বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[শিল্প]
ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস অনেক পুরোনো। কিন্তু সেই আন্দোলনের প্রথম পর্বে অর্থাৎ অর্থনৈতিক মন্দার যুগে শ্রমিকশ্রেণীর আত্মরক্ষামূলক সংগ্রামের (১৯২২ থেকে ১৯৩০) পর্বে যেটুকু সাংস্কৃতিক চর্চা ছিল, তা আজও যথাযথভাবে সংগ্রহ করা হয়নি। তেমনি এই পর্বে গণসংস্কৃতির প্রভাব শ্রমিক আন্দোলনকে মুক্তির অভিমুখী করে তোলেনি। অথচ একটা দেশের সামগ্রিক অগ্রগতির জন্যে শ্রমিক আন্দোলনে সাংস্কৃতিক কার্যকালাপ খুবই জরুরি।
ঊনবিংশ শতাব্দির মধ্যভাগ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত সময়টা ছিল ভারতের শ্রমিকশ্রেণীর উদ্ভবকাল। এই সময়ে ভারতের শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলন অসংগঠিত স্তর থেকে সংগঠিত স্তৱে উত্তরণ ঘটে। অর্থনৈতিক সংগ্রামের পাশাপাশি প্রথমদিকে বিচ্ছিন্নভাবে হলেও, পরে অধিকতর বলিষ্ঠভাবে, রাজনৈতিক গণসংগ্রামেও তারা অংশগ্রহণ করেছেন। স্বাভাবিকভাবে, এটা তো হতে পারে না যে, এই পর্বে শ্রমিক শ্রেণীর জীবনে কোনও সাংস্কৃতিক কার্যকালাপ ছিল না। অবশ্যই ছিল এবং তা ছিল স্থান, কাল ও পরিবেশ অনুযায়ী বৈচিত্রময়।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ছিল বোম্বাই। এখানেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেস সংগঠিত হয়েছিল। গণসংস্কৃতির ক্ষেত্রে সর্বভারতীয় সংগঠন হিসাবে আইপিটিএ-র আত্মপ্রকাশ হয়েছিল বোম্বাইয়ে। এই সংগঠন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মূল উদ্যোগ নিয়েছিল তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি। এই কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন কমিউনিস্ট পাটির সাধারণ সম্পাদক পি সি যোশি।
তারও বহু আগে, ১ নভেম্বর, ১৮৬৬ সালে শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায় ও কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়দের মতো বেশ কিছু মানুষ শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য একটি সভা করেন। উনবিংশ শতাব্দির ষাটের দশকে বরানগর কামারপাড়া, আড়িয়াদহ ও কুঠিঘাটের বোর্নিও জুটমিলে অনেক মজুর কাজ করতেন। ওই সময়ে শ্রমিকরা বিনোদন বলতে বুঝতেন জুয়া খেলা ও মদ খাওয়া। তাঁরা শ্রমিকদের জুয়া খেলা ও নেশা করার ব্যাধি থেকে মুক্ত করার চেষ্টা শুরু করেন। সভায় মিলিত হওয়ার পরে তাঁরা একটি পর্ণ কুটিরে স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেন। গড়ে ওঠে ‘শ্রমজীবী সমিতি’। এটাই সম্ভবত ভারতের প্রথম শ্রমিক সংগঠন। তখন ট্রেড ইউনিয়ন ছিল না। সেই সময়টা ছিল শ্রমিক আন্দোলনের উষাকাল। এই সমিতির মাধ্যমে শ্রমিকদের স্বাক্ষর করানোর চেষ্টা শুরু হয়। ২৯ আগষ্ট, ১৮৭১ লন্ডনের ‘ইষ্টার্ন পোস্ট’ পত্রিকায় একটি সংবাদে উল্লেখ করা হয় যে, কলকাতা থেকে কে বা কারা প্রথম আন্তর্জাতিকের (১৮৬৪-১৮৭৬) কাছে কলকাতা শাখা খোলার জন্য আবেদন করেছেন। জানা যায়, কার্ল মার্কসের উপস্থিতিতে ওই আবেদনটি গৃহীত হবার পর ২ সেপ্টেম্বরের সংখ্যায় লেখা হয়, ভারতে শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষেই ধর্ম, বর্ণ ও নিপিড়িত শ্রেণীর মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার অর্জন করা সম্ভব। এই পরিপ্রেক্ষিতেই শাখা খোলার অনুমোদন দেওয়া হয়।
