বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

শান্তির নোবেল, চূড়ান্ত এক অশান্তির ইঙ্গিত

শান্তির নোবেল, চূড়ান্ত এক অশান্তির ইঙ্গিত

অরূপ ঘোষ

cover

শান্তির নোবেল পেয়েছেন ভেনেজুয়েলার “মারিয়া করিনা মাচাদো”। নোবেল কমিটির ঘোষণায় বলা হয়েছে, মাচাদো ভেনেজুয়েলায় স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে রূপান্তরের জন্য যে সংগ্রাম করছেন, এটা তারই পুরস্কার। মাচাদোর এই পুরস্কার প্রাপ্তির বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ, ইজরায়েলের কট্টর সমর্থক, দেশে দেশে মার্কিন কুদ্যেতার সমর্থক এবং যিনি সরাসরি বলেন, মুসলিমদের পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া উচিত, এরকম একটি ব্যক্তিকে কি করে নোবেল পুরস্কার দেওয়া যায়! নোবেল কমিটির এইরূপ ন্যক্কারজনক ঘটনার পিছনের কারণ লুকিয়ে আছে — গণতন্ত্রের আড়ালে মার্কিন তৈল ব্যবসায়ী ও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের মিলনে সস্তা যুদ্ধকেন্দ্রিক (cheap war) যে অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল তার পতনের সম্ভাবনা। এই পরিকল্পনায় লাদেন, হামাস ইত্যাদিদের তৈরি করেছিল আমেরিকা বা তার সহযোগী ইজরায়েল। এই বাহিনীগুলো ব্যবহৃত হয়েছিল তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির বিরুদ্ধে অথবা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে উঠলে তাকে বিপথে পরিচালনা করার জন্য। এখন এই সংগঠনগুলি আবার আমেরিকার বিরুদ্ধে চলে গেছে। ভেনেজুয়েলার উপরে এই রকম একটি যুদ্ধ চাপাতে হবে। কারণ যে ল্যাতিন আমেরিকাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উঠোন বলা হতো, সেই উঠোনের মধ্যে থেকে ভেনেজুয়েলা ডলারের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে বসেছে।
কেন এই আগ্রাসন
২০০২ সালে মার্কিন মদতে সেনাবাহিনীর একটি অংশ এবং দক্ষিণপন্থী সংগঠনগুলি গায়ের জোরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করতে সফল হয়। কিন্তু ৪৭ ঘন্টার মধ্যেই জনগণের অভ্যুত্থান আবার বামপন্থী সরকারকে ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে। মাচাদো ছিলেন এই ষড়যন্ত্রের এক হোতা। মাচাদোর আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে মার্কিন দেশ ভেনেজুয়েলা দখল করে তার হাতে ক্ষমতা তুলে দিক। মাচাদোর ক্রোধের কারণ, তিনি অভিজাত ব্যবসায়ী জুয়েলাগো পরিবারের সদস্য, যারা ছিল মার্কিন মদতপুষ্ট এবং ভেনেজুয়েলায় খনিজ সম্পদ, তৈল খনি, কলকারখানা ও কৃষি জমির উপর একছত্র আধিপত্য কায়েম করেছিল। কিন্তু হুগো সাভেজ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর এই সমস্ত সম্পদ সরকার অধিগ্রহণ করে নেয়। তাই মূল দ্বন্দ্ব হচ্ছে ব্যক্তি মালিকানা বনাম সমাজতান্ত্রিক মালিকানার দ্বন্দ্ব।
ভেনেজুয়েলায় সমাজতান্ত্রিক মালিকানার রূপটি ঠিক কি
হুগো সাভেজ ১৯৯২ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মার্কিন মদতপুষ্ট সরকারকে উৎখাত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিফল হন এবং কারাগারে বন্দি হন। ১৯৯৪ সালে মুক্তি পেয়ে, ১৯৯৮ সালে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তিনি ক্ষমতায় আসেন। এসেই খনি ও তৈল খনিগুলিকে সরকারিভাবে অধিগ্রহণ করেন। এর ঠিক ঠিক আগেই সোভিয়েত ব্যবস্থার পতন ঘটেছে। তাই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে তিনি ভাবনা-চিন্তা শুরু করেন, সোভিয়েত ও চীন মডেলের বাইরে। এই সময়ে তার সঙ্গে পরিচয় ঘটে হাঙ্গেরির সমাজতান্ত্রিক চিন্তাবিদ মেসজারেসের। তাঁর Beyond Capital বইটি এরই মধ্যে বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক চিন্তাবিদদের মধ্যে ভাবনা চিন্তার খোরাক যোগায়। এই বইতে তিনি উল্লেখ করেন কেন সোভিয়েত ব্যবস্থা পুঁজিকে অতিক্রম করতে পারল না।
