বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[সম্পাদকীয়]

[সম্পাদকীয়]

ডিএ সরকারি কর্মচারীদের অর্জিত অধিকার

ডিএ সরকারি কর্মচারীদের অর্জিত অধিকার

সম্পাদকীয়, ১ জুন ২০২২

photo

কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিসন বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ, সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘভাতা বা ডিএ তাঁদের ন্যায়সঙ্গত আইনি অধিকার। ডিএ দেশের খুচরো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সূচকের সঙ্গে যুক্ত। বাজারে জিনিসের দাম বাড়ার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে ডিএ দিতে হবে। বেসিক ও ডিএ যোগ করে কর্মীদের বেতন ঠিক করা হয়। রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের বকেয়া ডিএ ৩১ শতাংশ। ডিভিসন বেঞ্চ বকেয়া ডিএ আগামী তিন মাসের মধ্যে মিটিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সরকারের মূল যুক্তি ছিল, ডিএ সরকারি কর্মীদের অধিকার নয়, সরকারের দয়ার দান। সরকার তার কোষগারের সামর্থ্য অনুযায়ী ডিএ দেবে। ডিভিসন বেঞ্চ সরকারের যুক্তি বাতিল করেছে। ডিএ মামলায় স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব্যুনাল বা স্যাট যে নির্দেশ দিয়েছিল, ডিভিসন বেঞ্চ তা বহাল রেখেছেন এবং তা কার্যকরি করার নির্দেশ দিয়েছেন।
কর্মচারীদের দাবি ছিল, কেন্দ্রীয় হারে রাজ্য সরকারি কর্মীদের ডিএ দিতে হবে। বকেয়া ৩১ শতাংশ ডিএ দিতে হলে খরচ হবে প্রায় ২৩,০০০ কোটি টাকা। সরকারের যুক্তি, এই বিপুল পরিমাণ অর্থ রাজ্যের কোষাগার থেকে দিতে গেলে রাজ্যের স্বাস্থ্যসাথী বা লক্ষী ভান্ডারের মতো কল্যাণ প্রকল্পের টাকায় টান পড়বে। রাজ্য সরকার সুচতুরভাবে রাজ্য সরকারি কর্মীদের ডিএ দেওয়ার বিষয়টিকে কল্যাণ প্রকল্পের উপভোক্তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে চাইছেন। এ যেন ব্রিটিশ শাসকদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’।
শুধু ডিএ নয়, কল্যাণ প্রকল্পগুলি সম্পর্কেও সরকার এমন একটা কথা ধারণা চারিয়ে দিয়েছে, সরকার যা দিচ্ছে সেটা তাদের দয়ার দান। সরকারের সর্বোচ্চ স্তর থেকে বার বার শোনা যায়, অনেক তো দিয়েছি। আর হবে না। এর বেশি আর দিতে পারবো না। এর কোনওটাই পাইয়ে দেওয়া, পেয়ে যাওয়ার প্রশ্ন নয়— অধিকারের প্রশ্ন।
ডিএ কারও দয়ার দান নয়, সরকারি কর্মচারীদের ন্যায়সঙ্গত আইনি অধিকার— শুধুমাত্র সরকারি কর্মচারীদের নয়, সমস্ত শ্রমিক-কর্মচারীদের। বহু সংগ্রাম-লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে এই অধিকার অর্জিত হয়েছিল এবং আইনি স্বীকৃতি পেয়েছিল। যে ভাবে বহু লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ৮ ঘন্টার শ্রমদিবস, পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, ইএসআই বা চিকিৎসা সুরক্ষার মতো অধিকারগুলি শ্রমিক-কর্মচারীরা অর্জন করেছিলেন। আজ নয়া উদারনীতির পর্বে সেই অধিকারগুলি একে একে কেড়ে নিতে চাইছে কর্পোরেট মালিক এবং তাদের স্বার্থবাহী সরকার। পুঁজির চাহিদা অনুযায়ী দেশের শ্রম আইন সংশোধন করে শ্রমিক-কর্মচারীদের অর্জিত অধিকারগুলি হরণ করতে চারটি লেবার কোড পাশ করানো হয়েছে। সুতরাং শ্রমিক-কর্মচারীদের ডিএ ছাঁটাই করার চেষ্টা চলতে থাকবে। পেনশন ছাঁটাই করার চেষ্টা চলতে থাকবে। বেতন ছাঁটাই চলতে থাকবে। কোটি কোটি শ্রমিকদের প্রভিডেন্ড ফান্ড, ইএসআই দেওয়া হবে না। শ্রমিকদের ১০-১২ ঘন্টা খাটানো চলতে থাকবে। মালিকরা মর্জি মাফিক ছাঁটাই করতে থাকবে। আর এর জন্য যুক্তি সাজাবে ছোট-মাঝারি থেকে কর্পোরেট মালিক এবং সরকার। কর্পোরেট মিডিয়া এই অধিকার হরণের পক্ষে যুক্তি সাজাবে নানা ছলে।
যখন সরকারি কর্মচারীদের ডিএ না দেওয়ার পক্ষে সরকার যুক্তি সাজায় তখন তাদের মনে থাকে না, এই রাজ্যের কোটি কোটি বেকারের সম্মানজনক কাজ সৃষ্টি করার দায়িত্ব তাদেরই। কেন লক্ষ লক্ষ বেকার কাজ না পেয়ে ভিন রাজ্যে পাড়ি জমাচ্ছে। কেন খোদ সরকারি দপ্তরে শূণ্যপদে স্থায়ী নিয়োগ না করে অস্থায়ী চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করে বছরের পর পর যথসামান্য ‘কনসোলিডেট পে’ দেওয়া হচ্ছে। কেন এ রাজ্যের ৯০ শতাংশের বেশি অসংগঠিত শ্রমিকদের মাসিক উপার্জন ১০ হাজার টাকা বা তারও কম। কেন অসংগঠিত শ্রমিকদের বিপুল অংশ কোনও ধরনের সামাজিক সুরক্ষা পান না, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, ইএসআই বা চিকিৎসা সুরক্ষা পায় না। কেন এ রাজ্যের আশা কর্মীরা সারা দেশের মতো কোনও চিকিৎসা সুরক্ষা পান না— যারা রাত-দিন এক করে কোভিড সংক্রমণের ভয়ঙ্কর দিনগুলিতেও রাজ্যবাসীর কাছে চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দিয়েছেন। কর্পোরেট মিডিয়া এই সব বিষয়ে নীরব কেন?
সরকারি কর্মচারীদের বেতন বা বেতনবৃদ্ধিকে উৎপাদনশীলতার সঙ্গে যুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছে কোনও কর্পোরেট মিডিয়া। যেন সরকারি কর্মচারীদের কাজের সঙ্গে কর্মকুশলতা, দায়বদ্ধতা, কোনও কিছুরই সম্পর্ক নেই। এ যেন শ্রমিকদের বেতন বা বেতনবৃদ্ধিকে উৎপাদনশীলতার সঙ্গে যুক্ত করার কর্পোরেট যুক্তি। কিন্তু একটু খোঁজ নিলেই তারা দেখতে পেতেন, ‘দুয়ারে সরকার’ থেকে সরকারের যাবতীয় কল্যাণ প্রকল্প রূপায়নে সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্য নিষ্ঠা, এমন কি ছুটির দিনগুলিতেও।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.