আর একটু পথ ফেলে, যদি আমরা গত শতাব্দির প্রথম পর্বের দিকে ফিরে দেখি তবে দেখব, দুই বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বাভাস লক্ষ্য করে লিখেছিলেন, “শতাব্দির সূর্য আজি রক্তমেঘ-মাঝে/ অস্ত গেল, হিংসার উৎসবে আজি বাজে/... দেশপ্রেম নাম ধরি প্রচন্ড অন্যায়/ ধর্মেরে ভাসাতে চাহে বলের বন্যায়।/ কবিদল চিৎকারিছে জাগানিয়া ভীতি/ শ্মশানকুক্কুরদের কাড়াকাড়ি গীতি।” আবার পুঁজির বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যমদমত্ততা দেখে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা এবং সেই যুদ্ধের আবাহনে ধর্ম ও জাতিপ্রেম তথা জাতীয়তাবাদের নির্লজ্জ আস্ফালন কী স্পষ্টতায় রবীন্দ্রনাথ উদঘাটন করেছেন, ভারতের বামপন্থী চেতনার যর্থাথ বিকাশের কত আগে তা লক্ষ্যণীয়। ‘নৈবেদ্য’-তে লেখেন: “স্বার্থ যত পূর্ণ হয় লোভাক্ষুধানল/ তত তা বেড়ে ওঠে- বিশ্বধরাতল/ আপনার খাদ্য বলি না করি বিচার/ জঠরে পুরিতে চায়। বীভৎস আহার/ বীভৎস ক্ষুধারে নির্দয় নিলাজ-/... ছুটিয়াছে জাতিপ্রেম মৃত্যুর সন্ধানে/ বাহি স্বার্থতরী গুপ্ত পর্বত পানে।”
রবীন্দ্রনাথের “ভয়শূন্য” স্বর আরও তীব্র হয়ে ওঠে স্পেনে ফ্যাসিবাদের আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে। বলা যায়, ওই যুগের বুদ্ধিবিমুখতা, জাতিবৈষম্য, মারণতাণ্ডব ও যুদ্ধের মহিমা প্রচারের বিষবাষ্পের মধ্যে রবীন্দ্রনাথই ভারতের জনমানসে অক্সিজেনের যোগান দেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ভারতে কমিউনিস্ট পাটি খুবই কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। এই সময়ে নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘ ও গণনাট্য সংঘের (আইপিটিএ) মতো সংগঠন দুটি আত্মপ্রকাশ করে। যার ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছিল অনেকদিন ধরে অনেক উদারবাদী মানুষের সযত্ন উদ্যোগে। একথা ঠিক তাঁরা অনেকেই সাম্যবাদী দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন না। কিন্তু তাঁদের প্রগতীশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল গণসংস্কৃতিতে। উল্লিখিত ওই দুটি সংগঠনে শুধু কমিউনিস্টরা নন, বহু খ্যাতকীর্তি অ-কমিউনিস্ট লেখক, কবি ও উপস্থাপনা শিল্পের শিল্পীরা যোগ দিয়ে ছিলেন। সংগঠকরা ‘পিপলস থিয়েটার’ নামটির ধারণা পেয়েছিলেন রমা রঁলার বিখ্যাত বই ‘দি পিপলস থিয়েটার’ থেকে। বিংশ শতাব্দির বিশ ও তিরিশের দশকে লেখক-কবি-শিল্পী-সংস্কৃতির কর্মীদের ফ্যাসিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জনমত নির্মাণে বিশ্বব্যাপী