বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[সম্পাদকীয়]

[সম্পাদকীয়]

নতুন বছর হোক প্রতিস্পর্ধার

নতুন বছর হোক প্রতিস্পর্ধার

সম্পাদকীয়, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

photo

ফেলে আসা বছরে বিশ্বজুড়ে আমেরিকা ও পশ্চিমী দেশগুলির আধিপত্য চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। আমেরিকা, ইউরোপের দেশে দেশে রাষ্ট্রনায়কদের যুদ্ধবাজ নীতির বিরুদ্ধে তীব্র জনমত গড়ে উঠছে। পশ্চিম আফ্রিকার মালি, বারকিনা ফাসোর পর নাইজার, চাদ, সেনেগাল, আইভরি কোস্ট ঔপনিবেশিক অবশেষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ওই দেশগুলি থেকে ফ্রান্স তাদের সামরিক ঘাঁটি ও সৈন্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য হচ্ছে। গাজ়া, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, লেবাননে আমেরিকার অস্ত্রে সজ্জিত ইজ়রায়েলের আগ্রাসী যুদ্ধ সারা পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষের ধিক্কার ও নিন্দা কুড়িয়েছে। গাজ়া, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, লেবানন, ইরাক, ইয়েমেনের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম বিশ্ব মানবতার অকুন্ঠ সমর্থন পেয়েছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘে সুবিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে মতদান করেছে। অর্থনৈতিক সংকটে জেরবার আমেরিকা ইউরোপ দক্ষিণপন্থাকে বেছে নিচ্ছে, তখন ফ্রান্সে নতুন বামপন্থী জোট প্রথম শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে। বাম-ঘেষা শক্তিকে বেছে নিয়েছেন শ্রীলঙ্কা, উরুগুয়ে, মেক্সিকোর মানুষেরা। দক্ষিণ কোরিয়ায় সামরিক শাসন জারি হলে ব্যাপক গণবিক্ষোভে প্রত্যাহৃত হয়েছে।
সারা পৃথিবী জুড়ে পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ দাবি হয়ে উঠেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধনতান্ত্রিক শক্তি প্রকৃতিকে লুঠ করেছে। জলবায়ু সংকটের জন্য তারাই প্রধানত দায়ী। অথচ তারা সেই দায় নিতে অস্বীকার করছে। বিগত পর্বে ট্রাম্প জলবায়ু সংকটের সমস্যাকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এখন এশিয়া, আফ্রিকা, দুই আমেরিকা মহাদেশের ব্যাপকতম দেশ পরিবেশ রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। আজ়ারবাইজানে জলবায়ু সম্মেলনে তারা পরিবেশ-বান্ধব জ্বালানী ও শিল্প গড়ে তোলার জন্য উন্নত দেশগুলির কাছে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার দাবি করে। আদায় করা গেছে ৩০০ বিলিয়ন ডলার। এদেশেও বনভূমি লোপাট করে আদিবাসী উচ্ছেদের বিরুদ্ধে লড়াই চলছে।
বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। সিরিয়ায় বাসার আল আসাদের শাসনের অবসান ঘটেছে। এই দুই দেশের ঘটনাবলি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, গণতন্ত্র ছাড়া ধর্মনিরপেক্ষতাকে রক্ষা করা যায় না। সিরিয়ায় আসাদের পতনের পর ইজ়রায়েলি বাহিনী গোলান মালভূমি সহ বিশাল এলাকা দখল করে নিয়েছে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ক্ষতচিহ্ন বাংলাদেশ-ভারতের মৈত্রীর সম্পর্কে কালো মেঘ নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশে হিন্দু সহ সংখ্যালঘু পীড়নের অতিরঞ্জিত প্রচার করে এদেশে উগ্র হিন্দুত্ববাদের জিগির চলছে। বাংলাদেশ-ভারতের মৈত্রী ও হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি পরস্পরের পরিপূরক। নতুন বছরে দুই দেশে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি রক্ষা করতে কঠিন সংগ্রাম করতে হবে। দুই দেশে সংখ্যালঘু পীড়ন বন্ধ করতেও কঠিন সংগ্রাম করতে হবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মৈত্রী রক্ষা করতে আমাদের সংগ্রাম করতে হবে।
এই দেশে হিন্দুত্ববাদীদের বিজয় রথ আটকে গেছে। এখন জোট সরকারের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তবে বিপদ কমেনি। ৩৭০ ধারা বাতিল করার পর কাশ্মীর বিজেপিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। বুলডোজার-রাজ বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রীম কোর্ট। এই দেশে নানা ভাষা, জাতি, জাতিসত্ত্বা, ধর্মের বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের গ্যারেন্টি ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দ দুটি বাতিল করার অভিসন্ধি আপাতত জলে গেছে। যদিও বাংলাদেশের ঘটনাবলি নিয়ে এই রাজ্য দুই শাসক দলের অভিসন্ধিমূলক সাম্প্রদায়িক প্ররোচনা চলছে। সাম্প্রদায়িক প্ররোচনা তাদের উভয়ের মেরুকরণের প্রধান হাতিয়ার।
এই সময়ে সারা দেশে শ্রমিক বিরোধী চারটি শ্রম কোড চালু কারার জোরদার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। বিভিন্ন রাজ্য তাতে সম্মতিও দিচ্ছে। এই রাজ্য সরকার নাকি সম্মতি দেবে না বলে জানিয়েছে। অবশ্য এই রাজ্যে ‘শ্রম কোড’এর দরকার হয় না। ক্ষমতায় এসেই পরিবর্তনের সরকার ধর্মঘট করা যাবে না বলে ঘোষণা করেছিল। তাই ধর্মঘট এখানে কার্যত নিষিদ্ধ। তবুও এখানে আন্দোলনে নামছেন চা বাগিচার শ্রমিক, আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিড ডে মিলের কর্মীরা। জুনিয়র ডাক্তাররা কর্ম বিরতি করেন। অন্ধ্রে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা ৪২ দিন ধরে ধর্মঘট করেন। তামিলনাড়ুতে বহুজাতিক স্যামসাঙ কারখানায় ধর্মঘট হয়। উড়িষ্যায় আদানির বিরুদ্ধে খনি ধর্মঘট হয়।
আরজিকর কন্যার হত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে মেয়েরা রাত দখলে নামেন। শাসকের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে কলকাতা ও শহরতলির মানুষেরা স্বতঃস্ফুর্ত প্রতিবাদে নামেন। নতুন বছরে প্রতিস্পর্ধার এই বার্তাকে পৌঁছে দিতে হবে গ্রাম-শহরের শ্রমজীবী প্রান্তিক মানুষের কাছে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.