বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[সম্পাদকীয়]
শ্রমজীবী ভাষা ১ জানুয়ারি, ২০২২— প্রতিস্পর্ধী কৃষক আন্দোলন উদ্ধত শাসকদের দম্ভ চূর্ণ করে প্রাথমিক জয় ছিনিয়ে নিয়েছে। ঐক্যবদ্ধ কৃষক আন্দোলনের দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কাছে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে অপরাজেয় বলে কথিত শাসক-কর্পোরেট জোটের অভিযান। মোদি সরকার তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছে। পাঁচ রাজ্যের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে শাসকদের পরাজিত হওয়ার শঙ্কা একটি কারণ হলেও মোদি সরকারের পিছু হটার সব থেকে বড় কারণ— জাতি-ধর্ম-ভাষা-বর্ণ নির্বিশেষে কৃষকদের নানান স্তর, শ্রেণী, স্বার্থ ও আদর্শের কৃষক সংগঠন আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। উত্তর-পশ্চিম ভারতের এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে লাগাতার গণজমায়েত ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ে শাসক জোটকে ক্রমশ কোণঠাসা করে ফেলছিল। সারা দেশের কৃষক জনতা ও সাধারণ মানুষের ক্রমবর্ধমান অংশ এই আন্দোলনের প্রতি তাঁদের সমর্থন ন্যস্ত করেছেন। স্বাধীন ভারতে জাতীয় পরিধিতে এমন দাগ ফেলা কোনও শান্তিপূর্ণ দীর্ঘস্থায়ী গণআন্দোলন আমরা এর আগে দেখেছি কিনা, তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে।
কৃষক আন্দোলন শাসক জোটের ধর্ম-জাতপাত-ভাষা-প্রদেশ-শ্রেণী ভিত্তিক বহুমাত্রিক বিভাজনের বিষাক্ত কৌশলকে ভোঁতা করে দিয়েছে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মন্ত্র দিয়ে। বিভাজনের শক্তি নৈতিকভাবে হতমান হয়ে পড়েছে। শাসক-কর্পোরেট জোটের টাকার থলি, প্রচারের শক্তি কৃষক আন্দোলনকে বিভ্রান্ত ও নৈতিকভাবে দুর্বল করতে ব্যর্থ হয়েছে। শাসক জোট এবং কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যমের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ প্রথম থেকেই এই আন্দোলনকে নিছকই ধনী কৃষক ও ট্রেডারদের আন্দোলন হিসেবে বর্ণনা করেছে। দাবি করেছে, এই আন্দোলন ব্যাপকতর ক্ষুদ্র-প্রান্তিক-দরিদ্র কৃষকদের স্বার্থবাহী নয় এবং আন্দোলনে তাদের অংশগ্রহণ নগণ্য— তাদের সেই নগণ্য অংশগ্রহণও ধনী কৃষকদের অর্থনৈতিক-সামাজিক ক্ষমতার প্রভাবে। তিনটি কৃষি সংস্কার আইন কৃষক সমাজের নিম্নতর ব্যাপক অংশের সমৃদ্ধি নিয়ে আসবে বলেই তারা প্রচার করেছে। আন্দোলনকারী শক্তি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী স্বার্থে তার বিরোধিতা করছে। কিন্তু বাস্তব অনেক জীবন্ত। প্রত্যক্ষ আন্দোলনে, গণজমায়েতে, আন্দোলনের ময়দানে জীবন দানে ক্ষুদ্র-প্রান্তিক-দরিদ্র কৃষকদের অংশগ্রহণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাঁদের ভূমিকা এই ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের প্রাথমিক জয়ের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করেছে।
প্রায় দু’বছর আগে নরেন্দ্র মোদি সরকার অতিমারি ও লকডাউনে জনসাধারণের অসহায় অবস্থাকেই বেছে নিয়েছিলেন কর্পোরেটদের চাহিদা মতো বকেয়া সংস্কারগুলি বেপরোয়াভাবে সম্পন্ন করার জন্য। দেশ ও জনতার স্বার্থের পরোয়া না করে কয়লা রেল প্রতিরক্ষা বিমানবন্দর ব্যাঙ্ক-বীমা বেসরকারিকরণ করে দেশের রাষ্ট্রীয় ও প্রাকৃতিক সম্পদ কর্পোরেট লুঠেরাদের হাতে তুলে দেওয়া এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ঘাটতি পূরণ করা ছিল তাদের এজেন্ডা। তিনটি কৃষি আইন, চারটি লেবার কোড সেই এজেন্ডারই অংশ— কর্পোরেটদের মুনাফার স্বার্থে কাছে শাসকদের উপঢৌকন। মোদি সরকার ও কর্পোরেট লুঠেরাদের ধারণা ছিল তাদের অশ্বমেধের ঘোড়াকে মোকাবিলা করার ক্ষমতা কারো নেই। কিন্তু কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী জনতার প্রতিরোধে থমকে দাড়াঁতে হয়েছে সরকারকে।
ফেলে আসা বছরের শুরুতে আমরা লিখেছিলাম, ২০২১ শুরু হচ্ছে প্রতিস্পর্ধী কৃষক আন্দোলন এবং তার সংহতিতে দেশব্যাপী মহতী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। সেই মহতী সংগ্রাম দীর্ঘ ১৫ মাসের বন্ধুর পথ বেয়ে প্রাথমিকভাবে জয়যুক্ত হয়েছে। কৃষক আন্দোলন দেশবাসীকে সাহস ও অনুপ্রেরণা দিয়েছে, দাবি যদি ন্যায়সঙ্গত হয়, লড়ার মতো লড়তে পারলে সব থেকে উদ্ধত শাসকদেরও পিছু হটতে বাধ্য করা যায়।
কৃষক আন্দোলনের তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দাবি— স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মতো উৎপাদন খরচের দেড় গুণ দাম ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য হিসেবে দিতে হবে। এমএসপি-র আইনি নিশ্চয়তা দিতে হবে। সেই দাবি এখনও অপূর্ণ। তার জন্য আন্দোলন চলবে।
নতুন বছরে শ্রমজীবী ভারত শাসক-কর্পোরেট জোটকে পরাস্ত করতে, শ্রমিক বিরোধী লেবার কোড বাতিল করতে, দেশ বিরোধী বেসরকারিকরণ রুখে দিতে, ব্যাঙ্ক-বীমা সহ লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা রক্ষা করতে বৃহত্তর সংগ্রামে সামিল হবে। সর্বাত্মকভাবে সফল হবে ২৩-২৪ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী শ্রমিক ধর্মঘট। স্বাগত ২০২২।