বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[সম্পাদকীয়]
১ মে, ২০২০, শ্রমজীবী ভাষা— ১০০ বছর আগে আমেরিকার কথা সাহিত্যিক জ্যাক লন্ডন লিখেছিলেন, খাদ্য ও বাসস্থানের জন্য মানুষকে কিছু না কিছু বেচতে হয়। ব্যবসায়ীরা জুতো বেচে বা অন্য কিছু। কিছু ব্যতিক্রম বাদে রাজনীতিকরা বেচে দেয় মনুষ্যত্ব। কেউ বেচে তাদের মর্যাদা, কেউ বা বেচে তাদের বিশ্বাস। নারীরা সে রাস্তাতেই হোক অথবা বিবাহের বন্ধনের মধ্যেই হোক দেহ বেচতে বাধ্য হয়। শ্রমিক শ্রেণীর বেচার মতো পণ্য একটাই— তাদের শ্রমশক্তি যা বাজারে বিক্রি হয়। বিক্রি না হলে শ্রমিকের শ্রমের মূল্য কানাকড়িও না। শ্রমের মর্যাদা শুধুই কথার কথা। মাত্র ৪০ দিন। মাত্র চল্লিশ দিনের লকডাউন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল কথাগুলি এত বছর পরেও সমান বাস্তব— কাজ না থাকলে শ্রমিকের জীবনের দাম কানাকড়িও না।
লকডাউনে বিহারের ভোজপুরের শিশু শ্রমিক ১১ বছরের কিশোর রাহুল মুসাহরের অনাহারে মৃত্যু বা তেলেঙ্গানার লঙ্কা খেতের শিশু শ্রমিক ১২ বছরে কিশোরী জামলো মাকদমের ছত্তিশগড়ের ঘরে ফেরার অসমাপ্ত যাত্রা আমাদের সংবেদনশীল মনকে বেদনাতুর করে। দেশের বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষের বিপন্নতা— পরিযায়ী শ্রমশক্তির মর্মান্তিক প্রত্যাবর্তন আমাদের মনকে নাড়া দিয়ে যায়।
পরিযায়ী শ্রমিকরা দেশের অগণিত অসংগঠিত শ্রমশক্তির এক দুর্ভাগা অংশ, যারা নিজের গ্রাম-শহরে কাজ না পেয়ে বহু দূরে ভিন রাজ্যে পাড়ি জমাতে বাধ্য হন। দেশের ৪৫ কোটিরও বেশি শ্রমশক্তির ৯৩ শতাংশই সুরক্ষাহীন অসংগঠিত শ্রমিক— যাদের না আছে কাজের নিশ্চয়তা, ন্যূনতম বেতন, কাজের ঘন্টার ঠিক-ঠিকানা, ছুটি বা চিকিৎসা ও অবসরকালীন সুরক্ষা। মালিক, সরকার ও ঠিকাদারের প্রয়োজন ও মর্জিতে নিরাপত্তাহীন সস্তা শ্রমশক্তি হিসেবেই তারা নিয়োজিত। লকডাউনে কোটি কোটি শ্রমশক্তির কাজ বন্ধ, রোজগার বন্ধ। এই সব মানুষেরা আর তাদের পরিবার কি খেয়ে বেঁচে আছেন তার খবর কে রাখে। যাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা মেহনতে সভ্যতা ও অর্থনীতির রথের চাকা সচল থাকে— যাদের শ্রম নিঙরে কর্পোরেট সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে এবং আম্বানি-আদানি-টাটার মতো অতিধনীদের সম্পদের পাহাড় আরও স্ফিতকায় হয়।
অতিমারির এই কর্মহীন সময়ে সরকার তথা রাষ্ট্র এই অগণিত শ্রমিক সাধারণকে কার্যত ভবিতব্যের উপর ছেড়ে দিয়েছে। অসাম্য পীড়িত এই সমাজ কতটা অমানবিক হতে পারে লকডাউন তা উলঙ্গ করে দিল। এটাই দস্তুর। বিপর্যয় ও সংকটের সময়ে প্রকাশ হয়ে পড়ে ব্যবস্থা হিসেবে ধনতন্ত্র শ্রমজীবীদের প্রতি কতটা নির্দয়।
