বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[সম্পাদকীয়]

[সম্পাদকীয়]

২০২৩ পঞ্চায়েত নির্বাচন

২০২৩ পঞ্চায়েত নির্বাচন

সম্পাদকীয়, ১ জুলাই, ২০২৩

photo

পশ্চিমবাংলায় ২০২৩ পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ভয়ঙ্কর হিংসার মধ্য দিয়ে। মনোনয়ন পর্বের মাত্র কয়েকটা দিনে শাসক দলের বেলাগাম সন্ত্রাস, পাল্টা প্রতিরোধ এবং পুলিশ-প্রশসান এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের নিস্ক্রিয়তায় বলি হয়েছে আটটি তাজা প্রাণ। পঞ্চায়েত নির্বাচন কতটা হিংসাত্মক হতে পারে তার ইঙ্গিত মিলেছিল অনেক আগেই। বাহুবল ও অস্ত্রের দাপটে বিরোধী দল ও মতকে নিকেশ করতে উন্মত্ত প্রচেষ্টা চলেছে পরিবর্তনের পুরো সময়কাল জুড়েই। বাম ও কংগ্রেস সহ বিরোধী দলগুলিকে দুরমুশ করার কাজ চলেছে প্রথম থেকেই। কেন্দ্রের বিজেপির সরকার যেমন সারা দেশে কংগ্রেস সহ বিরোধী দলগুলিকে নিশ্চিহ্ন করার অভিযান চালাচ্ছে তারই রকমফের চলছে এই রাজ্যে। কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকরা বিরোধী দল ও ভিন্ন মতের জন্য গণতান্ত্রিক পরিসর ছাড়তে রাজি না।
পঞ্চায়েত নির্বাচনের বহু আগে থেকে বাংলার নানা প্রান্তে বোমা বিস্ফোরণ, বাজি কারখানার আড়ালে বোমা তৈরির মহাযজ্ঞ চলছিল পুলিশ-প্রশাসনের নাকের ডগায়। পঞ্চায়েতের মধুভাণ্ডের শেয়ার বিরোধীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না। এমনকি সেই মধুভাণ্ডের কর্তৃত্ব কার দখলে থাকবে সেই নিয়ে শাসক দলের বিবাদমান বাহুবলীদের মধ্যে রক্তাক্ত সংঘর্ষ হিংসার অন্যতম কারণ।
এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। ১৯৭৮ সালে যখন এই রাজ্য প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন হল— গ্রামের গরিব প্রান্তিক মানুষেরা যেন উৎসবে মেতে উঠলেন। প্রায় সর্বত্র সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা ভূমিহীন-প্রান্তিক-গরিব কৃষক, খেতমজুর, আদিবাসী, নিম্নবর্ণ ও সংখ্যালঘু মানুষেরা প্রবল উদ্দীপনা নিয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচনের কাজে অংশ নিলেন। তাঁদের অনেকেই নির্বাচিত হলেন। পঞ্চায়েতের তিনটি স্তরে প্রায় এক চিত্র। পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদেও নির্বাচিত হলেন গরিব মানুষের আস্থাভাজন দরদী নেতারা। কামিয়ে নেওয়া যাঁদের জীবনের মোক্ষ ছিল না। সেই সময় পঞ্চায়েতের কাজে অর্থ বরাদ্দ ছিল খুব সামান্য। কিন্তু প্রতি সন্ধ্যায় পঞ্চায়েত অফিসে হাজির হতেন গ্রামের গরিব মানুষেরা। পঞ্চায়েত অফিসগুলির অবস্থাও ছিল অথৈবচ। পাকা ঘর কদাচিত দেখা যেত। উত্তপ্ত আলোচনা চলতো সামান্য যে অর্থ এসেছে তা দিয়ে কী করা হবে। কোন গরিবদের অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখতে হবে। কোন গরিবরা পাট্টা পাবেন, কাদের নাম অপারেশন বর্গায় নথিভুক্ত করতে হবে। ভেঙে পড়েছিল গ্রামীণ সম্পত্তিবান কায়েমী স্বার্থের যুগ যুগ ধরে চলা কর্তৃত্ব। বিডিও অফিস বা পার্টি অফিস থেকে নয় গ্রামীণ কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো পঞ্চায়েত অফিস থেকে গ্রামের গরিব মানুষদের সঙ্গে পরামর্শ করে। বর্গায় নথিভুক্ত করার কাজ করা হতো বিডিও অফিস থেকে নয়— মাঠে গিয়ে পঞ্চায়েতের জনপ্রতিনিধি এবং কৃষক জনতার উপস্থিতিতে বিডিও অফিসের কর্মীরা সেই কাজ সুসম্পন্ন করতেন। পঞ্চায়েত হয়ে উঠল গ্রামীণ জনতার স্থানীয় সরকার। নানা সীমাবদ্ধতা থাকলেও পশ্চিমবাংলায় শুরু হয়েছিল ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের ফলিত অনুশীলন। ৮০-র দশকে পশ্চিমবাংলার পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে মডেল করে সারা দেশে চালু হল নির্বাচিত পঞ্চায়েত ব্যবস্থা।