উদ্যোগে রমা রঁলা ছিলেন অন্যতম সংগঠক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেকেই তিনি এক জায়গায় আনতে সক্ষম হয়ে ছিলেন। সব মিলিয়ে এদেশে বিকল্প সাংস্কৃতিক ভাবনা একটা সাংগঠনিক রূপ পায় ‘নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘ’-এর প্রচেষ্টায়। ১৯৩৪ সালে সংগঠনটির প্রথম সভার আয়োজন করেছিলেন ব্রিটেনে বসবাসরত ভারতের লেখকরা। উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন মুলকরাজ আনন্দ, সাজ্জাদ জাহির, জ্যোতির্ময় ঘোষ, ফৈয়াজ আহমেদ, সাদত হাসান মন্টো, রশিদ জাহান, হাজরা বেগম, ইসমত চুগতাই প্রভৃতিরা। ১৯৩৫ সালের জুন মাসে প্যারিসে ‘ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস ফর দি ডিফেন্স অফ কালচার’ অনুষ্ঠিত হলে ওই সভায় ভারতের পক্ষে যোগ দেন মুলকরাজ আনন্দ ও সাজ্জাদ জাহির। এর এক বছর পরে ১৯৩৬ সালে ১০ এপ্রিল লক্ষৌয়ে আয়োজিত সম্মেলন থেকে নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘ ভারতের মাটিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আশীর্বাণী পাঠিয়েছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টি অনুঘটকের কাজ করলেও ১৯৩২-১৯৪২ সালের ২৩ জুলাই পর্যন্ত তাদের উপর ব্রিটিশ শাসকদের নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল। এই গৌরবময় অতীত অন্য কোনও সংগঠনের নেই।
আইপিটিএ-র প্রথম সম্মেলন হয়েছিল নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘের চতুর্থ সম্মেলনের পরে ১৯৪৩ সালের ২৫ মে। বোম্বাইয়ের মারোয়াড়ি স্কুল হলে। সংগঠনের প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতিতে যুক্ত ছিলেন যে সব বিশিষ্ট মানুষ তাঁরা হলেন সজ্জাদ জাহির, কে পি জি নাম্বুদিরি, বিষ্ণু দে, মুলকরাজ আনন্দ, মামা ওয়ারেরকার, বলরাজ সাহনি, পৃত্থীরাজ কাপুর, অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখার্জি, স্নেহাংশু আচার্য, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সুধী প্রধান, চিম্মোহন সেহানবীশ, কে এল সায়গল, বিজন ভট্টাচার্য, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, বিনয় রায়, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, শম্ভু মিত্র, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, শ্রীমতি অনিল ডি সিলভা, রামা রাও প্রমুখ। পি সি যোশি তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন।
এখানেই হল গণসংস্কৃতির গুরুত্ব। কারণ গণসংস্কৃতিই মানুষের মনের গঠন সম্পূর্ণ করে, সমসাময়িক আর্থ-সামাজিক চেতনার ভিত্তিতে। এক কথায় বলা যায়, গণসংস্কৃতি হল যূথবদ্ধ হয়ে বাস করতে করতে মানুষের মধ্যে জ্ঞান, বিশ্বাস, অনুভূতি, নীতিবোধ, আচার, বিচার, প্রথার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা একধরনের জীবনযাপন সম্পর্কিত মনোভাব, এটাই গণসংস্কৃতি বা সমাজিক জীবনধারা। জীবনধারাকে কেন্দ্র করে সমাজ গড়ে ওঠে এবং জীবনধারার উপরেই সামাজিক স্থায়িত্ব নির্ভর করে। সকলেই জানি, সংস্কৃতি হল মনোজগতের বিষয়। সমাজে সমষ্টির মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও ভাবনা-চিন্তার প্রতীকী প্রকাশ সংস্কৃতি।
