বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
ক্রিস গিলবার্টের লেখা “Luisa Cáceres: Commune-Building in Urban Venezuela” প্রবন্ধে ভেনেজুয়েলার বার্সেলোনা শহরের একটি অনন্য সমাজতান্ত্রিক উদ্যোগ — লুইসা কাসেরেস দে আরিসমেন্দি কমিউন এর অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়েছে। এটি দেশের অন্যতম সফল নগর কমিউন, যা হুগো শাভেজের ২০০৯ সালের আহ্বানের পর গড়ে ওঠা সমাজতান্ত্রিক কমিউন আন্দোলনের অংশ। লেখাটি মূলত দেখায়, কীভাবে এই নগর কমিউন পুঁজিবাদী সংকট ও রাষ্ট্রীয় সীমাবদ্ধতার মধ্যেও স্বনির্ভরতা, সমবায়-চেতনা ও সামাজিক ন্যায়বোধ গড়ে তুলছে।
প্রবন্ধটি শুরু হয় জনপ্রিয় ইউটিউবার লুইসিতো কমুনিকা-র ঘটনায় — যিনি দেশের অর্থনৈতিক সংকটকে পুঁজিবাদী সুযোগে রূপান্তর করে অল্প দামে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছিলেন। এর বিপরীতে কয়েক কিলোমিটার দূরেই গড়ে উঠেছিল শ্রমজীবী মানুষের কমিউন “লুইসা কাসেরেস”, যেখানে মূল লক্ষ্য ছিল মুনাফা নয়, বরং জনগণের আত্মনির্ভর সমাজ গঠন।
ক্রিস গিলবার্টের প্রবন্ধটি সমসাময়িক লাতিন আমেরিকার সমাজতান্ত্রিক প্রয়োগের এক মূর্ত্ত বাস্তবতা হাজির করছে। ভেনেজুয়েলার বার্সেলোনা শহরের একটি নগর কমিউন — লুইসা কাসেরেস দে আরিসমেন্দি কমিউন — কীভাবে অর্থনৈতিক সংকট, মার্কিন অবরোধ, এবং রাষ্ট্রীয় সীমাবদ্ধতার ভেতরেও সমাজতান্ত্রিক স্বশাসনের পথে এগিয়ে চলেছে, তা বিশ্লেষণ করা সময়েরই দাবি । এটি একদিকে নগর সমাজতন্ত্রের সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতার অনন্য দৃষ্টান্ত, অন্যদিকে পুঁজিবাদী সংস্কৃতির সঙ্গে এক সরাসরি নৈতিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব।
নগর সমাজতন্ত্রের চ্যালেঞ্জ ও লুইসা কাসেরেসের জন্ম
২০০৯ সালে হুগো শাভেজ ভেনেজুয়েলায় কমিউন নির্মাণের ডাক দেন—”সমাজতন্ত্রের মৌলিক কোষ” হিসেবে। তবে অধিকাংশ কমিউনই গ্রামীণ অঞ্চলে সফল হলেও নগরাঞ্চলে তা জটিল হয়ে পড়ে, কারণ এখানে উৎপাদনের ভিত্তি দুর্বল। বার্সেলোনার লুইসা কাসেরেস কমিউন এই সংকটের মাঝেই জন্ম নেয়। শুরুতে তারা ভুট্টা প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তুললেও বাজার প্রতিযোগিতা টিকতে না পেরে তা ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতার মধ্য দিয়েই তারা বুঝতে শেখে, নগর সমাজতন্ত্রকে দাঁড় করাতে হলে শহরের বাস্তব সমস্যার ভেতর থেকেই উৎপাদনের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। নগর কমিউনের প্রধান সমস্যা হল উৎপাদনের ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়া — যেখানে কৃষি বা মৎস্যচাষ সম্ভব নয়। প্রথমদিকে কমিউনটি ভুট্টা প্রক্রিয়াজাত করার উদ্যোগ নিলেও বাজার প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেনি। পরে তারা আবিষ্কার করল শহরের সবচেয়ে অব্যবহৃত কিন্তু প্রয়োজনীয় সম্পদ — আবর্জনা। সেখান থেকেই তারা শুরু করে বর্জ্য সংগ্রহ ও পুনর্ব্যবহারের প্রকল্প, যা পরে তাদের প্রধান আয়ের উৎসে পরিণত হয়। অন্য আটটি কমিউন ব্যর্থ হলেও লুইসা কাসেরেস সফল হয়, কারণ তারা পুরো প্রক্রিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ রাখে — ড্রাইভার থেকে পরিষেবা পর্যন্ত সবই সমবায়ভাবে পরিচালিত।