মেসজারেসের মতবাদ ও সাভেজ
মেসজারেসের কথা হচ্ছে মজুরি, পুঁজি ও রাষ্ট্র এই তিনটির কোনও একটি থাকলেই পুঁজি নিজেকে পুনর্গঠন করে নিতে পারে। তাঁর কথায় পুঁজিবাদের থেকে পুঁজি উচ্ছেদ খুব সরল ঘটনা নয়। তিনি আরো বিশ্লেষণ করে দেখান, উৎপাদক সমাজের পরিকল্পনায় উৎপাদন যদি না ঘটে, পার্টি ও রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় যদি উৎপাদন ঘটে, তাহলে পুঁজি নিজেকে পুনর্গঠিত করে নিতে পারে, ব্যক্তিগত পুঁজিপতি না থাকলেও। এইখান থেকে বেরোবার জন্য মেসজারেস ও সাভেজের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে একটি পথ বার হয়।
মেসজারেসের কাজের দুটি কৌশলগত উপাদান সাভেজ এবং বলিভারীয় বিপ্লবের গতিপথের জন্য অপরিহার্য প্রমাণিত হয়েছিল। এর মধ্যে প্রথমটি ছিল মার্কসের ‘পুঁজি’ থেকে গৃহীত ধারণা। পুঁজিকে সামাজিক বিপাকীয় একটি ব্যবস্থা হিসাবে, একটি স্ব-পুনরুজ্জীবন ব্যবস্থা হিসাবে দেখা, যা একটি জটিল সম্পর্কের সমন্বিত ব্যবস্থা, যা বিলুপ্তি করা বা টুকরো টুকরো পরিবর্তন করা সম্ভব না, বরং কমিউন সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে একটি বিকল্প জৈব বিপাক দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা সম্ভব।
দ্বিতীয়টি হল কমিউন ব্যবস্থা এবং মূল্যের আইনের মূল্য কাঠামো, যা Beyond Capital এর ১৯ নম্বর অধ্যায়ে চিত্রিত হয়েছে। যেখানে মেসজেরাস উৎপাদক শ্রেণীর সামাজিক সম্পর্ককে একটি ব্যবস্থার বিপ্লবী উত্তরণের জন্য কৌশলগত ভিত্তি প্রদান করেছিলেন। যেখানে জনগণ সার্বভৌম শাসনকে নিজের মধ্যে পুনর্গঠিত করেছিল একটি নতুন ধরনের কমিউন ভিত্তিক রাষ্ট্র বা ব্যবস্থা যা সমাজতন্ত্রে রূপান্তরের মূল চাবিকাঠি। জনগণের কাছে ক্ষমতার এই স্থানান্তর, মেসজরাসের ভাষায়, বিপ্লবকে অপরিবর্তনীয় করার একটি উপায়। ২০১০ সালে ভেনেজুয়েলায় পাশ হওয়া কমিউনের জৈব আইনে উৎপাদক শ্রেণীর সমাবেশ দ্বারা নির্বাচিতরা বুর্জোয়া প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের মতো প্রতিনিধি হবে না বরং প্রতিনিধি বা মুখপাত্র হবেন উৎপাদক সমাজের। সম্প্রদায়গত বিনিময়ে তার ব্যাখ্যায় মেসজেরাস আন্তরিক ভাবে উৎপাদক সমাজের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তোলার উপায় হিসাবে পণ্য বিনিময় এর পরিবর্তে মূল্যবোধ ও মৌলিক চাহিদা ব্যবহার করে কমিউন গুলির মধ্যে শক্তিশালী সম্পর্ক তৈরির উপর জোর দিয়েছিলেন। এই সম্পর্কটিই “বলিভিয়ান অ্যালায়েন্স ফর পিপলস অফ আমেরিকার (আমেরিকা মহাদেশ) মাধ্যমে আন্তর্জাতিক স্তরে প্রসারিত করার উপরে জোর দেন মেসজারেস।” (Meszaros and Chavage: The Point from Which to Move the World Today, Monthly Review, June 2022) তাই ভেনেজুয়েলায় যে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে তা চীন ও রাশিয়ার থেকে শিক্ষা নিয়ে, নতুন এক ধারায় প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। যেখানে পুরনো সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভুলগুলিকে সচেতনভাবে পরিহার করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