সংস্কৃতির ওপর অধিপত্য বিস্তার করতে পারলে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বস্তুবাদী বৈজ্ঞানিক ভাবনায় ইতিহাসের প্রতিটি স্তরে উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন হেতু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে পরিবর্তনসূচিত হয়, তা সংস্কৃতির গঠনকেও নির্দিষ্টতা দেয়। কাঠামোর ওপর নির্ভরশীল উপরিকাঠামো। এখানে মনে রাখা দরকার অনেক সময়ে উপরিকাঠামো আপেক্ষিক স্বতন্ত্রতা অর্জন করে। যে আর্থিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে— সেই সংস্কৃতিও কখনো কখনো প্রবলভাবে নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়ে রাজনীতি ও অর্থনীতির শর্তাবলীকে নিজের ব্যবহারিক আচরণ দিয়ে ছায়াবৃত করে রাখে। যেমন, এই মুহূর্তে সাম্প্রদায়িক জিগির তোলা ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাতাবরণকে কলুষিত করে চলেছে।
১৯২০ সালের পর থেকে ভারতে সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী চিন্তাধারার যে বিকাশ ঘটতে থাকে ১৯২৪ সালের কানপুর ষড়যন্ত্র মামলার মধ্য দিয়ে তা স্পষ্ট হয়। তদানীন্তন সময়ে শ্রমিক ও সমাজতন্ত্র বিষয়ক বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার প্রকাশ এই চিন্তধারাকে জনমনে আরও বিকশিত করে তোলে। এস এ ডাঙ্গে সম্পাদিত ‘সোশ্যালিস্ট’, বাংলার শ্রমিকনেত্রী সন্তোষ কুমারী গুপ্তা সম্পাদিত ‘শ্রমিক’, মুজফ্ফর আহমেদ ও কাজী নজরুল সম্পাদিত ‘লাঙ্গল’ এবং ‘গণবাণী’, কুতুবুদ্দিন আহমেদের ‘মজদুর’ পত্রিকাগুলি ছাড়াও ভারতের অন্যান্য শহর থেকে ‘কীর্তি কিসান’, ‘স্পার্ক’, ‘ক্রান্তি’, প্রভৃতি পত্র-পত্রিকা শ্রমজীবী মানুষের সমস্যা, মালিকশ্রেণীর শোষণ, পুঁজি ও মজুরদের সংগ্রামের বিষয়ে নানান ধরনের সংবাদ, প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প, উপন্যাস ইত্যাদি প্রকাশ করে জনগণের মনে বিশেষ করে শ্রমিক, কৃষকদের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে।
গণসংস্কৃতি বিকাশের দায় নিয়ে যখন লেখক শিল্পীরা ১৯৩৪-৩৬ সালে সংগঠিত প্রয়াস শুরু করেন, তখন ওই একই সময়ে ভারতের শ্রমিক আন্দোলনকে পূর্ববর্তী বছরগুলির দুর্বলতা থেকে সবলতায় ফিরিয়ে আনারও প্রচেষ্টা হয়। কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি থাকা সত্ত্বেও আত্মগোপনকারী নেতৃত্ব গান্ধীজীর ও কংগ্রেসের আইন অমান্য আন্দোলনের ব্যর্থতা, পশ্চাদপসরণ ও তাদের শ্রেণী মুখোশ খুলে দেন। ১৯৩৪ সালেই বিশ্বমন্দা পরিলক্ষিত হয়েছিল। মন্দা কেটে যাওয়ার ফলে ভারতে সংগঠিত শিল্পে নিযুক্ত মজরের সংখ্যা বাড়তে থাকে। মন্দার সময়ে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের যে মজুরি হ্রাস করেছিল