বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[সম্পাদকীয়]

[সম্পাদকীয়]

বাংলার শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ভবিষ্যত

বাংলার শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ভবিষ্যত

সম্পাদকীয়, ১ নভেম্বর ২০২২

photo

১ নভেম্বর, ২০২২, শ্রমজীবী ভাষা— মাঝ রাতের অন্ধকারে পুলিশ দিয়ে অনশন-অবস্থানে অবসন্ন প্রাথমিকের নিয়োগপ্রার্থীদের তুলে দেওয়ার মধ্যে ক্ষমতার দর্প ও অমানবিকতার যে প্রকাশ হয়েছে, বাংলার ইতিহাসে তার তুলনা মেলা ভার। টেট উত্তীর্ণ প্রাথমিকের নিয়োগপ্রার্থীদের বড় একটা অংশ ২০১৪ সাল থেকে নিয়োগের দাবি জানিয়ে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে ফিরছেন। আবার টেট উত্তীর্ণদের আর এক অংশ ২০১৬ সাল থেকে নিয়োগ দাবি করছেন। হাজার হাজার নিয়োগপ্রার্থীদের দাবি, তাঁরা যোগ্য কিন্তু বঞ্চিত। তাঁরা লক্ষ লক্ষ টাকা উৎকোচ দিয়ে চাকরি কিনতে পারেনি।
ধর্মতলার গান্ধী মূর্তি পাদদেশ ও মাতঙ্গিনী হাজরা মূর্তির পাদদেশ এখন চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনের কেন্দ্র। ছোট ছোট জমায়েতে অস্থায়ী ছাউনির নীচে চাকরিপ্রার্থীরা প্রখর রোদ, ঝড়-বর্ষা, শীতের ঠান্ডা উপেক্ষা করে ধর্না চালিয়ে যাচ্ছেন। পুলিশের ঘাড় ধাক্কা খেয়েছেন, লাঠিপেটা খেয়েছেন তবুও চাকরির দাবিতে নাছোড় আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এসএসসির বঞ্চিত নিয়োগপ্রার্থীরা চাকরির দাবিতে তাঁদের অবস্থান-ধর্না চালাচ্ছেন ৫৯৬ দিন ধরে। প্রাথমিকের টেট উত্তীর্ণ, শরীর শিক্ষা ও কর্ম শিক্ষার নিয়োগপ্রার্থী— কে নেই চাকরি দাবির আন্দোলনে।
বছরের পর বছর ধরে এই সমস্ত শিক্ষিত যুবক-যুবতীরা আন্দোলন চালাতে চালাতে ক্লান্ত, কিন্তু চাকরির দাবিতে অনড়। এত দিন তাঁরা প্রায় নিঃশব্দে শিক্ষা প্রশাসনের নানান স্তরে, সরকারের কাছে বার বার আবেদন নিবেদন করেছেন। শিক্ষা অধিকর্তা, মন্ত্রী-আমলা, খোদ মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে বহু আশ্বাস, প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। কিন্তু দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ হয়নি। যোগ্য অথচ বঞ্চিত প্রার্থীরা চাকরি পাননি, অযোগ্যরা মোটা অঙ্কের উৎকোচের বিনিময়ে স্কুলে স্কুলে যোগদান করে স্কুলশিক্ষাকে কলূষিত করে যাচ্ছিলেন।
বঞ্চিত নিয়োগপ্রার্থীদের সামনে অন্য সমস্ত রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁরা বাধ্য হয়ে আন্দোলনের রাস্তা গ্রহণ করেন এবং আদালতের দারস্থ হন। উচ্চ আদালতের নিয়োজিত তদন্ত কমিটি শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে। মেধাতালিকায় যোগ্য প্রার্থীদের তালিকা বাতিল করে নতুন তালিকা তৈরি করা হয়েছে, যেখানে অকৃতকার্য প্রার্থীকে দেখানো হয়েছে কৃতকার্য হিসেবে। লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে অযোগ্যদের নিয়োগ করা হয়েছে বলে অভিযোগ।
উচ্চ আদালতের নির্দেশে শিক্ষা রাষ্ট্রমন্ত্রীর কন্যা সহ বহু অযোগ্য শিক্ষক বরখাস্ত হয়েছেন। পদ থেকে বরখাস্ত হয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিকর্তা। উচ্চ আদালতের সুনির্দিষ্ট নির্দেশে কেন্দ্রীয় তদন্তকারি সংস্থা সিবিআই ও ইডি শিক্ষা দুর্নীতির তদন্তে নেমেছে। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী, প্রাথমিক শিক্ষা অধিকর্তা, এসএসসি-র একদা শীর্ষ অধিকর্তারা এখন ইডি, সিবিআই এবং বিচারবিভাগীয় হেপাজতে। উদ্ধার হয়েছে কোটি কোটি টাকার অবৈধ অর্থ। কিন্তু ক্ষমতার অলিন্দে থেকে যে মূলচক্রীরা রাজ্যের শিশু-কিশোরদের শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে তার রহস্য কি উন্মোচিত হবে — লোভী অপরাধীরা কি শাস্তি পাবে — তার থেকেও বড় প্রশ্ন, যোগ্য ও বঞ্চিত প্রার্থীরা কি চাকরি এবং ন্যায়বিচার পাবেন। সারদা ও নারদা মামলার পরিণতি দেখে প্রশ্ন বাংলার জনসমাজের মনে, কোনও সেটিংয়ে বাংলার ইতিহাসে শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগে সবচেয়ে বড় বেনিয়মের তদন্ত ধামাচাপা পড়ে যাবে না তো।
