বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[সম্পাদকীয়]
শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ জানুয়ারি, ২০২২— "এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার"… জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের এই পু্রোনো গানটির আবার নতুন করে মনে পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল এইজন্য যে, ২০২১ এর শেষ থেকে নতুন বছর ২০২২ এর শুরুতে আমাদের সকালগুলি কোনও শুভ বার্তা নিয়ে আসে নি। প্রতিটি দিন শুরু হয় অজানা আতঙ্ক দিয়ে শেষ হয় নতুন কোনও আতঙ্কের অপেক্ষায়। একটু পিছন ফিরে দেখলে মনে পড়বে ২০২০ সালের ২৪ মার্চের আকস্মিক লকডাউনের কথা। কতো প্রিয়জনের মৃত্যু ঘটেছে কোভিড ১৯ এর কারণে। আজও তার শেষ নেই। নতুন বছরে ভাইরাস সংক্রমণ বিদ্যুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে জনপরিসরে। সাধারণ মানুষের জন্য শুধু নিয়ম পালনের ফতোয়া দেওয়া ছাড়া সেই পুরোনো প্রবাদ "আপনি আচরি ধর্ম" নীতিবাক্যটি কি আমাদের দন্ডমুন্ডের কর্তারা কেউ মানেন? কেন্দ্রে বা রাজ্যে?
এই অন্ধ বোবা সময়ের কথা ও কাহিনী নিয়ে নানা লেখা হয়েছে। তার মধ্যে চিরাগ ঠাক্কর সম্পাদিত "দি ডার্ক আওয়ার" বইটিতে বিভিন্ন লেখকেরা ফেলে আসা দু'বছরের স্মৃতিকে তুলে ধরেছেন। শুধুই কি স্মৃতি? না কি কিছু প্রশ্নও তুলেছেন লেখকেরা। প্রশ্ন তো আজও তুলছি সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষেরা। বিশেষত ডাক্তারদের একটি বড়ো অংশ। সাধারণ যে কোনও বিষয়ে সুবিচার পাওয়ার রাস্তা কি আদালত? মনে আছে, হাটেবাজারে চক দিয়ে গোল গোল দাগকাটার মিডিয়া বাহিত প্রচারের প্লাবনের কথা। অনুশাসন বিধি প্রচার করা আবার একই সঙ্গে বাস-মিনিবাস-ট্যাক্সির ভাড়া না বাড়িয়ে আম পাবলিককে সুকুমার রায়ের খুড়োর কলে শামিল করা। আচ্ছা, করোনায় কতো মানুষ মারা গেছেন? সত্যিকারের কোনও পরিসংখ্যান আছে! আছে, কত পিপিই কেনা হয়েছে, কত অক্সিজেন সিলিন্ডার কেনা হয়েছে নানা ফর্দ। মানে উন্নয়নের ফর্দ।
উন্নয়নের কথা বলতে ভোটের কথা মনে হল। ২০২১ এর ভোট। দীপ হালদার "বেঙ্গল ২০২১: এ্যান ইলেকশন ডায়েরি" বই-এ একটি চমৎকার বিবরণ দিয়েছেন।
তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন অরিন্দম শীল পরিচালিত "একদিন ঝড় থেমে যাবে" নামক পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রচারচিত্রের কথা যা ২০২০ সালে টিভি চ্যানেলগুলিতে নিরন্তর প্রচার করা হয়েছে। ঝড় থামেনি।
মনে করা যেতে পারে এই করোনা কালেই স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু হয় কারান্তরালে। ভারাভারা রাও অনেক কষ্টে শারীরিক অসুস্থতার কারণে জামিন পান। আর আইনি ফস্কা গেরো খুলে জামিন পান সুধা ভরদ্বাজ। বাহবা সময় তোর সার্কাসের খেলা।
১৮৯৮ সালে ডা. রাধাগোবিন্দ কর (যার নামে আর. জি. কর মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল) "প্লেগ" নামে একটি বই লেখেন। ১৮৯৮ এর প্রথম দিকে এই মহামারি ভারতবর্ষের তৎকালীন রাজধানী কলকাতা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। তার লেখাতেই পাই এই প্লেগ নিরাময় ও শুশ্রূষার ক্ষেত্রে ভগিনী নিবেদিতার ভূমিকার কথা। সুতরাং মহামারি আমাদের কাছে নতুন নয়। এই বইটি ২০১১ সালে আবার পুনর্মুদ্রিত হয়। আর সেই বছরই তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে সরকার গঠন করে। আগাম কোন সতর্কবার্তা ছিল না ঠিকই, তবুও কী আশ্চর্য সমাপতন!
আকিরা কুরোসওয়ার "রেড বিয়ার্ড" ছবিতে ডাক্তারকে ঈশ্বরের প্রতিভূ বলে দেখানো হয়েছে। আলবেয়ার ক্যামুর "দি প্লেগ" উপন্যাসের রিউ আর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের "পুতুলনাচের ইতিকথা"র শশী ডাক্তার দু’ জনেই মহামারির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। সেই ডাক্তার বাবুরা বলছেন, যে কোনও সমাবেশ বা মেলা বন্ধ হোক। কিন্ত, এখন দেশজুড়ে চলছে শ্রেয়োবোধ বনাম কৌশলের লড়াই। আমরা জানি, আমাদের পুরাণ, মহাকাব্যে কৌশলেরই জয় হয়। হয়তো এবারও তাই হবে; কিন্ত অনেক মানুষের মৃত্যু্র বিনিময়ে।