তা ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি উঠল। শুধু তাই নয়, মন্দার সময়ে শ্রমিকদের কাজের যে সময় বৃদ্ধি করা হয়েছিল, তাও হ্রাসের দাবি করা হল। মালিকপক্ষ শ্রমিকদের বকেয়া দাবিগুলি অস্বীকার করলে ধর্মঘট অবধারিত হয়ে পড়ে। বোম্বাই, আমেদাবাদ, কলকাতায় চটকল ও সুতাকলে ধর্মঘট শুরু হয়। আমেদাবাদের বস্ত্ৰকলে গান্ধীজী মজুরি হ্রাসের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন ‘মজুর মহাজনে’র পক্ষে। কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে ১৯৩৫ সালে ২১ জানুয়ারি সফলভাবে ধর্মঘট শুরু হয়ে শেষ হল ৫ ফেব্রুয়ারি। ওই সময়ে বিশ্ব পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যেভাবে গণসংস্কৃতির বিস্তার ঘটেছিল তা শ্রমিক আন্দোলনের অগ্রগতিতে সাহায্য করেছে। ২৩ জুলাই, ১৯৪২ কমিউনিস্ট পাটির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু সরকারের জমিদার-মজুতদার তোষণ নীতির কারণে বাংলায় ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। কমিউনিস্ট ও শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্ব রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি ত্রাণের কাজেও ঝাঁপিয়ে পড়েন। গণসংস্কৃতির মঞ্চ থেকে দুর্ভিক্ষ পীড়নের সীমারেখার বাইরের মানুষকে জনকল্যাণে সামিল করতে গান, নাটক ইত্যাদি উপস্থাপনা শিল্প ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
১৯৪৮ সালে দ্বিতীয় কংগ্রেসের পর কমিউনিস্ট পার্টি আবার নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে তার গভীর প্রভাব পড়ে গণসাংস্কৃতিক আন্দোলনের ওপর। শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে এআইটিইউসি-র সাধারণ সম্পাদক এন এম যোশি ওই সময়ে পদত্যাগ করেন। কারণ তিনি বেআইনি ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির কোনও সদস্যের নাম আইএলও-তে পাঠাতে অনিচ্ছুক ছিলেন।
কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত এবং পার্টির ওপর তীব্র দমন-পীড়ন সত্ত্বেও শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রাম এক অভূতপূর্ব জায়গায় পোঁছে যায়। ১৯৫০ সালে শ্রমিক আন্দোলের জন্য যে শ্রম দিবস নষ্ট হয়েছিল তা ওই দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, এই পর্বে সাংস্কৃতিক ও শ্রমিক ফ্রন্টের ঘনিষ্ঠতার যথেষ্ট বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণ ঘটে। কিছু কিছু ইউনিয়ন গণনাট্যের শাখা গড়ে গান, নাটক ও যাত্রার চর্চা শুরু করে। এই সবের মধ্য দিয়ে ভারতের সমাজজীবনে এতকাল ধরে চলে আসা গ্রামীণ সামন্ততন্ত্রের অনুগৃহীত সংস্কৃতি চর্চার পর্বটিও কার্যত অপসারিত হয়। কিন্তু উপনিবেশিক সমাজের অভ্যন্তরেই ইতিমধ্যে মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছিল ধান্দা ও ফাটকা পুঁজি নির্ভর সংস্কৃতির পণ্যায়ন। সংস্কৃতির মঞ্চে শিল্প ও দর্শক-শ্রোতার পারস্পরিক সম্পর্কের