ক্রমে ক্রমে অবস্থার বদল ঘটতে শুরু করল। গ্রামের নব্য ও পুরানো সম্পত্তিবান শ্রেণী যখন বুঝলো যে রাজ্যে বাম শাসন স্থায়ী হতে চলেছে, কেন্দ্রীয় সরকার আগের মতো এই সরকারকে ভেঙে দেবে না, গুটি গুটি পায়ে চুপিসাড়ে তাদের একটা অংশ বামদলগুলিতে সেধোতে শুরু করল। বাম নেতৃত্বের মধ্যেও সজাগ সতর্কতার ঘাটতি দেখা দিল। পরে আর চুপিসাড়ে নয় সদলে সম্পত্তিবান শ্রেণীর স্বার্থবাদীদের একাংশ বামদলগুলিতে অনুপ্রবেশ করতে থাকল। পঞ্চায়েতগুলি ক্রমশ দখল নিতে শুরু করল সম্পত্তিবান শ্রেণীর স্বার্থবাদীরা। বেনোজলের স্রোতে প্রান্তিক-গরিব কৃষক, খেতমজুর, আদিবাসী, নিম্নবর্ণের মানুষেরা ক্রমশ গুরুত্ব হারাতে থাকলেন। বামদলগুলির সঙ্গে প্রান্তিক-গরিব মানুষের আত্মিক যোগাযোগ ক্রমে ক্রমে ছিন্ন হতে থাকল। যদিও প্রক্রিয়াটা চলল বহু বছর ধরে। গ্রামীণ স্বার্থবাদীরা পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি এবং আখের গোছানোর ব্যবস্থায় বদলে ফেলতে শুরু করল। গ্রামীণ সম্পত্তিবানদের ক্ষমতাসীন অংশ এবং ক্ষমতাবঞ্চিত অংশের অন্যতম সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল পঞ্চায়েতের কর্তৃত্ব দখল। আর সেই সংঘাতের পরিণতিতে বাম শাসনের শেষ দশকে পঞ্চায়েত নির্বাচনগুলি হয়ে উঠল রক্তাক্ত। যদিও হিংসার বলি ছিলেন প্রধানত বাম কর্মী-সমর্থকরাই। আজকের মতো সম্পূর্ণ বিরোধীশূণ্য পঞ্চায়েত গঠন বা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পঞ্চায়েত দখল করার ছবি সেই সময় দেখা যায়নি। বাম নেতৃত্ব এই নেতিবাচক যাত্রার গতি রুখতে ব্যর্থ হলেন। সম্পত্তিবান শ্রেণীর বঞ্চিত অংশটি উপযুক্ত সময়ের জন্য অধীর প্রতিক্ষায় প্রস্তুতি চালাতে থাকল, এক সময় তাদের ভাগ্যেও শিকে ছিড়বে। এরই প্রতিক্রিয়া ও নানা সমীকরণের পরিণতিতে ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে কয়েকটি জেলায় বামশক্তির পরাজয় হল। ২০১১ সালে মানুষের প্রত্যাখ্যানে বামেরা রাজ্যে পরাজিত হল। বেনোজল রাতারাতি শাসক দলে ভিড়বার স্রোতে ভেসে পড়ল।
ইতিমধ্যে সারা দেশে ইতিহাসের বিপরীত যাত্রা তীব্র গতি পেয়েছে। কেন্দ্রে বিজেপি সরকার নয়া উদারনৈতিক সংস্কারের গতি তীব্র করে এবং হিন্দুত্ববাদী লক্ষ্যে ধর্ম, ভাষা, পরিচিতিসত্ত্বার বৈচিত্রকে উস্কে বিভেদ ও মেরুকরণের রাস্তা নেয়। আরএসএস-বিজেপি সরকার ভারতের সহস্র বছরের বহুত্ববাদের ঐতিহ্য, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের যা কিছু ইতিবাচক অর্জন, সামন্তবাদের বিরুদ্ধে ভারতের কৃষক জনতার সংগ্রমের অর্জনকে জলাঞ্জলি দিয়ে— সংবিধান, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে উন্মত্ত প্রচেষ্টা শুরু করে। দেশের আর্থিক সয়ম্ভরতাকে ধ্বংস করে দেশি-বিদেশি ক্রোনি কর্পোরেটদের কাছে প্রায় জলের দরে রাষ্ট্রায়ত্ত ও প্রাকৃতিক সম্পদ তুলে দিতে থাকে। মানুষের অর্জিত অধিকারগুলি হরণ করা হতে থাকে। সারা দেশে অসাম্য তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। আর অসাম্যের ক্ষতে প্রলেপ লাগাতে