বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[সম্পাদকীয়]
কাফনে ঢেকে রাখা গেল না পশ্চিমবাংলার পঞ্চায়েত নির্বাচন উপলক্ষ্যে হিংসা, সন্ত্রাস, মৃত্যু আর গ্রামাঞ্চলে গণতন্ত্রের বেআব্রু চেহারাকে। ২০২৩ এর পঞ্চায়েত নির্বাচনের হিংসা ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের হিংসার থেকে কম না বেশি অথবা ১৯৭২ সালের বিধানসভা নির্বাচনের হিংসা থেকে বেশি না কম— এর বিচার করবে ইতিহাস।
আদালতের রায়কে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শাসক দল পরিকল্পনা মাফিক পুলিশ, প্রশাসন, রাজ্য নির্বাচন কমিশন এবং সশস্ত্র দুষ্কৃতিদের উপর ভর করে পঞ্চায়েতের মধুভাণ্ডের উপর একচেটিয়া দখলদারির কায়েম করতে চেয়েছিল। ছলে বলে কৌশলে, প্রশাসন ও পুলিসকে ব্যবহার করে বিরোধীদের হিংস্রভাবে বাধা দেওয়া শুরু হয়েছিল প্রথম থেকেই— পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঘোষণা, মনোনয়ন, মনোনয়ন প্রত্যাহার, প্রচারপর্ব থেকে শুরু করে ভোটের দিন এবং গণনাপর্ব অবধি। পঞ্চায়েত নির্বাচনের লড়াইকে যেন গৃহযুদ্ধে পরিণত করা হয়েছে। অসংখ্য জায়গাতে মানুষ অবাধে নিজের ভোট দিতে পারলেন না। দেশকে বিরোধী-শূন্য করবার লক্ষ্যে কেন্দ্রের শাসকদের যে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার ছবি দেশবাসী দেখছেন তারই পশ্চিমবাংলার সংস্করণ দেখা যাচ্ছে রাজ্যের শাসকদের কার্যকলাপে। সব কটি জেলা পরিষদে প্রায় বিরোধীশূণ্য জয়ের পরও শাসক দলের ভয় তবু কেন যায় না।
পঞ্চায়েত সমিতি স্তরে কোথাও কোথাও, বিশেষ করে, গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে শাসক দলের একাধিপত্য কড়া টক্করের মুখে পড়েছে। কেবল বিরোধী দলগুলির সংগঠিত প্রতিরোধ শুধু নয়, গ্রামীণ জনগণের একটা অংশের প্রবল বাধার মুখে পড়েছে শাসক দলের ভোট লুঠের চেষ্টা। পরিস্থিতি ক্রমশ পাল্টাচ্ছে। মার খেতে খেতে গরিব-প্রান্তিক গ্রামীণ জনতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিজের ভোট নিজে দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন।
পঞ্চায়েত নির্বাচনে সংগঠিত সন্ত্রাস সত্ত্বেও শাসক দলের একাধিপত্য ভাঙার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। আবার কর্পোরেট শক্তি এবং রাজ্য ও কেন্দ্রের শাসক দল প্রচারিত তৃণমূল-বিজেপির বাইনারি ভাঙার ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়েছে। শাসক তৃণমূল এত মারকাটারি করে ৫২ শতাংশ ভোট পেয়েছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছে ২২ শতাংশ ভোট— ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল ৩৮ শতাংশ। বিজেপি যে ১৬ শতাংশ ভোট হারিয়েছে— কোনও সংবাদ মাধ্যমে এই খবর গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনায় আসেনি। ২০২১-এ বামেরা সাকুল্যে পেয়েছিল ৭.৫ শতাংশ ভোট— বাম, কংগ্রেস ও আইএসএফ মিলে পেয়েছিল ১০ শতাংশ ভোট। এবারে পঞ্চায়েত নির্বাচনে বাম, কংগ্রেস ও আইএসএফ-এর ভোট ২০ শতাংশ ছাপিয়ে গেছে। বাম-কংগ্রেসের রক্তক্ষরণ সম্পর্কে শুনতে শুনতে শ্রোতা-পাঠকদের মুখস্ত হয়ে গেছিল। কিন্তু বাম-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির ভোট যে দ্বিগুণ হল, সে নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে কোনও আলোচনা কি দেখেছেন। অবশ্য ব্যাপক কারচুপির অভিযোগে আদালত পঞ্চায়েত নির্বাচনের রায় ঘোষণা স্থগিত রেখেছেন।
পরিবর্তনের ১২ বছরে লাগাতার সন্ত্রাস হিংসা ও মানুষের অধিকার হরণে ভীত-শঙ্কিত মানুষ। গ্রাম বাংলায় কাজের আকাল। প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে চলে যাচ্ছেন। কৃষকরা ফসলের দাম পাচ্ছেন না— কৃষকরা অভাবী বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। সরকার নির্ধারিত সংগ্রহ মূল্যের লাভটা আত্মসাৎ করে নিচ্ছে ফড়ে আর চালকল মালিকরা। ১০০ দিনের কাজ, আবাস যোজনা, মিড-ডে-মিল, অঙ্গনওয়াড়ি সহ বহুবিধ প্রকল্পে একদিকে কেন্দ্রীয় সরকার বরাদ্দ কমিয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে সেই টাকা নিয়ে যথেচ্ছ পুকুর চুরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু শাসক দল হিসেব দিতে রাজি নয়। হিসেব না দেওয়াতে কেন্দ্রীয় সরকার বরাদ্দ টাকাও আটকে রেখেছে। কেন্দ্র-রাজ্যের তরজায় বঞ্চিত হচ্ছে বাংলার শ্রমজীবী মানুষ। কাজের অধিকারের বদলে হরেক রকম সরকারি প্রকল্পের অনুদান সাধারণ মানুষের কাছে খুদকুঁড়ো। আর তার জন্য শাসক দলের মাতব্বরদের কাছে গলবস্ত্র হয়ে থাকতে হবে। না হলে, সরকারি প্রকল্প থেকে বঞ্চিত হতে হবে। অধিকারহীন, কর্মহীন মানুষ আর কত দিন এই বঞ্চনা সহ্য করবে। জনজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সর্বগ্রাসী প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, মানুষের অর্থের নয়ছয়, মানুষের অর্থের হিসেব না দেওয়া দেখতে মানুষ ক্লান্ত বিরক্ত। শাসক দলের ছোট-বড় নেতারা চোখের সামনে ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’। সারদা, নারদা থেকে শিক্ষা নিয়োগ দুর্নীতি, কয়লা, গরু পাচার সমস্ত অনৈতিক কালো টাকার কারবারের সঙ্গে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরা জড়িত। কেউ কেউ কারান্তরালে বাস করেছেন দীর্ঘ দিন, কেউ বা এখনও করছেন। রাজ্যের শাসক দলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কেন্দ্রের শাসক দল সংবাদ মাধ্যমে এবং প্রচারে ভীষণ সোচ্চার। কিন্তু বছরের পর বছর কেটে গেলেও কেউই শাস্তি পায়নি। জামিনে মুক্ত হয়ে নানা পদ অলঙ্কৃত করে দাপিয়ে রাজনীতি করে যাচ্ছেন। আদালতে সিবিআই, ইডি বার বার তিরস্কৃত হচ্ছে। জনপরিসরে তৃণমূল-বিজেপির বাইনারি সম্পর্কে বার্তা ক্রমশ পৌঁছে যাচ্ছে— প্রকাশ্যে এই দুই দল যতই রণংদেহী মূর্তিতে অবতীর্ণ হোক না কেন, প্রচ্ছন্নে এদের ভূমিকা সহযোগীর। কেবল অতীত নয় বর্তমানেও। মানুষের একটা অংশে তৃণমূল ও বিজেপি উভয় দল সম্পর্কে মোহমুক্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
পরিস্থিতির এই পরিবর্তনের জন্য এই রাজ্যে প্রতিস্পর্ধী তৃতীয় শক্তি হিসেবে বাম-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির উত্থান ঘটছে। এতে বিরোধী ভোট বিভাজনের ফলে আশু বিচারে রাজ্যের শাসক দলের সুবিধা হলেও দীর্ঘমেয়াদে তৃতীয় শক্তির উত্থান বাংলায় গণতন্ত্রের পরিসরকে প্রসারিত করবে। কেন্দ্রের বিজেপির সরকার সারা দেশে কংগ্রেস সহ বিরোধী দলগুলিকে নিশ্চিহ্ন করার অভিযান চালাচ্ছে। পরিবর্তনের পুরো সময়কাল জুড়ে তৃণমূল বাম ও কংগ্রেস সহ বিরোধী দলগুলিকে দুরমুশ করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকরা বিরোধী দল ও ভিন্ন মতের জন্য গণতান্ত্রিক পরিসর ছাড়তে রাজি না।
বিজেপি যেমন ধর্ম, জাতিসত্ত্বা, ভাষার ভিত্তিতে বিভাজন ও মেরুকরণ করে সারা দেশে একাধিপত্য কায়েম করার উন্মত্ত প্রচেষ্টা চালাচ্ছে— তৃণমূলও প্রায় সেই একই কায়দার ধর্ম, জাতিসত্ত্বা, ভাষার ভিত্তিতে মানুষে মানুষে বিভাজনের রাজনীতি করে একাধিপত্য ধরে রাখতে চায়। বিজেপির আক্রমণের মূল লক্ষ্যবস্তু মুসলমান জনগোষ্ঠী। আর তৃণমূল সেই মুসলমান জনগোষ্ঠীকে ব্যবহার করেছে নিজেদের ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে। চলতে চলতে মুসলমান সমাজের একটা বড় অংশে তৃণমূল সম্পর্কে মোহমুক্তি ঘটছে। তার ফলে মুসলমান অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে তৃণমূল কড়া টক্করের মুখে পড়তে হয়েছে। মুর্শিদাবাদ, মালদা, দেগঙ্গা, কুলপী, ভাঙ্গড় তাই রক্তাক্ত। ভাঙড়ের কাশীপুরে আইএসএফ-জমি কমিটির জোট গ্রাম পঞ্চায়েতে জিতেছে। আর সেইখানেই গণনার দিন রাতে আলো নিভিয়ে শাসক দলের ভয়ঙ্কর আক্রমণ চলেছে। প্রার্থী সহ অনেকে এখনও নিখোঁজ। আবার ঝাড়গ্রাম সহ কুর্মি অধ্যুষিত এলাকায় কুর্মি প্রার্থীদের জয় দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
সংবাদ মাধ্যমে হিংসার জন্য শাসক ও বিরোধী সমানভাবে দোষী সাবাস্ত করার ঝোঁক লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শাসক ও আক্রমণকারীদের হিংসা আর আক্রান্তদের আত্মরক্ষার অধিকারকে একাসনে বসানো অনৈতিক। নিরপেক্ষতার আড়ালে শাসকদের প্রশ্রয় দেওয়ার নামান্তর।