বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[সম্পাদকীয়]

[সম্পাদকীয়]

মণিপুরে ঘটে চলেছে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ

মণিপুরে ঘটে চলেছে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ

সম্পাদকীয়, ১ অগাস্ট, ২০২৩

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ অগাস্ট ২০২৩— মণিপুরে ঘটে চলেছে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। হিংস্র জাতিদাঙ্গায় ভেসে গেছে উত্তর-পূর্বের ছোট রাজ্যটি। মণিপুরের হিংসা, গণহত্যা, নারীর উপর মধ্যযুগীয় বর্বরতা ফিকে হয়ে যাওয়া গুজরাট দাঙ্গাগুলির হিংসা ও নিষ্ঠুরতার স্মৃতিগুলি ফিরিয়ে আনল। গুজরাটে বিলকিস বানুর ঘটনা বা মায়ের পেট চিঁরে ভ্রুণ বার করে নারকীয় উল্লাস ভারত দেখেছে।

এখন ভারত দেখছে, মণিপুরে দুই নারীকে নগ্ন করে দলবদ্ধভাবে মধ্যযুগীয় উল্লাসে ধর্ষণ। সেখানে আদিম হিংস্রতায় কুকি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যা চলছে তা কার্যত জনগোষ্ঠীর নির্মূলকরণ। নাজি শাসনে ইহুদিদের বিরুদ্ধে যেমনটা হয়েছিল। মারা গেছেন মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষরাও। জাতিদাঙ্গায় প্রায় এক লক্ষ মানুষ ঘরছাড়া। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ঘর-বাড়ি। ২৫০ এর বেশি চার্চ ধ্বংস করা হয়েছে। আবার পাল্টা হিংসায় পুড়েছে বহু মন্দির। বহু মানুষ শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। বহু মানুষ পাশের রাজ্যগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে মায়ানমারে পালিয়ে গেছেন। দাঙ্গা রুখতে, শান্তি স্থাপনের কোনও উদ্যোগই নেয়নি ডবল ইঞ্জিন সরকার। মণিপুরকে প্রায় গৃহযুদ্ধের মুখে ঠেলে দিয়েছে বিজেপি সরকার। পাহাড়ের মানুষ উপত্যকায় যেতে পারছেন না, উপত্যকার মানুষ পাহাড়ে যেতে পারছেন না। ছোট্ট রাজ্য মণিপুর যেন ভাগ হয়ে গেছে মেইতেইল্যান্ড ও কুকিল্যান্ডে।

মণিপুরে আইনের শাসন ভেঙে পড়েছে। রাজ্য ও কেন্দ্র কোনও সরকারই মানুষের পাশে নেই। রাজ্যে কাজ ও খাদ্যের তীব্র আকাল শুরু হয়েছে। শিবিরগুলিতে জল নেই, খাবার নেই, ওষুধ নেই। অমানবিকভাবে রেশন ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। এক একটি শিবিরে চার পাঁচশো মানুষ গাদাগাদি করে বাস করছেন। সব থেকে করুণ অবস্থা শিশু, বৃদ্ধ ও শিশু সন্তান সহ মায়েদের। সরকারি সাহায্য প্রায় মিলছে না। বিভিন্ন এনজিও সংস্থা শিবির পরিচালনা করছে। ইন্টারনেট বন্ধ। ব্যাঙ্ক পরিষেবা বন্ধ। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ।

মণিপুরের সংগঠিত হিংসার পিছনে রয়েছে রাজ্যের পার্বত্য এলাকায় সন্ধান পাওয়া মূল্যবান খনিজ আকরিক ভাণ্ডার আত্মসাৎ করার হীন উদ্দেশ্য। ক্ষমতাসীন শাসকদের সঙ্গে ক্রোনি কর্পোরেটদের নিগূঢ় সম্পর্ক আজ আর গোপন নয়। কুকি জনজাতি সম্প্রদায় প্রধাণত পার্বত্য এলাকায় বাস করে। ধর্মবিশ্বাসে তারা খ্রিস্টান। সুতরাং বিধর্মীদের পার্বত্য এলাকা থেকে উচ্ছেদ করার ইন্ধন কারা কারা দিতে পারে সহজেই অনুমান করা যেতে পারে। মণিপুরের পার্বত্য এলাকার আদি অধিবাসী কুকি সম্প্রদায়কে ‘বহিরাগত’, ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে আক্রমণ করা হচ্ছে। কুকি সম্প্রদায়কে ‘ড্রাগ মাফিয়া’, ‘আফিম চাষী’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার প্রচার ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে।