নানা কিসিমের প্রকল্পের নামে অনুগ্রহ বিতরণের আয়োজন শুরু হয় দেশে এবং রাজ্যে রাজ্যে। এই প্রেক্ষাপটে বিকেন্দ্রীভবন, গ্রামীণ জনগণের ক্ষমতায়ন, পঞ্চায়েত রাজ, স্থানীয় স্বশাসন, জনসাধারণের নজরদারি, গ্রাম সংসদ— সবকিছুর মর্মবস্তুকে বিলোপ করে পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রের আমলাতন্ত্রের উপাঙ্গে পরিণত করার সংস্কার চলছে সারা দেশ জুড়ে। যেখানে জনগণের অধিকার ও ক্ষমতায়নের বদলে রাষ্ট্র, সরকার তথা শাসক দলের অনুগ্রহ বন্টনের উপাঙ্গ হিসাবে কাজ করবে পঞ্চায়েত। আর কোনও রাজ্যে যদি তৃণমূলের মতো শাসক দল থাকে, সেখানে অনুগ্রহ বন্টনের কাজকেও কামিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থায় অধঃপতিত করতে কোনও রকম রাখঢাকের বালাই যে থাকবে না তা বলাই বাহুল্য। এই অধঃপতিত আঞ্চলিক শাসকদের দুর্নীতি ও গণতন্ত্র বিরোধী কাজকে ব্যবহার করে তাদের বশে রাখার কৌশলও কেন্দ্রের শাসকদের বাঁ হাতের খেলায় পরিণত হয়েছে।
অধিকার নয়, অনুগ্রহ বিতরণের জন্য নানান প্রকল্পে, নানান খাতে পঞ্চায়েতের হাতে বিপুল অর্থের জোগান আসছে। আর সেই মধুভাণ্ডের কর্তৃত্ব ছাড়তে রাজি নয় শাসক দলের বাহুবলীরা। সে কারণেই পঞ্চায়েত নির্বাচন উপলক্ষ্যে এত বোমা, বন্দুক, গুলি। এত লাগামহীন হিংসা ও সন্ত্রাসের আয়োজন।
রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসন ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনারের পরিচালনায় শান্তিপূর্ণ অবাধ পঞ্চায়েত নির্বাচন যে অসম্ভব ইতিমধ্যে তার প্রমাণ মিলেছে। বিরোধীদের মনোনয়ন রুখতে শাসক দলের বাহুবলী ও দুষ্কৃতিরা যথেচ্ছ লাঠি-বোমা-গুলি ব্যবহার করেছে, ১৪৪ ধারা ভেঙে জমায়েত চালিয়ে গেছে, একের পর এক ব্লক অফিসের দখল নিয়েছে, মনোনয়নপত্র কেড়ে নিয়েছে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দিয়ে মনোনয়নচপত্র প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেছে, এমনকি প্রতীক জমা দেওয়ার ফর্ম কেড়ে নিয়েছে। আর সব কিছুই ঘটেছে পুলিশ বাহিনির চোখের সামনে।
পঞ্চায়েত নির্বাচনে কেন্দ্রীয় বাহিনি মোতায়েন আটকাতে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় রাজ্য সরকার ও নির্বাচন কমিশন বার বার ছুটে গেছে হাইকোর্ট থেকে সুপ্রীম কোর্টে। আদালত পঞ্চায়েত নির্বাচন অবাধ ও শান্তিপূর্ণ করতে রাজ্য জুড়ে কেন্দ্রীয় বাহিনি মোতায়েনের আদেশ দেওয়া সত্ত্বেও এখনও কেন্দ্রীয় বাহিনি নিয়ে টালবাহানা চলছে। আর পর্যাপ্ত কেন্দ্রীয় বাহিনি আসলেও পঞ্চায়েত নির্বাচন অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হবে তার কোনও গ্যারেন্টি নেই। কারণ তাদের পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন কমিশনার ও পুলিশ-প্রশাসন। বিগত নির্বাচনগুলিতে তার উদাহরণ পাওয়া গেছে।
তবে পরিস্থিতি ক্রমশ পাল্টাচ্ছে। মার খেতে খেতে গ্রামীণ জনতা এবং বাম-গণতান্ত্রিক শক্তি মরিয়া প্রতিরোধে নামছেন। গরিব-প্রান্তিক গ্রামীণ জনতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিজের ভোট নিজে দিতে বদ্ধপরিকর। বাহুবলী ও দুষ্কৃতিদের হামলা রুখে তাঁরা ভোট দিতে যাবেন। তাঁরা চান দুর্নীতি মুক্ত স্বচ্ছ পঞ্চায়েত। গ্রামীণ স্বশাসন তাঁরা ফিরে পেতে চান। বাম-গণতান্ত্রিক শক্তির উপর তাঁরা ক্রমশ আস্থা ফিরে পাচ্ছেন।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.