বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[সম্পাদকীয়]

[সম্পাদকীয়]

ছলনায় যেন ভুলে না যাই

ছলনায় যেন ভুলে না যাই

সম্পাদকীয়, ১ অক্টোবর, ২০২৩

photo

বিজেপির প্রতীক কমল। সেই কমল বা পদ্মের পাপড়ির মতো একে একে খুলে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী এই দলটির আসল স্বরূপ। সংসদীয় রীতিনীতিকে তুচ্ছ করে, আলোচনার বিষয়বস্তু না জানিয়েই ১৮ সেপ্টেম্বর ডাকা হল সংসদের অধিবেশন। পরে বোঝা গেল ওই দিনটা ছিল গণেশ চতুর্থী। হিন্দুত্বের সমর্থক ভোটারদের কাছে বার্তা দিতেই নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনের জন্য সুকৌশলে ওই দিনটাকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল। সেদিন সংসদে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে।

এমনটাই ঘটেছিল নতুন সংসদে যেদিন মোদি সেখানে সেঙ্গল পুজোর ব্যবস্থা করেছিলেন। তামিল ব্রাহ্মণদের উপস্থিতিতে নতুন সংসদ ভবনে পুজোপাঠের মূল হোতা ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেদিনও ভারত রাষ্ট্রের প্রধানের ঠাঁই হয়নি সংসদে। বিরোধীদের অভিযোগ, আদিবাসী বলেই উচ্চবর্ণের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তিনি প্রবেশের ছাড়পত্র পাননি। একইভাবে নতুন সংসদ ভবনে প্রথম অধিবেশনেও আমন্ত্রিত ছিলেন না রাষ্ট্রপতি। এর চেয়ে বেশি আর কোন ভাবে সংবিধানকে অবজ্ঞা করা যায়? এর চেয়ে বেশি আর কোন ভাবে বহুত্ববাদী ভারতের অবমাননা করা যায়?

নতুন সংসদে পাশ করানো হল মহিলা সংরক্ষণ বিল। রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু এক জন মহিলা। তবু তাঁর তরফে ছিল না কোনও বার্তা। ভারতে উচ্চবর্ণের লোকেরা যে ভাবে আজন্মকাল ধরে শূদ্রদের পায়ের তলায় রেখে এসেছে, একবিংশ শতকেও মোদির ভারতে তার কোনও ব্যতয় হল না। প্রচারের সব আলো শুষে নিতে হবে একজনকেই। তিনি নরেন্দ্র মোদি। তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম।

মহিলা বিল পাশ হলেও আশু কোনও লাভ হল কি? না, হল না। নিয়মবিধি অনুসারে ২০২৯ এর আগে এই বিল কার্যকর করার কোনও আশা নেই। জনগণনা ও এলাকা পুনর্বিন্যাস না হলে মহিলা সংরক্ষণ বিল কার্যকর করা যাবে না। অনেকেই বলছেন, মহিলা সংরক্ষণ কার্যকর করতে ২০২৯ নয়, ২০৩৪ সাল হয়ে যাবে। অর্থাৎ, নতুন সংসদের প্রথম অধিবেশনেই মোদি যে বিলটিকে পাশ করালেন তা আসলে একটি জুমলা। এই জুমলা প্রচার করেই ২০২৪এ ভোট চাইবেন তিনি। জনধন অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা দেওয়া, বা বছরে ২ কোটি চাকরির মতোই জুমলার ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেন মোদি।

বিজেপি অত্যন্ত সুকৌশলে নতুন সংসদ ভবনের প্রথম অধিবেশনের দিন সংবিধানের যে কপি বিলি করল তার প্রস্তাবনায় বাদ দেওয়া হল ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র শব্দদুটি। দুটি শব্দ গোড়ায় সংবিধানে ছিল না। পরে সংবিধান সংশোধন করে প্রস্তাবনায় যুক্ত করা হয়েছিল। আইনমন্ত্রী মেঘাওয়াল দিলেন কূট ব্যাখ্যা। সংশোধিত নয়, সংবিধানের মূল কপিটাই বিলি করেছেন তাঁরা। যদি সংবিধান সংশোধন করে প্রস্তাবনায় বদল করা হয়ে থাকে, তাহলে আগের কপিটার কোনও কার্যকারিতা থাকে না। মেঘাওয়াল ভাবলেন, সাধারণ মানুষ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের এটুকু কাণ্ডজ্ঞানও নেই।

আসলে বিজেপির বার্তা স্পষ্ট। বিজেপি দেখাল, মা যা হইবেন। ২০২৪এ লোকসভা জিতে এলে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র শব্দ তারা বাদ দেবেন। এতে একদিকে যেমন এদেশের মাটিতে বামপন্থার বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ জারি রাখার সুবিধা হবে, তেমনই ধর্মনিরপেক্ষতাকে ক্ষমতার যূপকাষ্ঠে বলি দিয়ে অহিন্দুদের শোনিতে দেশের মাটি সিক্ত করা যাবে। এখনও যা চলছেই। তবে সংবিধান যদি বৈধতা দেয় তাহলে আর কোনও বাধা সামনে থাকে না। ধাপে ধাপে বহুত্ববাদী ভারতকে হিন্দু ভারতে রূপান্তরিত করার আয়োজন সম্পূর্ণ করা হচ্ছে।

অধিবেশন শেষ করা হল এক বিজেপি সাংসদকে এগিয়ে দিয়ে। তাঁর ভাষণে ছিল অকথ্য ভাষায় সংখ্যালঘুদের আক্রমণ। বিজেপির বড় বড় নেতারা তা শুনে হেসে কুটোপাটি। এভাবেই সংসদের মঞ্চ থেকে সরাসরি সংখ্যালঘুদের আক্রমণ করে কার্যত ২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচার শুরু করে দিলেন মোদি-শাহরা। এও বহুত্ববাদী ভারতকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলার বার্তা।

কোভিডে এদেশে মারা গেছেন কয়েক লক্ষ মানুষ। পরিযায়ীদের দুর্দশা দেশ ভোলেনি। সেসবের ধাক্কা এখনও আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এখন শহর ও গ্রামে বেকারির হার সর্বোচ্চ। দেশে খাদ্যপণ্যে মুদ্রাস্ফীতি সব রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে। পারিবারিক সঞ্চয়ের হার গত পাঁচ দশকের মধ্যে তলানিতে। লোকের কাজ নেই, আয় নেই। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে নজর দেওয়ার কেউ নেই। এমন দুর্দশার দিনে ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে নতুন সংসদ ভবন নামক প্রাসাদ তৈরি করা হল শুধুমাত্র নরেন্দ্র মোদির নামকে অমর করে রাখার আকাঙ্ক্ষায়। নতুন সংসদে ভবন থেকে এতদিনের সংবিধানকে বিদায় দেওয়ার আয়োজন শুরু হয়ে গেল। আয়োজন শুরু হয়ে গেল হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র গড়ার।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.