বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[সম্পাদকীয়]

[সম্পাদকীয়]

বন্ধ হোক হিংসা আর হত্যার রাজনীতি

বন্ধ হোক হিংসা আর হত্যার রাজনীতি

সম্পাদকীয়, ১ এপ্রিল ২০২২

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ এপ্রিল, ২০২২— বীরভূম জেলার রামপুরহাটের বগটুই গ্রামে গণহত্যায় শিউরে উঠেছে সারা বাংলা। ধিক্কার উঠেছে সারা দেশ জুড়ে। ক্ষমতার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত যে অন্ধকারের শক্তি শিশু-নারী সহ ৯ জনকে জীবন্ত দগ্ধ করে হত্যা করতে এতটুকু দ্বিধা করে না, সেই শক্তি দেশ ও জাতির কলঙ্ক— মানবতা ও গণতন্ত্রের বড় বিপদ।

ক্ষমতার দম্ভ এবং একাধিপত্য কায়েমের উদগ্র বাসনা বার বার সামনে আসছে। সমস্ত বিরোধী ও প্রতিবাদী কন্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দিতে হবে। যে কোনও উপায়ে ক্ষমতা দখল রাখতেই হবে। কারণ ক্ষমতার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারলে অবৈধ উপার্জনের ব্যবস্থাও পাকা।

ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে রাজ্যকে বিরোধীশূন্য করার কাজ শুরু হয়েছিল প্রথম থেকেই। প্রথমে বামমুক্ত বাংলা, তারপর কংগ্রেসমুক্ত বাংলা। যে কোনও বিপরীত মত ও শক্তিকে দুরমুশ করতে হবে। পুলিশ-প্রশাসনকে বশংবদ ক্রীড়নকে পরিণত করে শাসক দল তার একাধিপত্য কায়েম করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সারা দেশে যে কায়দায় মোদি সরকার সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে কব্জা করেছে এবং স্বশাসিত সংস্থাগুলিকে বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে— প্রায় একই ধরনের কায়দায় বাংলাকে বাম-কংগ্রেস মুক্ত তথা বিরোধীশূন্য করার প্রয়াস বাংলার মাটিতে আরএসএস-বিজেপির মতো শক্তিকে বেড়ে উঠতে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। কর্পোরেট চালিত সংবাদমাধ্যমও বাংলার রাজনীতিতে তৃণমূল-বিজেপি এই দুই শক্তির দ্বিমেরুকরণের উপযুক্ত জল-হাওয়া দিয়েছে।

প্রায় বিরোধীশূন্য বাংলায় তাই এখন তৃণমূলই তৃণমূলের শত্রু। বাংলা জুড়েই ক্ষমতা দখল রাখা এবং তার সূত্রে কালো টাকার অবাধ উপার্জনের রাজত্ব চালিয়ে যেতে শুরু হয়েছে উন্মত্ত গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব। রামপুরহাট এলাকার বালি, পাথর, কয়লা খাদানের অবৈধ লেনদেনের কর্তৃত্ব কার হাতে থাকবে সেই দ্বন্দ্বের পরিণতিতে বগটুই গ্রামের নির্মম গণহত্যা। উপপ্রধান খুন হওয়ার রাতে পুলিশকে ঠুঁটো জগন্নাথ হিসেবে দাঁড় করিয়ে রেখে এই গণহত্যা সংগঠিত করা হয়েছে।

সাম্প্রতিক বাংলায় একের পর এক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটে চলেছে। আমতার গ্রামে গভীর রাতে পুলিশ ও সিভিক ভলান্টিয়ারের পোষাকে বাড়িতে ঢুকে প্রতিবাদী যুবক অনিস খানকে খুন করা হয়েছে। খুন হয়েছেন ঝালদার কংগ্রস কাউন্সিলার। এমনকি খুন হয়েছেন পানিহাটির শাসক তৃণমূল দলের কাউন্সিলার। পঞ্চায়েত, পুরসভা, বিধানসভা থেকে ক্লাব, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সমবায় কব্জা করতে বাহুবলীদের তান্ডবে সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। তাতে যদি মানুষের প্রাণ যায় যাক। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও শ্রমজীবী মানুষের অধিকার হরণের এই গতি এক নিষ্ঠুর, অমানবিক, নারীবিদ্বেষী শাসনে পরিণত হয়েছে।

