বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[সম্পাদকীয়]
কলকাতা মহানগরীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সরকারি হাসপাতাল আরজিকর-এ কর্মরত চিকিৎসক কন্যার নৃশংস হত্যা ও ধর্ষণ কর্মক্ষেত্রে নারীদের নিরাপত্তার আসল ছবিটা সামনে নিয়ে এসেছে। এই ঘটনা কর্মক্ষেত্রে নারীদের নিরাপত্তাহীনতার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
একুশ শতাব্দীর নয়া উদারনৈতিক ভারতে এবং পশ্চিমবাংলায় গ্রাম থেকে শহরে কর্মক্ষেত্রে, পরিবারে, সমাজ জীবনের প্রতিটি পরিসরে নারীদের প্রতি অমর্যাদা, অসম্মান, বঞ্চনা, যৌন হিংসা, নারী শ্রমের অবাধ শোষণ প্রায় সাধারণ ছবি।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০২২ সালের গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্টে ১৪৬টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ছিল ১৩৫তম। সে বছর লিঙ্গ অসাম্য সূচকে ভারত সৌদি আরবের থেকেও পিছনে ছিল। ২০২৪ সালে হিসেবে ১৪৬টি দেশের মধ্যে ভারত ১২৯তম স্থান অধিকার করেছে। লিঙ্গ অসাম্য মাপা হয় অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্ষমতায়নে পুরুষের তুলনায় ব্যবধান দিয়ে।
তবুও বেঁচে থাকার অনন্ত ইচ্ছা ও তাগিদে ভর করে এদেশে নারীরা এগিয়ে আসছেন অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবনের সর্বক্ষেত্রে, রাজনীতিতেও। এই বাস্তবতাকে স্বীকার করেই নারীদের প্রতি বঞ্চনা, লাঞ্ছনা, শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তোলার পথ বেছে নিতে হবে। এই লড়াই কেবল নারীদের একার নয় — নারী-পুরুষের ঐক্যবদ্ধ লড়াই।
একদা সম্পত্তির অধিকার থেকে মৃতের বিধবা স্ত্রীকে বঞ্চিত করতে জীবন্ত নারীকে মৃতের জ্বলন্ত চিতায় পুড়িয়ে মারা হতো। পুরুষতন্ত্রের নিষ্ঠুর প্রথা মানুষের শুভবুদ্ধি এবং রাজা রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে আন্দোলনে বন্ধ হয়েছে। তবুও একুশ শতাব্দীর আধুনিক ভারতে পুরুষতন্ত্রের দগদগে ক্ষতগুলি রয়ে গেছে। তার বিরুদ্ধে একসঙ্গেই লাগাতার লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
নয়া উদারনৈতিক ভারতে পুঁজির মুনাফার লোভের অন্যতম ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে সস্তা নারী শ্রম। দেশের ৯০ শতাংশ শ্রমজীবী মানুষ অসংগঠিত ও ইনফর্মাল ক্ষেত্রে কাজ করেন। এই শ্রমজীবীদের কাজের নিশ্চয়তা, বেঁচে থাকার মতো প্রয়োজনীয় মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা, কাজের সময়ের ঠিকঠিকানা নেই। অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবীদের মধ্যে নারী শ্রমিকরা অমানবিক ও নিষ্ঠুরভাবে শোষিত — কৃষি, পশুপালন, মৎসচাষ, গৃহকর্ম থেকে বিড়ি, চা, নির্মাণ, পাথর-বালি খাদানে নারী শ্রমিকরা পুরুষ শ্রমিকের তুলনায় অর্ধেক বা তিনভাগের একভাগ মজুরি পান। পথেঘাটে বা কর্মস্থলে অধিকাংশ জায়গায় নারী শ্রমিকদের জন্য টয়লেট নেই। নেই নিরাপত্তা। প্রায় কোথাও মাতৃত্বকালীন ছুটি নেই সংগঠিত ক্ষেত্র ছাড়া। তার উপর, কাজ বাঁচাতে নারী শ্রমিকরা প্রায়শ মালিক, মালিকের পেয়াদা, ঊর্ধ্বতনদের যৌন শোষণের শিকার হন। পারিবারিক উদ্যোগ বা পারিবারিক জমিতে নারীরা শ্রম দিলে তা প্রায় পুরোটাই পারিবারিক আয় — নারীর নিজস্ব আয় বলে কিছু থাকে না। একে বলা যায় ছদ্মবেশী বেকার। এমনকী নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী পরিবারেও বাইরে খেটে আসার পর গৃহকর্ম নারীদেরই করতে হয়। সরকারি প্রকল্পে যে আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিড ডে মিল কর্মীরা কাজ করেন তাঁদেরও মজুরি অতি সামান্য — তারা যে সেবা ধর্ম করছেন তাই মজুরি বা বেতন নয়, সরকার তাঁদের সাম্মানিক দেন!
সারা দেশেই পুরুষরা কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে ও ভিন দেশে পরযায়ী শ্রমিক হয়ে চলে যাচ্ছেন। গ্রামে থেকে যাচ্ছেন প্রধানত মহিলারাই। ১০০ দিনের কাজে কার্যত ব্যয় বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়ায় গ্রামের গরীব পরিবারগুলিকে আরও কঠিন অবস্থার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। পরিবার ও সন্তানদের বাঁচাতে মহিলারা কাজে নামছেন সস্তা শ্রমিক হিসেবে। পশ্চিমবাংলা সহ অধিকাংশ রাজ্যের একই ছবি।
নারী আন্দোলনকে ব্যাপক গণভিত্তিতে দাঁড় করাতে হলে নারী শ্রমজীবীদের সমস্যাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। রাজ্যসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে সরকারিভাবে জানানো হয় যে, ২০২৩-২৪ সালে সারা দেশে মহিলা জনসংখ্যার মধ্যে শ্রমজীবী জনসংখ্যার হার ৪০.৩ শতাংশ। পশ্চিমবাংলায় এই হার ৩৯.২ শতাংশ। এই বিপুল নারী শ্রমশক্তিকে তাঁদের আপন সক্ষমতায় জাগাতে হলে প্রয়োজন এক ব্যাপকতম গণআন্দোলন। এই কাজে হাত লাগাতে হবে সমাজ পরিবর্তনে বিশ্বাসী সমস্ত মানুষকে। এগিয়ে আসতে হবে সমস্ত শ্রমিক, কৃষক, ক্ষেতমজুর সংগঠনকে। এগিয়ে আসতে হবে ছাত্র, যুব, মহিলা সংগঠনকে। কৃষক আন্দোলনের মতোই নারী শ্রমশক্তির উত্থানে প্রয়োজন ব্যাপকতম নারী শ্রমজীবীদের আন্দোলনের মঞ্চ। নারী শ্রমজীবীদের আন্দোলন রাজ্যে ও দেশে শ্রমিক আন্দোলনকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করাতে পারে।