বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[সম্পাদকীয়]

[সম্পাদকীয়]

বাংলার শিক্ষার করুণ চিত্র

বাংলার শিক্ষার করুণ চিত্র

সম্পাদকীয়, ১ মার্চ, ২০২৩

photo

শ্রমজীবী ভাষা ১ মার্চ, ২০২৩— ২০২২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছিল ১০ লক্ষ ৯৮ হাজার— এবার ২০২৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ৬ লক্ষ ৯৮ হাজার। শুধু এক শিক্ষাবর্ষেই মাধ্যমিকে ৪ লক্ষ পরীক্ষার্থী কমে গেছে। অতিমারি ও লকডাউনে সুদীর্ঘ সময় বন্ধ স্কুল দরিদ্র-প্রান্তিক পরিবারের বিপুল সংখ্যক শিশুদের শিক্ষার অঙ্গন থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। শিক্ষার সর্বস্তরে ড্রপআউটের হার বিপুলভাবে বেড়েছে। মাধ্যমিকে ৪ লক্ষ পরীক্ষার্থী কমে যাওয়া তারই এক প্রকাশ।
অতিমারি ও লকডাউনের সুযোগ নিয়ে সারা দেশের মতো এ রাজ্যেও শিক্ষা ক্ষেত্রে ডিজিটাল বিভাজন তীব্র হয়েছে। অনলাইন শিক্ষার সুযোগ নিতে পেরেছে ধনী, উচ্চবিত্ত, সচ্ছল পরিবারের ছেলে-মেয়েরা। বেসরকারি স্কুলের সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি অনলাইন অ্যাপের ব্যবসা রমরমিয়ে বেড়েছে। শিক্ষা অঙ্গন থেকে ক্রমশই ছিটকে যাচ্ছে সাধারণ শ্রমজীবী পরিবারের ছেলে-মেয়েরা। যে ব্যবস্থায় শিক্ষা, স্বাস্থ্যও আর সব পণের মতো বাজারের পণ্য— সেখানে এটাই হওয়ার ছিল।
অতিমারির আগে প্রাক প্রাথমিক স্তর থেকে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত এরাজ্যে ছাত্র-ছাত্রী ছিল প্রায় ৮০ লক্ষ। সেই সংখ্যা এখন প্রায় ৭২ লক্ষে নেমে গেছে। রাজ্যের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ৮ লক্ষের ওপর ছাত্র-ছাত্রী উধাও হয়ে গেছে। এ রাজ্যে ৫৪ হাজার প্রাথমিক স্কুল ছিল। ছাত্র সঙ্কটে পড়ে কোভিডের পর প্রায় ২ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে তুলে দেওয়া হয়েছে।
২০২২ থেকে প্রতিটি প্রাথমিক স্কুলের বার্ষিক অনুদানের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ করা হয় তা প্রায় ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ অর্থ প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় অর্ধেক।
সরকারি স্কুলে লেখাপড়া হয় না, এই বিশ্বাসটা অভিভাবকদের মনে গেঁথে দেওয়ার পিছনে বাজারের অবদান যতখানি তার চেয়ে বেশি দায়িত্ব শিক্ষাব্যবস্থার। পাঁচ বছর স্কুলে পড়ার পরও যখন অনেকের অক্ষর পরিচয়ও ঘটে না, তখন অনাস্থা জন্মানো স্বাভাবিক।
সরকারি ঔদ্যসীন্যে এবং অর্থের অভাবে সরকারি স্কুলগুলি হাজারো সমস্যায় জর্জরিত। প্রাথমিক স্তর থেকে শিক্ষার সর্ব স্তরে শিক্ষকের অভাব এক নিদারুণ সমস্যা। প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য সংখ্যক শিক্ষক বহু স্কুলে শত শত ছাত্রছাত্রীকে পড়াতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রাথমিক স্তরে শিক্ষক ঘাটতি আরো প্রকট। গ্রামাঞ্চলে বিজ্ঞান-অংকের শিক্ষক প্রায়ই অমিল। অসংখ্য শিক্ষকপদ শূণ্য পড়ে থাকছে। রাজকোষের ঘাটতির কারণে অসংখ্য শূণ্য শিক্ষকপদে নিয়োগ হচ্ছে না। ছাত্রছাত্রীরা প্রয়োজনীয় যত্ন পাচ্ছে না। রাজ্যে শিক্ষার মানের অবনতি ঘটছে। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি শিক্ষক ঘাটতির সমস্যাকে লজ্জাজনকভাবে সামনে নিয়ে এসেছে।
অতিমারির উপর শিক্ষক নিয়োগে ভয়াবহ দুর্নীতি সরকারি স্কুলগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা আরও তলানিতে ঠেলে দিয়েছে। এই সংগঠিত অপরাধে কেবল যোগ্যপ্রার্থীদের প্রতিই অবিচার করা হয়নি, সরকার পোষিত স্কুলগুলিতে অযোগ্য শিক্ষকদের শিক্ষা দানে ব্যর্থতা নিদারুণভাবে প্রকাশ্যে এসেছে। যাদের সামান্য আর্থিক সঙ্গতি আছে সেই সব পরিবার তাদের সন্তানদের সরকারি স্কুলের না পাঠিয়ে বেসরকারি স্কুলে পাঠানোর পথে যাচ্ছেন। সুযোগ বঞ্চিত দরিদ্রতর পরিবারের ছেলে-মেয়েরা ক্রমেই বহিস্কৃত হচ্ছে শিক্ষার আঙিনা থেকে। শিক্ষা ক্ষেত্রে অসাম্য আরো তীব্র হচ্ছে। নীল সাদা পোষাকের আড়ালে সেই অসাম্যকে আড়াল করা যাবে না।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.