বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[সম্পাদকীয়]
শ্রমজীবী ভাষা, ১ ডিসেম্বর, ২০২১— নরেন্দ্র মোদি বলছেন, কংগ্রেস, গণতন্ত্রের শত্রু। কারণ সেই দলে পরিবারতন্ত্র কায়েম রয়েছে। যে দলের নেতৃত্বের তিন প্রজন্ম জেলে কাটিয়েছে, সন্ত্রাসবাদী হামলায় গুলিতে প্রাণ দিয়েছে এবং সাত দশক ধরে নানা সীমাবদ্ধতা থাকলেও এদেশে গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছে, মোদি বললেই সেই পরিবার গণতন্ত্রের শত্রু হয়ে যাবে? মোদির এমন সাহসে দেখে লোকজন স্তম্ভিত।
তৃণমূল কংগ্রেস বলছে উল্টো কথা। তাদের দাবি, কংগ্রেস মোদি বিরোধী লড়াই না করে হাত গুটিেয় বসে আছে। অথচ বিরোধী শিবিরের নেতা হতে চাইছে। কংগ্রেসের অযৌক্তিক এই দাবি মানা যায় না। তাই কংগ্রেসের সঙ্গে আপাতত ব্যবধান বাড়িয়েই চলেছে তৃণমূল। ত্রিপুরা, গোয়া, মণিপুরে এবং অন্যত্র কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল নিজেদের শক্তি বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে, এরাজ্যে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার সিংহভাগ প্রতিদিন প্রমাণ করতে চেষ্টা করছে যে, কংগ্রেস কার্যত মৃত এবং কংগ্রেসের যা অবশিষ্ট আছে তাকে আর
রেখে লাভ নেই। তাকে ভেঙে ফেলতে হবে। এখন তৃণমূলই হয়ে উঠতে পারে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় বিকল্প।
মোদি এবং কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াকুল যখন কংগ্রেসকে খতম করার খেলায় নেমেছে, ঠিক তখনই কংগ্রেস থেকে তো বটেই, সামগ্রিক ভাবে বিরোধী শিবির থেকেই তৃণমূল নিজেকে আলাদা করে রাখছে। যেন কংগ্রেস একটা ভাইরাস। তার কাছে গেলেই বিপদ।
আর এই সুযোগে কর্পোরেট মিডিয়া বলতে শুরু করেছে, তাহলে আর ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে মোদি বিরোধী জোট আর হচ্ছে না। মানে ২০২৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকে যাবেন মোদিই। আর দেশজুড়ে চলবে কর্পোরটের অবাধ লুন্ঠন পর্ব।
সত্যিই কি মোদি নিশ্চিন্ত? আদৌ নন। এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা কৃষক আন্দোলন কর্পোরেটের সাধের কৃষি সংস্কার তথা কৃষি লুঠের কর্মসূচি ঠেকিয়ে দিয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে নোটবন্দি–লকডাউন–পরিযায়ী সঙ্কটের ক্ষত, পেট্রোল, ডিজেল, রান্নার গ্যাসের আকাশছোঁয়া দাম। হাওয়া বলছে, কৃষকদের যেভাবে অশ্রদ্ধা করেছেন মোদি, যেভাবে গরিবকে চটিয়েছেন তাতে উত্তরপ্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে জেতা কঠিন।