এ রাজ্যের শিক্ষা সমস্যার গুরুতর দিক এই সময়ে সামনে এসেছে। শিক্ষক নিয়োগে বেনিয়মে শুধুমাত্র যোগ্যপ্রার্থীদের প্রতিই অবিচার করা হয়নি, সরকার পোষিত স্কুলগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা বড় প্রশ্নের মুখে পড়েছে। সরকারি ঔদ্যসীন্যে এবং অর্থের অভাবে সরকারি স্কুলগুলি হাজারো সমস্যায় জর্জরিত। রাজ্যজুড়ে শিক্ষকের বিপুল ঘাটতি স্কুলশিক্ষার প্রতিটি স্তরে বড় সমস্যা। প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য সংখ্যক শিক্ষক বহু স্কুলে শত শত ছাত্রছাত্রীকে পড়াতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রাথমিক স্তরে শিক্ষক ঘাটতি আরো প্রকট। অসংখ্য শিক্ষকপদ শূণ্য পড়ে থাকছে। রাজকোষের ঘাটতির কারণে অসংখ্য শূণ্য শিক্ষকপদে নিয়োগ হচ্ছে না। ছাত্রছাত্রীরা প্রয়োজনীয় যত্ন পাচ্ছে না। রাজ্যে শিক্ষার মানের অবনতি ঘটছে। শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতি সরকারি স্কুলের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা আরও তলানিতে নিয়ে যাচ্ছে। যাদের সামান্য আর্থিক সঙ্গতি আছে সেই সব পরিবার তাদের সন্তানদের সরকারি স্কুলের না পাঠিয়ে বেসরকারি স্কুলে পাঠান। মূলত দরিদ্র–নিম্নবিত্ত-প্রান্তিক পরিবারের সুযোগ বঞ্চিত ছেলেমেয়েরা সরকারি স্কুলে যায়। নিয়োগ দুর্নীতি সরকারি স্কুলগুলিকে সামাজিকভাবে আরও অবজ্ঞা–অবহেলার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিপরীতে, বেসরকারি স্কুলের শিক্ষা ব্যবসা আরও লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হচ্ছে। বাজার থেকে অন্যান্য পণ্যের মত শিক্ষা কেনার সামর্থ্য যাদের আছে তারা সেই মহার্ঘ শিক্ষা কিনছেন। আর সুযোগ বঞ্চিত দরিদ্রতর পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীরা পড়ে থাকছে শিক্ষা-বঞ্চনার অন্ধকারে। এরই মধ্যে খবরে এসেছে, নতুন নতুন বেসরকারি শিক্ষক-শিক্ষণ কলেজ ও কারিগরি কলেজ খুলে বিপুল মুনাফা কামানোর ব্যবস্থার কাহিনি।
অতিমারির লকডাউনে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের মর্মান্তিকভাবে ঘরে ফিরে আসা এই রাজ্যে অসংগঠিত-ইনফর্মাল ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের আসল ছবি জনসমক্ষে এনেছিল। এবার শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগপ্রার্থীদের আন্দোলন শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের গুরুতর সমস্যা সামনে এনে দিল। অর্থের অভাবে স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল থেকে সমস্ত সরকারি দপ্তরে অসংখ্য শূণ্যপদ খালি পড়ে থাকছে। স্থায়ী নিয়োগ নামমাত্র, অস্থায়ী চুক্তি ভিত্তিক কর্মী নিয়োগ করে কাজ চালানো হচ্ছে। চুক্তিভিত্তিক কর্মীরা সামান্য বেতনে স্থায়ী পদের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। স্থায়ী চাকরির আকালে স্কুলশিক্ষকের স্থায়ী চাকরির জন্য শিক্ষিত বেকারদের এমন আকুতি এবং যোগ্যতা মানে পৌঁছানো নিয়োগপ্রার্থীদের এই নাছোড় আন্দোলন। সারা দেশে সম্মানজনক স্থায়ী চাকরির আকালের কারণেই মোদি সরকারের অগ্নিপথ প্রকল্পে চুক্তিতে ঠিকা সেনা নিয়োগের প্রতিবাদে দেশজুড়ে বিক্ষোভ জ্বলে উঠেছিল।
দেড় দশক ধরে এ রাজ্যে কোনও বড় বিনিয়োগ হয়নি। বড় শিল্প গড়ে ওঠেনি। সিঙ্গুর থেকে টাটাদের প্রস্থানে এই রাজ্য সম্পর্কে বিনিয়োগকারিদের মধ্যে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তার রেশ থেকে এখনও এই রাজ্য বেড়িয়ে আসতে পারেনি। জাঁকজমক করে শিল্পসম্মেলন করলেও বিনিয়োগ হয়েছে নামমাত্র। যেটুকু বিনিয়োগ হয়েছে তার গতি বিনোদন, রিটেল মার্কেট বা রিয়েল এস্টেট। যেখানে অধিকারহীন গিগ শ্রমিক ও অস্থায়ী শ্রমিক ছাড়া নিয়োগই হয় না। এখন অবশ্য দেউচা-পাচামির কয়লা, তেজপুরের সমুদ্রের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ ক্রোনি পুঁজির গন্তব্য হয়ে উঠতে পারে, শুরু হতে পারে লুঠের মহাভোজ।
যাঁরা দেশ ও রাজ্যের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য কাজ করছেন তাঁদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সমস্যার গভীরতার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। শ্রমজীবী জনতার নানা অংশের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের দাবির সঙ্গে সৃজনশীলভাবে নিজেদের যুক্ত করতে হবে। শ্রমজীবীদের বিভিন্ন অংশ বিশেষত অসংগঠিত অংশের সঙ্গে আত্মীয়তার যোগ গড়ে তুলতে হবে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.