একজন আমার দক্ষিণ বাহুতে চন্দন লেপন করে এবং অপর একজন আমার বাম বাহু ছেদ করে তবে দুজনকেই আমি সমদৃষ্টিতে দেখব”। এখান থেকে জনক রাজার আন্বীক্ষিকী বিষয়ে সম্যক পরিচয় পাওয়া যায়। রাজার আন্বীক্ষিকী হবে নির্মোহ, স্বার্থরহিত এবং বিশুদ্ধ। অর্থাৎ বাদী-প্রতিবাদী উভয়কেই সমদৃষ্টিতে দেখে তিনি সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন। সুলভা জনক রাজাকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন, তাও আন্বীক্ষিকীর এক চমৎকার নিদর্শন। সুলভাকেও আন্বীক্ষিকীর আচার্যা হিসেবে আমাদের মেনে নিতে হয়। সুলভা রাজা জনককে বলেন, “রাজা! জ্ঞানীরা ইহাকেই বাক্য বলেন- যাতে বাক্য ও বুদ্ধির দোষজনক অষ্টাদশ প্রকার গুণ থাকে এবং দুর্বোধ্যতা, সংখ্যা, ক্রম, নির্ণয় ও প্রয়োজন- এই পঞ্চবিধ অর্থ থাকে। রাজা! পদ, বাক্য, পদার্থ, বাক্যার্থ অনুসারে আমি এই সৌম্য প্রভৃতি এক একটি বিষয়ে লক্ষণ বিবৃত করেছি আপনি শ্রবণ করুন। এইভাবে সুলভা প্রত্যেকটির অর্থ বলতে শুরু করলেন। বক্তা কোনও বিষয়ে অভিপ্রায় করে অংশবিশেষ দোষ ও গুণের যে প্রমাণ করেন তার নাম সংখ্যা। পূর্বের বক্তব্য ও পরের বক্তব্য--এই পৌর্বপর্যায়ের নাম ক্রম--যাকে বিবক্ষিত বলে। প্রতিজ্ঞাবাক্য করে শেষে ‘ইহা সেই’ এইরূপ যে বক্তা বলেন তার নাম নির্ণয়। প্রয়োজন মনের বৃত্তিজাত। অতিরিক্ত পদ, সন্দেহজনক শব্দ, ভিন্নার্থসূচক শব্দ, ককর্শ শব্দ না থাকলে তা হবে উত্তম বস্তু। বাক্যে রুক্ষবর্ণ ও বিপরীতার্থবোধক পদ থাকবে না। তবেই তা ব্যাকরণ অনুসারে শুদ্ধ হবে। শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ ও শ্রৌত্র- এই পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় পরস্পর পৃথক হলেও জতুকাষ্ঠের ন্যায় মনে পরস্পর সংশ্লিষ্ট আছে। এগুলির পরস্পর কোনও প্রেরণা নেই, ইহা হল নিশ্চয়। রূপ, চক্ষু ও আলোক- এই তিনটি রূপ চাক্ষুষ-প্রত্যক্ষের হেতু। তেমনই অন্যান্য জ্ঞাতব্য বিষয়েও তিন হেতু থাকে। অবশ্য এখানে ‘মন’ নামক একটি দ্রব্য আছে, জীব যার দ্বারা নিশ্চয় বিষয়ে সৎ ও অসৎ বিচার করে। এই নানা প্রত্যক্ষ বিষয়ে ‘বুদ্ধি’ নামক একটি গুণ আছে যার দ্বারা সংশয়িত জ্ঞাতব্য বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়। বুদ্ধি নির্দিষ্ট হলে আর একটি ত্রয়োদশ গুণ আছে যার দ্বারা অনুমান করা হয়। এই অনুমানই তো যুক্তি, যা আন্বীক্ষিকীর প্রধান বিষয়। বেদ নয়, প্রত্যক্ষ ও বৈধ অনুমান হল প্রমাণ।