এখানেই আসে তাদের মৌলিক উদ্ভাবন — আবর্জনা সংগ্রহ ও পুনর্ব্যবহার। যেখানে পুঁজিবাদী অর্থনীতি বর্জ্যকে অপ্রয়োজনীয় বলে ফেলে দেয়, সেখানে কমিউন সেটাকেই রূপান্তর করে সমাজতান্ত্রিক উৎপাদনের ভিত্তি হিসেবে। তাদের প্রিয় ট্রাক “লুচো” শুধু বর্জ্য সংগ্রহের যন্ত্র নয়, বরং শহুরে শ্রমিক সংহতির প্রতীক।
পরে কমিউনটি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয় — একটি বন্ধ হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রীয় খাদ্যবিতরণ কেন্দ্র Mercal দখল করে জনগণের নিয়ন্ত্রণে আনে। নারী সদস্যরা নেতৃত্ব দিয়ে এটি পুনরায় চালু করে এবং এখন এটি শুধু খাদ্য সরবরাহ নয়, জনগণের সভা ও সংগঠনের কেন্দ্রেও পরিণত হয়েছে।
নৈতিক অর্থনীতি বনাম পুঁজিবাদী লেনদেন
গিলবার্ট “moral economy” ধারণাটি ব্যবহার করেছেন — যেখানে মানুষের সম্পর্ক অর্থনৈতিক বিনিময়ের বাইরে গিয়ে ন্যায্যতা, পারস্পরিকতা ও সমাজিক দায়বদ্ধতার উপর দাঁড়ায়। লুইসা কাসেরেস কমিউনের সদস্যরা এই নৈতিক অর্থনীতির বাস্তব প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। তাদের কাজ কেবল মজুরি বা মুনাফা নয়; বরং সম্মিলিত দায়িত্ববোধের প্রকাশ।
এই সমাজতান্ত্রিক নৈতিকতা পুঁজিবাদের “Homo economicus” — স্বার্থকেন্দ্রিক মানুষের বিপরীতে দাঁড়ায়। এখানে বর্জ্য সংগ্রহের সময় শ্রমিক ও নাগরিকরা পরস্পরের সঙ্গে আনন্দমুখর সংলাপে যুক্ত হন। শহর পরিষ্কার রাখা এক সামাজিক দায়িত্বে রূপ নেয়। ফলে শ্রম সম্পর্ক হয়ে ওঠে বিরোধের নয়, সহযোগিতার।
তবে লেখক দেখিয়েছেন, এই নৈতিক অর্থনীতির ভেতরও দ্বন্দ্ব আছে। দীর্ঘদিন “তেল-সমৃদ্ধ কল্যাণরাষ্ট্রে” অভ্যস্ত মানুষ সরকারি সেবাকে বিনামূল্যে পাওয়া তাদের অধিকার মনে করে। কমিউনকে তাই জনগণকে বোঝাতে হয় — শ্রমের মূল্য ও সমাজতান্ত্রিক সেবার পারস্পরিকতা কেমনভাবে কাজ করে। তাদের আয় নারীকেন্দ্র, শিক্ষা ও সামাজিক কাজে ব্যয় করাই জনগণের আস্থা পুনর্গঠনের কৌশল।
রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বিপরীতে স্বশাসনের পথ
প্রবন্ধের অন্যতম কেন্দ্রীয় থিম হল রাষ্ট্র বনাম জনগণের স্বশাসন। ভেনেজুয়েলার তেলভিত্তিক “ম্যাজিকাল স্টেট”–এর মানসিকতা এখনও সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত। এই প্রেক্ষাপটে কমিউনের মুখপাত্র জোহান তোভার বলেন, “আত্মসংগঠনই সংকট থেকে মুক্তির একমাত্র পথ; স্বশাসন শুধু কথায় নয়, বাস্তব রূপে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।”
এই বক্তব্যে প্রতিফলিত হয় লাতিন আমেরিকার নতুন সমাজতান্ত্রিক চিন্তা — রাষ্ট্রের কেন্দ্রীকরণ নয়, বরং নিচ থেকে জনগণের ক্ষমতায়ন। গিলবার্ট এখানে ইস্তভান মেজারোসের বিশ্লেষণ টেনে আনেন, যিনি বলেছিলেন— সোভিয়েত সমাজতন্ত্র ব্যর্থ হয় “দুই মঞ্চের মধ্যে পড়ে গিয়ে” — না পুরোপুরি পুঁজিবাদ, না প্রকৃত সমাজতন্ত্র। সেই অনিশ্চয়তাই শ্রমিকদের প্রকৃত মালিকানা থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। সোভিয়েত মডেল ব্যর্থ হয়েছিল কারণ সেখানে সম্পদ ছিল “সামাজিক” নামে কিন্তু জনগণের নিয়ন্ত্রণে ছিল না — যেমন অন্য আটটি কমিউনও ব্যর্থ হয়েছিল। লুইসা কাসেরেস-এর সাফল্য এখানেই যে তারা স্বশাসন ও বাস্তব মালিকানা অর্জন করেছে।
