বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[সম্পাদকীয়]
শ্রমজীবী ভাষা, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২— বাংলার তিনজন খ্যাতনামা মানুষ মোদি সরকারের পদ্মসম্মান প্রত্যাখ্যান করেছেন। এই তিন জন হলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও সিপিআই(এম) নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, নবতিপর সঙ্গীতশিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এবং প্রবীণ তবলা বাদক অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়।
প্রতি বছর প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে পদ্মসম্মান প্রাপকদের নাম ঘোষণা করা হয়। এবারে ২০২২ সালের পদ্মপ্রাপকদের তালিকায় মোদি সরকারের আদর্শ-রাজনীতির একেবারে বিপরীত মেরুর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নাম ঘোষণা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বুদ্ধবাবু পদ্মসম্মান প্রত্যাখ্যান করেছেন এতে অভিজ্ঞ মহল খুব একটা বিস্মিত নয়। কারণ অতীতেও বাম-কমিউনিস্ট নেতারা রাষ্ট্রীয় সম্মান ফিরিয়ে দিয়েছেন। এর আগে জ্যোতি বসু ‘ভারতরত্ন’ সম্মান ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদও।
কেন্দ্রীয় শাসক দল রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়ার ক্ষেত্রে আদর্শ-রাজনীতির স্বার্থ নিরপেক্ষভাবে প্রাপকদের তালিকা তৈরি করে, এমনটা নয়, বরং নিজেদের আদর্শ-রাজনীতির স্বার্থেই রাষ্ট্রীয় সম্মান বিতরণ করে থাকে। আর মোদি সরকারের মতো একটি কর্পোরেট বান্ধব, উগ্র বিভাজনের সরকার সেই কাজটি যে নির্লজ্জভাবে করবে তা বলাবাহুল্য। এবারে পদ্মপ্রাপকদের তালিকায় তারই স্পষ্ট স্বাক্ষ্য বহন করে।
এবারে পদ্মবিভূষণ সম্মান পেয়েছেন প্রয়াত চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ বিপিন রাওয়ত। মরণোত্তর পদ্মবিভূষণ সম্মান দেওয়া হয়েছে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের অন্যতম অভিযুক্ত উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংহকে এবং গীতা প্রেসের সভাপতি রাধেশ্যাম খেমকাকে। পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে কোভিড টিকা প্রস্তুতকারক সিরাম ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান সাইরাস পুনাওয়ালা এবং আর এক কোভিড টিকা প্রস্তুতকারক ভারত বায়োটেকের চেয়ারম্যান কৃষ্ণ এল্লা ও তাঁর স্ত্রী সুচিত্রা এল্লাকে। একইভাবে, পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে ভারতীয় বংশোদ্ভূত দুই মার্কিন নাগরিক মাইক্রোসফটের সিইও সত্যনারায়ণ নাদেলা, গুগল অ্যালফাবেটের সিইও সুন্দর পিচাইকে। পদ্মভূষণ সম্মান পেয়েছেন টাটা সন্সের চেয়ারম্যান নটরাজন চন্দ্রশেখরন। এই সমস্ত মানুষদের রাষ্ট্রীয় সম্মানের জন্য মনোনীত করার মধ্য দিয়ে মোদি সরকারের কর্পোরেট বান্ধব, উগ্র হিন্দুত্ববাদী চরিত্র গোপন থাকেনি।
পদ্মসম্মান প্রাপক তালিকায় সিপিআই(এম) নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও কংগ্রেসের বিক্ষুব্ধ নেতা গুলাম নবি আজাদের নাম ঘোষিত হওয়া যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত কৌশল তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। যে দুটি শক্তি আরএসএস-বিজেপির আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু তাদের প্রথমটি সিপিআই(এম) তথা বামশক্তি। তাদের সংগঠনশক্তি আজ যতই দুর্বল হোক না কেন সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলন ও দেশব্যাপী শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংগঠিত শক্তি তাঁরা। কেরালাতে উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তিকে পর্যুদস্ত করেছে বামেরাই। বামেরা আরএসএস-বিজেপির সুদীর্ঘ সময়ের মতাদর্শগত-রণনৈতিক শত্রু। তবুও পশ্চিম বাংলায় সিপিআই(এম) তথা বামশক্তির শাসক তৃণমূলের হিংস্র আক্রমণ মোকাবিলায় ব্যর্থতা এবং নেতা-কর্মী-সমর্থকদের একটা বড় অংশের চেতনার নীচু মানের কারণে তৃণমূলকে ঠেকাতে বিজেপিতে আশ্রয় নেওয়ার মতো পরিস্থিতির সুযোগ নিতে মোদি সরকার বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নাম মনোনীত করেছে। যদিও কৌশলটি মোটা দাগের।
আরএসএস-বিজেপির আশু আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু কংগ্রেস। কংগ্রেসের দেউলিয়া ও জনবিরোধী নীতি, জনসাধারণের ক্ষোভ এবং বিরোধীদের অনৈক্যকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি কেন্দ্রের ক্ষমতায় এসেছে। কংগ্রেসই এ দেশে নয়া উদারনীতি চালু করেছে এবং কংগ্রেসের নরম হিন্দুত্বের নীতি আরএসএস-বিজেপির মতো শক্তির উত্থানের সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু কংগ্রসের ক্রমাগত ক্ষয় সত্ত্বেও তারা এখনও পর্যন্ত সারা দেশে বিজেপির প্রধান বিরোধী শক্তি। কংগ্রেসকে নিকেশ করেই বিজেপি নিরাপদ হতে পারে। বিজেপির আশু রণনৈতিক লক্ষ্য কংগ্রেসমুক্ত ভারত গড়া। কংগ্রেসের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে কংগ্রেসকে দুর্বল করা বিজেপির রণকৌশল হওয়াই স্বাভাবিক। কংগ্রেসের অন্যতম বিক্ষুব্ধ নেতা গুলাম নবি আজাদকে পদ্মসম্মানের জন্য মনোনীত করা সেই রণকৌশলেরই অঙ্গ। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বুদ্ধবাবুর প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, ‘‘বুদ্ধবাবু আজাদ রয়েছেন, গুলাম হতে চাননি।’’