গণতন্ত্রে ক্ষমতায় থাকতে হলে ভোটে জিততে হবে। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটদাতা গরিব মানুষ। তাদের চটালে ভোট আসবে না। যেমন আসবে না কৃষকদের চটালে। কৃষি সংস্কারের প্রয়াস আটকে যাওয়া মানে আটকে যাবে শ্রম কোড চালু করার প্রয়াসও। এর আগে আটকে গেছে মোদির সাধের জমি বিল। জমি, শ্রম ও পুঁজি— এই তিন বিষয়ে অবাধ লুঠের অধিকার চায় কর্পোরেট। কিন্তু জমি প্রশ্নে আগেই আটকে গেছেন মোদি। এবার আটকে গেল কৃষি। ২০২৪এর আগে শ্রম বিল নিয়েও বেশি চাপাচাপি করতে পারবে না কেন্দ্র। ফলে কর্পোরেটের কাছে মোদির ফানুস এখন ফুটো।
এমন পরিস্থিতি কারা সবচেয়ে বেশি কাজে লাগাতে পারে। সেই ‘ভাঙাচোরা’ কংগ্রেস। তাদের খুঁটি করে বিরোধীরা ২০২৪এ জোর ধাক্কা দিতে পারে মোদিকে। ধাক্কা দেবে উত্তরপ্রদেশসহ আসন্ন পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনেও। সেই বার্তা পেয়ে গেছেন মোদি। পেয়ে গেছে কর্পোরেটও। তাই হাত ধরাধরি করে তারা বিরোধীদের খুঁটি কংগ্রসকে শেষ করতে উঠে পড়ে লেগেছে। আর নীরবতা দিয়ে বামকে জাতীয় রাজনীতি থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা তো চলছেই।
এপর্যন্ত ত্রিভুজের দুটি বাহুর সমীকরণ স্পষ্ট। এখানে ত্রিভুজের তৃতীয় বাহু কি তৃণমূল? ক্রমশ গভীরতর হচ্ছে সংশয়।
বিধানসভা ভোটে এরাজ্যে বিজেপি বিরোধী শক্তি হিসাবেই তৃণমূলকে বেছে নিয়েছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটদাতারা। সেটা তৃণমূলের জোরের জায়গা। এই বিজয়ই বিরোধী শিবিরে তৃণমূলের অবস্থানকে আরও পোক্ত করেছিল। অথচ মোদি যখন কৃষক আন্দোলনের ধাক্কায় ক্রমশ দুর্বল হচ্ছেন, তখন তৃণমূলের কর্মসূচি হয়ে দাঁড়াচ্ছে কংগ্রেসকে দুর্বল করা। শক্তি বাড়িয়ে বড় হওয়ার আকাঙ্খার মধ্যে ভুল কিছু নেই। কিন্তু তৃণমূল তো জানে, এরাজ্যে ভোটের সময়ের গয়ারামের দল তো আয়ারাম হয়ে ফিরে আসছে। ফলে অন্য রাজ্যে কংগ্রেস ভাঙিয়ে যাদের দলে আনছে তৃণমূল, তারাও তো সেই আয়ারাম গয়ারামেরই দল। কংগ্রেসকে দুর্বল করে কেন্দ্রের ক্ষমতার বাইরে রাখার লক্ষ্য সফল হওয়ার পর বিজেপি ফের এদের কিনে নেবার পথেই তো হাঁটবে। ঠিক যেমন করে বিজেপি বিধায়ক কিনেছে মধ্যপ্রদেশে, কর্ণাটকে। সে তো হয়ে দাঁড়াবে ঘুরিয়ে মোদিরই হাত শক্ত করার খেলা।
আর কংগ্রেসকে দুর্বল করার মধ্যে দিয়ে যে বার্তা দিচ্ছে তৃণমূল, তাতে অন্য বিরোধীরাও তো শঙ্কিত হতে পারে। তাদের ভাবার সুযোগ আছে, পরবর্তী পরিস্থিতি অনুকূল হলে তৃণমূল তাদেরও ভাঙবে। ঠিক যেমন বিজেপি জোটের ছলে গ্রাস করতে চেষ্টা করেছে শিবসেনাকে, নীতীশের দলকে গ্রাস করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যেমন ছেঁটে ফেলতে চাইছে ওয়াইএসআর রেড্ডি এবং চন্দ্রশেখর রাওকে।
বিজেপি আর তৃণমূল অবশ্যই দুটি পৃথক দল এবং বিজেপি কর্পোরেট স্বার্থরক্ষা ও দেশের বহুত্ববাদের পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক। কিন্তু কর্পোরেট স্বার্থরক্ষার সঙ্গে কংগ্রেসকে নিকেশ করা এবং বামপন্থীদের মুছে ফেলার লক্ষ্যের বিচারে, ক্রমশ দুই দলের ফারাকটাই গুলিয়ে যাচ্ছে।