বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[সম্পাদকীয়]
শ্রমজীবী ভাষা, ১-১৬ মার্চ, ২০২২— উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, পাঞ্জাব সহ পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে ক্ষমতায় টিকে থাকতে শাসক বিজেপি মরিয়া কিন্তু চাপের মুখে ছিল। লাগাতার কৃষক আন্দোলনের চাপে কেন্দ্রীয় সরকার তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছিল। মোদি নেতৃত্বের অপরাজেয় দুর্নাম বা সুনামে বড় ধরনের আঘাত এসেছে। কৃষক সংগঠনগুলি কর্পোরেট স্বার্থবাহী শাসকদের পরাস্ত করার আওয়াজ তুললেও উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড সরাসরি জিতে নিয়েছে বিজেপি। বিজেপি বিরোধী দলগুলির পরস্পর বিরোধিতা এর অন্যতম কারণ হলেও কৃষক আন্দোলন, বেকারি, পেট্রল-ডিজেল-গ্যাস সমস্ত নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিকে ছাপিয়ে আরএসএস-বিজেপি-এর সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের স্ট্র্যাটেজি সফল হয়েছে। অন্যভাবে বললে, জনসাধারণের একটা বড় অংশ, ৪৫ শতাংশ, আরএসএস-বিজেপি-এর প্রস্তাবিত হিন্দু জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করে নিয়েছে। অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি উত্তরপ্রদেশে বৃহত্তম বিরোধী দল হিসেবে উঠে এসেছে। অন্তর্দ্বন্দ্বে দীর্ণ কংগ্রেস সর্বত্র খারাপ ফল করেছে। কংগ্রেসের কাছ থেকে পাঞ্জাব ছিনিয়ে নিয়েছে আপ। অনেকের মতে, দিল্লির পর পাঞ্জাব জেতায় কেজরিয়াল বিরোধীদের প্রধান মুখ হওয়ার দাবিদার হয়ে উঠেছেন। উত্তরাখণ্ডে কংগ্রেসকে পরাজিত করেছে বিজেপি। গোয়ায় তৃণমূলের অভিযান ফেল করেছে। তারা সেখানে খাতা খুলতে পারেনি। তাদের জোটসঙ্গী বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিয়েছে। তৃণমূল গোয়ায় নিজের নাক কেটে কংগ্রেসের যাত্রাভঙ্গ করেছে এবং বিজেপিকে ক্ষমতায় ফিরতে পরোক্ষে সাহায্য করেছে।
মোদি সরকারের আগ্রাসী উদারনীতির সৌজন্যে দেশে অসাম্য তীব্র। দেশের ৮৪ শতাংশ পরিবারের আয় কমে গেছে। বিপরীতে, আদানি, আম্বানিদের মতো বিলিয়নিয়রদের সম্পদ উপছে পড়ছে। লক্ষ কোটি মানুষ কাছ হারিয়েছে। বেকার, আধা বেকারের অগণিত সারি। কত যে ছোট ও ইনফর্মাল ইউনিট বন্ধ হয়ে গেছে তার হিসেব নেই। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের শূণ্য পদে সমস্ত নিয়োগ কার্যত বন্ধ। চুক্তিভিত্তিক ঠিকা কর্মী দিয়ে সরকারি কাজ চলছে। ১০০ দিনের কাজে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাজের বাজারে চলছে হাহাকার। নগণ্য মজুরির বিনিময়ে অসংগঠিত শ্রমজীবীরা উদয়-অস্ত কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। অতিমারিতে দেশের ৯০ শতাংশ শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থেকেছে। অনলাইন শিক্ষারসুযোগ নেওয়া তাদের হাতের বাইরে। পেট্রল-ডিজেল-গ্যাসের রেকর্ড দাম বৃদ্ধি সমস্ত ভোগ্যপণ্য সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের নাগালের বাইরে নিয়ে গেছে।
পশ্চিমবাংলায় পুরসভা নির্বাচন পর্ব শেষ হয়েছে। কলকাতা এবং চারটি নগরনিগম নির্বাচনে এবং তার আগে চার বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচনে রাজ্যের শাসক দলের পেশিশক্তির পরিচয় রাজ্যবাসী পেয়েছিলেন। এরাজ্যে চলছে শাসক দল আশ্রিত বাহুবলী আস্ফালন ও সংগঠিত তোলাবাজি। বিরোধী মত ও বিরোধী দলগুলিকে নিশ্চিহ্ন করার ধারাবাহিক প্রয়াস চলছেই। তারই প্রতিফলন ঘটেছে রাজ্যের বাকি পুরসভা নির্বাচনগুলির ফলাফলে।
রাজ্যের পরিস্থিতি সারা দেশের পরিস্থিতি থেকে খুব একটা আলাদা নয়। কাজের বাজারে হাহাকার চলছে। দু’ বছর ধরে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকার পর তীব্র জনমতের চাপে শিক্ষাঙ্গন সবে মাত্র খুলেছে। পাঠশালা বন্ধ থেকেছে, কিন্তু পানশালা খুলে দেওয়া হয়েছে অনেক আগেই। নানা প্রকল্প ও যৎসামান্য অনুদান দিয়ে রাজ্যবাসীর দুর্দশা মোচন করা যাচ্ছে না। ক্ষোভের আগুন জমছে।
ইতিমধ্যে মোদি সরকারের অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক আদানিরা নবান্নে আসতে শুরু করেছেন। তারা নাকি বাংলায় বড় পরিমাণ বিনিয়োগ করবেন। রাজ্য সরকারের দেউচা-পাচামির খোলামুখ কয়লা প্রকল্পে তাদের আগ্রহ। আদিবাসীদের জীবন, বসতি, পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে ওই এলাকায় প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর এক লক্ষ চাকরির আশ্বাসে রাজ্যবাসী আশা দেখতে পারছেন না। সেখানে চাকরি ও পুনর্বাসনের প্রলোভন সহ বলপ্রয়োগ ও গ্রেপ্তার করে অবস্থা সামাল দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।
আমতার গ্রামে গভীর রাতে পুলিশ ও সিভিক ভলান্টিয়ারের পোষাকে বাড়িতে ঢুকে প্রতিবাদী যুবক অনিস খানের হত্যা ক্ষোভের আগুনকে বিস্ফোরিত করেছে। আমতা, আলিয়া, কলকাতা ছাত্র-যুব বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। মুখ্যমন্ত্রী ‘সিট’ গঠন করেছেন। ১৫ দিনের মধ্যে আদালতে সিটের তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়ার সময়সীমা পেরিয়ে গেছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে এক হোমগার্ড ও এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে। তারা বলছেন, তাদের বলির পাঁঠা করা হয়েছে। আমতার ওসিকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু প্রতিবাদ চলছেই। যে মুসলিম সম্প্রদায়কে ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে শাসক দল ব্যবহার করে এসেছে— সেই মুসলিম জনতার একাংশ আস্থা রাখতে পারছেন না শাসক দলের উপর। সিঁদুরে মেঘ দেখছেন শাসকরা। মেরামতির চেষ্টা চলছে। কারা যেন ‘গ্রেটার ইভিল’কে রুখতে ‘লেসার ইভিল’কে মদত করার তত্ত্ব হাজির করেছিলেন!