চেনা জগতকে বদলে দেওয়া শুরু হল। তার পরেও উদয়শঙ্করের মতো নৃত্যশিল্পী ও রমেশ শীলের মতো স্বদেশী লোকশিল্পীও গণনাট্য সংঘের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। ঐতিহাসিক ডাক-তার ধর্মঘটকে প্রেরণা দিতে সলিল চৌধুরী শহিদ মিনার ময়দানে গেয়েছেন ‘ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘ময়দান চলে’ ‘স্বাধীনতা’ দৈনিকের প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছে। ১৯৪৭ এর উত্তর পর্বের কথা যথাসাধ্য বক্তব্যকে সংক্ষিপ্ত করব।
১৯৬০-র দশকের মাঝামাঝি থেকে শ্রমিক আন্দোলন ও গণনাট্য আন্দোলন অনেক ক্ষেত্রেই হাত ধরাধরি করে চলেছে। ভারতীয় সংস্কৃতির জগতে গণনাট্য সংঘ মূলগতভাবে অতীতের সমস্ত সাংস্কৃতিক উদ্যোগের চেয়ে আলাদা। একেবারে আত্মপ্রকাশের সময়েই গণনাট্য সংঘ সামাজিক রূপান্তরের সংগ্রামের সঙ্গে শিল্প ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের যোগসূত্রটিকে চিহ্নিত করতে চেয়েছিল। কিন্তু এই নতুন পর্বে বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর নির্মাণের সীমাবদ্ধতা সর্বভারতীয় গণসাংস্কৃতিক সংগঠন হিসাবে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলে। সর্বোত্তম শিল্পীদের ব্যক্তিগত দক্ষতা দিয়ে এই মৌলিক সংকটের নিরসন সম্ভব হয়নি। জাতীয় এবং রাজ্যস্তরে সাংগঠনিক কাঠামো অবলুপ্তির পরেও নতুন সময়ের চাহিদায় সাড়া দিয়ে নতুন সাংস্কৃতিক পরিসর নির্মাণের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে কয়েকটি রাজ্য। সাংস্কৃতিক উপস্থাপনার নতুন পরিসরের উদ্ভাবন গণনাট্য সংঘের অনন্য কীর্তি। ধর্মঘটী শ্রমিকদের জন্য কারখানা গেট, শ্রমিক বস্তি, গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষের সমাবেশ, কৃষক সম্মেলন, মহিলা-ছাত্র-যুব-শ্রমিক সম্মেলনে সাংস্কৃতিক উপস্থাপনা— এসবই গণশিল্পীদের জন্য নতুন অনন্য পরিসর ও নতুন ধরনের দর্শক শ্রোতাকে হাজির করে। বাস্তবত এটাই হল নতুন ধরনের সম্প্রসারিত সাংস্কৃতিক পরিসর। ঔপনিবেশিক শাসন পর্বে গণনাট্য আগে ঠিক এরকম পরিবেশ পায়নি। বাউড়িয়ার চটকল শ্রমিক থেকে চা-শ্রমিক কিংবা ডোঙ্গাজোড়ার খেতমজুরের চেতনা ও সাংস্কৃতিক জীবনের নতুনতর সৃষ্টির চ্যালেঞ্জ গণনাট্য সংঘ নিয়েছে। গণনাট্য গানে নৃত্যে নাটকে যাত্রায় নারীর চরিত্র নির্মাণে নতুন ধারার সূত্রপাত ঘটিয়েছে। কিন্তু আজ দেশে ফ্যাসিবাদী শাসকের শাসনে তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে শ্রমিক-কৃষক শ্রেণী তথা সমাজ। গণতন্ত্র শব্দটি এখন উপহাসের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক শক্তির নতুন বিন্যাস হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও নেটো যুদ্ধ ও সন্ত্রাসের ফাঁদে গোটা বিশ্বকে আজও নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা চালাচ্ছে। ধান্দার পুঁজি ও বহুজাতিক পুঁজির বিশ্বায়নের আগ্রাসী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নাগপাশ গোটা বিশ্বে সামাজিক রূপান্তরের আন্দোলনের সামনে প্রবল প্রতিকূলতার তৈরি করেছে। এহেন পরিস্থিতিতে গণসাংস্কৃতিক আন্দোলনকেও বিকল্পের অনুসন্ধান করতে হচ্ছে। প্রতিকূলতা উজান ঠেলেই এগিয়ে যেতে হবে।