মহাভারতের শান্তিপর্বের মোক্ষধর্মপর্বাধ্যায় হল দার্শনিক তত্ত্বালোচনার প্রধান জায়গা। মোক্ষধর্মপর্বাধ্যায়ের শুরুতেই আমরা দেখি আত্মজ্ঞান সম্পর্কে বর্ণনা, সেখানে ব্রাহ্মণ-সেনাজিৎ-সংবাদ বিবৃত হয়েছে। ভীষ্ম শরশয্যায় শুয়ে আছেন। যুধিষ্ঠির তাঁকে প্রশ্ন করছেন। সৃষ্টিতত্ত্ব প্রসঙ্গে সুলভা-জনক সংবাদ প্রভৃতি নানা বিষয় উত্থাপিত হয়েছে। সুলভা ছিলেন লোকায়ত দার্শনিক। এই অধ্যায়ে লোকায়ত বিষয়ে নয়টি শ্লোক বলা হয়েছে। শ্রীপাদ কৃষ্ণ বেলবলকর সম্পাদিত মহাভারতেও চার্বাক বিষয়ে নয়টি শ্লোক বিবৃত হয়েছে। পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত মহাভারতে নয়টি শ্লোকের কথাই পাওয়া যায়। সুলভাকে মাথায় রেখে আমরা লোকায়ত বিষয়ে সেই শ্লোকসমূহের আলোচনায় প্রবেশ করব।
হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ মহাশয় সম্পাদিত মহাভারতে যে নয়টি শ্লোক পাওয়া যাচ্ছে তার প্রথমটি হলঃ দেহই আত্মা, দেহ ভিন্ন আত্মা নেই। কারণ, দেহেরই বিনাশ দেখা যায়, প্রত্যক্ষ করা যায়। মানুষই তা প্রত্যক্ষ করে। অথচ শাস্ত্রে আত্মার কথা বলা আছে। অতএব এই আস্তিকরা পরাজিত হয়।
“দৃশ্যমানে বিনাশে চ প্রত্যক্ষে লোকসাক্ষিকে।
আগমাৎ পরমস্তীতি ব্রুবন্নপি পরাজিতঃ”।। (২১৫/২৪)
এই শ্লোকটিকে টীকাকার নীলকণ্ঠ সুলভার ন্যায় লোকায়তদের মত বলেই গণ্য করেছেন। এখান থেকে যে কয়েকটি কথা উঠে আসে, তার মধ্যে প্রথমটি হল দেহ ও আত্মার অভিন্নতা- দেহ ছাড়া যে আত্মার কথা বলা হয়, তার অনস্তিত্ব সাধন। সেই অনস্তিত্বের প্রমাণ হিসাবে প্রত্যক্ষকেই গণ্য করা হয়েছে- অনুমান বা আগমকে নয়। শাস্ত্রে যে আত্মার কথা বলা হয়েছে, তাকে নাকচ করা হয়েছে, কারণ তা দেহভিন্ন আত্মা এবং সেই আত্মা প্রত্যক্ষের দ্বারা সিদ্ধ হয় না।
এই শ্লোকটির পরবর্তী শ্লোকেও যেন দেহাত্মবাদ ও প্রত্যক্ষৈপ্রমাণবাদকেই প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। সেই ২৫ নং শ্লোকটি হলঃ
অনাত্মা হ্যাত্মনো মৃত্যুঃ ক্লেশো মৃত্যুর্জরাময়ঃ।
আত্মানং মন্যতে মোহাত্তদসম্যক্পরং মতম্।।(২১৫/২৫)
অর্থাৎ দেহের মৃতুতেই আত্মার শেষ। ক্লেশ, জরা, রোগ প্রভৃতিতে তার মৃত্যু ঘটে। মোহগ্রস্থ হয়ে যে ব্যক্তি আত্মাকে দেহভিন্ন কিছু ভাবেন, তাঁর মত ঠিক নয়।
যখন কেউ বলে- আমি স্থূল, আমি কৃশ, আমি পীড়িত তখন সে দেহ থেকে, আমি বা আত্মাকে পৃথক করে না। মানুষ ‘আমার দেহ’ বা ‘আমার আত্মা’ এইরূপ প্রয়োগও করে থাকে। ‘আমার দেহ’ এই প্রয়োগ থেকে অনেকে আত্মাকে আমি বলে। তা হলে ‘আমার আত্মা’ প্রয়োগ থেকেও ‘আমি-কে দেহ বলতে হয়। আসলে দেহই আত্মা, দেহাতিরিক্ত আত্মা নেই--কারণ তাঁর প্রমাণও নেই--এই হল লোকায়ত সিদ্ধান্ত।