আরও কদর্য বিষয় হল— লকডাউনে শ্রমজীবী সাধারণের খাদ্য, আশ্রয় ও চিকিৎসার জন্য যথকিঞ্চিত সাহায্য আর তার বিপুল বিজ্ঞাপন, কেন্দ্র-রাজ্যের তরজা, সংবাদ মাধ্যমে তার রাত্রি-দিন পরিবেশন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদী শক্তির পরাজয় ও ধনতন্ত্রের পশ্চাদ অপসারণ, ঔপনিবেশিক দেশগুলির স্বাধীনতা অর্জন এবং সোভিয়েতের বিজয় ও খাদ্য-বস্ত্র-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অর্থনীতি সহ জীবনের প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে অগ্রগতি— ধনতান্ত্রিক দেশগুলিকে বাধ্য করেছিল কল্যাণকামী রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের অস্তিত্বকে রক্ষা করার পথ নিতে। এ ছিল একই সঙ্গে সোভিয়েত ব্যবস্থার সাফল্যের প্রভাব এবং নিজ নিজ দেশের মানুষকে সমাজতন্ত্র থেকে দূরে রাখার কৌশলও বটে। কিন্তু তা ছিল নিছকই বাধ্যতা।
সোভিয়েতের পতন ধনতন্ত্রকে সেই বাধ্যতা থেকে মুক্তি দিল। অনুকূল পরিস্থিতে এবার ধনতান্ত্রিক বিশ্ব লাগামহীন ভাবে নয়া উদারনীতির পথ নিল। অর্থনীতিকে পুরোপুরি বাজারের হাতে তুলে দেওয়া হল। অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ অর্থনীতির গতিরুদ্ধ করে— এই আদর্শ ছড়িয়ে দেওয়া হল আকাশে বাতাসে, সংবাদ মাধ্যম হল সেই আদর্শ প্রচারের হাতিয়ার। লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে জলের দরে বেচে দেওয়া হতে থাকল বেসরকারি পুঁজির কাছে। জল-জঙ্গল-জমি, সমুদ্র, নদী, পাহাড়, প্রকৃতির কোনও কিছুই পুঁজির উদগ্র লালসা থেকে রক্ষা পেল না— যা জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্ব উষ্ণায়নকে তীব্র করে তুললো। সরকার পোষিত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সর্বনাশ করে ব্যবসায়ীদের মুনাফার জন্য খুলে দেওয়া হল। শ্রমিক শ্রেণীর বহু সংগ্রাম ও লড়াইয়ের মাধ্যমে অর্জিত অধিকারগুলিকে ক্রমাগত সংকুচিত করার প্রয়াস শুরু হয়। এ হল পুঁজির মুনাফার হারকে বৃদ্ধি করার নিষ্ঠুর অভিযান। আমেরিকা, ইউরোপ এবং আমাদের দেশ নয়া উদারবাদের রাস্তা নিয়ে দেশ ও জনসাধারণকে বিপর্যয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। নয়া উদারবাদের পর্বে ইউরোপ, আমেরিকার দেশে দেশে এবং ভারতে অসাম্য যেন সর্বকালের রেকর্ড ভেঙে ফেলল। উন্নত দেশগুলি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেসরকারিকরণ করে নিজ নিজ দেশকে করোনার বধ্যভূমি করে তুলেছে। ইতিমধ্যে করোনা সংক্রমণে মৃত ২ লক্ষাধিক মানুষের মধ্যে ১ লক্ষ ৮০ হাজার জনই আমেরিকা ইউরোপের মানুষ। পরবর্তি সময়ে গবেষণায় হয়ত জানা যাবে, এই হতভাগ্য মানুষদের বড় অংশই শ্রমজীবী, নিম্নবিত্ত ও প্রান্তিক পরিবারের।
