বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
শারদ উৎসবের আগে দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে ভারী বর্ষণ সহ উত্তরবঙ্গ এবং হিমালয় সংলগ্ন হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, কাশ্মীরে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াল রূপ সাধারণ মানুষকে বিচলিত করেছে। প্রকৃতির নিয়মকে সরাসরি উলঙ্ঘন করে সরকার ও কর্পোরেট পুঁজি যেভাবে হিমালয়ের ভঙ্গুর পার্বত্য এলাকায় ব্যাপক নির্মাণ কাজ চালাচ্ছে, তার অবধারিত পরিণতি এই বিপর্যয়।
এরই মধ্যে পশ্চিমবাংলা জুড়ে প্রকৃতির সম্পদকে লুঠ করার বহু ধরনের কারবার আমরা লক্ষ্য করছি। সুবর্ণরেখা, অজয়, দামোদর, কাঁসাই, কোপাই ও ময়ূরাক্ষী সহ বিভিন্ন নদীর দুই তীর থেকে অবাধে বালি লুঠ হচ্ছে।
অবাধে বালি উত্তোলনের ফলে নদীর পাড় ক্ষয় হচ্ছে এবং চাষের জমি ও ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নদীর স্বাভাবিক গতিপথ পরিবর্তিত হচ্ছে। নদীর তলদেশ, ভূ-প্রকৃতি এবং আশপাশের পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করছে। বর্ষাকালে নদী ভাঙনের আশঙ্কা বাড়ছে, যা আশেপাশের গ্রাম ও কৃষিজমির জন্য বিপদ ডেকে আনছে। নদীগর্ভ গভীর হয়ে যাওয়ায় আশপাশের কৃষিজমি সেচের জল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং মাটির ক্ষয়ও বেড়ে যাচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গে বীরভূম ও পশ্চিম বর্ধমান জেলায় অবৈধ পাথর খাদান, কয়লা খাদানের কথা সবাই জানে। বাঁকুড়া জেলায় অবৈধ পাথর খাদান রমরমা চলছে। পুরুলিয়াতে গ্রানাইট ও কালো পাথর অবৈধভাবে খনন করা হয়। বীরভূম ও পশ্চিম বর্ধমানের অবৈধ পাথর ও কয়লা খাদানের কারবার বহু দিনের। রানিগঞ্জ-আসানসোল কয়লা বেল্টের একটি বড় অংশ কয়লা মাফিয়ারা নিয়ন্ত্রণ করে। অবৈধ খনিজ ব্যবসা — পাথর ও বালির ব্যাপক চাহিদা ও উচ্চ মুনাফার কারণে ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠছে। প্রশাসন-পুলিশ ও শাসকদলের প্রশ্রয় ও মদত ছাড়া এইসব বেআইনি কারবার চলতে পারে না।
এইসব অবৈধ খাদানে শ্রমিকদের নিরাপত্তা গুরুতর ঝুঁকির মুখে থাকে। প্রায়ই দুর্ঘটনায় শ্রমিকদের হতাহতের খবর পাওয়া যায়। নিয়মিত রোজগারের অন্য কোনও রাস্তা না থাকায় অসংখ্য মানুষ বেআইনি খাদানে বিপদ ও ঝুঁকি মাথায় নিয়ে কাজ করে রুজি চালাতে বাধ্য হচ্ছেন।
বীরভূমের নলহাটিতে বাহাদুরপুরে একটি অবৈধ পাথর খাদানে ধস নেমে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় ৬ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। গুরুতর আহত হন আরও কয়েকজন শ্রমিক। নিহত-আহত শ্রমিকরা সবাই নলহাটির আসেপাশের গ্রামের বাসিন্দা। প্রত্যেকেই গরিব পরিবারের সদস্য। দুপুরে পাথর খাদানের ভেতরে শ্রমিকরা কাজ করছিলেন। খাদানের মধ্যে ড্রিল করে বিস্ফোরক ঢোকানোর সময় আচমকা ধস নামে। ধস নামার খবর পেয়ে অন্যান্য পাথর খাদানের শ্রমিকেরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধারকাজ শুরু করেন।
নলহাটির অধিকাংশ খাদানই চলে অবৈধভাবে। অবৈধ পাথর খাদানের কারবারে মুনাফা লুঠের তাগিদে চুলোয় যায় শ্রমিকদের নিরাপত্তা। গত বছর অক্টোবরে নলহাটি মহিষাগড়িয়ায় অবৈধ পাথর খাদানে ধস নেমে তিন জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছিল। মহেশপুরে মৃত্যু হয় দু’জনের। ফেব্রুয়ারিতে মৃত্যু হয় আরও একজনের। অনেক মৃত্যুর কোনও হিসাব থাকে না। কোটি কোটি কাঁচা টাকার কারবারে নিয়ম-আইন লাটে ওঠে। গতর খাটা মানুষ লাশ হয়ে কবরে যাচ্ছেন খাদানের গহ্বরে।
গত এক বছরে নলহাটি-রামপুরহাট পাথর খাদানে দুর্ঘটনায় ঘোষিত মৃত্যুর সংখ্যা দশ ছাড়িয়েছে। বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর খবর খাদানের বাইরে বেরোয় না। প্রভাবশালী পাথর কারবারীদের অবৈধ অর্থের দাপট এবং পুলিশ-প্রশাসন-শাসকদলের যোগসাজসের কারণে। সামান্য কিছু টাকা সর্বস্বান্ত পরিবারগুলোর হাতে গুঁজে সব সামলে নেয় পাথর কারবারীরা। দলবল নেমে পড়ে মানুষের মুখ বন্ধ করতে। গাঁয়ে গাঁয়ে গরিব মানুষগুলো ভয়ে মুখে রা কাড়তে পারেন না। মানুষ পাথর কারবারী এবং তাদের মদতদাতা পুলিসের শাসানিতে তটস্থ। প্রশাসন এবং শাসকদলের মদতে দিনের পর দিন অবৈধ পাথর খাদানগুলি রমরমিয়ে চলছে। মাঝে মাঝে লোক দেখাতে খাদান বন্ধের নির্দেশ জারি হয়। দিন কয়েক বন্ধ থাকে। ফের আবার নিজের চেহারায় ফেরে লুটের কারবার।
বন্ধ হোক প্রকৃতি ও সস্তা শ্রম লুঠ আর মৃত্যুর কারবার।