বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[সম্পাদকীয়]

[সম্পাদকীয়]

অগ্নিপথ প্রকল্প ও যুব বিক্ষোভ

অগ্নিপথ প্রকল্প ও যুব বিক্ষোভ

সম্পাদকীয়, ১ জুলাই ২০২২

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ জুলাই ২০২২— নয়া উদারবাদী লুঠ, তার সঙ্গে কোভিডের আঘাতে দুনিয়া জুড়ে অসাম্য তীব্র হয়েছে— আমাদের দেশেও। সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষ নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হচ্ছে, বিপরীতে কতিপয় ধনকুবেরদের সম্পদের পাহাড় স্ফীত হয়ে চলেছে। মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারির আঘাতে তলিয়ে যাচ্ছে সারা বিশ্ব এবং আমাদের দেশ। বিশ্ব নীতিনির্ধারকরা এই সংকট থেকে বার হওয়ার কোনও পথ বাতলাতে পারছে না। ব্যয়-সংকোচন ও কৃচ্ছ্রসাধনের অজুহাতে সংকট মোচনের পুরো বোঝাটা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে শ্রমজীবী জনতার উপর। বিশ্বের নানা প্রান্তে শ্রমজীবী জনতা বাধ্য হচ্ছেন প্রতিবাদ আন্দোলনের রাস্তা নিতে। তীব্র বিক্ষোভে উত্তাল হয়েছে শ্রীলঙ্কা— পরিণতিতে পতন ঘটেছে মহিন্দ্রা রাজাপক্ষের একছত্র শাসনের। কর্মী ছাঁটাই এবং বেতন-পেনশন ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে ব্রিটেনে হাজার হাজার রেল, টিউব, বাস শ্রমিক তিন দিন পালা করে ধর্মঘটে নামেন— গত ৩০ বছরে ব্রিটেনে এত বড় ধর্মঘট দেখা যায়নি। বেলজিয়ামে কয়েক লক্ষ রাষ্ট্রায়ত্ত শ্রমিক ধর্মঘটে নেমেছিলেন জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধির প্রতিবাদে এবং উন্নততর চাকরির শর্তের (working conditions) দাবিতে। ফ্রান্সের ইউনিয়নগুলি মুদ্রাস্ফীতির ফলে জীবনযাত্রা ব্যয়বৃদ্ধির প্রতিবাদে এবং বেতনবৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, কাতারে ভিনদেশ থেকে আসা পরিযায়ী শ্রমিকরা বিলম্বিত বেতন ও অমানবিক পরিবেশের প্রতিবাদে ধর্মঘটে নামেন। জ্বালানি ও খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ট্রাক ড্রাইভারদের এক সপ্তাহব্যাপী ধর্মঘটে দক্ষিণ কোরিয়ার উৎপাদন ক্ষেত্রে অচলাবস্থা তৈরি হয়। বেসরকারিকরণ, মজুরি ছাঁটাই ও ভর্তুকি কমানোর প্রতিবাদে টিউনেশিয়ার সরকারি-বেসরকারি কর্মীরা একযোগে ধর্মঘট করেন। বেঁচে থাকার তাগিদে প্রতিবাদ-আন্দোলন আজ এক বিশ্বজনীন প্রবণতা। এর থেকে বাইরে নেই আমাদের দেশ।

এদেশে জ্বালানি, খাদ্যদ্রব্য সহ নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনকে বিপর্যয়ের কিনারায় ঠেলে দিয়েছে। ভোক্তা মুদ্রাস্ফীতি এপ্রিল, ২০২২এ আট বছরের সর্বোচ্চ ৭.৭৯%-এ পৌঁছেছে। মোদি সরকারের জমানাতেই বেকারির হার ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ রেকর্ড করেছে। এখন দেশে বেকারির হার ৮%, গ্রামাঞ্চলে ৭.৫%, শহরাঞ্চলে ৮.৩% (সিএমআইই, ২৫ জুন, ২০২২)। দেশে বিপুল বেকার বাহিনির অস্তিত্ব এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকা— শ্রমজীবী জনতাকে অধিকারহীন সস্তা শ্রমিকে পরিণত করেছে। যাদের না আছে কাজের সময়ের ঠিক-ঠিকানা, না আছে সামাজিক সুরক্ষা, বেতন ও কাজের নিশ্চয়তা।

বছরে ২ কোটি বেকারের চাকরির প্রতিশ্রুতি মোদি সরকারের প্রবক্তারা ভুলতে চাইছেন। গত বছর রাজ্যসভায় উত্তর দিতে গিয়ে মন্ত্রী জানিয়েছিলেন, কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে শূণ্যপদের সংখ্যা ৮.৭২ লক্ষ। এত হল সরকারি হিসেব। বাস্তবে, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারি, আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে শূণ্যপদের সংখ্যা বহুগুণ বেশি। সরকারি-বেসরকারি ক্ষেত্রে অস্থায়ী নিয়োগ, চুক্তিতে নিয়োগ, ঠিকাপ্রথা ব্যাপক হারে বাড়ছে। এইভাবে চলতে থাকলে স্থায়ী কর্মী কার্যত বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতি হয়ে যাবে। এদেশের শ্রমজীবী মানুষ বহু লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চাকরির স্থায়িত্ব, ৮ ঘন্টার শ্রমদিবস, পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, ইএসআই বা চিকিৎসা সুরক্ষার মতো অধিকারগুলি অর্জন করেছিলেন। আজ নয়া উদারনীতির পর্বে সেই অধিকারগুলি একে একে কেড়ে নিতে চাইছে কর্পোরেট মালিক এবং তাদের স্বার্থবাহী সরকার।