নয়া উদারনীতি ধনতন্ত্রের অন্তসারশূণ্য দেউলিয়া চরিত্রকে প্রকট করেছে। ২০০৮ সালে আমেরিকা থেকে উদ্ভূত মহামন্দা প্রায় সারা পৃথিবীকে গ্রাস করে। কয়েক কোটি মানুষ কাজ হারায়। তবুও সতর্ক হয়নি ধনতন্ত্র ও নয়া উদারনীতির প্রবক্তারা। মন্দা থেকে বাঁচতে আমেরিকার সরকার নাগরিকদের ট্যাক্সের টাকায় ১৩ ট্রিলিয়ন ডলার (১৩ লক্ষ কোটি ডলার) বেলআউট করে দেউলিয়া হতে বসা অতিকায় সংস্থাগুলিকে রক্ষা করে। সরকারের ভারসাম্যহীন নীতির পরিণতিতে অসাম্য আরও তীব্র হয়েছে। মুষ্টিমেয় কয়েক শতাংশ ধনী-অতিধনীদের হাতে সম্পদ আরও কুক্ষিগত হয়েছে আর ব্যাপকতর জনসংখ্যাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বঞ্চনা, দারিদ্র, বেকারি ও নিঃস্ব হওয়ার দিকে। অসাম্যের বিরুদ্ধে আমেরিকায় ‘অকুপাই ওয়ালস্ট্রীট’ আন্দোলন আমারা স্মরণ করতে পারি। তারপরেও সর্তক হয়নি হোয়াইট হাউসের কর্তারা। ট্রাম্প সরকার ‘ওবামাকেয়ার’ বাতিল করে দিয়ে ২ কোটি মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা কেড়ে নিয়েছে।
২০০৮ সালের মন্দার রেশ থেকে পৃথিবী বেরিয়ে আসতে পারেনি। অর্থনৈতিক সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে আমেরিকা বাণিজ্য সংরক্ষণ নীতি চালু করেছে— সারা পৃথিবীর উপর শুল্ক যুদ্ধ তথা বাণিজ্য যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। প্রতিক্রিয়ায় চীন ও ইউরোপ একই পথ নিয়েছে। আমেরিকার শুল্ক যুদ্ধের হাত থেকে মিত্র ভারতও পরিত্রাণ পায়নি। যার ফলে বিশ্ব অর্থনীতির গতি আর এক প্রস্থ শ্লথ হয়েছে। ১৯৩০ সালে আমেরিকা একই রকম ভাবে বাণিজ্য সংরক্ষণ নীতি গ্রহণ করেছিল এবং শুল্ক যুদ্ধ শুরু করেছিল যা ১৯৩৩-এর অতিমন্দার অন্যতম কারণ হিসাবে চর্চিত।
এই রকম মন্দাবস্থায় করোনা সংক্রমণ উন্নত বিশ্ব সহ সারা পৃথিবীকে আঘাত করেছে। বিশ্বায়নের অর্থনীতির হাত ধরে অতিমারির অভিঘাতও বিশ্বজনীন। পৃথিবীজোড়া লকডাউনে চলমান বিশ্বব্যাপী মন্দা আরও গভীর রূপ নেবে। অর্থনীতি প্রায় স্তব্ধ। আমাদের দেশ ও সারা বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ কাজ হারাবে। বিশ্বায়নের অর্থনীতি এক মহাপতনের দিকে ধাবিত হচ্ছে যা ১৯৩৩-এর অতিমন্দাকেও ছাপিয়ে যেতে পারে।
এই সময়ে দুটি পরস্পর বিরোধী প্রবণতা বিশ্বজনীন ভাবে ক্রিয়াশীল। এক দিকে, লগ্নি পুঁজির স্বার্থ ও ক্ষমতাধর বিশ্ব এই পরিস্থিতিকে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার কাজে ব্যবহার করতে চায়। এই প্রবণতা করোনা সংক্রমণকে বাণিজ্য সংরক্ষণ ও অর্থনীতিতে রুদ্ধদ্বারবাদের সপক্ষে যুক্তি সাজায়। উন্নত বিশ্ব সারা পৃথিবীর জন্য দরজা বন্ধ করে দেয়। আমেরিকা এই অবস্থাতেও ইরান ও কিউবার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ চালিয়ে যায়। আমেরিকা থেকে ভারত সর্বত্র শিল্পপতি ও কর্পোরেট সংস্থাগুলি রাষ্ট্র ও সরকারের কাছ থেকে জনসাধারণের ট্যাক্সের টাকায় লক্ষ কোটি টাকার ভর্তুকি, বেলআউট বা স্টিমুলাস প্যাকেজ আদায় করে