তবে যারা গণসংস্কৃতির জন্যে প্রাণপাত করে চলেছেন, তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী তো দূরের কথা সাধারণ মধ্যবিত্তের মধ্যেও সাড়া জাগাতে পারছেন না। গণসংস্কৃতির মঞ্চ বা মাচায় যা দেখছি এককথায় তা পানসে ও নিষ্প্রাণ পুনরাবৃত্তি। আমাদের একটি সমীক্ষার থেকে মনে হয়েছে, এর মূলে আছে গণসংস্কৃতির সংগঠকদের সঙ্গে শ্রমজীবীদের সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা। এখানে সংগঠিত সংস্কৃতিচর্চা প্রচলিত কেবল মধ্যবিত্তের মধ্যেই, যা সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের থেকে
বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্নতাই তাদের থেকে শ্রমজীবীদের সঙ্গে মানসিক ব্যবধান বাড়িয়ে তুলছে। সংখ্যাগরিষ্ঠের রক্তধারাকে ধারণ না করলে কীভাবে গণসংস্কৃতির বিকাশ সার্থক হবে।
শ্রমজীবীদের সংস্কৃতি চর্চার উৎস হল তাঁর জীবিকা। সংস্কৃতিচর্চা তাঁর কাছে কেবল মনোরঞ্জনের ব্যাপার নয়। কৃষক যখন গান গান তখন মন হালকা করার জন্য গান না, ওই গান তাঁর শ্রমের অব্যাহত ধারার জন্য। একই কারণে নৌকা চালাতে চালাতে মাঝি, ছাদ ঢালাইয়ের সময় শ্রমিক, টিউবওয়েলের পাইপ বসাতে ও তুলতে শ্রমিক বা চাষের কাজ করতে করতে চাষি মেয়েরাও গান গান। তাঁদের প্রেম, ভালবাসা বা স্নেহ বাৎসল্যের প্রকাশের ভাষা মাখো মাখো, নরম মার্কা মিষ্টি হতে পারে না।
মনে রাখতে হবে, আধুনিক কালে সংস্কৃতি ঠিক প্রাকৃতিক নিয়মে গড়ে ওঠে না। বর্তমানে ধান্দার ও কর্পোরেট পুঁজির প্রসারিত হাতই নিয়ন্ত্রণ করছে সংস্কৃতির ব্যবসা। আমরা যদি এই নিয়ে শুধু সেমিনার আর বক্তৃতা করি তাহলে শ্রমজীবীদের সাংস্কৃতিক সম্পদের প্রাণশক্তির ক্ষয়প্রাপ্তি চলতেই থাকবে। ভারতের বুকে শ্রমজীবীদের অধিকার ও ক্ষমতা নির্মাণের কাজ ব্যাহত হবে। তাই নিষ্ঠাবান গণসংস্কৃতির কর্মী-সংগঠকদের শ্রমজীবীর সংস্কৃতিকে চিনতেই হবে। শ্রমজীবীর সঙ্গে মেলামেশা করলেই হবে না, কেবল ভালাবাসা নয়, চাই শ্রমজীবী মানুষের প্রতি গভীর মর্যাদাবোধ— গভীর মর্যাদাবোধেই শ্রমজীবী মানুষ পরিচিত ও উদ্বুদ্ধ হতে পারেন শ্রমজীবী সংস্কৃতির সঙ্গে। সংসদীয় চেতনায় ভারাক্রান্ত রাজনীতিবিদের মতো ছলে-বলে-কৌশলে শ্রমজীবীদের মহামূল্যবান ভোটটি নিয়ে ছিবড়ের মতো ফেলে দেওয়া কখনোই গণসংস্কৃতি বিকাশের অভিমুখ নয়।
গণসংস্কৃতির নতুনতর নির্মাণে আজকের বাস্তবতায় অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আগামী দিনের পথ খুঁজতে হবে। কোনও বাঁধা ছক নেই। সময়ের চাহিদা পূরণ করতে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে নতুনতর সাংস্কৃতিক পরিসর নির্মাণই হোক অভিমুখ। — শ্রমজীবী ভাষা, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২২