বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[সম্পাদকীয়]
শ্রমজীবী ভাষা, ১ ডিসেম্বর, ২০২২— নিয়োগের দাবি জানতে গিয়ে পুলিশের কামড় খেলেন প্রাথমিকের চাকরিপ্রার্থী। ডিএ-র দাবি জানাতে গিয়ে ঘুষি খেলেন সরকারি কর্মচারী। পুলিশের হেনস্থা থেকে রেহাই পেলেন না প্রবীণ পেনশনাররা। নার্সিং থেকে, এসএসসি, টেট উত্তীর্ণ যোগ্য চাকরি প্রার্থীরা নিয়োগের দাবিতে কালিঘাট, ক্যামাক স্ট্রিট থেকে করুণাময়ী যেখানেই শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ জানাতে গেছেন সেখানেই তাঁদের জুটেছে পুলিশের ঘাড়ধাক্কা, টেনেহিচড়ে তাঁদের পুলিশের ভ্যানে তোলা হয়েছে, কোথাও বা জামিন অযোগ্য ধারায় কেস দিয়ে কয়েদ রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।
অবশ্য গণতন্ত্রের দাবি তুলে ২০১১ সালে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছিল!
এসএসি ও টেট পরীক্ষার মেধাতালিকায় উত্তীর্ণ যোগ্য প্রার্থীরা শীত, বর্ষা, গ্রীষ্ম উপেক্ষা করে রাস্তায় বসে চাকরির দাবি করছেন এবং আদালতের দরজায় কড়া নাড়ছেন। অন্যদিকে, অযোগ্যরা অসৎ উপায় অবলম্বন করে মোটা উৎকোচের বিনিময়ে স্কুলশিক্ষকের চাকরি হাসিল করে সরকারি স্কুলের শিক্ষাকে অসম্মানিত ও কলঙ্কিত করছে। সরকারের মন্ত্রী-আমলারা নিয়োগ দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা দিয়ে রাজ্যের স্কুলশিক্ষাকে আরও অবনমনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। রাজ্যের ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার ভবিষ্যত অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। উচ্চ আদালতের আদেশ সত্ত্বেও রাজ্যের মন্ত্রী-নেতারা অবৈধভাবে নিযুক্তদের চাকরি বাঁচাতে তৎপর। এই সব অযোগ্য ‘ব্যতিক্রমী’দের চাকরি বাঁচাতে রাজ্যের মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্তে সৃষ্টি করা হয়েছে অতিরিক্ত শূণ্যপদ। সিঙ্গল বেঞ্চের আদেশের বিরুদ্ধে ডিভিশন বেঞ্চে, ডিভিশন বেঞ্চের আদেশের বিরুদ্ধে শীর্ষ আদালতে ছুটছে সরকার।
এই হচ্ছে এখনকার পশ্চিমবাংলায় স্বচ্ছতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের নমুনা।
মাত্র ১১০০০ প্রাথমিক শিক্ষকপদের জন্য ১১ ডিসেম্বর টেট পরীক্ষায় বসতে চলেছেন প্রায় ৬ লক্ষ ৯০ হাজার চাকরি প্রার্থী। শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের মধ্যে সরকারি স্কুলের চাকরির প্রতি এই চাহিদা স্থায়ী চাকরির আকাল এবং পশ্চিমবাংলায় প্রকট বেকার সমস্যাকে বুঝিয়ে দেয়। সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা লক্ষ লক্ষ নিয়োগের হিসেব দিয়ে থাকেন। কিন্তু সরকারি কোনও নথি বা ওয়েবসাইট থেকে এই নিয়োগের তথ্য জানার উপায় নেই।
নিয়োগ দুর্নীতি ও চাকরিপ্রার্থীদের নাছোড় আন্দোলন রাজ্যজুড়ে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলগুলিতে শিক্ষকের বিপুল ঘাটতি সামনে নিয়ে এসেছে। একইভাবে, সরকারি কোনও নথি বা ওয়েবসাইট থেকে জানার উপায় নেই, পশ্চিমবাংলায় কত শিক্ষকপদ শূণ্য পড়ে আছে। প্রাথমিক স্তরে কত শিক্ষকপদ শূণ্য, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক বা নার্সিংয়ে কত শূণ্যপদ।
যেমন ভাবে, এই রাজ্যে জানা যায় না, প্রকৃতই কত জন ডেঙ্গিতে মারা গেলেন বা কতজন কৃষক-ক্ষেতমজুর-বর্গাদার ঋণের জ্বালায়, অভাবের তাড়নায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এখন কত লক্ষ শ্রমজীবী এই রাজ্যে কাজের অভাবে কেরালা, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, দিল্লি ও অন্যান্য দূর রাজ্যে পরিযায়ী হয়ে কাজ করতে গেছেন, তার খবর কে রাখে। সরকারি বয়ান অবশ্য এক-একটা থাকে যা জনসাধারণের বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলে না।
তথ্য জানার অধিকার কিন্তু সাংবিধানিক অধিকার।
স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইবুনাল, হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চ, ডিভিশন বেঞ্চ প্রতিটি স্তরে আদালত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে ডিএ কর্মচারীদের ন্যায়সঙ্গত আইনি অধিকার। ডিএ দেশের খুচরো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সূচকের সঙ্গে যুক্ত। বাজারে জিনিসের দাম বাড়ার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে ডিএ নির্ধারণ করা হয়। এখন এই রাজ্যের সরকারি কর্মচারীদের বকেয়া ডিএ ৩৫ শতাংশ। সরকার বার বার নানা যুক্তিতে রাজ্যের সরকারি কর্মচারীদের কেন্দ্রীয় হারে বকেয়া ডিএ দেওয়ার বিষয়টি উপেক্ষা করে চলেছে— কখনও রাজ্যের কোষাগারের সামর্থ্যের অজুহাত দেখিয়ে, কখনও বকেয়া ডিএ দিতে গেলে রাজ্যের কল্যাণ প্রকল্পগুলি বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে সরকার কালক্ষেপ করে চলেছে। এখন দেখার সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর সরকার কী করে।
এখানেও সরকার কর্মচারী থেকে সরকারি স্কুলের শিক্ষক, সরকারি হাসপাতালের স্বাস্থ্য কর্মী, পুলিশ সকলের ন্যায়সঙ্গত বেতনের অধিকার ক্রমাগত উপেক্ষা করে চলেছে।