নিতে চায়। জনসাধারণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংগঠিত হওয়ার অধিকার, প্রতিবাদ করার অধিকারকে খর্ব করে অতি ক্ষমতাসম্পন্ন কর্তৃত্ববাদী হিংস্র রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলে সাম্ভাব্য গণবিক্ষোভকে স্তব্ধ করতে চায়। এই প্রবণতার ভারতীয় নমুনা হল, লকডাউনের মধ্যেই শ্রমিকদের কাজের সময় বিধিবদ্ধ ভাবে ৮ ঘন্টা থেকে ১২ ঘন্টা করার অমানবিক প্রয়াস। খাদ্য ও চিকিৎসার দাবিতে মানুষের আকুতিকে পুলিশি হিংসা দিয়ে স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা।
এর বিপরীত প্রবণতা হল, বিষয়ীগত ভাবে সারা পৃথিবীতেই দাবি উঠেছে, শ্রমজীবী ও গরীব জনসাধারণের খাদ্য, আশ্রয়, চিকিৎসার দায়িত্ব রাষ্ট্র ও সরকারকেই নিতে হবে। আমাদের দেশে পরিযায়ী ও অসংগঠিত শ্রমিকদের রক্ষা করার দাবি যথেষ্ট জোরালো ভাবে উত্থাপিত হচ্ছে। অমর্ত্য সেনের মতো মানুষেরা অনাহার রুখতে সরকারি-বেসরকারি গুদামের মজুত চাল-ডাল-গম শ্রমজীবী ও গরীব মানুষের মধ্যে বিলি করার পরামর্শ দিয়েছেন। কৃষক সংগঠনগুলি দাবি করেছেন, খাদ্য নিরাপত্তা যাতে বিঘ্নিত না হয় তার জন্য সরকারকে কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ফসল ক্রয় করতে হবে। করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায় সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালগুলিকে খুলে দেওয়ার দাবি উঠে এসেছে। আর এই সব অত্যাবশ্যকীয় জরুরি কাজগুলি করার জন্য ধনী-অতিধনীদের উপর করোনা ট্যাক্স চালু করা এবং ধনী-অতিধনীদের অনাদায়ী ঋণ উদ্ধারের দাবি জানিয়েছেন বামপন্থী দল ও কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি। এই বিষয়ীগত কারণে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি গরীব জনসাধারণের জন্য যথসামান্য হলেও কিছু পদক্ষেপ ও অর্থ বরাদ্দ করতে বাধ্য হয়েছে। জনমত ও আন্দোলন যত সংগঠিত হবে পুঁজি ও ক্ষমতার ধামাধরা সরকারগুলির কৃপণ হাত থেকে শ্রমজীবী ও গরীব সাধারণের সপক্ষে অর্থনৈতিক নীতিগুলির আরও পরিবর্তনের সম্ভবনা বাড়বে। তাছাড়া ভোট বড় বালাই। প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক নীতি ও পদক্ষেপগুলি না গ্রহণ করলে শাসকরা প্রত্যাখাত হবে, কি কেন্দ্রে কি রাজ্যে।
বিশ্ব পরিধিতে বস্তুগত ভাবে প্রবণতা হল, ‘পরিসমাপ্ত’ ইতিহাসের পাতা খুঁড়ে নয়া উদারনীতির উল্টো পথে যাত্রা শুরু হওয়া। স্পেন করোনা সংকট মোকাবিলায় দেশের সবকটি বেসরকারি হাসপাতালের জাতীয়করণ করেছে। ফ্রান্সের মার্সেই শহরে শ্রমিকরা ম্যাকডোনাল্ডের দখল নিয়েছেন শ্রমিকরা— রেস্তোরাকে ঘাঁটি করে স্থানীয় মানুষদের মধ্যে খাবার বিলি করছেন। ইউনিয়ন তাদের এই কাজে সাহায্য করছে। আদালত এই কাজে অনুমোদন দিয়েছে। আমাদের দেশে ইতিহাস