বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[সম্পাদকীয়]

[সম্পাদকীয়]

বঞ্চনার বিরুদ্ধে অধিকার ও ইনসাফের দাবিতে

বঞ্চনার বিরুদ্ধে অধিকার ও ইনসাফের দাবিতে

সম্পাদকীয়, ১ ডিসেম্বর, ২০২৩

photo

খাদ্যের অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, কাজের অধিকার, বাসস্থানের অধিকারের মতো মানুষের মৌলিক অধিকারগুলি লঙ্ঘিত হচ্ছে। এই নিয়ে দুই সরকার ও তাদের প্রতিনিধিদের মধ্যে কাজিয়া লেগেই আছে। নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে দুই পক্ষের বিতন্ডা বাড়তে থাকবে। সংবাদমাধ্যমও ফলাও করে তা প্রতিদিন পরিবেশন করতে থাকবে। হারিয়ে যাবে মানুষের বেঁচে থাকার সমস্যার কথা, তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা, তাদের বঞ্চনা ও ক্ষোভের কথা, তাদের দাবি ও ইনসাফের কথা।

রেশনের চাল-গমের একটা বড় অংশ প্রকৃত প্রাপকদের বঞ্চিত করে চলে যাচ্ছে খোলাবাজারে। গরিব মানুষের খাদ্য নিয়ে কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত রেশনের ডিস্ট্রিবিউটার, ডিলার, খাদ্য দপ্তরের আধিকারিক থেকে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রী। ধান কেনাতেও চলছে অবৈধ কারবার। রাজ্য সরকার এবছর ধানের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য স্থির করেছে ২১৮৩ টাকা কুইন্টাল প্রতি। চালকলগুলি ফড়েদের মাধ্যমে চাষিদের কাছ থেকে ধান কিনে সরকারের কাছে বিক্রি করছে মুনাফা করছে। চাষিরা অভাবি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন অনেক কম দামে। চালকল মালিক, ফড়ে থেকে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রী — লুঠের চক্র মানুষের খাদ্যের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। মানুষের খাদ্যের অধিকার, কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার অধিকারের কথা তুলে ধরতে হবে ব্যাপক মানুষের কাছে।

রাজ্যে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ছেলেখেলা চলছে। সরকারি স্কুলগুলিতে কয়েক লক্ষ শিক্ষক পদ শূণ্য পড়ে থাকছে। মাত্র এক জন, দু’ জন মাস্টার মশাই বিপুল সংখ্যক ছাত্রকে সামলাতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছেন। প্রতিটি স্তরে স্কুলছুটের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে পরীক্ষার্থী সংখ্যা কমেছে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে কয়েক হাজার সরকারি স্কুল। যোগ্য প্রার্থীরা বছরের পর বছর রাস্তায় বসে ধর্না দিচ্ছেন নিয়োগের দাবিতে। আর লক্ষ লক্ষ টাকা উৎকোচের বিনিময়ে চাকরি পেয়েছে ফেল করা প্রার্থীরা। শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েরা। গরিব ছেলেমেয়েদের শিক্ষার অধিকার ও বঞ্চনার কথা তুলে ধরতে হবে সকলের কাছে।

২০০৫ সালে গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারেন্টি আইন পাস হয় এবং সারা দেশে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প চালু হয়। এই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা থাকলেও গ্রাম ভারতে এই প্রকল্প কর্মসংস্থানের অন্যতম অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়। প্রায় গত দু’ বছর ধরে এই রাজ্যে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প কার্যত বন্ধ হয়ে আছে। কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রকল্পের ব্যয়বরাদ্দ ক্রমান্বয়ে কমিয়ে চলেছে। অন্যদিকে, এই প্রকল্পে বরাদ্দ অর্থের ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির কারণে রাজ্য সরকার হিসেব পেশ করতে পারছে না। এ সুযোগ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এই খাতে অর্থ বরাদ্দ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে। কোটি কোটি গ্রামীণ গরিব মানুষের কাজ নেই, মজুরি বকেয়া পড়ে থাকছে। কেন্দ্র-রাজ্যের কাজিয়া চলছেই। কিন্তু গ্রামীণ গরিব মানুষেরা যে তিমিরে সেই তিমিরেই থেকে যাচ্ছেন। বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ ও সম্ভাবনা না থাকায় নিরুপায় হয়ে এ রাজ্যের লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজের সন্ধানে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছেন। শ্রমজীবী মানুষের কাজ ও মজুরির দাবি তুলে আনতে হবে লোকসমাজের সামনে।

যেভাবে ইনসাফের দাবিতে গোবিন্দভোগ ধানের আঁটি মাথায় নিয়ে রাস্তায় নেমেছে স্কুলছাত্রীরা। বর্ধমানের বাকুড়া মোড়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে সপরিবারে তারা বিক্ষোভে সামিল হয়েছে গোবিন্দভোগ ধানের ন্যায্য দাম চেয়ে। উত্তর দামোদরের রায়না, খণ্ডকোষ ও মাধবডিহি থানার কৃষকরা অনেকেই গোবিন্দভোগ ধান চাষের উপর নির্ভরশীল। এই সুগন্ধী চাল বিদেশেও রপ্তানি হয়। গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার এই চালের উপর ২০ শতাংশ হারে শুল্ক চাপিয়েছে। ফলে বিদেশে গোবিন্দভোগ চাল রপ্তানি মার খাচ্ছে। অনেক চাষীর ঘরে গত বছরের ধান এখনও মাড়াই বাঁধা আছে, বিক্রি হয়নি। সঙ্কটে পড়েছেন এই এলাকার কৃষকরা। গোবিন্দভোগ ধান বিকোচ্ছে না। এই চাল রপ্তানি মার খাওয়ায় কেবল কৃষকরা নয় ওই এলাকার ১৩০টি চালকলের কয়েক হাজার শ্রমিকের রুজি-রোজগার অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

এইভাবেই বাংলার হাজার হাজার গ্রামে, জনপদে ছড়িয়ে যেতে হবে। সে কাজ শুরু হয়েছে। যেতে হবে আরও বহু পথ। ঐক্যবদ্ধ করতে হবে শ্রমজীবী-কৃষিজীবী স্বার্থের প্রতি দায়বদ্ধ ব্যাপকতম শক্তিকে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.