মণিপুরের পার্বত্য এলাকায় সমতল বা উপত্যকার মানুষদের জমি কেনার আইনত নিষিদ্ধ ছিল। যেমন আছে উত্তারাখণ্ড, হিমাচলের মতো দেশের অন্যান্য পার্বত্য রাজ্যে। মেইতেই সম্প্রদায়ের বাস উপত্যকায়। ধর্মবিশ্বাসে হিন্দু। সংঘ পরিবারের প্ররোচনা পাচ্ছে জঙ্গী মেইতেই সংগঠনগুলি। মেইতেই লিপুন নামে একটি সংগঠন তো ঘোষণাই করেছে, মণিপুর হল সনাতন হিন্দু ধর্মের শেষ আউটপোস্ট। মণিপুর সরকারের আবেদনের ভিত্তিতে হাইকোর্ট মেইতেই সম্প্রদায়কে তফশিলি জনজাতি হিসেবে তালিকাভুক্ত করার বিতর্কিত নির্দেশ দিয়েছে। মেইতেইরা জনজাতি হিসেবে তালিকাভুক্ত হলে, তাঁরা পার্বত্য এলায় জমি কিনতে পারবে। পার্বত্য জনজাতি কুকিরা এই আদেশ মেনে নিতে পারছেন না।

প্রায় এক শতাব্দী কাল আগে ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের বহু ধারার মহাসাগর থেকে একেবারে পৃথক ধারা হিসেবে নাজি আদর্শের আদলে যে ধারার জন্ম হয়েছিল যাদের উদ্দেশ্য ছিল বিধর্মীমুক্ত ভারত রাষ্ট্র গঠন— তারাই এখন দেশের শাসন ক্ষমতায়। স্বাধীনতা সংগ্রামের যা কিছু ইতিবাচক অর্জন, স্বাধীনতা উত্তর কালে যা কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি সমস্ত কিছুকে নস্যাৎ করে ভারতকে উন্মত্তভাবে পশ্চাদগমনের পর্বে ঠেলে নিয়ে চলেছে এই শাসকরা। তাদের হিন্দু সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের অর্থ বৈচিত্রের ভারতকে, বহুত্ববাদের ভারতকে দলন করে এক আগ্রাসী হিন্দু ভারত রাষ্ট্রের দিকে গমন। যেখানে মুসলিম-খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাসীরা যে নির্মমভাবে দলিত হবে তার প্রমাণ তারা বারে বারে রেখেছে। যেখানে নারীরা শুদ্রের অধম দলনের পাবেন তারও প্রমাণ হাথরাস থেকে বহু জায়গায় রেখে চলেছে। কিন্তু অসংখ্য জাতি-জাতিসত্তার মহামিলন ক্ষেত্র ভারতে কর্পোরেট মুনাফার স্বার্থে প্রান্তিক জাতিসত্তাগুলির দলন কিছুদিন আগেও কেউ কল্পনাও করেনি। ধর্ম, বর্ণ, জাতি-জাতিসত্ত্বা, ভাষা, লিঙ্গ সহ আত্মপরিচিতির সংগ্রাম যে বহু ক্ষেত্রে শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থের বিপরীতে বিভাজন ও মেরুকরণের দিকে ঠেলে দেয় এবং সব থেকে নিষ্ঠুর শক্তির একাধিপত্য কায়েমের পথ প্রশস্থ করে— এটা বোঝার সময় এসেছে। এটা উপলব্ধি না করতে পারলে ভারতকে আমরা রক্ষা করতে বড় দেরি করে ফেলবো।

এ কেবল অশনি সংকেত নয়, ভারতে সামনে আজ সমূহ বিপদ। দেশের সকল গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল শক্তিকে এগিয়ে আসতেই হবে মণিপুরকে রক্ষা করতে— এগিয়ে আসতে হবে ভারতকে রক্ষা করতে। দেশের গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এবং দেশের সংবিধানকে বাঁচানোর জন্য শপথ নেওয়ার সময় এসেছে। পরাজিত করতে হবে ‘ভাগ করো এবং শাসন করো’ নীতিকে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.