প্রসিদ্ধ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেঙ্গল কেমিক্যালের মৃত্যুঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার, সেই সংস্থাই অতি প্রয়োজনীয় ওষুধ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন উৎপাদন করে ঘুরে দাঁড়ানোর রাস্তায় হাঁটছে। জার্মানি ইতালি বা গ্রীসকে সাহায্য করতে পারছে না, কিন্তু কিউবা দেশে দেশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ভিয়েতনাম তার গণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জোরে নিজের দেশের একটি মানুষকেও মারা যেতে দেয় নি। আমেরিকা ন্যাপাম বোমা ফেলে ভিয়েতনামকে ছিন্নভিন্ন করেছিল— সেই আমেরিকায় মেডিকেল সাহায্যের সাহায্য পৌঁছে দিচ্ছে ভিয়েতনাম। চীন লকডাউনে সকলের কাছে খাবার, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পৌঁছে দিয়ে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর প্রাথমিক আঘাতকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং অবরুদ্ধ ইরান সহ সারা পৃথিবীতে ওষুধ, সরঞ্জাম, চিকিৎসক, নার্স পাঠাচ্ছে। আমেরিকা ও উন্নত বিশ্ব যতই চীন বিরোধী কুৎসা করুক না কেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা মোকাবিলায় চীনের ভূয়সী প্রশংসা করছে। আমাদের দেশে কেরালার বাম-গণতান্ত্রিক সরকার শ্রমজীবী মানুষের অভিমুখী অর্থনৈতিক নীতি ও জনস্বাস্থ্য নীতির জোরে লকডাউনে পরিযায়ী ও অসংগঠিত শ্রমিক সহ দরিদ্র জনসাধারণের কাছে খাদ্য, আশ্রয় ও চিকিৎসা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে সারা দেশকে পথ দেখাচ্ছে।
পৃথিবী এক যুগ সন্ধিক্ষণের মুখোমুখি। বিশ্বায়ন ও নয়া উদারবাদের শক্তিগুলি করোনা মহামারির বিরুদ্ধে কার্যকরি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। ২০০৮ সালের মন্দা প্রমাণ করেছে, ধনতন্ত্রের তূণীরে এমন কোনও ব্যবস্থা নেই যা দিয়ে করোনা বিপর্যয় পরবর্তি সাম্ভাব্য অতিমন্দাকে মোকাবিলা করতে পারে। সংকট সমাধানের জন্য ধনতন্ত্রের কাছে কোনও অর্থনৈতিক রাস্তা খোলা নেই— সে কারণে তাকে বারবার যুদ্ধ, দাঙ্গার মতো অর্থনীতি বহির্ভূত রাস্তা নিতে হয়। বন্টন ব্যবস্থার অসাম্য ধনতন্ত্রের অন্তর্লীন সমস্যা যা ব্যবস্থা হিসেবে ধনতন্ত্রকে ভারসাম্যহীন, অমানবিক এবং প্রাগৈতিহাসিক করে তুলেছে। পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গেলে অসাম্য বিরোধী শক্তিসমূহকে শ্রমজীবী মানুষের অভিমুখী নীতি ও প্রসারিত গণতন্ত্রের ভিত্তিতে নতুনতর মেরুকরণের দিকে সচেতন প্রয়াস শুরু করতে হবে। ইতিহাসের পরিসমাপ্তি নয়, আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে ইতিহাসের সমষ্টিবদ্ধ গণতান্ত্রিক অগ্রগতি। মে দিবসে তাৎপর্যপূর্ণ দিনে নতুনতর ইতিহাস সৃষ্টির আমাদের পদচারণা শুরু হোক।