এরপর থেকেই সাভেজ গ্রামে গ্রামে কৃষকদের উৎসাহিত করেন কৃষি কমিউন গড়ে তোলার জন্য। ২০১৩ সালে সাভেজ মারা যাওয়ার পরও এই পদ্ধতি আরো বিকশিত হতে শুরু করে, শুধু তাই নয় মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধ হওয়া সত্ত্বেও, ভেনেজুয়েলা ডলারের বাহিরে বেরিয়ে এসে বলিভিয়া, চীন, কিউবা, ব্রাজিল ইত্যাদি দেশকে ডলার ছাড়াই তেল বিক্রি করতে থাকে। পাশাপাশি, এই সকল দেশের কাছে কমিউনের উৎপন্ন কফি ও বিভিন্ন উৎপাদিত বস্তু রপ্তানি শুরু করে এবং তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি আমদানি করে নিতে শুরু করে। ভেনেজুয়েলার কমিউন ও এই তৈল রপ্তানি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নাভিশ্বাস তুলে দেয়। তখন থেকেই মার্কিন তৈল ব্যবসায়ী ও অস্ত্র ব্যবসায়ীরা পরিকল্পনা গ্রহণ করে ভেনেজুয়েলায় শাসন পরিবর্তন করতে হবে। না হলে ল্যাতিন আমেরিকা জুড়ে মার্কিন নিয়ন্ত্রণ শেষ হয়ে যাবে। এই কারণেই সাভেজ মারা যাওয়ার পর, মাচাদোদের দিয়ে অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা, মার্কিন অর্থের সাহায্যে নির্বাচনকে জেতার চেষ্টা। কোনওটাই সফল না হওয়ায় এখন যুদ্ধ প্রস্তুতি নিচ্ছে মার্কিন দেশ — ড্রাগ মাফিয়াদের বিরুদ্ধে অভিযান বলে বর্ণনা করে বোমা বর্ষণ করছে ভেনেজুয়েলার মৎসজীবীদের নৌকার উপর। ভেনেজুয়েলার বামপন্থী সরকারকে একনায়কতান্ত্রিক, ড্রাগ মাফিয়াদের মদতকারী এবং সন্ত্রাসবাদীদের হোতা হিসাবে বর্ণনা করে যাতে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে, সেই উদ্দেশ্যেই এই নোবেল পুরস্কার।
কমিউন গঠন ও ভেনেজুয়েলার শক্তি
বিশ্ববাজার হতে ভেনেজুয়েলাকে অবরোধ করে রাখলেও, প্রকৃতিকেন্দ্রিক নতুন যে ধরনের অর্থনীতি গড়ে তুলছে ভেনেজুয়েলার কমিউনগুলি তা বিশ্ব বামপন্থীদের নজর কাড়ছে। পৃথিবীব্যাপী পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা উৎসাহিত হচ্ছে তাদের অর্থনীতি দেখে। শহুরে শ্রমিকদের দ্বারা এইরূপ একটি কমিউনের উদাহরণ তুলে ধরা হচ্ছে। বার্সেলোনা নামক বন্দর শহরে, শ্রমিকরা শহরের জঞ্জালকে কেন্দ্র করে কমিউন গঠন করেন। একদিকে প্লাস্টিককে আলাদা করে রিসাইক্লিং করে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরি করছে। ফলে প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রভাব যেমন কমছে, পাশাপাশি জৈব আবর্জনা আলাদা করে যে জৈব সার হচ্ছে, তা দিয়ে শহরের সর্বত্র সুন্দর বাগান গড়ে হচ্ছে ও শহুরে চাষ গড়ে উঠছে। শহরের অক্সিজেনের মাত্রা যেমনি বেড়ে যাচ্ছে, তেমনি শহর স্বাস্থ্যকর হয়ে উঠছে। গ্রাম শহরের মধ্যেকার বিভাজন দূর করার ভেতর দিয়ে, প্রকৃতি কেন্দ্রিক একটা বিপাকীয় ব্যবস্থা গড়ে তুলছে, যা পুঁজিবাদ ধ্বংস করেছিল, তাকে আবার পুনর্গঠন করা হচ্ছে। পৃথিবীব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির কুফল যে বিপাকীয় ফাটল যা আজ পৃথিবীর ভবিষ্যৎকে চ্যালেঞ্জ করছে, তারই বিকল্প হিসেবে উঠে আসছে কমিউনের এই শ্রম পদ্ধতি। আর এরই প্রভাব পড়ছে ল্যাতিন আমেরিকা সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। এই কারণেই আতঙ্কে মার্কিন সরকার। আর এই কারণেই নোবেল শান্তির পুরস্কার।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.