লুইসা কাসেরেস কমিউন এই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেয়। তারা আংশিক রাষ্ট্রীয় প্রকল্পে যুক্ত থেকে নয়, বরং সম্পূর্ণ শ্রমিক-পরিচালিত ব্যবস্থায় সেবা প্রদান করে। এইভাবেই তারা “দুই চেয়ারের মধ্যে পড়ে যাওয়ার” পরিণতি এড়ায় এবং প্রকৃত সামাজিক সম্পত্তির চেতনা গড়ে তোলে।
পরিবেশ, পুনর্ব্যবহার ও সমাজতান্ত্রিক নান্দনিকতা
লেখকের বিশ্লেষণের শেষাংশে দেখা যায়, এই কমিউন অর্থনীতির পাশাপাশি পরিবেশ ও সংস্কৃতির রূপান্তর ঘটাচ্ছে। তাদের উদ্ভিদ নার্সারি ও রিসাইক্লিং কেন্দ্র শুধু সৌন্দর্যবর্ধন নয়, বরং নগর জীবনের নৈতিক রূপান্তরের প্রতীক।
তারা বর্জ্যের স্থানেই ফুল ও গাছ লাগিয়ে নাগরিকদের মনে শহরপ্রেম ও দায়িত্ববোধ জাগাতে চায় — যা একপ্রকার “social ecology”-র প্রয়োগ। এই উদ্যোগের মাধ্যমে তারা বিশ্বজুড়ে প্রচলিত “Reduce, Reuse, Recycle” মন্ত্রকে স্থানীয় সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতায় নতুন অর্থ দিয়েছে।
এখানে “Reduce” মানে সংকটের মধ্যে সংযম, “Reuse” মানে সৃজনশীল উৎপাদন, আর “Recycle” মানে বেঁচে থাকার সামাজিক প্রক্রিয়া। তাদের উদ্যানের নাম পাবলো চারাকো, যিনি জিএমও বিরোধী ও দেশীয় বীজ সংরক্ষণের পথিকৃৎ ছিলেন — এই নামকরণও তাদের রাজনৈতিক ও পরিবেশগত চেতনার মিলন ঘটায়।
লুইসা কাসেরেস কমিউন তাই শুধু একটি শহুরে উদ্যোগ নয়; এটি ভেনেজুয়েলার সমাজতান্ত্রিক পরীক্ষার জীবন্ত প্রতীক। এখানে বর্জ্যকে সম্পদে, শ্রমকে মর্যাদায়, আর রাষ্ট্রনির্ভর মানুষকে আত্মনির্ভর নাগরিকে রূপান্তরিত করা হচ্ছে।
গিলবার্টের বিশ্লেষণে এই কমিউন এক প্রতিস্পর্ধী চিত্র তুলে ধরে — যেখানে ইউটিউবার লুইসিতো কমুনিকার ভোগবাদী বিনিয়োগের বিপরীতে দাঁড়ায় শ্রমিক সমাজের নৈতিক ও সমবায়ী বিনিয়োগ।
এই কমিউনের স্লোগান, “¡Comuna o nada!” (“কমিউন না হলে কিছুই নয়”) — শুধু রাজনৈতিক উচ্চারণ নয়, বরং একটি দার্শনিক ঘোষণা। এটি সমাজতান্ত্রিক ভবিষ্যতের সেই পথে আলোকিত চিহ্ন, যেখানে নগর সমাজতন্ত্র, নৈতিক অর্থনীতি ও পরিবেশচেতনা একত্রে এক নতুন মানবিক সভ্যতার স্বপ্ন নির্মাণ করছে।
পুনশ্চ: গঙ্গা নদীর পাশের বন্ধ কারখানার শেডগুলো ব্যবহার করে শহরের বর্জ্যকে সার তৈরীর কাজ করবেন শ্রমজীবীরা, গঙ্গার মাঝে গজিয়ে ওঠা চরের ঊর্বর মাটি বস্তাবন্দী করে চালানের কাজে কলতানে মুখরিত হবে কারখানার শেডগুলো এমনটা কি কষ্টকল্পনা! উৎপাদকদের তৈরি নিজস্ব সমবায়ে প্রযুক্তি ইত্যাদি জোগাবেন নাগরিকদের একদল, চালান হবে অঞ্চল সংলগ্ন চাষের জমিতে, পরম্পরাগত চাষে অভ্যস্ত হয়ে ফসল থেকে রাসায়নিক বিষ তাড়াবেন কৃষিজীবী মানুষ যা কিনে নেবেন স্থানীয়রা এমনটা ভাবাই যায় ও ভাবছেন কোথাও না কোথাও, কেউ না কেউ। সেটা বোঝা যায়। বরং নাগরিক সমাজ ও প্রশাসনকে একাজে সামিল করানোর জন্য শ্রমিক-কৃষকের সংহতি-অর্থনীতির পক্ষে বামপন্থার বাস্তব উপস্থিতির সম্ভবনা কেন সুদূর সেটা বুঝতে অসুবিধা হয়।