শাসক দল এতদিন মুসলিম সম্প্রদায়কে ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে ব্যবহার করেছে— মুসলিম সমাজের দারিদ্র, অশিক্ষা, কর্মহীনতার গভীর সমস্যা সমাধানের আশু ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা কার্যকর না করে তাদেরই একাংশকে দুর্বৃত্ত বাহিনি হিসেবে কাজে লাগিয়েছে শাসক দল। আনিস খানের হত্যা এবং রামপুরহাটের গণহত্যায় শঙ্কিত মুসলিম সমাজ। সরকার হত্যা ও গণহত্যার ক্ষতিপূরণের দাম ধরে দিতে চাইছেন পাঁচ লক্ষ টাকা আর চাকরি। টাকা আর চাকরির লোভ দেখিয়ে কত দিন মানুষকে দমিয়ে রাখা যাবে। আনিসের বাবা প্রত্যাখ্যান করেছেন সরকারের উপঢৌকন।

শিল্পের বিকাশহীন, কৃষির বিকাশহীন, প্রায় কর্মসংস্থানহীন বাংলায় কালো টাকা, তোলাবাজি, কাটমানি তাই উপার্জনের সহজ রাস্তা। দুর্নীতির এই ক্লেদাক্ত পথে কোটি কোটি মানুষে টেনে নামানো সম্ভব নয়। বাংলার হতভাগ্য মানুষের ভাগ্যে তাই অনুদানের প্রকল্পরাজি। যে অনুদানের টাকা পেতে গেলেও মানুষকে শাসক দলের বশংবদ হতে হয় এবং মাতব্বরদের কাটমানি দিতে হয়। যদিও উত্তরপ্রদেশ জয়ে হিন্দুত্ববাদী মেরুকরণের তাসের সঙ্গে মোদি-যোগীর বাজি ছিল এই ধরনের অনুদানের প্রকল্পগুলি।

একাধিপত্য কায়েমের উদগ্র বাসনা, দুর্নীতি ও কালো টাকার ক্লেদাক্ত রাস্তা, হত্যা ও গণহত্যার রাজনীতি কিন্তু বাংলায় মোদি-যোগীদের রাস্তা সুগম করে তুলতে পারে। সুতরাং বাংলার ঐতিহ্য, মানবতা ও গণতন্ত্রকে রক্ষা করার স্বার্থে সমস্ত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আওয়াজ তুলতে হবে— বন্ধ হোক হিংসা ও হত্যার রাজনীতি।
আশার কথা, বাংলার বাম ছাত্র-যুবদের এক গুরুত্বপূর্ণ শক্তি প্রবল প্রতিবাদের মাধ্যমে এই হত্যার রাজনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। নারীদের এক সচেতন অংশ হিংসার রাজনীতির বিরুদ্ধে রাজপথে নেমেছেন। শাসক দলের ধর্মঘট বিরোধী ফতোয়াকে উপেক্ষা করে বাংলায় ব্যাঙ্ক ধর্মঘট হয়েছে সর্বাত্মকভাবে। ধর্মঘট করেছেন বিএসএনএল শ্রমিকরা, চা শ্রমিকরা, পাওয়ার গ্রীড কর্পোরেশনের কর্মীরা, বেসরকারি পরিবহন কর্মীরা। কলকাতা থেকে জেলা সর্বত্রই ধর্মঘটের সমর্থনে শ্রমিক-কর্মচারী, ছাত্র-যুব-মহিলারা মিছিল, পিকেটিং করে মানুষের সমর্থন আদায় করে নিয়েছেন।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.