অগ্নিপথ প্রকল্প মোদি সরকারের একটি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রকল্প। আগামী দেড় বছরে ১০ লক্ষ অগ্নিবীর নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছ মোদি সরকার। লোকসভা নির্বাচনের ঠিক দেড় বছর আগে এই ঘোষণা যে নির্বাচনমুখী এক প্রকল্প তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে সেনাবাহিনির গড় বয়স কমিয়ে এনে বাহিনির আক্রমণ ও প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর যুক্তি দেওয়া হয়েছে। যদিও প্রয়াত চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ বিপিন রাওয়াত সেনাবাহিনির অবসরের বয়স ৫৮ বছর করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যুক্তি যাই হাজির করা হোক না কেন মূলত অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মীদের পেনশনের ব্যয়ভার ছাটাঁই করার জন্য অগ্নিপথ প্রকল্পে চার বছরের চুক্তিতে ঠিকা সেনা নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে— এ কথা সরকার আড়াল করেনি। নয়া উদারবাদী প্রেসক্রিপশন মেনেই পেনশন ছাটাঁই এবং ঠিকা সেনা নিয়োগের সিদ্ধান্ত। চার বছর পরে অগ্নিবীরদের ৭৫% কাজ হারাবেন।

যে সমস্ত পরিবারের আর্থিক-শিক্ষাগত স্তর এমন নয় যে সন্তানের শিক্ষার জন্য বিপুল খরচ করে সরকারি-বেসরকারি একটি পাকা চাকরি নিশ্চিত করতে পারে— সেই সব গরিব ও নিম্নবিত্ত পরিবারের, বিশেষত গ্রামাঞ্চলের, তরুণ প্রজন্মের কাছে সেনাবাহিনির চাকরি খুবই কাঙ্ক্ষিত বিষয়— চাকরির স্থায়িত্ব, নিয়মিত বেতন, নানারকম সুযোগ-সুবিধা ও অবসরকালীন পেনশনের জন্য। সেনাবাহিনির চাকরির জন্য তারা দীর্ঘ কষ্টকর প্রস্তুতি চালান। মোদি সরকারের অগ্নিপথ প্রকল্প এবং চার বছরের চুক্তিতে ঠিকা সেনা নিয়োগের ঘোষণা সেই যুবকদের নিদারুণ হতাশ ও বিক্ষুব্ধ করেছে। তারই প্রতিক্রিয়ায় উত্তর থেকে দক্ষিণে ১৩টি রাজ্য উত্তাল হয়েছে। আগুন জ্বলেছে। সেনাপ্রধানদের পুলিশের খাতায় নাম ওঠানোর হুমকিকে উপেক্ষা করে মরিয়া যুবকরা বিক্ষোভে সামিল হয়েছেন। যুবকদের এই তাৎক্ষণিক স্বতঃস্ফুর্ত বিক্ষোভ বিহার, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখন্ড, হরিয়ানার মতো সেই সমস্ত রাজ্যগুলিতেই বেশি যেখানে বেকারির হার বেশি এবং যেখানকার যুবকরা সেনার চাকরিকে কর্মজীবনের উপায় হিসেবে বেছে নেন।

অগ্নিপথের বিরুদ্ধে যুবকদের এই স্বতঃস্ফুর্ত বিক্ষোভ কৃষক আন্দোলনের মতো এক দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনে পরিণত হতে পারবে কিনা তা সময়ই বলবে। কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে এই যুববিক্ষোভের গুরুত্বপূর্ণ বৈসাদৃশ্য লক্ষ্যণীয়। মত, পথ, শ্রেণীগত পার্থক্য থাকলেও কৃষকরা বিভিন্ন সংগঠনে সংগঠিত ছিলেন এবং আন্দোলনের প্রক্রিয়ায় কৃষক সংগঠনগুলিকে এক ছাতার তলায় আনার জন্য পরিণত যৌথ নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। একাজে বামপন্থী কৃষক সংগঠনের নেতৃত্ব যোগ্য অনুঘটকের ভূমিকা নিতে পেরেছিলেন। কিন্তু অগ্নিপথ প্রকল্পের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী যুবকরা কদাচিত কোনও যুব সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত বা কোনও যুব সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও সেই সংগঠনের নেতৃত্বে এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েননি। বরং অগ্নিপথ প্রকল্প তাদের সেনাবাহিনির স্থায়ী চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ানোয় হতাশায় ক্রুদ্ধ হয়ে স্বতঃস্ফুর্তভাবে বিক্ষোভে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বিভিন্ন যুব সংগঠন ও রাজনৈতিক দল অগ্নিপথ প্রকল্পের বিরুদ্ধে পথে নামলেও বেকার যুবকদের অন্তরাত্মার সঙ্গে তাদের সংযোগ এখনও বোঝা যায়নি। এটি এদেশের এক গভীর সমস্যা। শ্রমজীবী জনতা বা কর্মপ্রার্থী বেকার যুবকদের সঙ্গে এদেশের প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও বামপন্থী শক্তির আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলা সময়ের দাবি।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.