জরা ও মৃত্যু দেহরূপ আত্মারই ধর্ম। দেহাত্মবাদের সমর্থনে সুলভার ন্যায় যুক্তিবিজ্ঞানীর মুখ দিয়ে পরের শ্লোকটিও উচ্চারিত হয়েছেঃ
অথ চেদেবমপ্যস্তি যল্লোকে নোপপদ্যতে।
অজরোহয়মমৃত্যুশ্চ রাজাসৌ মন্যতে যথা।। (২১৫/২৬)
আস্তিকরা যদি বলেন, জগতে দেখা যায় না, এরূপ বস্তুও আছে;
যেমন অঙ্কুর দেখা যায় না, অথচ তা বীজে আছে। সে বিষয়ে
নাস্তিকদের বক্তব্য এই যে, স্ততিপাঠকরা যেমন রাজাকে অজর ও অমর মনে করেই তাঁর সেই রূপ বর্ণনা করে; আস্তিকরাও তেমন আত্মাকে অজর ও অমর মনে করে সেই রূপ বলে থাকেন। বাস্তবিক পক্ষে রাজার ন্যায় আত্মারও জরা এবং মৃত্যু আছে।
মহাভারতে দেবী সরস্বতী মূল কাহিনির অংশ না হলেও তিনিও এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। মহাভারতের প্রতিটি পর্ব শুরু হয়েছে নারায়ণ, নর ও সরস্বতীকে প্রণাম জানিয়ে। মহাভারতে উল্লেখ আছে, সরস্বতী দণ্ডনীতি বা রাজনীতির সৃষ্টি করেছিলেন।
সসৃজে দণ্ডনীতিং সা ত্রিষু লোকেষু বিশ্রুতা। (শান্তিপর্ব)
দেবী সরস্বতী বাক্যের অধিষ্ঠাত্রী। বাক্য কী? বাক্য হল সার্থক পদসমষ্টি। পদ কী? যা শক্তিবিশিষ্ট তাকে পদ বলে। শক্তি হল পদ ও তার অর্থের সম্বন্ধ। খেয়াল করলে দেখা যাবে, সরস্বতীর সঙ্গে দুটো বিষয় খুব গভীরভাবে সম্পৃক্ত—একটি হল নিরুক্ত (semantics) এবং অন্যটি দণ্ডনীতি যাকে আমরা politics বলতে পারি। পদ ও তার অর্থের সম্পর্ক সাধারণত সিমানটিকসে আলোচিত হয়। কোনও একটি পদ দিয়ে অমুক বস্তু কেন বুঝবো, সেটা কী শুধু একটি প্রথা বা বৃদ্ধব্যবহারজনিত? নাকি পদ যে পদার্থকে বোঝায় সে দুটির (পদ ও পদার্থ) মধ্যে কোনও অন্তরঙ্গ নিবিড় সম্বন্ধ আছে? এ নিয়ে বহু কথা বিভিন্ন জায়গায় আলোচিত হয়েছে। এটি বৈয়াকরণের বিষয় নয়। সনৎসুজাতীয়-প্রকরণে বলা হয়েছে, যিনি শব্দগত অর্থ, ব্যুৎপত্তি প্রভৃতির ব্যাক্রিয়া অর্থাৎ তত্ত্বার্থ বোঝেন, তাঁকে বৈয়াকরণ বলে। ষড়ঙ্গের মধ্যে যেমন ব্যাকরণ আছে, তেমনি রয়েছে নিরুক্ত। আচার্য যাস্কের নিরুক্তের কথা পাওয়া যায় শাস্ত্রে। নিরুক্ত হল নিঃশেষে ব্যাখ্যাত বা কথিত। পদের অবয়বশক্তি থেকে নির্বচন করে পদের অর্থ নিষ্কাশিত হয়। পদের অর্থের জন্য পদের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে যাচ্ছে যে পদের শক্তিই পদার্থকে নির্দেশ করে। কোন শব্দ বা পদ দিয়ে কোন অর্থ বুঝবো তাকে এই ভাবে বায়বীয় শক্তি দিয়ে বোঝার মধ্যে এক ধরণের রাজনীতি আছে। মহাভারতের গুরুত্বপূর্ণ নারী চরিত্রগুলো নানা ভাবে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.